ভাষার বরপুত্র হিসেবে যদি সলিমুল্লাহ খানের কথা উচ্চারণ করি, তাহলে বোধ হয় একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। বর্তমানে একমাত্র তাঁর গদ্যই স্বতন্ত্র হয়ে পাঠকের সামনে ধরা দেয়। কেউ যদি লেখকের নাম না-ও পড়ে, তারপরও রচনার শৈলী দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটা সলিমুল্লাহ খানের লেখা। তিনি ঊনবিংশ শতকের সাধু ভাষার কাঠামো গ্রহণ করে, তার ভেতর তৎসম শব্দের প্রভাব কমিয়ে, খাঁটি বাংলা ও বাংলায় আত্তীকৃত বিদেশি শব্দ ব্যবহার করে আধুনিক চিন্তার সংশ্লেষ ঘটান। এতে তাঁর রচনাশৈলী হয়ে ওঠে আধুনিক ধ্রুপদি গদ্যের অনন্য উদাহরণ। এটা সম্ভব হয়ে উঠেছে কেবল ভাষার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা এবং ভাষাকে দেখার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
সলিমুল্লাহ খান ভাষা নিয়ে প্রায়ই একটি কথা বলেন, যারা কথা বলতে পারে, তারা সবাই দার্শনিক। তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে লেখালেখির মধ্য দিয়ে দর্শনচর্চাই করেন। ২০১৮ সালে করা ফ্রানৎস ফানোঁ সম্পর্কিত এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “ফিলোসফির ক্ষেত্রে মৌলিক জিনিস হচ্ছে ভাষা। ভাষাবিহীন চিন্তা নাই বন্ধুগণ। এটা হলো ফেনোমেনোলজির একটা আর্টিকেল অব ফেইথ। আমাদের দেশে কেন লোকে দর্শনচর্চা করতে পারছে না, কারণ আমাদের দেশে লোকজন ভাষাচর্চা করতে পারছে না। (এখানে) মানুষ নিজের ভাষাই নিজে জানে না। অর্থাৎ নিজে সে কিভাবে কথা বলছে, সেটাও জানে না, তো সেখানে দর্শনচর্চা হতে পারে না।”
এমনিতে সলিমুল্লাহ খান নানা বিষয়ে লেখাপড়া তো করতেই থাকেন। কিন্তু অবসরে কি করেন? ভাষাচর্চা করেন। হয় বাংলা, নয় ইংরেজি, অথবা ফরাসি, কিংবা ইতালীয়। আমরা স্যারের কাছে লাকাঁ, বোদলেয়ার, ফানোঁ পড়ার সময়েই বুঝেছি কি গভীরভাবে ফরাসি ভাষাটা চর্চা করেন। এমনকি মাসের পর মাস তিনি ফরাসি ঝালাই করেছেন আমাদের নিয়েই। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দুই ফোঁটা ফরাসি ভাষা শিখেছিলাম, এরপর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজেও বছর দুই লেখাপড়া করেছি ফরাসি ভাষা নিয়ে। সে সুবাদে স্যারের সঙ্গে ফরাসি ভাষাচর্চা করতে আমার বেশ লাগত। সেসব দিনের কথা খুব মনে পড়ে। ফরাসি ভাষা কেবল নয়, স্যার একবার বললেন, চলুন আমরা অনুবাদের ওপর সেমিনার করি। নাম দিলেন: অনুবাদকলা। সেটা ২০০৬ সাল। ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের কলাকৌশল নিয়ে এক মাস ধরে চলল সেমিনার। আমরা বসি সপ্তাহে এক দিন করে। তিনি আমাকে পার্থ সারথী গুপ্তের লেখা ‘মিউজিক অ্যান্ড কমিউনালিজম ইন বেঙ্গল’ নামের এক বিশাল প্রবন্ধ দিলেন অনুবাদ করতে। আমি কিছুটা সময় নিয়ে অনুবাদটা শেষ করি। মনে আছে স্যারের বাসায় গিয়ে অনুবাদটা দেখিয়েছিলাম। তিনি যত্ন নিয়ে আমার অনুবাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিলেন।
আমার কেন যেন মনে হয়, পড়ালেখার ব্যাপারে আমি কতটা সিরিয়াস, সেটা পরখ করতেই স্যার আমাকে বড় প্রবন্ধটি অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া প্রবন্ধটির আলাদা গুরুত্ব তো ছিলই। কাজী নজরুল ইসলাম যেহেতু স্যারের অত্যন্ত প্রিয়, আর প্রবন্ধটির কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গ ছিল নজরুল ইসলাম। যাহোক, অনুবাদের কাজটি ঠিকঠাক সম্পাদন করতে পেরেছিলাম বলেই হয়তো পরবর্তী সময়ে স্যার আমাকে আরও অনেক ছোটখাটো অনুবাদের কাজ করতে দিয়েছিলেন। সর্বশেষ কাজটি করলাম জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময়। স্যার ডেইলি স্টারের জন্য একটি ইংরেজি নিবন্ধ লিখেছিলেন, সেটাও অনুবাদ করতে দিলেন আমাকে। অনুবাদকর্ম পাঠানোর পর স্যার বললেন, আপনি একশতে ৯৯ পেয়েছেন। আমার অনুবাদে একটু ভুল ছিল। ভুলটা উনি এত সুন্দর করে ধরিয়ে দিলেন! সে জন্যই বলি, আমি কখনোই প্রচলিত অর্থে তাঁর ক্লাসরুমে বসিনি, কিন্তু তিনি আমাকে যেভাবে শিখিয়ে চলেছেন, তাতে আমি বলব, সলিমুল্লাহ খান আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
বিভিন্ন সভায় স্যারের বক্তৃতায় ভাষা সম্পর্কে যে নতুন দ্বার আমার সামনে উন্মুক্ত হয়েছে, তা অতুলনীয়। অনেকের কাছেই বিষয়গুলো সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা অসামান্য। সত্যি কথা বলতে, আমিও একজন নগণ্য ভাষাপ্রেমী, সে জন্যই হয়তো। যেমন উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, বাংলায় ‘টানাপোড়েন’ কথাটি। এর প্রচলিত অর্থ আমরা সবাই জানি: কোনো সংকট বা সমস্যা, রূপকটি এসেছে বুননকর্ম থেকে। কিন্তু এর সঙ্গে যে মেটাফোর ও মেটোনিমির তুলনা টানা যেতে পারে, তা সলিমুল্লাহ খানের আগে কেউ আমাকে বলেননি। ‘টানা’, যা আনুভূমিক, মেটাফোর বা রূপান্তর প্রক্রিয়ার চলনটাও তেমন। আর ‘পোড়েন’ হলো উল্লম্ব, এর সঙ্গে তুলনা চলে মেটোনিমি বা ‘নামান্তরে’র। এরপর কি আর চিহ্নবিদ্যা কঠিন থাকে? শুধু ভাষার দিকে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে যে চিন্তার নববেলাভূমিতে পা রাখা সম্ভব, তা স্যারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরই বুঝতে পেরেছি।
মেটোনিমিকে যে বাংলায় নামান্তর বলা যায়, তা বলে দেখিয়েছেন সলিমুল্লাহ খান। শুদ্ধ তা-ই নয়, প্যাসিভ রেভল্যুশনকে তরজমা করেছেন ‘বেহাত বিপ্লব’, দার্শনিক অর্থে সাবজেক্টের বাংলা করেছেন ‘সহজ মানুষ’, ডিসকোর্সের বাংলা প্রস্তাব করেছেন ‘জবান’। তো এমন হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে। এসব কাজের কোনো তৎজলদি ফল চোখে পড়বে না। কিন্তু বাংলাচর্চার ক্ষেত্রে এর অবদান যে কত বড় এবং এর প্রভাব যে কত সুদূরপ্রসারী, তা বলতে পারবেন আগামী দিনের ভাষাচর্চাকারীরা। সুখবর হলো ফ্রানৎস ফানোঁর বিখ্যাত ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক’ বইয়ের বাংলা অনুবাদ তো স্যার করেছেনই, সম্প্রতি মূল ফরাসি থেকে ইংরেজিতে তরজমা করেছেন পুরো বইটা, প্রচুর নোক্তাসহকারে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বাজারে যেসব অনুবাদ রয়েছে, সেখানে কোথাও না কোথাও কিছু ত্রুটি রয়েছে। তা ছাড়া অনুবাদগুলোও একটু পুরোনো হয়ে গেছে। তাই ফানোঁর জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে নতুন করে তরজমায় হাত দেওয়া।
অনুবাদ সম্পর্কে বাল্টার বেনিয়ামিনের দোহাই দিয়ে সলিমুল্লাহ খান ২০১৪ সালের এক সেমিনারে বলেছিলেন, “অনুবাদ দুই প্রকারের হয়: আপনি পরের ভাষাকে নিজের ভাষায় রিডিউস করেন, অথবা আপনার ভাষাকে বিকশিত করে পরের ভাষার পর্যায়ে নিয়ে যান। কোনটা করা বাঞ্ছনীয়, আপনারা বলুন।” অনুবাদের ক্ষেত্রে স্যার মূল ভাষার কাছাকাছি থাকাটাকেই উচিত বলে মনে করেন। বাকিটা নির্ভর করে অনুবাদকের সোর্স ও টার্গেট-ভাষার ওপর কতটা দখল তার ওপর। অনুবাদ মূলানুগ হয়েও, রূপান্তরিত ভাষায় কতটা নতুন স্বাদের জন্ম দিতে পারে, তা সলিমুল্লাহ খানের করা ডরোথি জুল্লে, পেন্টি সারিকস্কি ও শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার অনুবাদ পড়লেই বোঝা যায়।
ভাষার কারবারে ষোলোআনা মনোনিবেশ করেছেন বলেই, বাংলার বানান নিয়ে তিনি কথা বলছেন দীর্ঘদিন ধরে। স্যারের সবচেয়ে বিখ্যাত বিতর্ক হলো রবীন্দ্রনাথের ‘কি’ ও ‘কী’ বানান নিয়ে। স্যার মনে করেন সর্বনাম ও অব্যয় দুই ক্ষেত্রেই ‘কি’ যথেষ্ট। কারণ, এখানে ভাষার মেটাফোর কাজ করে। তিনি ভাষাকে ‘রিডিউস’ করার পক্ষপাতী নন। এই বিতর্কের তাৎপর্য না বুঝে অনেকেই স্যারের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই বানান সংস্কার নিয়ে কিন্তু সলিমুল্লাহ খান প্রথম কথা বলেননি। স্যার নিজেই এক সভায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ যে অর্থের ভাগ করে ‘কি’ ও ‘কী’কে আলাদা করেছেন, এটা বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্যায়, সেটা ১৯১১ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদারই প্রথম বলেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাতি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকার দ্বাবিংশ বর্ষের নবম সংখ্যায় বিজয়চন্দ্রের লেখাটি আছে, শিরোনাম ‘বাঙ্গালা ভাষার মামলা’। বক্তৃতা ছাড়াও স্যার একাধিক প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথের বানান সংস্কারের বিষয়ে নিজের দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে মুখে মুখে তিনি একটি উদাহরণ প্রায়ই দেন, বলেন, ‘বর্ণ’ শব্দটি দিয়ে তো রং, জাতি ও অক্ষর বোঝায়। তবে কি বর্ণের তিন ধরনের বানান হবে? তাহলে সর্বনাম ও অব্যয়ের জন্য ‘কি’ ও ‘কী’ আলাদা কেন? নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের গোটা সাহিত্যকর্মকে সামনে রাখেন প্রমাণ হিসেবে।
মাইকেল থেকে শুরু করে হালের নবীনদের সব জরুরি লেখাই পড়ে ফেলেন সলিমুল্লাহ খান। বাংলা সাহিত্য স্যারের ব্যাপকভাবে পড়া। অনেকেই মনে করেন, তিনি কথাসাহিত্য কম পড়েন। তাদের জন্য একটি অপ্রকাশিত কথা বলি, কঠিন বিষয়ে লেখাপড়া করতে করতে স্যার পাঠের স্বাদ পরিবর্তনের জন্য কথাসাহিত্য বা কবিতা পড়েন। সেটা হোক বাংলায় বা অন্য ভাষায়।
পড়া, লেখা ও বলার ভেতর দিয়ে মানুষ যে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে, তাতে তার ভাষাচর্চার অবদান অনস্বীকার্য। অন্যভাবে বললে, মানুষের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ভাষা ছাড়া সম্ভব নয়, আবার ভাষা বিনা চিন্তা করাও অসম্ভব। কাজেই ভাষা ও চিন্তা একে অপরের পরিপূরক, অবিচ্ছেদ্য। আমার মনে হয় সলিমুল্লাহ খান ও ভাষাচর্চাও সেই একইভাবে পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
আজ ১৮ আগস্ট, স্যারের জন্মদিন। ভাষাচর্চার প্রতি স্যারের এই ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের মধ্যেও।