নাসিম বানুকে নিয়ে আপনি যদি জানতে চান তাহলে দুটি বিষয় আপনি খুঁজে পাবেন। প্রথমত, তিনি ষাট সত্তরের হার্টথ্রব সায়রা বানুর মা, দ্বিতীয়ত তিনি ত্রিশের দশকের অন্যতম সফল সবাক ছবি, ‘খুন কা খুন’ ছবির নায়িকা। সেটা ছিল হ্যামলেটের ভারতীয় প্রথম সিনেমা এডপ্টেশন। সিনেমাটা চলেছিলও বেশ। এই তথ্য নিয়ে অবাক হতে হতেই আপনি পেয়ে যাবেন আরেকটা তথ্য, সংগীত পরিচালক নওশাদের একটা বক্তব্য, নাসিম বানু দেখতে ছিলেন পুরোদস্তুর পরীর মতো। কেউ তাকালে পলক ফেলতে পারত না। কিন্তু নাসিম বানুকে কেউ মনে রাখেনি তেমন, তার মেয়ে সায়রা বানু অবশ্য সেই তুলনায় অনেক অনেক ভাগ্যবান। যতবার দিলীপ কুমারের নাম আসে ততবার মনে করি সায়রা বানুকে। তিনি জীবিত ও আজ তার জন্মদিন।
সায়রা বানুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় টিভিতে যেদিন দেখি ‘ম্যায় চালি ম্যায় চালি’ গানটা শুনি। আমি বোম্বে ভাইকিংসের রিমিক্সটা শুনেছিলাম। সামনের বিল্ডিংয়ে থাকতো তন্নী, সে সারাদিন বাজাতো। অরজিনাল গানটা দেখে শান্তি পাই, কারণ সবার প্রশ্ন তুমি সাইকেল চালাতে পারো না? দুনিয়ার সবচাইতে সহজ কাজটাও পারি না। পেরে আর কী হবে এতদিনে। এমন যদি হতো আমাকে সায়রা বানুর সাথে ‘পাডোসান’ ছবিতে ম্যায় চালি ম্যায় চালি পিয়ারকে গলি গাইতে গাইতে সাইকেল চালানোর টিমের সাথে অফার করছে। তখন আপসোস হতো অনেক। আহ কী গান! ফাঁকা শহর ফাঁকা রাস্তাঘাট, সায়বা বানু সখীদের নিয়ে লা লা লা লা করতে করতে টহল দিচ্ছে। মেয়েদের জন্য সেরকম ইউটোপিয়ান শহর এই ভুখণ্ডে কখনো আসবে না। সেখানে থাকে কমেন্ট—ভারত আগে কত সুন্দর ছিল। এটার চিত্র ধারণ করা হয়েছিল মাইসোরে সম্ভবত। উপরিকাঠামোর ভেতর থেকে দেখলে সব কিছুই সুন্দর লাগে, যেমন সমরেশ মজুমদার এরশাদ আমলে ঢাকায় এসে অবাক হয়ে গেছিলেন। তিনি ভাবতে পারেন নাই ঢাকা এত বদলে গেছে। কিন্তু আমরা তো জানি এরশাদ আমল আমাদের জন্য কত ট্রমাটিক ছিল? কত রক্ত কত সংগ্রামের পর এরশাদের পতন হয়েছিল? পতনের পর নাকি লোকজনের উচ্ছ্বাসই থামছিল না।
যাক সায়রা বানুর আলাপেই ফিরি। সায়রা বানু খুবই অভিজাত এক পরিবারে বড় হয়েছিলেন। স্কুল শেষ করেছেন ব্রিটেনের এক প্রাইভেট স্কুলে। বাসায় উর্দু ও বাইরে ইংরেজি এটাই ছিল তাদের পারিবারিক অভ্যাস। স্কুল জীবনে তিনি সংগীতশিল্পী হতে চাইতেন। ক্লাসিকালের তালিমও নিয়েছিলেন। সেই সময়ই তিনি দেখেন ‘মোঘল-এ-আজম’। সিনেমাটা দেখে তিনি এত মুগ্ধ ছিলেন, সেই কিশোরী বেলাতেই তিনি দিলীপ কুমারের ওপর ক্রাশ খান আর ভাবেন তারও সিনেমা করতে হবে। এইজন্য তিনি কলেজে ভর্তি না হয়েই লন্ডন থেকে চলে আসেন। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। শাম্মি কাপুরের সাথে করেন ‘জংলি’। আমি কালই জানলাম, সায়রা বানুর ‘গাইড’ ও ‘জুয়েল থিফ’ করার কথা ছিল দেব আনন্দের সাথে। কিন্তু ডেট মিলে নাই তাই আর কাজটা করা হয়ে ওঠেনি। পরে ‘গাইড’ ছবি দেখে তিনি এত মুগ্ধ হয়েছিলেন, ওয়াহিদা রেহমানকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, এই ছবিতে আপনার চেয়ে ভালো অভিনয় ভারতবর্ষে কেউ করতে পারতো না। সায়রা বানু মানতেন সিনেমা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। সে আমলে সব থেকে বেশি টাকা পারিশ্রমিক নিয়েও তিনি দেখেছেন, কিছু ছবি আর আলোর মুখ দেখেনি। আবার কিছু ছবিতে অভিনয় কী করছেন বুঝে ওঠার আগেই সিনেমা শেষ। ছবি সুপার হিট। রিয়েল লাইফেও তিনি কখনো ভাবেননি দিলীপ কুমারের সাথে তার কোনোদিন বিয়ে হবে। নায়ক রাজেন্দ্র কুমারের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। হবেই না কেন, রাজেন্দ্র কুমার এলভিস প্রিসলির মতোই সুদর্শন এক অভিনেতা। সায়রা বানুর মা ব্যাপারটা পছন্দ করতেন না। তাই তিনি দিলীপ কুমারের সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। দিলীপ কুমারও সন্দিহান ছিলেন সায়রা বানু রাজি কিনা এবং অতীতে তার কয়েকটা রিলেশন খুবই বাজেভাবে শেষ হয়েছে। এমনকি সায়রা বানুর সাথে বিয়ের দিনেও তিনি তার প্রাক্তনকে সময় দিয়ে তারপর বিয়ে করেছিলেন।
তাদের ছিল সুখের এক দাম্পত্য জীবন। বিয়ের পরেও সায়রা বানু সিনেমা করেছেন, কিন্তু তার প্রায়োরিটি হয়ে যায় দিলীপ কুমার। সায়রা বানু স্ক্রিনে ছিলেন ভীষণ সাহসী, তার অন্তত দু-তিনটা গান আছে বাথটাবে চিত্রায়ণ করা। পোশাকের ব্যাপারেও তার বিশেষ বক্তব্য ছিল না। নিজে সালোয়ার কামিজ পরে জীবন কাটিয়ে দিলেও যেকোনো ওয়েস্টার্ন পোশাক অথবা শাড়িতে তিনি মানানসই। অমিতাভ বচ্চনের সাথেও সায়রা বানুর দুটো ছবি আছে, জামির আর হেরাফেরি। মোটামুটি সিক্সটিজ আর সেভেনটিজের স্টাইল আইকন বলতে যা বোঝায় সবই ছিলেন তিনি। হেয়ারস্টাইল থেকে শুরু করে চাহনী সব কিছুই সেই জেনারেশনকে ডিফাইন করে। সায়রা বানু আর দিলীপ কুমারের একটা পুরোনো বিবাহবার্ষিকীর ভিডিও আছে ইউটিউবে। এত সুন্দর ও গ্রেইসফুল লাগছিলো সবাইকে। আরও অদ্ভুত সরলতা সবার চোখে মুখে হাসি ঠাট্টায়। এখন শত শত সাংবাদিক আর হাজার হাজার ইউটিউবার বলিউডের যেকোনো উদযাপনকে মাটি করতে সদা বিরাজমান।