ঋত্বিক কুমার ঘটক: সময়ের চেয়ে অগ্রগামী

শৈবাল চৌধূরী প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২১, ০৭:৫৮ পিএম

ঋত্বিক কুমার ঘটকের কোমল গান্ধার প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘এটি প্রচলিত সময়ের চাইতে অনেক বেশী এগিয়ে থাকা ছবি।’ যে কোন মহৎ শিল্পীর গুণই হলো তাই। তিনি সবসময় এগিয়ে থাকেন তাঁর সময়ের থেকে। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে তিনি যেমন খাপ খাইয়ে নিতে পারে না তাঁর সমসাময়িক সময় ও সমাজের সঙ্গে, তেমনি তাঁর সময় সমাজও খাপ খাইয়ে নিতে পারে না তাঁর সঙ্গে। ঋত্বিক ঘটকও তেমনি মিলে যেতে পারেননি, তাঁর সময়ের সেই অবক্ষয়িত সমাজের সঙ্গে। তাই তাঁর ছবিগুলোতে বারেবারে এসেছে বিপর্যস্ত সেই সমাজের কথা, অবিন্যস্ত সেই সময়ের কথা, ভঙ্গুর মুল্যবোধের কথা, সেই সমাজ সময় মূল্যবোধের যাঁতাকলে পিষ্ট অসহায় মানুষের কথা এবং সেই সমাজ সময় ও মূল্যবোধ থেকে মুনাফা করা মানুষের কথাও। তাই সেই সময় সমাজ ও শেষোক্ত মানুষেরা তাঁর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে, তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার কারণে তাঁকে আটকে রাখতে চেয়েছে, তাঁর ছবিগুলো আটকে রেখে- তাঁর ছবি করা মাঝপথে বন্ধ করে।

নাগরিক (১৯৫২), অযান্ত্রিক (১৯৫৭), বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৯), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণ রেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) ও যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪) ঋত্বিকের শেষ করে যাওয়া আটটি চলচ্চিত্র। এসব চলচ্চিত্রে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে চিত্রিত করে রেখে গেছেন তাঁর সেই সময় সমাজ ও মানুষের হতাশা বঞ্চনা ও নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার চিত্র। ঋত্বিক তাঁর এই আটটি ছবিতে চিত্রবন্দী করে রেখে গেছেন শঠ রাজনীতিক, ফাঁপা বুদ্ধিজীবী (তাঁর ভাষায় Broken lntellectual) আর লোভী সমাজ ও সংস্কৃতিকর্মীদের শঠতা, প্রতারণা এবং মুনাফা আহরণের চিত্র। এই একই রকমের দৃশ্য তিনি চিত্রায়িত করতে চেয়েছিলেন অরূপকথা (৫১), কত অজানারে (৫৯), বগলার বঙ্গদর্শন (৬৪), রঙের গোলাম (৬৮) এ চারটি অসমাপ্ত চলচ্চিত্রেও। তাই বলা যায়, ঋত্বিকের এসব প্রয়াস কেবল মাত্র একেকটি চলচ্চিত্র নয়, আমাদের ইতিহাসের একেকটি চিত্রিত অধ্যায় যা সামনের দিনগুলোতে আমাদের অতীতকে তুলে ধরবে বারবার।

যাদের বিরুদ্ধে ছিল ঋত্বিকের যুদ্ধ, তারা ঠিকই সব টের পেয়েছিলেন। তাই তারা সেজেছেন কখনো প্রযোজক, কখনো পরিবেশক, কখনো প্রদর্শক। আটকে দিয়েছেন মাঝপথে ছবির নির্মাণ, কিংবা শেষ করে বাক্সবন্দী করে রেখেছেন, নয়তো তিনদিনের জন্যে নমো নমো করে মুক্তি দিয়েছেন দূর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো ভাঙাচোরা প্রেক্ষাগৃহে। কেউ সেজেছেন আইনরক্ষক- হুলিয়া জারী করেছেন ছবির মুক্তির ওপর, মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির ওপর। ফলে কোনো কোনো ছবি ঋত্বিকের জীবদ্দশায় মুক্তির আলো দেখেনি, কোনো কোনো ছবি তিন দিনের মাথায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে নেমে গেছে।

এসব ঘটনা ঘটেছে তাঁর মৃত্যুর পরেও। (এতটাই আক্রোশ!) কেউ সেজেছেন সমালোচক-তুলোধুলো করেছেন তাঁর ছবিকে, ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন কিচ্ছু হয়নি বলে। কেউ সেজেছেন সমাজকর্মী: পাগল, ক্ষ্যাপাটে, আখ্যা দিয়েছেন তাঁকে। কেউ সেজেছেন সরকারি কর্তা: আটকে দিয়েছেন ছবির বিদেশ যাত্রা, করতে দেননি সাবটাইটেল, চেয়েছেন হাস্যকর ব্যাখ্যাতলব।

আবার কেউ সেজেছেন আত্মীয়: যারা আত্মার কোনো সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করেননি তাঁর সঙ্গে। কিন্তু আশ্চর্য! সেই তারাই আজ প্রতিদিন মুনাফা তুলছেন! ছানা মাখন খাচ্ছেন ঋত্বিকের ছবিগুলোর থেকে যেগুলো তিনি মন্থন করেছিলেন নিজেকে দন্ডী করে।

ঋত্বিকের মাষ্টারপিসগুলো গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নির্মিত। ৬০ বছর হয়ে গেল। আমাদের প্রজন্মের পূর্বে। বাকী দুটি সত্তরের দশকের প্রথম দিকে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্মের পূর্বে। কিন্তু তাঁর ছবিগুলো এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। আমরা দেখছি বারবার। চেষ্টা করছি অনুধাবন করতে। অনুধাবন করতে পারলে পেছন ফিরে তাকাচ্ছি, তাকাচ্ছি সামনের দিকে। বিদেশেও ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছেন ঋত্বিক। তাঁর ছবিগুলো সাবটাইটেলড হয়ে প্রদর্শিত হচ্ছে আজ বিশ্বজুড়ে। অসমাপ্ত ছবিগুলোতে ধারাভাষ্যযুক্ত হয়ে সাবটাইটেল সহ প্রদর্শন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সমাপ্ত অসমাপ্ত সব চলচ্চিত্র নিয়ে দেশে-বিদেশে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশেষ রেট্রোসপেকটিভ। নিত্য নতুন গবেষণার মধ্য দিয়ে ঋত্বিক প্রতিনিয়ত আবিস্কৃত হচ্ছেন।

বিশ্লেষিত হচ্ছে তাঁর চলচ্চিত্র, তাঁর নাটক, তাঁর গল্প, প্রবন্ধ নানা বিশ্লেষণে। ঋত্বিকের প্রতিটি চলচ্চিত্র সবসময়ই অগ্রবর্তী হয়ে থাকবে। এর নেপথ্যের কারণ তার বিষয় নির্বাচন। এ অঞ্চলের যে রাজনৈতিক ঘটমানতার উপর তাঁর ছবিগুলোর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত তা দীর্ঘদিন আলোড়িত করবে তার দর্শককে- কারণ এই দর্শককূল প্রত্যক্ষে পরোক্ষে সেই ঘটমানতার শিকার। এ অঞ্চলের বাইরের দর্শকের কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেকখানি, বিপর্যস্ত সময় ও মূল্যবোধহীন সমাজের বিশ্বজনীনতার কারণে।

অযান্ত্রিক প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক কুমার ঘটকের বিষয় নির্বাচনের সাহসিকতার কথা বলেছিলেন। কেবল সাহসিকতা নয়, প্রতিটি ছবির বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঋত্বিক সমাজ সচেতনতারও পরিচয় রেখেছেন। অহেতুক হাত বাড়াননি গোয়েন্দা কাহিনী, কল্পকাহিনী কিংবা মনোরঞ্জক কোনো কাহিনীর কাছে। সমাজের বিপর্যস্ততার চিত্র রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে, নির্মম সততার সঙ্গে চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর ছবিতে। কোনো প্রলেপ নেই তাতে। ফলে তাঁর ছবিগুলো কেবল চলচ্চিত্র বিশেষ হয়ে নয়, সময়ের-সমাজের সেলুলয়েড ডকুমেন্ট হয়ে চিরদিন রয়ে যাবে।

৪ নভেম্বর ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতি দেবীর জন্মদিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে তাঁদের জন্ম। তাঁদের পিতা সুরেশচন্দ্র ঘটক তখন ঢাকার জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জন্মদিনের এই শুভক্ষণে তাঁদের দুজনের প্রতি আমাদের সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি।