হোর্হে লুইস বোর্হেসের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৪, ০৮:১২ পিএম
হোর্হে লুইস বোর্হেস

বিশ্ববিশ্রুত আর্হেন্তিনীয় কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হোর্হে লুইস বোর্হেস (২৪ আগস্ট ১৮৯৯-১৪ জুন ১৯৮৬) এর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী চলে গেল গত ২৪ আগস্ট। এই দিনটিকে স্মরণ করে, তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাস্বরূপ কবির তিনখানা প্রতিনিধিত্বশীল কবিতার সাম্প্রতিক অনুবাদ উপস্থাপিত হল এখানে।

 

যে আমাকে পাঠ করছে


তুমি অপরাজেয়। তারা কি তোমাকে
(সেইসব শক্তি যারা তোমার নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করে)
ধূলিপরিণতির অমোঘতার কথা বলেনি? এটা কি হতে পারে না যে,
তোমার এই অপরিবর্তনেয় সময়ই আসলে সেই নদী
যার উজ্জ্বল আয়নায় হেরাক্লিটাস তাঁর নশ্বরতাকে
পাঠ করেছিলেন? তোমার জন্য একটি সমাধিপ্রস্তর
প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যার লেখা তুমি কখনোই পড়তে পারবে না,
মৃতদের সময়, শহর ও সমাধিলিপির সঙ্গে ইতোমধ্যে শায়িত তুমি।
অন্য মানুষেরাও আসলে সময়ের স্বপ্ন,
কঠিন ব্রোঞ্জ কিংবা বিশুদ্ধ স্বর্ণ নয়। তারাও
তোমার মতো ধূলিকণা; পৃথিবী নিয়ত পরিবর্তনশীল।
তোমার ভ্রমণপথের সামনে অপেক্ষমাণ ছায়া,
একেবারে খাদের কিনারে অপেক্ষা করছে মৃত্যুময় ছায়া।
এটা জেনো: কোনো না কোনোভাবে তুমিও মৃতই আসলে।

 

গোলকধাঁধা: ১


দেবতা জিউস স্বয়ং আমার চারপাশের
পাথরের জটাজালকে ছাড়াতে পারেননি।
আমি একদা যে-পুরুষ ছিলাম 
তার কথা ভুলে গেছি,
আমি একঘেয়ে দেয়ালসমূহের 
ঘৃণিত পথ অনুসরণ করি,
যা আমার নিয়তি। নির্মম কক্ষের সারি 
গোপন বৃত্তের মতো 
বেঁকে যায় বৎসরের শেষাবধি।
দিনের কুসীদবৃত্তি 
ফাটল ধরায় খাটো দেয়ালের গায়ে।

বিবর্ণ ধুলোর ভেতরে আমি এমনসব চিহ্ন দেখি
যা আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে।
অবতল সন্ধ্যাসমূহে বাতাস আমার জন্য 
বয়ে আনে একটি চিৎকার, অথবা কোনো
নির্জন গর্জনের প্রতিধ্বনি।

আমি জানি ছায়ার মধ্যে একজন ‘অপর’ রয়েছে,
যার নিয়তি এই মৃত্যুকূপের নির্মাণ ও বিনির্মাণকারী
দীর্ঘ একাকিত্বের অবসান ঘটানো এবং 
আমার রক্তের জন্য আকাঙ্ক্ষা ও মৃত্যুকে গিলে নেওয়া।

আমরা এক অপরকে সন্ধান করি।
আহা এ-ই যদি আমাদের অপেক্ষার 
সবশেষ দিন হত।

 

 

গোলকধাঁধা: ২
 

সেখানে কখনও কোনো দরজা থাকবে না।
তুমি ভেতরে
এবং এই প্রাসাদদূর্গ পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে
এবং এর কোনো সম্মুখবর্তী, বিপরীত, 
বৃত্তাকার দেয়াল কিংবা গোপন কেন্দ্র নেই।

আশা কোরো না যে, তোমার সরলসোজা পথখানি
যা গোঁয়ারের মতো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়
আবারও গোঁয়ারের মতো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়,
তার কোনো শেষ থাকবে।
তোমার নিয়তি লৌহকঠিন,
যেনবা তোমারই বিচারক।
ভুলে যাও সেই ষাঁড়ের অগ্রাসনের কথা যে আসলে মানুষ,
যার অদ্ভুত বহুরূপ অনিঃশেষ ও জড়াজড়ি করে থাকা 
পাথরের জটাজালকে তাড়া করে ফেরে।

তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ঘনকালো সন্ধ্যায়
এমনকি সেই বন্য পশুর প্রত্যাশাও কোরো না তুমি।

 

অনুবাদ: আলম খোরশেদ
 

(হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬) এর জন্ম আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে। শিক্ষাজীবন কাটে সুইজারল্যান্ডে। তখনই  ফরাসি ও জার্মান উভয় ভাষাই খুব দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করেন তিনি। প্রথম মহাযুদ্ধের পরপর ইউরোপ ভ্রমণকালে খ্যাতনামা লেখকদের সংস্পর্শে আসেন এবং সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কবিতা দিয়েই হাতেখড়ি, যদিও বোর্হেসের খ্যাতি মূলত নতুন ধরনের, নিরীক্ষাধর্মী, দর্শনঋদ্ধ গল্প-লিখিয়ে হিসেবে। গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের প্রায় সব বড় বড় পুরস্কারপ্রাপ্তির সৌভাগ্য হলেও নোবেল পুরস্কারটি একাধিকবার মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও কেন জানি শেষপর্যন্ত তা জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। ১৯৮৬ সালে প্রায়ান্ধ অবস্থায় জেনেভায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কবিতায় স্মৃতি, সময়, অস্তিত্ব ও আত্মবীক্ষণের মতো আধিবিদ্যক বিষয়গুলো উঠে আসে একধরনের নিজস্ব ও প্রাতিস্বিক কাব্যভাষায়। বোর্হেসের কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রণিধানযোগ্য: ফারভার অভ বুয়েনোস আইরেস (১৯২৩), পোয়েমাস (১৯৪৩), ড্রিম টাইগারস (১৯৬০), ওবরাস পোয়েতিকাস (১৯৬৪), দা গোল্ড অভ দা টাইগারস (১৯৭২), ইন প্রেইজ অভ ডার্কনেস (১৯৭৪) ইত্যাদি। -- অনুবাদক)