রণেশ দাশগুপ্তের চিন্তাভূমি

মার্কসবাদের আলোকে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রূপকল্প

রহমান মুফিজ প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৪, ০৯:১৫ এএম
রণেশ দাশগুপ্তের চিন্তাভূমি । প্রবন্ধ

রণেশ দাশগুপ্ত বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের একজন প্রধানতম মনীষা। গত শতাব্দীতে যে কজন মার্কসবাদী তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী জন্মেছেন, তাদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত স্বীয় প্রজ্ঞাগুণে দীপ্যমান। মার্কসীয় মতবাদের অক্ষরবাদী চর্চার বাইরে গিয়ে তিনি যে চিন্তাভূমি তৈরি করেছেন তার পাটাতন বেশ বিস্তৃতই বলা চলে। যদিও রণেশ দাশগুপ্তের নাম আজকের বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে খুব কমই চর্চিত। তথাপি রণেশ দাশগুপ্তের যে যৎসামান্য সাহিত্যকর্ম ও চিন্তাসমগ্র লিখিতরূপে আমাদের পাঠ ও চর্চার সীমানায় এসেছে, তার রস আস্বাদন করতে করতে আমরা এক মহান আত্মারই সন্ধান পাই, যিনি গোটা জীবন মহত্তর এক আকাঙ্ক্ষার কাছে সঁপে দিয়েছেন, আর সে আকাঙক্ষার নাম ‘মুক্তি’।

মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইকে পরিণতি দেওয়ার লক্ষ্যে একটা পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক মুক্তির দিকেই রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন সবথেকে বেশি মনোযোগী। এবং তার সে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রূপকল্প সঙ্গত কারণে মার্কসবাদ দ্বারাই সুসংহত। বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর অন্তঃশীল শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন বলেই তিনি এ দেশের মানুষের অন্তরে বিধৃত করতে চেয়েছেন এমন এক চৈতন্য যা তাদের একটা উচ্চতর উপলব্ধি দেবে, যেখান থেকে মিলবে মুক্তির প্রেষণা। এবং সঙ্গত কারণেই তিনি সর্বাগ্রে স্পর্শ করতে চেয়েছেন এই দেশের বিকাশমান অগ্রসর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনন; যাদের দিয়ে তিনি এই মাটির ব্রাত্যশ্রেণির মুক্তির ইশতেহার রচনার মকসদ হাসিল করতে চেয়েছেন।

একজন মার্কসবাদী সাহিত্যিক হিসেবে রণেশ দাশগুপ্ত তার রচনার প্রতিটি বিষয় নির্বাচনে থেকেছেন সচেতন ও যত্নবান। লিখেছেন বিশ্বসাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে, লিখেছেন চলচ্চিত্র ও চিত্রকলা নিয়ে। এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক, দার্শনিক, কবি, বিপ্লবী ও সমসাময়িক আলোচিত বিশ্বরাজনীতিকদেরও। শেক্সপিয়ার, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি,  মায়াকোভস্তি, রমা রঁ লা, ম্যাক্সিম গোর্কি, জ্যঁ পল সার্ত, পাবলো নেরুদা, মার্কেজ, লুকাচ, গ্রামসি, রিলকে, হেনরিক হাইনে, আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, চ্যাপলিন, সাজ্জাদ জহির, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, মখদুম মহীউদ্দীনসহ নানা লেখক, দার্শনিক এবং শিল্পীর চিন্তা ও সৃষ্টিকর্মের গভীর আলোচনা হাজির করে রণেশ দাশগুপ্ত পাঠকের ভাবনাকে যে অভিমুখ দান করেন তা মূলত সর্বহারা ও নিপীড়িত শ্রেণির পক্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক সংকল্প নির্মাণের পাথেয়।  

একইসঙ্গে বিদ্যাসাগর, লালন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতি, শরৎ, মানিক, জীবনানন্দ, সোমেন চন্দ প্রমুখ বাঙালির চিত্ত জাগরণকারী মনীষারা রণেশ দাশগুপ্ত কর্তৃক বিশ্লিষ্ট হয়েছেন ভিন্ন আলোতে। বিশ্বসাহিত্য ও শিল্পকলার বিপুল ভাবসম্পদকে মানবচিত্ত উন্নয়নের অকৃত্রিম রসদ হিসেবে বিবেচনা করেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’ রচনায় গভীর অনুরাগের সঙ্গে তিনি দেখেছেন সমগ্র সৃষ্টি ও সৃষ্টিমানসকে। বলতে চেয়েছেন মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজেই কেবল শিল্পী পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন, তার আগে নয়। সে মুক্ত সমাজ দিতে পারে কেবল সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র নয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে ছদ্মবেশি। শিল্পীর স্বাধীনতা খর্ব করতে প্রতিমুহূর্তে প্রতিকূল পরিবেশকেই সে পুষ্ট করে তোলে। রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন—‘এ কালের শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যক্তিক অস্থিরতা এবং অগ্নিপরীক্ষা প্রধানত সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য এবং ব্যাপক অনুপূরক হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে এবং সমাজতন্ত্রের কার্যক্রমের পরিপূরণেই এদের সমাধান অবধারিত। ধনিকতন্ত্রের তাগিদে কিংবা মরণকামড়ের প্ররোচণার ফলেই সমাজতন্ত্রের যুগের শিল্পীচিত্তে দ্বন্দ্ব ও আবর্তের সৃষ্টি হয়েছে কিংবা হয়ে চলেছে বলে আমাদের মনে মাঝে মাঝে যে ধারণার সৃষ্টি হয়, সেটা ভ্রান্ত। সমাজতন্ত্রই শিল্পীচিত্তকে অভাবিতপূর্ব নব নব দিগন্তে পৌঁছে দিয়ে এই শতাব্দীতে নতুন করে শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নের উদ্ভব ঘটিয়েছে’।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের উৎপাদন বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঘনীভূত প্রকাশ। মানুষের অবকাশ বা স্বাধীনতা ব্যতিরেকে এ বিপুল শিল্প-সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে পারে না। কিন্তু ধনবাদী ব্যবস্থায় মানুষের শ্রমশোষণের মধ্য দিয়ে যে উদ্বৃত্তমূল্য পুঁজিপতিদের পকেটে পুঞ্জিভূত হয় তা তো শুধু মুনাফা নয়, তা মানুষের হৃত অবকাশ ও স্বাধীনতা। ধনবাদী সমাজ মানুষের অবকাশ ও স্বাধীনতা অনুমোদন করে না। মানুষের মর্যাদা বরদাশত করে না। সে অর্থে ধনবাদী সমাজে শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন অবান্তর। কার্ল মার্কস সে গূঢ় সত্যকেই উদ্বৃত্তমূল্য তত্ত্বে হাজির করেন। কার্ল মার্কস মানুষের ওপর মানুষের শোষণ বাজেয়াপ্ত করতে চেয়েছেন। সমাজতন্ত্র তার প্রথম লক্ষ, শেষ লক্ষ সাম্যবাদ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে সমাজতন্ত্রের পথে অনিবার্য লড়াইয়ের প্রধান শক্তি শ্রমিকশ্রেণি তথা সর্বহারা মানুষ (প্রলেতারিয়েত)।

রুশ বিপ্লবের নায়ক মহামতি লেনিন বিপ্লবের আগে ও পরে প্রলেতারিয়েতের বিপ্লবী সংস্কৃতি নির্মাণে গভীর মনোযোগ দিয়েছিলেন। তিনি এ কর্মসূচিকে দেখেছিলেন একটি বিপ্লব হিসেবে। দেখেছিলেন মতাদর্শগত পুনর্গঠনের একটি বিপ্লবী উপায় হিসেবে। লেনিন মনে করতেন, সাংস্কৃতিক বিপ্লব হলো সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের একটি ধারাবাহিক কার্যপ্রক্রিয়া। ১৯০৫ সালে ‘পার্টি এবং পার্টি সাহিত্য’ নিবন্ধে লেনিন লিখেছেন—‘আমাদের সাহিত্য হবে মুক্ত সাহিত্য। এই সাহিত্য মানব সমাজের বিপ্লবী চিন্তাধারার সর্বশেষ বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করে তুলবে সমাজতন্ত্রী শ্রমিক শ্রমিকশ্রেণির অভিজ্ঞতা ও জীয়ন্ত কাজ দিয়ে। এই সাহিত্য অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমানের শ্রমজীবী সাথীদের অভিজ্ঞতার স্থায়ী সক্রিয় সংযোগ স্থাপন করবে।’

১৯২০ সালে শ্রমিক শ্রেণির সংস্কৃতির ওপর প্রাথমিক খসড়া প্রস্তাবে লেনিন ওই সংযোজককে আরও স্পষ্টভাবে সামনে এনে বলেছিলেন, ‘কোনো নতুন শ্রমিক শ্রেণির সংস্কৃতি নয়, বর্তমান সংস্কৃতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, ঐহিত্য এবং ফল তাদেরই বিকাশ সাধন। এই বিকাশ সাধনের কাজ চলবে মার্কসীয় বিশ্বদর্শন অনুযায়ী এবং শ্রমিকরাজের আমলে শ্রমিক শ্রেণির জীবন ও সংগ্রামের অবস্থা অনুযায়ী’। লেনিন বোঝাতে চেয়েছেন সমাজতন্ত্র গড়তে হলে আমাদের এমন সব উপাদান গ্রহণ করতে হবে যা পুঁজিবাদী সমাজেই তৈরি হয়েছে। কেননা প্রলেতারিয় সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এটি মানবজাতির জ্ঞানের ধারাবাহিক বিকাশ।

আমাদের এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য গড়ে উঠেছে এখানকারর শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে। কৃষক, জেলে, তাঁতী, মুচি, মেথর, ময়রা, কামার-কুমার, ছুতার, ঘরামী, ভবঘুরে, বাউল, বৈরাগী প্রভৃতি শ্রেণির মানুষের শ্রম ও ভাবজাত উপাদন দিয়ে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক সম্পদের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরাই। শিল্পবিপ্লবোত্তর প্রাচীন সমাজকাঠামোর মধ্যকার নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতেও ছিল শ্রমজীবী মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদানের প্রাবল্য। কেন না তখনো উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে মানুষের উৎপাদন সম্পর্ক জটিল রূপ পরিগ্রহ করেনি। ফলে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন সমাজের পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করলো এবং গড়ে উঠতে শুরু করল নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, নয়া বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি, সুশীল সমাজ—তখন সংস্কৃতির কর্তৃত্ব চলে গেল মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বুর্জোয় শাসক শ্রেণি মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি ও সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সমাজের উপরিকাঠামোকে করায়ত্ত্ব করার মওকা পেয়ে গেলো। নানা ‘সাংস্কৃতিক উপাদান’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি আদায়ের রাজনীতি তৈরি হলো। বিশেষ করে পুঁজিবাদ তার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী জাল বিস্তারের মধ্যদিয়ে দেশে দেশে শুধু অর্থনৈতিক উপনিবেশই গড়ে তোলেনি, গড়ে তুলেছে সাংস্কৃতিক উপনিবেশও।

বিংশ শতকে ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক, নয়া মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি এ বুজরোকিকে বললেন ‘কালচারাল হেজিমনি’ বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য। তিনি দেখালেন, বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী এমন সামাজিক বিশ্বাস, বিভিন্ন জিনিসের ব্যাখ্যা, নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা হাজির করে, যার মধ্য দিয়ে শোষণমূলক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে সম্মতি আদায় করে। গ্রামসি দেখলেন, ইউরোপের অগ্রসর পুঁজিবাদী সমাজে সর্বহারার বিপ্লব থমকে আছে। কারণ এ দেশগুলোর রয়েছে শক্তিশালী সংস্কৃতি। তাদের সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারে রয়েছে নানা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এই সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই বিদ্যমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে। সর্বহারাকে আটকে রাখছে বিপ্লবী হওয়া থেকে। নানাধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য জারি রেখে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে সমাজবিপ্লব। কারণ বুর্জোয়া শাসকেরা এমন বিশ্বাস, নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যে তা দিয়ে মানুষ কী চায়, মানুষের আকাঙ্ক্ষা কী, মানুষের স্বপ্ন কী—এগুলো ঠিক করে দেয়। পুঁজিবাদী সমাজের সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। দাস বানিয়ে রাখে নিপীড়িত সর্বহারা শ্রেণিকে। সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা কালচারাল হেজিমনি বুযেজায়াদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে সুরক্ষা দেয়।

কার্ল মার্কস ভিত্তিভূমি ধরে টান মারতে বলেছিলেন। আর গ্রামসি বললেন ভিত্তিভূমি ধরে টান মারলেও লাভ হচ্ছে না, কারণ সর্বহারার মনোজগৎ আচ্ছন্ন হয়ে আছে বুর্জোয়া দ্বারা নির্মিত সংস্কৃতি ও প্রচারিত বিশ্বাস দ্বারা। ফলে উপরিকাঠামোর (সুপারস্ট্রাকচার) নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া নব্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তিমূল ভাঙা সম্ভব নয়। এজন্য গ্রামসি পাল্টা সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা ‘কাউন্টার হেজিমনির’ তত্ত্ব দিলেন। এবং আজকের নয়া উদারবাদী সমাজ-বাস্তবতায় পুঁজিবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিপরীতে ‘সর্বহারা শ্রেণির সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ নির্মাণের বিকল্প দেখছেন না সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী ও সমাজতাত্ত্বিকরা।

রণেশ দাশগুপ্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোজগতে মার্কসীয় মননকাঠামো নির্মাণ, সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির কার্যকর উপায় খুঁজবার নিমিত্তে পাল্টা সাংস্কৃতিক আধিপত্য তৈরির নিরন্তর সংগ্রামই করে গেছেন। সেইসঙ্গে তিনি বিশ্বের তাবড় সমাজবাদী দার্শনিকদের প্রবণতা হাজির করে আমাদের বুঝিয়েছেন মার্কসবাদ এক চিরবিকাশমান মতবাদ।

মার্কসবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে—দ্বান্দ্বিকতার আলোকে তার অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমন্বয়বাদী চরিত্র। মার্কসবাদের সমালোচনা বা বিরোধিতামূলক যুক্তিনির্ভর যত আলোচনা আছে তার সবটাকে নিয়েই মার্কসবাদ বিকশিত হয়, মার্কসবাদী মতবাদ সর্ম্পূণতা লাভ করে। ফলে মার্কস পরবর্তী মার্কসবাদের যুক্তিনির্ভর সমালোচনাও মার্কসবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মার্কসবাদ কার্যত আর ‘অক্ষরবাদী মতবাদে’ আটকে থাকে না।

রণেশ দাশগুপ্ত বিশ্বমনন এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন পরম যত্নের সঙ্গে। তাই তিনি তার দেশ-জাতি-শ্রেণি এবং সমসাময়িক বিশ্ব থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর নিকট ও দূরের সমস্ত সভ্যতার সৌন্দর্য, জ্ঞান ও অভিজ্ঞানকে মাড়াই করে নির্মাণ করেছেন এক মহৎ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রূপকল্প। যার প্রকট সন্ধান মেলে তার গল্প, প্রবন্ধ, সাহিত্যালোচনা, বিশ্বসাহিত্যের নানা অনুবাদ এবং তত্ত্বীয় আলোচনার মধ্যে। তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’—আধুনিক নন্দনতত্ত্ব, মার্কসীয় নন্দনভাবনা, বিশ্ব উপন্যাসের বহুবিধ প্রকরণ, বহুবিচিত্র কাঠামো, মহাকাব্যের ঐতিহাসিক উপযোগিতা, সর্বজনবিদিত শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়বিশ্লিষ্ট একটি দুর্লভ গ্রন্থ। ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা’, ‘আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ’, ‘সাম্যবাদী উত্থানপ্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’—প্রবন্ধগ্রন্থগুলোতে নিবিড়ভাবে আলোচিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের নানা সৃষ্টি, তাদের গতিমুখ, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, নানা দার্শনিকের চিন্তার সঙ্গে মার্কসবাদী চিন্তার সংযোগ। ‘সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ: একালের উপমহাদেশের অগ্নি-আখরে’ গ্রন্থটিতে সাম্যবাদী কবি মখদুম মহীউদ্দীন, শহীদ জাকী আনোয়ার, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, পারভেজ শাহেদী, সাজ্জাদ জহীর ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আছে শ্রেণিতাত্ত্বিক বিস্তর আলাপ।

তার লেখা ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম’ গ্রন্থে ঊনবিংশ-বিংশ শতকে পুঁজিবাদী সভ্যতার দানবীয় প্রকাশ, নয়া উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ, গণহত্যা, দেশে দেশে সম্পদ লুণ্ঠন ও ভয়াবহ শোষণজালের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের রুখে দাঁড়ানোর রোমাঞ্চকর সব ঘটনা বিবৃত আছে। ‘মুক্তিধারা’ প্রবন্ধগ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্ব নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে। রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার শ্রেণিভিত্তি নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা। এদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, জাতীয় মুক্তির লড়াই, সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষা, এ দেশের সমাজবাস্তবতায় মার্কসবাদের উপযোগিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে প্রজ্ঞাপূর্ণ আলোচনা রয়েছে ‘মুক্তিধারা’য়। তার অসামান্য গল্পগ্রন্থ ‘রহমানের মা ও অন্যান্য’ ১১টি গল্পের সংকলন। রহমানের মা শিরোনামীয় ছোট গল্পটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একদম ব্রাত্য মানুষের লড়াই ও বয়ানকে হাজির করে। ছোট ছোট গদ্যের সংকলন ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’। কখনো গল্পের ছলে বলে যাওয়া নিজের গূঢ় অনুভূতি কখনো গদ্যের ছলে বলে যাওয়া জীবনের অতি কিঞ্চৎ মুহূর্তের বর্ণনা রয়েছে গ্রন্থটিতে। প্রতিটি গদ্যেই রয়েছে এক অন্তঃশীল দর্শনজাত সৌন্দর্য।

১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এ কীর্তিমান সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর। গত শতকে গড়ে ওঠা এই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন নিজের সমগ্র শ্রম ও মেধাশক্তি দিয়ে। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতেই যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সঙ্গে গড়ে তোলেন প্রগতি লেখক সংঘের মতো সংগঠন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্তিম মুহূর্তের রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন তাকে আলোড়িত করেছে, তেমনি ১৯৪৭-এর দেশভাগের মতো বিয়োগান্ত ঘটনার অভিঘাতও ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। দেশভাগের সময় এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানী শাসনামলের নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেলেও রণেশ দাশগুপ্ত রয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। বৃটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে পাকিস্তানি জান্তাবিরোধী সংগ্রামের দীর্ঘ সময়ে বহুবার তাঁকে যেতে হয়েছে কারাগারে। কারাগারে অন্তরীণ থেকেও লিখেছেন প্রচুর লেখা।

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে এ দেশের মানুষ যখন পাকিস্তানি নয়া উপনিবেশে নিক্ষিপ্ত হলো এবং তা থেকে মুক্তির জন্য গড়ে তুলছিলো সংগ্রামের নানা পটভূমি, রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন সেসব পটভূমিতে একজন বিজ্ঞ ও চারণ সন্ত, একজন গভীর চিন্তাপূর্ণ পর্যবেক্ষক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে তিনি নিছক একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখেননি। দেখেছেন জাতীয় মুক্তির লড়াই হিসেবে। যে লড়াইয়ে পুরোভাগে ছিল এদেশের খেটে খাওয়া মানুষ ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে ‘সফল গণবিপ্লব’ বলেই অভিহিত করেছিলেন। তাই স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক বিনির্মাণের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই গণবিপ্লবের দেশে রণেশ দাশগুপ্ত শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের প্রগতিশীল ব্যক্তি ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর নেমে আসে নিপীড়ন-নির্যাতন ও নিষেজ্ঞার খড়্গ। এর মধ্যে ওই বছরের অক্টোরের শেষ দিকে ফিরতি টিকিট নিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত কলকাতায় গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। কিন্তু নভেম্বরের ৩ তারিখ জেলে চার নেতা হত্যার পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রণেশ দাশগুপ্ত আর দেশে ফেরেননি। ফিরেছিলেন মৃত্যুর পর, ১৯৯৭ সালে।

রণেশ দাশগুপ্ত কলকাতায় গেলেও এদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি এক মুহূর্তও। এদেশের পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভ্য ছিলেন আমৃত্য। সিপিবির মুখপত্র সাপ্তাহিক একতায় লিখেছেন সক্ষম থাকা পর্যন্ত। ১৯৮৮ সালের ২৬ মার্চ একতার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় ‘স্বাধীনতা দিবসে হিসাবের খাতায় জমা-বিপ্লব’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে রণেশ দাশগুপ্ত লেখেন—‘বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের গভীরে এই বিপ্লব (স্বাধীনতাযুদ্ধ) তার সমস্ত যাত্রাগুলি নিয়ে সুরক্ষিত ও লালিত। সুতরাং একাত্তরের বিশুদ্ধ বিপ্লবের থেমে থাকার অথবা পথভ্রষ্ট হবার ব্যাপারটা আলগা ও সাময়িক। জনগণ যে কোনো প্রশ্নে বৈপ্লবিকভাবে আলোড়িত হয়ে এগিয়ে যেতে চাইলেই একাত্তরের বিশুদ্ধ বিপ্লবকে নতুন করে তুলে আনবেন। এই বিপ্লব জনগণের রক্তখরচে অর্জিত সম্পদ। এই বিপ্লব যে কোনো সাময়িক ভ্রষ্টাচারের পাশে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে জমা-বিপ্লব।’

তাহলে দেখা যাচ্ছে রণেশ দাশগুপ্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর সময়ে বিশ্ব-বাস্তবতার আলোকে নুতন বীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ হাজির করছেন ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনা বিপ্লব, ভিয়েতনাম, ল্যাটিন আমেরিকা ও ইউরোশিয়ার মুক্তিকামী মানুষের লড়াই নিয়ে। কয়েক শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলের মানুষের নানামাত্রিক সংগ্রাম, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, প্রান্তিক মানুষের নানা বিদ্রোহের মার্কসবাদী বিশ্লেষণও হাজির করেছেন এমন উপভোগ্য কায়দায় যে, এর মধ্য দিয়ে এদেশের বহুমাত্রিক সংগ্রামের শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি যেমন স্পষ্ট হয়ে উঠে তেমনি লড়াইয়ের প্রচ্ছন্ন রূপকল্পও তৈরি হয়ে যায়।

রণেশ দাশগুপ্ত মার্কসবাদের আলোকে যে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের রূপকল্প হাজির করেন তার ভ্যানগার্ড হিসেবে সক্রিয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আরেক বাঙালি মার্কসবাদী মনীষা সাহিত্যিক সত্যেন সেনের সঙ্গে তাই উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। আজ দেখার বিষয় অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে এদেশের সাংস্কৃতিক লড়াই এবং তার মার্কসবাদী অভীষ্ট যথাযথ দৃশ্যমান কি না।

জানি এ প্রশ্নের উত্তর এখই মিলবে না। তবে রণেশ দাশগুপ্তের চিন্তার সার ও মজ্জা উপলব্ধি করতে না পারলে এ প্রশ্ন কেবলই প্রশ্নই রয়ে যাবে। উত্তর কখনোই মিলবে না। 

লেখক : কবি, সংস্কৃতিকর্মী