কবি রফিক আজাদের কাব্যদর্শন ও আত্মোপলব্ধি

ড. দিলারা হাফিজ প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
কবি রফিক আজাদ

রফিক আজাদকে বলা যায় কবিতার বনমোরগ। কাব্যজগতের অকৃতি অধম সন্তান হিসেবে কবি তাঁর যৌবনে স্বদেশের আকাশ-মাটি, তরুবীথি, নদ-নদী বৃক্ষলতার ছায়া-বিভোর বনভূমির অপার সৌন্দর্যালোকের রসাস্বাদন করেছেন সর্বদা। যে বনমোরগের আহ্বানে ঘুম ভেঙে যায় গভীর গহন অরণ্যের, শব্দবীণায় বাজে ভৈরবী রাগ-অনুরাগ। সেই অনন্য এক রাগে কারুময় কাব্যজগতে পদ্যপ্রবন্ধের মতো নতুন এক কাব্যধারা সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসের তুলোট পাতায়। নতুন এই কাব্যকলার ধারাস্নানের মূলে রয়েছে পয়ারের গভীরতাগামী অশেষ বাচ্যের অনির্ণীয় পথের শেষে, অনন্তের এক চপল আহ্বান।

শৈশবের কিছু ঘটনাবলি পথ ভুলিয়ে তাঁকে নিয়ে গেছে অধরা কবিতার কাছে। কৃষকের সন্তান হয়েও সবুজ অরণ্যের ধাঁধায় পথ হারিয়েছেন বারবার। মফস্বল শহরের নামকরা একজন গুন্ডা না হয়ে হয়েছেন বাংলা কাব্যজগতের খ্যাতিমান তারকা; অন্যতম প্রধান একজন কবি। এই কবিতা রোগে পেলে তার আর নিস্তার নেই। বিষয় হয়ে যায় বিষ। কবিতা ছাড়া কবির কাছে সকলই অর্থহীন অর্থের অপচয় বৈ কিছু নয়।

কবি ভালোবাসেন প্রকৃতির ডানায় উড়ে ভেসে বেড়াতে। ভালোবাসেন মেঘ-বৃষ্টির আকাশ, ঈষাণকোণে ঝড় বিদ্যুৎ, অমানিশা, জোনাক-পোকার অন্ধকার রাত। আরও ভালোবাসেন রংধনু মেঘ, মেঘের পালিত কন্যা বৃষ্টিকেও খুব ভালোবাসেন কবি। তুমুল সেই জলপ্রবাহে তরুবীথির আতিথ্যে আস্বাদন করেন বনভূমির নৈসর্গিক অপার সৌন্দর্যলীলা। কবিতার মতো রহস্যময়ী নারীর দেখা যে পায় একবার, সেই প্রকৃতির সন্তানের পক্ষে ঘরে থাকা কঠিন। কৃষ্ণপ্রেমিকা রাধার মতো কেবলই বলতে থাকেন, “ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।”

রবীন্দ্রনাথ এই রহস্যময়ীর নাম দিয়েছিলেন ‘জীবনদেবতা’। রফিক আজাদ তাকে মাধবী নামে ডেকেছেন। মাধবী এসেই বলে: ‘যাই’—খণ্ডিত ব্রিজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই/ নীরবে দাঁড়িয়ে আছি: আমার অন্ধতা ছাড়া আর/ কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে; উপেক্ষা কোরো না তবু নারী,—-অধরা এই নারী, লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব সেই পাখি, যে তার রহস্যময়তার ঘেরাটোপে সারাক্ষণ অস্থির করে রেখেছেন কবিকে—-

“কখনো জ্যুরিখে তুমি, বনে, কিয়োটোতে, বাম-তীরে,/ গ্রিনিচ পল্লীতে কিংবা রোমে পড়ে থাকো; কখনো বা/ যোগ দাও পোর্ট-সৈয়দের নোংরা বেলেল্লাপনায়। তোমার স্বভাব নয় স্থিরতায়—অস্থির, অধীর—-/ তুমি আছো অনুভবে, তুমি আছো শিশুর স্বভাবে।”

তবু তিনি তারই সেবায়, সংসার-জীবনের মোহ মাৎসর্য অগ্রাহ্য করে তারই পূজোয়, অর্চনায়, প্রার্থনায় ব্যয় করেছেন সমগ্র আয়ু।

“আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে, হে সুন্দরী/বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার, সোনার তরী?” রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী হয়তো ইতোমধ্যেই শতাব্দীর ঘাটে ভিড়ে নোঙ্গর ফেলেছে। কিন্তু অন্য কবিদের সোনার তরী কোন পাড়ে যে ভিড়বে, তা কেউ কখনো জানতে পারেন না।

যদিও সকলেই অসীমের ঘাটে বাঁধতে চান তার নৌকা।

অনন্তের এই পথ যাত্রাকালে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গ্রাম-গঞ্জের পথে প্রান্তরে, ধূলিকণায়, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, নেত্রকোনার অনেক তারার আকাশ, জামালপুরের মফস্বল শহর, জনকের জন্মভূমি ফরিদপুর, মধুপুরের আদিবাসী অঞ্চলের চুনিয়া, দোখলা—কোথায় না গিয়েছেন কবি!

জ্যোৎস্নাপ্লাবিত নিসর্গের মনোলোভা শোভা আস্বাদনের দুর্বার আকূতি নিয়ে প্রকৃতির কোলে কোলে খুব ঘুরে বেড়াতেন এক সময়—কবি-লেখক-বন্ধু সহযোগে। বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে যেতেন দল বেঁধে। লেখক, কবি, আবৃত্তিকারসহ সমমনাদের নিয়ে। সে এক সময় বটে!

একবার কলকাতা থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলেন মীনাক্ষী বউদিসহ। তাদের নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়া হয়েছিল ১৯৮৩ সালের মে মাসের দিকে। এ যাত্রায় সঙ্গে আমিও ছিলাম। কবি হায়াৎ সাইফ তখন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম কাস্টমস অফিসের বড় কর্তা। কবি সাহিত্যিকদের আতিথ্য ও কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল, যত দূর মনে পড়ে, হায়াৎ সাইফের উদ্যোগে চট্টগ্রামের সাহিত্য সংগঠনসমূহ আয়োজনটি করেছিল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একক পাঠের আয়োজন হয়েছিল একদিন। মাত্রাবৃত্তকে ভেঙে নতুন ফর্মে লেখা বেশ কটি কবিতা শক্তি খুব তারিয়ে তারিয়ে পাঠ করছিলেন সেই আসরে। ছান্দসিক বা গভীরভাবে ছন্দকে স্বায়ত্তশাসনাধীন করে রাখা কবি রফিক আজাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পড়ছিলেন কবিতাগুলো। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনন্য এক পাঠ শুনেছিলাম সেদিন অসাধারণ এক মোহময় কাব্যিক ব্যঞ্জনায়।

অন্য আর একটা অনুষ্ঠানে ঢাকা চিটগাং ও কলকাতার কবি মিলে কবিতা পড়েছিলেন সক্কলে।
রাতে হায়াৎ সাইফ আর লাকী ভাবির বাসায় রাতের ডিনার হয়েছিল। লাকী ভাবি অসাধারণ ঝালের গোমাংস রেঁধেছিলেন। এখনো মনে হয় স্বাদ লেগে আছে জিহ্বায়। আরও একবার ভাবির রান্না খেয়েছিলাম। রফিক আজাদের প্যারিয়ানাল এ্যাবসেস হলো যখন। নতুন আপত। কী করি?

শেষমেশ এ জন্য একটা অপারেশন করতে হয়েছিল মহাখালীর মেট্রোপলিটান হাসপাতালে। অপারেশন করেছিলেন ডা. কাদের। আমার দেশ একই মানিকগঞ্জে তারও বাড়ি। অত্যন্ত দরদ দিয়ে অপারেশনটি করেছিলেন। তখন নাম করা এই সার্জন, আমার দেশি কাদের ভাই।
অসম্ভব ভালো হাত। আজ বলতেই হয়, ভারি যত্ন করে করেছিলেন কবির অপারেশন।
কবি রফিক আজাদের বড় ভাই কন্যা আমাদের ভাইঝি ডা. নীরু নাজমুন্নাহার তখন মেট্রোপলিটন হাসপাতালে তার সহকর্মী।

নীরুই ডা. কাদিরের হাতে অপারেশনটা করাতে আমাদের উৎসাহিত করেছিল।

দিন দশেক থাকতে হয়েছিল সেই যাত্রায়। তখন হায়াৎ ভাই ও ভাবি প্রায়ই দেখতে আসতেন কবিকে। আর মাঝে মধ্যেই দুপুরের খাবার পাঠাতেন। কখনো আবার অফিস যাওয়র পথে নাশতাটাও নামিয়ে দিয়ে যেতেন কবির জন্য। একজন কবির প্রতি অপর কবির কী যে ভালোবাসা—এ ঘটনা না হলে বুঝতে পারতাম না। কথিত আছে, রফিক আজাদ অনেককেই কবি বানিয়েছেন। কবি রবিউল হুসাইন, কবি আসাদ চৌধুরী, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হায়াৎ সাইফ আরও অনেকের কথাই আসে গল্প প্রসঙ্গে।

নতুন নামকরণের ক্ষেত্রেও কবির জুড়ি নেই। অনেকের পিতৃদত্ত নাম কেটে তিনি কাব্যিক নাম বসিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। শাইখ সিরাজ, আসাদ চৌধুরী, সেলিম আল দীন, আরও অনেকে আছেন এই তালিকায়।

যে কথাটা বলছিলাম, কবি কেউ বানায় না, এ কথা বলার মাজেজা হলো, সম্পাদক হিসেবে রফিক আজাদ তখন, অনেকের থেকে জোর করে লেখা আদায় করে ছাপিয়ে দিতেন। কবি আসাদ চৌধুরী বলতেন, রফিক লেখার জন্য বাধ্য না করলে কস্মিনকালেও আমি কবি হতাম না। আমি বিশ্বাস করি এ কথা বলার মানে হলো আসাদ ভাইয়ের বিনয় এবং রফিক আজাদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার ও প্রকাশ। পাশাপাশি কোনো কোনো বন্ধুর নিষ্ঠুরতাও কম তো আর দেখেননি তিনি। তাই বোধ করি ক্ষতস্থান নামক কবিতাটি কবি লিখেছিলেন গভীর বেদনাবোধ থেকে।
“ক্ষত তো শুকিয়ে যাবে
দেরিতে হলেও,
দাগ রয়ে যাবে দেহে
সারাটা জীবন—
কারু কারু আচরণ মনে পড়ে যাবে”!।

——জীবন পাল্টে ফেলার অপরাধে অপরাধী কবির আক্ষরিক অর্থে ফাঁসি না হলেও ফাঁসির মঞ্চেই কাটিয়ে গেছেন তিনি আয়ুর অবশিষ্ট সময়-পরিসর। তো ঘাটে ঘাটে রফিক আজাদকে এতটাই মাশুল দিতে হয়েছিল যে সেই কষ্ট ভুলতেই নিয়মিত তিনি যেতেন সাকুরায়। সোনালি শিশিরে নিমজ্জিত থেকে কবিতার আরাধনায় কাটাতেন সামান্য হিরণ্ময় সময়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো মোমের দু’ধারে দীপ্ত জ্বালিয়ে আগুন তিনি নিজের আয়ু দ্রুত নিঃশেষ করেছেন গভীর অভিমানে।

সব কষ্ট নিতে পারতেন কিন্তু বন্ধুদের নিষ্ঠুরতা কিছুতেই মানতে পারতেন না। আবার মুখ ফুটে কখনো কিছু বলবেন না, বুঝতে দেবেন না যে, কষ্ট পাচ্ছেন তিনি—এটিও একধরনের তাঁর পণ। বন্ধুদের প্রতি মন যাতে কিছুতেই বিরূপ না হয়, সেজন্য একধরনের সচেতন প্রয়াস তিনি মেনে চলতেন।

একবার কবি আল মাহমুদ কোনো এক সাপ্তাহিক কাগজে রফিক আজাদের বিরুদ্ধে কিছু লিখেছিলেন। লেখাটা যাতে রফিকের চোখে পড়ে, সেজন্য সেই কাগজটি হাতে দিয়ে কবির কর্মস্থলে একেবারে ‘রোববার’ অফিসের টেবিলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর এক ভক্ত অনুজকে দিয়ে। বিষয়টি কবির আগেই জানা ছিল। তাই পত্রিকাটি হাতে পাওয়া মাত্র তিনি ইত্তেফাক ভবনের জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন সেটি। অনুজটিকে বলে পাঠিয়েছিলেন যে, আল মাহমুদ আমার ভালো বন্ধু, চিরকাল বন্ধুই থাকবে। আমিও তো মানুষ, লেখাটি পড়লে আমার ভেতরেও সামান্য প্রতিক্রিয়া হতে পারে, বন্ধুর প্রতি মন বিরূপ হোক—এ আমি কিছুতেই চাই না।
আমার বিরুদ্ধে কোনো বন্ধুর লেখাই আমি পাঠ করি না তাই। এটি আমার জীবনদর্শন, কাব্যদর্শনও বটে।

বন্ধুদের হাসি অমলিন রেখে কবি তাই কষ্টের কারুকাজময় কাফন পরে চলে গেলেন শেষাবধি।