মাথায় মুকট, দীর্ঘকায় মানুষ, একটু ঝুঁকে থাকেন, মোচে একটা আভিজাত্য ঝুলে থাকে। গৌর বর্ণের লোকটি রঙিন জামা গায়ে দিয়ে যশোর-বেনাপোল রোডে ঘড়ি বিক্রি করেন। নাম রামেশ্বর রাও। এ অঞ্চলের পরিচিত মুখ রামেশ্বর। তার বিক্রির ভাষায় কলকাতার ছাঁট আছে। শুনতে অসম্ভব সুন্দর। তার অসাধারণ অ্যাডভার্টইজিং শুনে কেউ কেনে কেউ কেনে না। কিন্তু মোবাইলের এই যুগে অনেকেই তার ছবি তোলে বা ভিডিও করে নিয়ে যায়। সাবলীলভাবে দরাজ কণ্ঠে তিনি বলে যান একাধারে। দিদি এবং দাদি, ঠাকমা এবং বউদি, মা এবং মাছি, দাদু এবং পিছি। আমি বিক্রি করি, প্রতাপাদিত্যের ঘড়ি। স্বাধীন ছিলেন যিনি, তার কথাই জানি। যশোরের রাজা, মোগল পেল ছাজা। কুছ পরোয়া নেহি, ছেলাম রাজা ছহি। এই ছেই ঘড়ি ভাই, আজ ছারাদিন তোমাকে চাই। প্রতাপাদিত্যের ঘড়ি, নেহি ঝাড়িঝুরি। এমন অজস্র কথা বলতে বলতে ঘড়ি বিক্রি করেন রামেশ্বর রাও। আমি তখন পত্রিকার কাজে সীমান্ত এলাকার গণহত্যা নিয়ে কাজ করছি। চুকনগরের গণহত্যা নিয়ে রাতদিন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। একদিনে দশ হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। চুকনগর বাজারে সালামের টংদোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এলাকার বয়স্ক লোক নুরুদ্দিন বলছিলেন, বুইচেন, এই যে ভদ্রা নদী দেহিচেন-এই নদীতে চেয়ারম্যানের আদেশে আমরা লাশ ফেইলেচি। প্রতি লাশ পোঞ্চাশ পয়সা। আমি শুনি আর যন্ত্রণায় কুঁকরে উঠি। আমার চা খাওয়া হয় না।
পত্রিকায় ফোন করে বার্তা সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলি। তিনি পাশে সাইড স্টোরি দিতে বলেন। আমি ঘুরে বেড়াই সাইড স্টোরির খোঁজে। মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি। কিন্তু একটা মুক্তিযুদ্ধ আমার ওপর কেমন করে যেন ভর করে আছে। আমি শৈশবে শুনেছি মায়ের কাছে। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প ছিল। সেই যুদ্ধের কত মুক্তিযোদ্ধার আজ তালিকায় নেই। এমন অজস্র প্রশ্ন এবং ক্ষত আমার ভেতরে। কিন্তু কী রিপোর্ট করব, এত দিন পরে এই গণহত্যার সাক্ষী যত পাওয়ার কথা, তত পাচ্ছি না।
ডিসেম্বরের শীত পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হলেই কুশয়াশায় ভরে যায় চারদিক। ডুমুরিয়ার রেস্টহাউসে বিলের শীতল বাতাস আসে। আসে পরিযায়ী পাখির ডাক। দূরে শিয়াল ডাকে। বিলগুলো ঘেরাও করছে ঘের। এই নোনা পানির রাজনীতির শিকার খুলনা অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু বাসে দেখা রামেশ্বর রাও কেন যেন আমার মনে ছায়াপাত করে। প্রত্যাপাদিত্যের ঘড়ি বিক্রি করে চলে রামেশ্বরের জীবন। কিন্তু রাও পদবি বাঙালির কী করে হয়?
আমার প্রথমেই মনে পড়ে ইতিহাসের বালাজী বাজী রাওয়ের কথা। যুদ্ধে বিচক্ষণতার অভাবে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হেরেছিলেন। আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতের মারাঠা সাম্রাজ্যের এই নেতা নানাসাহেব নামেই পরিচিত ছিলেন। তার সময়ে ‘ছত্রপতি’ (মারাঠা রাজা) কেবল একজন আনুষ্ঠানিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। একই সময়ে মারাঠা সাম্রাজ্য একটি কনফেডারেশনে পরিণত হয়, যেখানে বিভিন্ন স্থানীয় নেতা (যেমন হোলকার বংশ, সিন্ধিয়া বংশ কিংবা নাগপুরের ভোঁসলে বংশ) শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। বালাজী রাওয়ের সময়ে মারাঠা সাম্রাজ্য এর ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিস্তার লাভ করেছিল। তার মানে রাও পদবি বাঙালির নয়। তাহলে কে এই রামেশ্বর? পরদিন সকালে উঠেই রামেশ্বরের খোঁজে যাই। রামেশ্বরকে সব জিজ্ঞেস করতে তিনি উত্তর দিতে বিরক্ত হচ্ছিলেন। কিন্তু তার কলপ করা ভারী মোচের দিকে চোখ রাখতেই তার চোখে রিক্তির গভীরতা দেখে মনে হলো সাধারণ হকার নয়, স্টোরি এখানেও পেয়ে যেতে পারি। আমি তার বাড়ি যেতে চাই বলতেই সে অজস্র ঘড়ি হাতে গাড়ি থেকে নেমে গেল। তার প্রশ্ন, আমি কী চাই? আমি বললাম, ভাই তেমন কিছু না। আপনার বাসায় বসেই বলি? ঠিকানাটা দেন। তিনি শুধু বলনে বেনাপোল। গাড়ি ছেড়ে দিল। কিন্তু বেনাপোলে কোথায় পাব তারে? তার সঙ্গে কথা হওয়ার পরে দুদিন ধরে তিনি হাওয়া। আমার ভেতরে এবার আরও প্রশ্ন তৈরি হয়। রামেশ্বর পালাবে কেন? তা ছাড়া রামেশ্বর যে ঘড়ি বিক্রি করে তাকে প্রতাপাদিত্যের ঘড়ি বলেন কেন? প্রতাপাদিত্য ছিলেন মহারাজা প্রতাপাদিত্য রায়। বাংলাদেশের যশোহর সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম এক স্বাধীন সাম্রাজ্যের মহারাজা। মুঘল শাসনাধীন ভারতে প্রথম স্বাধীন ‘স্বরাজ’-এর আদর্শ স্থাপন করেন এই বাঙালি সম্রাট। ষোড়শ শতকের সূচনায় তিনি তাঁর যশোর সাম্রাজ্য কেন্দ্রে ধূমঘাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে বিহারের পাটনা, দক্ষিণে উড়িষ্যার পুরী ও পূর্বে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তারপরে মুঘলদের আক্রমণ। মানসিংহের অভিযান সবই তো ইতিহাস। এর সঙ্গে এই ঘড়ির সম্পর্ক কী? তা ছাড়া ঘড়ির কাহিনিও আলাদা। কারণ, ১৫২৪ সালে প্রথম পিটার হেনেলিন পকেট ঘড়ি তৈরি করেছিলেন। ১৬৫৭ সালে এসে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ার হাইজেন্স সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে মিনিট, সেকেন্ড ও ঘণ্টা নির্দেশকারী উন্নত মানের যান্ত্রিক ঘড়ির নকশা করেন। তাহলে এসব আধুনিক ঘড়ি যা বিংশ শতকে মানুষের হাতে উঠেছে। তার সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের সম্পর্ক কী? ভাবতে ভাবতে দেখি কাঁচা রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে আসছে বেনাপোলের গাড়ি। আমি কোনো চিন্তা না করে গাড়িতে উঠে পড়ি।
রিপোর্টের কাজে বেশি দিন এ এলাকায় থাকায় এলাকায় আমার একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে। যেকোনো জায়গায় কাজের খোঁজে যাওয়া আমার জন্য সমস্যা নয়। তাই বেনাপোল নেমে রামেশ্বরের খোঁজ করতে থাকি। অনেকক্ষণ খোঁজার পরে বকুলের চায়ের দোকানে রামেশ্বর রাওয়ের খোঁজ পাই। শার্শায় সে একা থাকে তার সংসারে কেউ নেই। আমি তার কাছে যেতে চাইলে বকুল একটা ছেলেকে পথ চিনিয়ে একটা বাইক ঠিক করে দেয়। সেই বাাইকে গিয়ে দুপুরের চকচকে আলোয় রামেশ্বর রাওয়ের বাড়িতে দরজায় থামি। দরমার বেড়া দেওয়া বাড়ি। দরজা বন্ধ। ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হলো। আমি দরজায় শব্দ করলেই দরজা খুলে যায়। খালি গায়ে রামেশ্বর রাও। দীর্ঘদেহী, বাঁ পায়ে কাটাছেঁড়া করা, অপারেশনের পুরোনো ক্ষত। ছোট এক টুকরো কাপড় পরে কী যেন করছিলেন তিনি। আমাকে দেখা মাত্রই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রামেশ্বর খুব চটে যান। তিনি চিৎকার করে লোক ডাকার হুমকি দেন। তিনি বলতে থাকেন আপনি পেয়েছেন কী? আমি বিশ বছর ধরে বাসে ঘড়ি বিক্রি করে খাই। আপনার কি ক্ষতি হলো? আমার কোনো কথাই যখন তিনি শুনছিলেন না, তখন আমি ব্যাগ থেকে আমার ক্যামেরা বের করে তার একটা ছবি তুলে বললাম, রামেশ্বরবাবু আমি একটা পত্রিকায় কাজ করি। আপনার অ্যাডভার্টাইজিং শুনে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার সঙ্গে গল্প করব ও একটা স্টোরি করব বলে অনেক খুঁজে আপনাকে বের করেছি। আপনার আপত্তি থাকলে তা-ও করব না। আমি কোনো ক্ষতিকর কেউ না। রামেশ্বর এতক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে হাসতে হাসতে বলল, মুই ভাবজেলাম আমনে বেমালা ভয়ংকর লোক। হেইয়ার লাইগ্যা মুই দুই দিন কামে যাই নাই। তিনি আমাকে খাটে বসতে দিয়ে নিজে একটা জলচৌকিতে সামনে বসেন। তারপর শুরু হয় কথাবার্তা। আমি অনেক কথার পরে তাকে জিজ্ঞেস করি আপনি প্রতাপাদিত্যের ঘড়ি পেলেন কোথায়? তার সময়কাল হলো ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ। এ সময় কি বাংলায় হাতঘড়ির ব্যবহার শুরু হয়েছে? তিনি হাসতে হাসতে বলেন হেয়া মুই জানমু কেমনে? মুই এইয়া কইলে মানুষ ঘড়ি কেনে হেইয়ার লাইগ্যা কই। এবার জিজ্ঞেস করি আপনার বাড়ি কোথায়? আর রামেশ্বর রাওইবা হলেন কীভাবে বলবেন? এবার তিনি বলেন ভাই এতকাল কওয়ার কোনো সুযোগ হয় নাই, আইজ কমু ভাত খাবেন তো, তয় ভাতটা চুলায় দিয়া লই। আমি রাজি হই, রামেশ্বর রাও এবার বলেন, মোর আসল নাম নলিনী চৌধুরী। মোর বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া। বাড়ি যাওয়া হয়নি কোনো কালে। বাবা কাজের সূত্রে যশোর থাকতেন। এখানেই আমাদের বেড়ে ওঠা। আমাদের দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল এর মধ্যে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকায় ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পরে আমরা প্রথমে বানারীপাড়ার বাইশারীতে আত্মীয় বাড়ি চলে যাই। পরে সেখানেও আর্মি আসবে আর্মি আসবে শুনি। সেখান থেকে বাবা-মাসহ চলে আসি যশোর। শুনলে পাই চুকনগর গেলে ভারত যাওয়া সহজ। পরে চুকনগরে সবাই গিয়ে আশ্রয় নেয় ভারত যাওয়ার আশায়। এখানে অন্য এলাকার অনেক মানুষজন এসে জমা হতে শুরু করে নিরাপদ আশ্রয় ভারতে যাওয়ার জন্য। আমি বাবা-মা দুই ভাইবোনকে রেখে এই এলাকার অনেক লোক মুক্তিযুদ্ধে যায়। আমিও চলে গেলাম। ভারতে বসেই শুনলাম চুকনগরে দশ হাজার মানুষ জমা হয়ে ভারত যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। এ সময় রাজাকাররা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে খবর দেয়। পাকিস্তান বাহিনী এসে চালায় খাণ্ডব দাহন। এখানে দশ হাজার মানুষ শহীদ হয়। তার মধ্যে আমার পরিবারের সবাই শহীদ হয়েছে বলে শুনেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে দেশে ঢুকে যশোর এলাকায় যুদ্ধ করলাম। দুর্ধর্ষ সব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একদিন যুদ্ধের ভেতরে পায়ে শত্রু সেনাদের গুলি লাগল। সীমান্তের হাসপাতালে চিকিৎসা হলে আবার যুদ্ধে গেলাম। দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু কোথায় যাব? যশোরের ভাড়া বাড়ি পুড়ে গেছে। বানারীপাড়ার বাড়ি সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে চলে গিয়েছিল আরও আগে। আমি কলকাতায় গিয়ে কাজের চেষ্টা করি। কাজ হয় না। পরে কাজ পেলাম মহারাষ্ট্রে গিয়ে। সেখানে এক মারাঠা পরিবারে কাজ নিলে আমার নাম হয় রামেশ্বর রাও। ওখানে কাজে মন বসল না। তারপর ট্রেনে ট্রেনে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করতাম। এভাবে একদিন ছোটবেলার বন্ধু হালিমের সঙ্গে দেখা হলো কলকাতায়। ও আমাকে নিয়ে এলো যশোরে। হালিমের গ্রামের বাড়ি শার্শা। এ বাড়িতে এই ঘর তুলে বহুদিন আছি। ঘড়ি বিক্রি করি। বাসে একাত্তরের রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা সবার সঙ্গে দেখা হয়। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম নেই, কেউ জানেও না এই দেশ স্বাধীন করে যারা নিঃস্ব হয়েছে, আমি তাদের একজন। চুকনগরে আমি এখনো যাই, মা-বাবাকে খুঁজি। দেশের পতাকাটা ছাড়া আর কেউ নাইরে ভাই। বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে যশোর -বেনাপোল বাসের রামেশ্বর রাও—আমার নলিনীদা। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে বলি আমি আপনার কথা লিখব দাদা। আসার সময় তিনি তার ঝোলা থেকে একটা ঘড়ি বের করে আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বলতে থাকেন। এই ভাই, এই পরালাম রাখি। মনে যেন থাকে, জীবনটা তো পাখি।
রাজা আছে, রানি নাই, প্রতাপাদিত্যের ঘড়ি, তোমাকে চাই। সন্ধের আগ ভাগ। দুধের সরের মতো কুয়াশা নামছে মাঠে। গ্রামের পথের দুধারের বৃক্ষরাজি ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আমি পরিবহনের খোঁজে হাঁটতে থাকি। রামেশ্বর রাও ভেজা চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমি চলতে থাকি নতুন সংবাদের খোঁজে।