বিশ্ব সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে অবদান রাখতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, “কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদয় সমর্থনকে আমরা বিনীতভাবে স্বীকার করি। আমরা এখন আমাদের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে অবদান রাখতে চাই।”
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) ইউনেসকো সদর দপ্তরের ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর ক্রিয়েটিভ ইকোনমি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বিজয়ীর নাম ঘোষণা করেন এবং পুরস্কার ও সনদ বিতরণ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি যে সৃজনশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ফলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সম্মিলিত লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে।”
এছাড়া শেখ হাসিনা পুরস্কার বিজয়ীর প্রশংসা করে বলেন, “ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর ক্রিয়েটিভ ইকোনমি পুরস্কার পাওয়ায় আমি এমওটিআইভি ক্রিয়েটিভ লিমিটেডকে (উগান্ডা) অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
এমওটিআইভিকে ৫৯টি মনোনীত প্রার্থী থেকে এই পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়। ক্রিয়েটিভ ইকোনমিতে যুব উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ এমওটিআইভিকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, “সৃজনশীল অর্থনীতির জন্য ইউনেসকো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত বিশ্ব মানবতা ও শান্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের প্রতি সবচেয়ে উপযুক্ত সম্মান।”
শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, “এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার যা বৈশ্বিক অগ্রাধিকার অর্থাৎ লিঙ্গ সমতা এবং গোষ্ঠী হিসেবে যুবকদের অগ্রাধিকারে অবদান রেখে সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউনেসকোর প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবে।”
এর আগে প্রধানমন্ত্রী ইউনেসকো সদর দপ্তরে পৌঁছালে সংস্থার মহাপরিচালক অড্রে আজুল তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ অবশ্যই সৃজনশীল উদ্যোক্তা বিকাশের সর্বোত্তম অনুশীলনকে ধারণ এবং যোগাযোগের মাধ্যমে একটি জ্ঞান বিনিময়ের কৌশল তৈরি করবে। এই অনুষ্ঠানটি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল অর্থনীতির আন্তর্জাতিক বছরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। আমাদের অগ্রাধিকারের এই ক্ষেত্রগুলোতে ইউনেসকোর প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ বিশেষভাবে ধন্য এবং সম্মানিত।”
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টিও আমি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেসকো জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এ বছর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। একই সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হচ্ছে। ইউনেসকো আনুষ্ঠানিকভাবে এই উদযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুজিববর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রবর্তন এবং বিতরণের জন্য আমি ইউনেসকোর মহাপরিচালক ম্যাডাম অড্রে আজুলেকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুপাক্ষিকতাবাদের একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন। তিনি জাতিসংঘকে ‘জনগণের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। জাতিসংঘের বিশেষ অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনেসকোর প্রতিও তিনি একই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা পোষণ করতেন।”
সরকারপ্রধান বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জুলিও-কুরি শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। সেই পুরস্কার গ্রহণ করার সময় তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের মূল লক্ষ্য বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা। আমি নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, শান্তিপ্রিয় এবং স্বাধীনতাকামী মানুষদের সঙ্গে আছি- তারা যেখানেই থাকুক না কেন। আমরা পৃথিবীতে শান্তি চাই। এই শান্তি অবশ্যই টেকসই হতে হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাস করি।”
শেখ হাসিনা বলেন, তার জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে খুব কাছ থেকে তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সে জন্যই আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, তিনি ইউনেসকোর একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রসার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার কর্মোদ্যোগসমূহ ইউনেসকোর বিভিন্ন আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অধিকন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং একটি সদ্য-স্বাধীন দেশ পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার নেতৃত্ব- সবই ইউনেসকোর মূল লক্ষ্যসমূহের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় সর্বোত্তম বিনিয়োগ এবং তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক ঘোষণা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন দেশে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক ও কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণ করেন। এই সাধারণ উদাহরণটিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে তার অগ্রাধিকারের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমার সরকারও শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে। আমরা দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছি। দেশে এখন প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার। এগুলোর মধ্যে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকার পরিচালিত। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে। এখন প্রতি বছর প্রায় ৪০ কোটি বই বিতরণ করা হয়। পিছিয়ে-পড়া এলাকাগুলোতে প্রায় ২৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বর্তমানে এক কোটি ৩ লাখের বেশি প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মা অথবা বৈধ অভিভাবকদের কাছে সরাসরি পৌঁছে যায়। মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আরও প্রায় ৭০ লাখ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে উপবৃত্তি ও বৃত্তি ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস, পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক্টরাল অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য আমরা ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’ চালু করেছি। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৮০ জন স্কলারকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ২০টি নতুন সরকারি প্রযুক্তি এবং সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২। এছাড়া ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত আছে। বর্তমানে ৪৯২টি উপজেলায় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। আমাদের উদ্যোগসমূহ ঝরে পড়া প্রতিরোধে ব্যাপক সহায়তা করেছে। প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্তরে ছাত্রভর্তির হার ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০১৭ সালে স্কুলে ছেলেমেয়ের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে ৫৩:৪৭-এ দাঁড়িয়েছে, যা ২০০৯ সালে ছিল ৩৫:৬৫। ক্রমবর্ধমান হারে নারী শিক্ষা প্রসারের ফলে বাল্য বিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষায় বিনিয়োগ সুফল দিতে শুরু করেছে। গত এক দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এ সময়ে, মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে এবং দারিদ্র্যের হার ৩১.৫ শতাংশ থেকে ২০.৩ শতাংশে এ হ্রাস পেয়েছে। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৩.৬৭-এ হ্রাস পেয়েছে; মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ১৭৩ এবং মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। বাংলাদেশ এ বছর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অর্থনৈতিকভাবে একটি স্বাবলম্বী এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি যখন সে লক্ষ্য পূরণের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখনই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও নিকটাত্মীয়সহ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ নৃশংস ঘটনায় আমার স্নেহময়ী মা, তিন ভাই, সবচেয়ে ছোটজনের বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর এবং দুই ভ্রাতৃবধূ শহীদ হন। শুধু আমার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং আমি সেই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম কারণ আমরা তখন বিদেশে ছিলাম। আমরা ৬ বছর দেশে ফিরতে পারিনি; শরণার্থী হিসেবে বিদেশের মাটিতে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি।”
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আমার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমার জীবন উৎসর্গ করেছি।”