আসক্তি

স. ম. শামসুল আলম প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২১, ০৪:৪৩ পিএম

কচি লাউ-ডগার মতো লকলকে থকথকে যৌবন। কখন ডগাসুদ্ধ নুয়ে পড়ে আর কখন তরতর করে বেয়ে ওঠে, ঠিক নেই। অনুপার অঙ্গসৌষ্ঠব মিহি দানার মুক্তোয় মোড়ানো। গোয়ালের বাছুরটাও কাছে পেলে হাত-পা চাটার জন্য মাতাল হয়। আতালিপাতালি করে। অনুপা মিষ্টি মিষ্টি হাসে। তার মিষ্টি হাসিটার মধ্যে দুষ্টুমি ভরা। ওই গরু চাটবি, চাট। অত আহ্লাদ কেন? যত চাটবি তত মজা। মুক্তোর অঙ্গ ক্ষয় হয় না রে। কোনো দিন ক্ষয় হবে না।
অনুপা যেদিন এ বাড়ির বউ হয়ে এল, সেদিন পাটল ভেঙে পাড়ার লোকেরা দেখতে এলো। যে দেখে সেই বলে, খুঁত ধরার জায়গা নেই। এত নিখুঁত সুন্দর মানুষ হয় নাকি আবার? বিশেষ করে নারীরা, হিংসেয় জ্বলে গেলেও বলতে বাধ্য, কী বলব দিদি—ভগবান রূপ একখান দেছেন বটে।
মুসলমান বাড়ির বউ-ঝিরা এসে দেখে গিয়ে অন্যজনকে বলল, কী কব রে বু, আল্লায় নিজ হাতে বানায়ছে। মা দুগ্গা দেহো নাই? ঠিক মা দুগ্গার লাহান, পতিমা একখান। 
প্রতিমা হোক আর যে-ই হোক, অনুপা এসেছে বলরামের বউ হয়ে। বলরাম মানে, যাকে গ্রামের সবাই বলাই বলে ডাকে। বলাইয়ের বউয়ের রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে অনুপা হয়ে গেল বলার বউ। অনুপা নামটি ঢাকা পড়ে গেল। কারণ, বলাইও তাকে ডাকে বউ বলে। কথায় কথায় বলে, ও বউ তুই কোনে গেলি, ও বউ আমার গামছাডা দে দেহি, ও বউ আমি মাটে যাতেছি। বউ-বউ করে অস্থির। অনুপা শুধু হাসে, আর হাসে।
আজ সেই অনুপা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল। মাথায় ঠাটা পড়লেও মানুষ অত জোরে চিৎকার দেয় না। হা ভগবান, তুমি এইডা কী কইরলে? আমার কপালে এইডা লিখছিলে? ও ভগবান, তুমি আমার সব কাইড়া নিলে? তার কান্না শুনে মাঠের কৃষকরা বলাবলি করল, বলার বউ কাঁদতেছে মনে হয়? ফুর্তির জ্বালায় মাগি বাঁচে না, তার আবার কান্না কী জন্যি বুজতি পারতিছিনে। চল যাই তো, দেইখা আসি। কিন্তু ঐ বাড়ি যাওয়াও তো বিপদ। হুমাই আবার কিছু না কয়। ঐসব কথা থাউক। মাগিডা চিল্লায়া কাঁদতেছে। দেহা দরকার কী হইছে।
এক এক করে লোক আসতে থাকল বলার বাড়িতে। বলার বউ তখনো চিৎকার করে কাঁদছে। উঠোনে তুলসীগাছের কাছে মাটিতে হাত থাবড়িয়ে শাঁখা-চুড়ি সব ভেঙে ফেলল। কপালের সিঁদুর মুছে ফেলল নিজের হাতেই। রাতের খাবার খেয়ে বলাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে আর ঘুম থেকে উঠছে না। অনুপা কাছে গিয়ে দেখে বলাই চিরঘুমের দেশে চলে গেছে। এবার তাকে চিতায় তুলতে হবে। হা ভগবান...। অনুপার কথা ক্যাসেটের জড়িয়ে যাওয়া ফিতার মতো জড়িয়ে যায়। শুধু ক্যাঁকর ক্যাঁকর আওয়াজ হয়, কিন্তু বোঝা যায় না। দেশে সিডি, ইউটিউব, ফেসবুক না এলে এখনো এ রকম ক্যাঁকর ক্যাঁকর নিয়ে থাকতে হতো।
সবাই জেনে গেল তাদের কাছের মানুষ বলরাম আর নেই। প্রিয় বলাইকে হারিয়ে কারও কারও মধ্যে শোক দেখা গেল। কেউ কেউ বলল, এবার তো মাগিটার আরও সুবিধা হইল। কোনু বাধা থাইকল না। পথের কাঁটা দূর হইল। মরা বাড়িতে এই সব কতা কতি নাই। তাছাড়া হুমাই জানতি পারলি ঝামেলা বাধাইবে। প্যাঁচ লাগানোর উস্তাদ সে। কিন্তুক আমার তো মনে কয়, হুমাই মিয়ার জন্যিই বলাটা মইরলো।
হুমাই একটা ফ্যাক্টর বটে। হুমাই মানে হুমায়ন কবীর। বছর পাঁচেক মালয়েশিয়া থেকে গত বছর দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরার এক বছরের মাথায় বলাটা মারা গেল। বলা মারা যাওয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা খতিয়ে দেখা দরকার। বলার সঙ্গে গলায় গলায় মিল হুমায়নের। ছোট বেলায় একসঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। একে অপরকে বন্ধু বলে ডাকত। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর বলার আর পড়ালেখা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। হুমায়ন কবীর পড়েছে ক্লাস টেন পর্যন্ত। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ‘বন্ধু’ সম্পর্কটা আজীবন রয়ে গেছে। হুমায়ন কবীর বিদেশ যাওয়ার আগে বিয়ে করেছে। তার দুটো সন্তানও আছে। সে যখন বিদেশ যায় তখন কন্যার বয়স ছিল তিন বছর, আর পুত্রের বয়স ছিল দেড় বছর। এখন তারা দুজনেই স্কুলে যায়। অপর দিকে, বলরাম বিয়ে করেছে মাত্র তিন বছর আগে। হুমায়ন তখন বিদেশে।
বিদেশ থেকে আসার পর বলরামের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো বাজারে। কামরুলের চায়ের দোকানে। হুমায়ন গিয়ে বলরামকে জড়িয়ে ধরল। সবাই দেখল হুমায়নের মনে কোনো হিংসে নেই। হিংসে থাকলে ছোটবেলার বন্ধুকে এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে না। তাছাড়া হুমাই তখন অনেক বড়লোক। আর বলা তো সেই বলা—এক বেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা উপোস। হুমায়ন একটু ফাঁকে ডেকে নিয়ে গেল বলাইকে। কত দিন পর দেখা। সুখ-দুঃখের কথা বলবে। বাজারের একপাশে ঘাসের ওপর গিয়ে বসল দুজন। উচ্ছ্বাস নিয়ে হুমায়ন বলল, তারপর ক দেহি কেমুন আছিস বন্ধু? এদ্দিন পর তোরে দেইখে মনডা ভইরে গেল। 
: আমারও পরানডা জুরায়া গেল। পাঁচ পাঁচটা বচ্ছর তোরে দেহি না। তা কি আবার চইলে যাবি, নাকি থাকবি দ্যাশে?
: না, ভাবতেছি আর যাবো না। মাশাল্লা টাহা-পয়সা হয়ছে, জমি-জিরেত অনেক হয়ছে। এত সম্পত্তি খাবি কিডা?
: তা ঠিক কইছিস। সম্পত্তি মেলা হইছে। তোর বাপের সম্পত্তিও তো কম আছিল না। মাত্তর চাইড্ডা ভাই। এক ভাগ মানেও তো মেলা।
: তোর কথা ক। শুনলাম তুই নাকি সোন্দর একখান বিয়া করছিস। দান মারছিস বিরাট একখান?
হাসল বলাই। বলল, তোরে এসব কেডায় কইল? দান তো মারছি বন্ধু, কিন্তুক সোন্দর ধোইয়ে জল খায়ে তো আর জেবন চলে না। বাবার বাড়িডাতেও থাকতি পারলাম না।
: ক্যান, কী হইছিল? শুনলাম নতুন বাড়ি করিছিস?
: হ। বড়দা আর মেজদা আমারে সহ্য করতি পাইরলো না। কামও বেশি করি, আবার কথাও বেশি শুনি। বিয়ের আগে বউদিরা আমারে কত আপন ভাবত—তারাও খিটমিট করতি লাগল। মনে কয় আমার বউডারে কেউ সহ্য করতি পারে নাই। তাই মাঠের মধ্যি যাইয়ে বাড়ি করিছি। বাড়ি কি? একখান কুঁড়েঘর আর একখান রান্ধার ঘর। এইটুকু করতি আমার জান শ্যাষ। পাইছি তো ভাগের ভাগ অল্প কদ্দুর জমি। জমি চাষে ফায়দা নাই। সার-বীজ, নিড়েন-ফিরেন, কাটাকুটো কইরতে যে খরচ যায়, ফসলে তার অর্ধেকটাও আসে না।
: ঠিক আছে। একদিন যাব তোর বাড়ি।
: চল, আজই চল।
: না, আরেক দিন। আজ কাম আছে।
একদিন হুমায়নকে নিয়ে বাড়িতে এলো বলাই। বউকে ডেকে বলল, ও বউ, বউরে, দেহে যা কারে নিয়াইছি। শিগগির বসপার দে। হুমাইরে নিয়াইছি। তোরে কইছি না, ও আমার জানের জান বন্ধু।
অনুপা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে টুল এনে বারান্দায় পেতে দিল। ঘোমটা টেনে নিতে নিতে বলল, আপনের কথা মেলা শুনছি। নেন, বসেন দাদা। 
অনুপাকে দেখে হুমায়নের মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। সে গিয়ে এক চিলতে বারান্দায় পাতা টুলটাতে বসল। তার পাশে মাটিতে বসে পড়ল বলাই। বলল, ঘরে চেয়ার নাই। তোরে যে কোনখানে বসাই বন্ধু—।
ঠিকই তো। কোথায় বসাবে বন্ধু হুমাইকে? ঘরইবা-কী? একটা ছনের দোচালা ঘর। দুই পাশে দুটো রুম, মাঝখানে মাচা। মাচার ওপর প্রয়োজনীয় মাটির হাঁড়িপাতিল। তার ভেতরে অল্পবিস্তর চাল-গম রাই-শর্ষে ইত্যাদি। এই ঘরের পাশে আরেকটি ছোট ছনের ঘর। তার অর্ধেকটা রান্নার জন্য, অর্ধেকটা বাছুরটার জন্য বরাদ্দ। এ রকম একটি বাড়ি করতেই বলার মরণদশা হয়েছে। তবু তো মাটি কেটে ভিটে বাঁধতে হয়নি। আগে অনেক বন্যা হতো বলে ভিটে বেঁধে উঁচু করতে হতো। এখন ফসলের মাঠেও বাড়ি করা যায়। এত সুবিধা পেয়েও বলার কোনো উপকার হয়নি। অর্থকড়ি না থাকলে কোনো সুবিধাই উপকারে আসে না। বলা গলা চড়িয়ে ডাক দিল, কই গেলি বউ— দ্যাখ কিছু গুড়-চিড়া-মুড়ি আছে নাকি? বন্ধুরে কিছু খাতি দে। আমার নতুন বাড়িতে আইছে। খালি মুখি যাবি নাকি?
ঘরে ছয় মাসের মেয়েটা কেঁদে উঠল। তাকেও দুধ খাওয়ানো দরকার। অনুপা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে মাচায় থাকা টিন থেকে মুড়ি বের করল। একটি সিলভারের থালায় গুড়-মুড়ি খেতে দিল হুমাইকে। সামনে রাখল সিলভারের ঘটিতে জল। তিনজনের মধ্যে কথা জমে উঠল। বলাই বেশি বলতে লাগল। পুরোনো কথা। বাল্যকালের কথা। গাছে চড়ে আম পেড়ে খাওয়ার কথা। কথার ফাঁকে হাসাহাসি। গোয়াল থেকে বাছুরটা একবার ডেকে উঠল। অনুপা ভাবল তাকেও খড় কেটে খেতে দিতে হবে।
তিন দিন পর বিকেলে আবার বলার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো হুমাই। অনুপা তখন বারান্দায় বসে মেয়েটাকে বুকের দুধ দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি মেয়েটার মুখ সরিয়ে কাপড়ে আড়াল করল বুক। হুমাই বলল, কই আমার বন্ধুডা কই? ওরে তো দেখতিছি নে?
: পূজার বাবায় তো কামে গেছে। সন্ধের আগে আসতি পারবিন নে। আপনি অতক্ষণ বসপেন দাদা?
: না আমি বসপো না। টুল টানাটানি কইরো না। আমি আইছি ওরে টাহা দেবার জন্যি। কাল আমার কাছে ১ আজার টাহা ধার চাইছিল। আমি তো আর অত টাহা নিয়ে ঘুরি না। তাই এহন টাহাডা দেবার আইছি। এই দিকে আসো।
অনুপা বারান্দা থেকে উঠোনে নামে। কোলে ৬ মাসের শিশু পূজা। হুমাই পকেট থেকে ৪টা ৫০০ টাকার নোট বের করে অনুপার হাতে দেয়। বলে, ওরে কইবা দুই হাজার টাহা দিলাম। ফেরত দেওয়া লাগবি নে। আমি কি আমার বন্ধুর জন্যি এইটুকু করতি পারি নে?
: তা পারেন। কিন্তুক—।
: ঐসব কিন্তু ফিন্তু আমার কাছে নাই। বুঝলা?
বোঝা না-বোঝার দোদুল্যমানতায় চেয়ে থাকে অনুপা। হুমাই বলে, কী বুঝলা? দুধ কি খালি বাচ্চাডারে খাওয়াইবা?
এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না অনুপা। নিজেকে সামাল দিতে মিষ্টি করে হাসে। হাসিটার এমন অর্থ করা যায়, দুধ খাওয়াতে কী আর এমন সমস্যা? আবার এমন অর্থও করা যায়, এটা বড়ই লজ্জার কথা। অনুপা বলল, কী যে কন না দাদা–।
: কী কইলাম কও? আমি কি তোমার কাছে বালতি ভরা দুধ চাইতেছি নাকি?
বালতি ভরা চাচ্ছে না, সেটা অনুপাও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু হুমায়নের অনেক টাকাপয়সা। ইচ্ছে করলে সকল হিন্দু বাড়ি নিজের দখলে নিয়ে নিতে পারে। ইচ্ছে করলে মেয়েদেরকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করতে পারে। ইজ্জত ছিনিয়ে নিতে পারে। অনুপা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। হুমাই তার কোলের বাচ্চাটিকে আদর করল, বাহ কী সোন্দর হইছে তোমার মাইয়া! মেয়ের মুখে আদর করতে গিয়ে মায়ের বুকে হাত চেপে রাখল কিছুক্ষণ। এই কিছুক্ষণ সময়ই অনুপার কাছে শিহরণ তোলা মুহূর্ত। এত বড় নামকরা একজন লোক। সুপুরুষ। তার হাতের স্পর্শ সারা শরীরে শিহরণ তোলাই স্বাভাবিক। অনুপার মনে হলো, আরও কিছুক্ষণ হাতটা চেপে রাখলেও সে আনন্দ বোধ করত।
পরদিন আবার গিয়ে হাজির হলো হুমাই। আজ তো টাকা দেবার ব্যাপার নেই। তবু কেন এলো? হুমাই নিজ থেকেই বলল, এইপথ দিয়া যাইতেছিলাম, ভাবলাম তোমার সাথে এট্টু দেহা কইরা যাই। বলারে যদি পাই, ওর সাথেও দেহা অইল। 
অনুপা বুঝতে পারল, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। মাঠের মধ্যে বাড়ি। আল ছাড়া কোনো পথ নেই। এ পথ দিয়ে যাবার মতো কোনো জায়গাও হুমায়নের আছে বলে জানা নেই। হুমায়নদের বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তা ধরে এগোলে বাজার। সুতরাং হুমাই মিথ্যে বলছে তাতে সন্দেহ নেই। সে অনুপার কাছেই এসেছে, এটা বুঝতে দেরি হলো না। অনুপা বলল, বসেন দাদা।
: তোমার মাইয়াডারে দেখতিছি নে—।
: ঘুমাইতেছে। দুধ খাইলেই ঘুমায়া পড়ে।
: তা আমারে একবার ঘুম পাড়ায়া দিতি পাইরতে—।
: কী যে কন দাদা! আপনারে ঘুম পাড়ানোর জন্যি বউদি আছে, কত মানুষ আছে।
মিষ্টি করে হাসে অনুপা। তার মানে সে ঘুম পাড়িয়ে দিতে রাজি। আবার মনে হয়, মরবার আর জায়গা পেলে না? হুমাই বারান্দায় উঠে টুলে বসতে গিয়ে বলে, ঘরে গিয়া বসলেই ভালা হইত না?
শিউরে ওঠে অনুপা। আবার ঘর কেন? মিষ্টি হেসে বলে, আপনি বড়লোক মানুষ। আমাগের চকিডায় ময়লা বিছানা। কেমনে কই—?
: কিছু হইব না। বিদ্যাশে কত ময়লা বিছানায় শুইয়া আইছি। আসো—। 
অনুপার হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল হুমাই। আবেগে জাপটে ধরল অনুপাকে। সারা মুখে চুমু দিয়ে অস্থির করে ফেলল। আপনাআপনি বুকের কাপড় পড়ে গেল অনুপার। শাড়ির আঁচল এখন তাদের দুজনের পায়ের নিচে। এই ভালোবাসার আবেদনে অনুপা নিরুপায় নয়, তার ইচ্ছোটাও ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সুপুরুষ। কত সুঠাম দেহ। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। এমন একজন মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আর বলা? বলার তো শুকনো শরীর। পাটকাঠির মতো। শ্যামবর্ণে কি এত উজ্জ্বলতা থাকে? তারা দুজন গড়িয়ে পড়ল তোশকবিহীন একটি বিছানায়। ময়লা কাঁথা-বালিশ থেকে একপ্রকার গন্ধ বের হচ্ছে। এই গন্ধের সাথে অন্য কোনো গন্ধ অনুভব করছে দুজন। আরেকটি ঘরে অনুপার মেয়ে পূজা ঘুমিয়ে আছে। সে এই পৃথিবীর কিছুই বোঝে না। মনে হলো পৃথিবীজুড়ে ঝড় উঠেছে। তখন গোরায় বাছুরটা ডেকে উঠল। ঝড় থেমে যাবার পর প্রকৃতিকে অনেকটা শান্ত মনে হয়। কিন্তু পূজার জীবনে কোনো ঝড় নেই। তবু সে সব সময় শান্ত। যেমন বড় শান্ত হয়ে উঠল অনুপা আর হুমাই। দুজনের মুখে তৃপ্তির হাসি। হাসতে হাসতে যেন কোনো পাল তোলা নৌকায় ভেসে যাচ্ছে দুজন। আকাশের একপাশে মেঘ, অন্য পাশে রোদ। ছইয়ের ভেতর বসে আছে দুজন মুখোমুখি। দুটি মুখে অনাবিল হাসি। ভেসে যাচ্ছে পালের নাও। আবার ডেকে উঠল গোয়াল থেকে বাছুরটা। সংবিৎ ফিরে পেল অনুপা। বাছুরটাকে তো ঘাস দিয়ে এসেছে। তবু এভাবে ডেকে উঠল কেন? বোবা প্রাণী  কখন কী কথা বলে, কে জানে!
তখনো হুমাই এসে পৌঁছায়নি। নিশ্চয়ই তার কানে খবরটা গেছে। প্রাণপ্রিয় বন্ধুটিকে একনজর দেখতে অবশ্যই সে আসবে। সৎকারের ব্যবস্থাও করবে। হুমাই এখন এই সংসারের অবলম্বন। অবলম্বন ছাড়া শুধু সংসার কেন, কোনো কিছুই টেকে না। মরার মতো পড়ে আছে অনুপা। হয়তো অজ্ঞান। কিছু বউ-ঝিরা তার মাথায় পানিও দিচ্ছে। তার জা দুজন দাঁড়িয়ে দেখছে। বড় জা বলল, জল ঢাইলে আর কী হবিনি? অজ্ঞান হয় নাই। ভান ধইরছে। আমার ঠাকুরপোরে আমি চিনি। সে এমনে মরবার মানুষ না। তারে ঐ নটী মাইরা ফেলিছে—।
কথাটা অনুপার কানেও গেল। সত্যিই সে অজ্ঞান হয়নি। বউদির কথার গুরুত্ব সবাই কমবেশি বুঝেছে। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। যা হবার হয়ে গেছে। এ কথা যে অনুপা অনুভব করছে না, তা নয়। তার অবজ্ঞা আর অবহেলাতেই বলার মৃত্যু হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর জন্যে তাকে শতভাগ দায়ী করলেও বলার কিছু নেই। সে তো একটি ফাঁদে পা দিয়েছে। মরণফাঁদ। যদিও সেটিকে সে বিনোদন ফাঁদ বানিয়ে রেখেছে। সেই ফাঁদে রাধা কৃষ্ণের লীলা শুধু নয়, যাবতীয় যৌনলীলা চলে। অনুপা তো সব বুঝে-শুনেই করেছে। এখন দুকথা শুনতে মন্দ লাগছে না। এত দিন সবাই আড়ালে আবডালে বলত, আজ সুযোগ পেয়ে প্রকাশ্যে বলছে। এটা একেবারে দুর্ভাগ্য নয়, পরম সৌভাগ্য। যে আনন্দটা হুমায়নের কাছ থেকে পেয়েছে, তা কে দিতে পারত? শুধু কি আনন্দ? পুরো সংসার সচ্ছলতার সাথে চলার আনন্দ। যেটা হতভাগা স্বামী বলার পক্ষে সম্ভব হতো না।
কেউ কেউ বলতে লাগল, বলাটা মইরে বরং শান্তি পাইল। চক্ষের সামনে কোন বেটায় এইগুলো সহ্য কইরবে?
: এমনে কইও না। হুমাই আইলে বুঝবা ঠেলা—।
: আসুক। বন্ধুরে উপকার করার কথা কইয়া যদি তারে মাইরাই ফেলায়, এমন উপকারে আমি গু ছিটাই।
হিন্দু-মুসলমান মিলে বেশ লোক জমা হয়েছে বলার বাড়িতে। কেউ কেউ আবার এসেই চলে যাচ্ছে বলার বউয়ের প্রতি ঘেন্না দেখিয়ে। সমাজে খারাপ লোক থাকলে তাকে ঘেন্না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রভাবশালী খারাপ লোক থাকলে প্রকাশ্যে ঘেন্না করা যায় না। তবে আড়ালে আবডালে ঠিকই নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। হুমাইকে সবাই সমীহ করে চললেও মনে মনে অনেকেই ঘেন্না করে, নিন্দা করে। তার কিছু চামচা আছে, যারা তার কাছ থেকে ফায়দা লোটে আর প্রশংসা করে। এই চামচাদেরও কেউ কেউ আবার গোপনে নিন্দার ঝাঁপি উপুড় করে দেয়। মরা বাড়িতে হুমাই আসবে সে জন্য অপেক্ষা করার কিছু নেই। তাছাড়া সে মুসলমান, আর যে মরেছে সে হিন্দু। সৎকার তো ঠাকুর পুরোহিত এসে করবে, হুমাই নয়। তখনো অনুপা মরার মতো পড়ে আছে উঠোনে। হয়তো হুমাই এসে হাতটা ধরলেই উঠে পড়বে। অনুপার মেয়েটি কেঁদে কেঁদে মায়ের চারপাশ ঘুরছে।
ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে গেলে লোক জানাজানি হলো। তখন হুমাই অনুপা দুজনেই একটু সতর্ক থাকার কথা ভাবল। কারণ, বলার কানেও চলে গেছে বউয়ের অপকর্মের কথা। মন্দ কথা ছড়াতে সময় লাগে না। বলাই রীতিমতো ফুঁসে উঠে বলেছে, তুই তাহলি হুমাইর বাড়িতে চইলে যা। আমার বাড়িতে গলা শুকায়া মরবি ক্যান?
: তুমি ভুল বুঝতেছো ক্যান পূজার বাবা? সে তোমার বন্ধু মানুষ। বাড়িতে আসে, একদণ্ড বসে, গপসপ করে। তারপর চইলে যায়। তাছাড়া সে তো তোমারে টাহা-পয়সা দিয়াও উপকার করতেছে। তারে নিয়া সন্দেহ করতেছো ক্যান? কেডায় কী কইলো তাই নিয়া তুমি ফাল পারো—।
: যেইডা রটে, সেইডা কিন্তু কিছু হইলেও ঘটে। আমারে তুই অত বোকা পাইছোস?
: ঠিক আছে, আমি তারে কয়া দিবা নে—যহন তুমি থাকো তহন আসতি। অমন দেবতার মতো মানুষটা নিয়া খামাখা চিল্লায়ো না।
চিল্লানোর মতো ঘটনা। বিষয়টা যখন বলা জেনে গেছে তখন বিপদ। বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। পাড়া-পড়শির জানাজানিতে কোনো সমস্যা নয়। হুমাই একাই সেটা ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু বলার ব্যাপারটা আলাদা। তার সঙ্গে অনেক সম্পর্ক জড়িত। অনুপা তার বউ। আবার হুমাই তার বন্ধু। সুতরাং বড়ই ভাবনার বিষয়। অনুপা বলল, দিনের বেলা আপনি আসেন, সবাই চাইয়া দ্যাহে। 
হুমাই বলল, কিন্তুক রাইতে আসপো কেমনে? ওই বেটা তো ঘরে থাকে।
: ব্যবস্থা একটা কইরতে হইব।
অনুপার কথায় সায় পেয়ে খুশি হয় হুমাই। এর পর থেকে সেই বিকল্প ব্যবস্থা। অনুপা বলে দিয়েছে, একটা মিসকল দিলে তখন আইসেন। একথা কেন বলবে না সে? নগদ ৬ হাজার টাকা দিয়ে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছে হুমাই। রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় অনুপা। খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম চলে আসে বলার। বলা ক্লান্ত পাখির মতো ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন মিসডকল দেয় অনুপা। ফোনে গানের রিংটোন বেজে উঠেই বন্ধ হয়ে যায়। তিন ব্যাটারির টর্চ হাতে রওনা দেয় হুমাই। সাথে নেয় গ্রেট চামচা তোজাম্মেলকে। তোজার কাজ হলো পাহারা দেয়া। তাছাড়া রাতবিরাতে চলাচল করতে বিশ্বস্ত একজন সহযোগীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু তাকে বলার বাড়ির উঠোন পর্যন্ত নেওয়া হয় না। বাড়িতে ঢোকার আগে ছোট আমগাছটার নিচে তোজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কোনো কোনো দিন সে গামছা বিছিয়ে বসে থাকে। এভাবে হুমাই আর অনুপার নিশি অভিসার মধুময় হয়ে উঠল। স্বামী আর সন্তান ঘুমিয়ে থাকে। আর অনুপা জেগে জেগে সুখের স্বাদ গ্রহণ করে। তাদের দুজনের কাছে জীবন এখন বড় সুন্দর। অনুপার শরীরে এখন দামি পারফিউমের গন্ধ থাকে। চকিটা খচখচ আওয়াজ করে বলে সেটা পাল্টিয়ে খাট বসানো হয়েছে। তোশক আর সুন্দর কাঁথা। সবকিছু সুসজ্জিত। এসব দেখেই তো আরও ফুঁসে উঠেছিল বলা। কিন্তু বলারও এখন আর বলার কিছু নেই। হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র এখন বলার বউ আর হুমাইকে নিয়ে আলোচনা। এলাকার সবার মুখেমুখে ফিরতে লাগল বলার বউ আর হুমাইকে নিয়ে গসিপ। শুরুটা বোধ হয় তোজা করে দিয়েছে। প্রথমে বলেছে কাছের মানুষ হানিফকে। ‘আর কস না হানেপ, সারা রাত গাছতলায় পাহারা দিতি হয়। এত সময় ধইরে কী করে সেইডাও বুঝতি পারি নে। ঐ কাম করতি কি অতক্ষণ লাগে, ক?’
হানিফ বলে, তুমি বুঝবা না তোজা। ঐরহম একখান শরীলের সাথে গা লাগাইয়া থাকলিও আরাম। হে-হে-হে—।
দুষ্টামির হাসি হাসে হানিফ। হয়তো হানিফ আবার কারও কাছে বলেছে। এখন পুরো এলাকায় বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে। কিন্তু হুমায়নের সামনে কেউ এ ব্যাপারে কথা বলে না। কিছু দুষ্টু কিসিমের লোক আছে। তারা মজা করে স্লোগানের মতো বলে, মজা লোটে বলার বউ—ফচাত ফচাত ফচ। মজা লোটে হুমাই মিয়া—ফচাত ফচাত ফচ। মজা লোটার কথা ঠিক আছে, কিন্তু ‘ফচাত ফচাত ফচ’ বিষয়টা কারও মাথায় ঢোকে না। তবু আজকাল অনেক বাচ্চারাও ‘ফচাত ফচাত ফচ’ বলে মজা করে বেড়াচ্ছে। বউ-ঝিদের কানেও কথাটা পৌঁছেছে। মন্দ কথা বাতাসের আগে ছোটে।
বলার সাথে দেখা হলে জব্বার খাঁ বলল, ও বলা—শুনলাম তোর বউ নাকি ফচাত ফচাত ফচ?
জব্বার খাঁ কথাটা জিজ্ঞেস করে দাঁত কেলিয়ে হাসে। রাগে মাথা গরম হয়ে যায় বলার। বলা চুপ করে থাকে। তার মাথা সড়কির ফালা হয়ে কোথাও বিঁধতে চায়। কিন্তু সে নির্বিকার। কারণ শরীর অনেক দুর্বল। দিনের বেলায়ও মনে হয় সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খাচ্ছে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ করছে। এই ঘুম কোত্থেকে আসছে, বলা যখন আঁচ করতে পেরেছ তখন আর তার কিছু করার নেই। 
ঘুমের ওষুধ কিনতে গেলে একদিন রোকন ফার্মেসির রোকনউদ্দিনের ছেলে জামাল বলল, হুমাই ভাই, এত ঘুমের ওষুধ দিয়া কী করেন? 
হুমাই হাসতে হাসতে বলল, খাই। বুঝিস না? মালয়েশিয়া থাকার সময় অভ্যাস হইয়া গেছে। তহন তো তোর ভাবি কাছে আছিল না। 
: এহন তো ভাবি কাছে আছে।
: সেই জন্যি আরো বেশি খাইতে হয়। তোর ভাবিরে কাছে পাইয়া ঘুম আসতিই চায় না। হা-হা-হা।

হুমায়নের বউ আতিয়া বেশ কিছুদিন ধরে বারণ করছে, রাতবিরাত বাইরে না যেতে। হুমায়ন তোয়াক্কা না করে বলে যে তাকে অনেক সালিস দরবার করতে হয়। লোকে মান্যগণ্য করে, তাদের সাথে মিশতে হয়, তাল মিলিয়ে চলতে হয় ইত্যাদি। এখন যখন বলার বউ নিয়ে কথা উঠেছে, তখন হুমায়ন অগ্নিশর্মা। বলল, আমি বলার বউয়ের কাছে যাই নাকি কালার বউয়ের কাছে যাই, তাতে তোর কী?
আতিয়া বলল, আমার কী মানে, আমি তোমার বউ না? আমি কি অক্ষম? কও? আমি কি অক্ষম? আমার দুইডা পোলাপান হইছে না?
: পোলাপান লইয়া থাকো? আমারে ডিস্টাব কইরবা না।
: আমি তোমারে আর যাইতে দিব না।
: চুপ থাক মাগি। ঘ্যানর ঘ্যানর করবি না। ইচ্ছে হয় এমনে থাক, না পোষাইলে চইলা যা।
চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আতিয়া। সে কোথায় যাবে? আত্মহত্যা ছাড়া তার কোনো গতি নেই। বাবার বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়। বিয়ের সময় তবু অনেকটা ভালো ছিল সংসার। বাবা মারা যাবার পর ভাইদের হাতে পড়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। এখন তাদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কোথায় যাবে আতিয়া? শিশু দুটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার শ্বশুর এসে সান্ত্বনা দেন। বলেন, আমি তারে বুঝাইবার অনেক চেষ্টা করছি বউমা। বুড়ো ছাওয়ালরে তো আর মারতি পারি নে। গায়ে হাত তুলতি পারি নে। সে-ই আমার ওপর চড়াও হয়। বলার বউ নিয়ে তার সাথে কোনো কথা বলা যাবি নে। তাহলে নাকি খুন কইরে ফেলাবি। তুমি কও বউমা, যে বাপেরে খুন করতি চায়, সে বউরে খুন করতি কতক্ষণ? চুপ কইরা থাহো। ভুল ভাঙলি একদিন ফিইরা আসবি।
কিন্তু এত কিছুর পরও হুমাই ফেরে না। বলার বউয়ের গলা জড়িয়ে শুতে পারলেই তার আনন্দ। বাজারে কামরুলের চায়ের দোকানে টিভিতে হিন্দি গান বাজছে— কাজরা রে, কাজরা রে। অমিতাভ বচ্চন, ঐশ্বরিয়া আর অভিষেকের নাচ চলছে ধুমছে। সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার চাইতে সবার মনোযোগ বলার বউ আর হুমাই মিয়ার দিকে। জব্বার খাঁ বলল, আমি তো বলারে পাইয়া কইলাম, ও বলা, তোর বউ নাকি ফচাত ফচাত ফচ। বলা কিছুই কইল না। তার মানে ঐ হারামজাদাও সব জানে। 
: না জানার কী আছে? কড়কড়ে টাহা আছে না? বিদ্যাশের টাহা, কেডায় লোভ সামলাবে কও?
: কিন্তু হুমাইয়ের সামনে তো কেউ কতি পারবা না, মজা লোটে হুমাইয়া মিয়া—ফচাত ফচাত ফচ?
ঠিক তখনই হুমাই গিয়ে উপস্থিত হয়। সবাই দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ সালাম দেয়। কেউ বলে, আসো হুমাই মিয়া আসো, চা খাও।
তখনো গান বাজছে—কাজরা রে, কাজরা রে।
হুমাই ভাবল, মালয়েশিয়া যাবার আগেও এত চায়ের দোকান ছিল না। গ্রামের কটা লোক চা খেত? অথচ কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন হিন্দিতে গানও বাজে, হিন্দি ছবিও চলে চায়ের দোকানে। হুমাই বলল, আমি একটু আগে চা খাইছি। বসব না, আমার তাড়া আছে, তোমরা চা খাও। ওই কামরুল, বিল কিন্তু আমি দেব।
কামরুল চায়ের মধ্যে চিনি গুলাতে গুলাতে বলল, ঠিক আছে মিয়া ভাই। লিখ্যে রাখপো নে।
এই হুমাই কোনো অন্যায় করলেও কারো কিছু বলার নেই। আর সে তো একটি সংসারে হেল্প করছে। অন্যায় হিসাবে না দেখলেই চলে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া সর্বত্র। বলা গেল ইউপি চেয়ারম্যান শরীফুজ্জামানের কাছে। চেয়ারম্যান তখন বেশ কিছু লোকজনের সাথে কথা বলছে। বলা বলল, চেয়ারমেন সাব, আপনার সাথে এট্টু দরবার ছিল।
চেয়ারম্যান শরীফ বললেন, নতুন অনুদান-টান আসে নাই। আসলি তোগেরে খবর দিব দফাদার। 
: দানের জন্যি আসি নাই চেয়ারমেন সাব। এট্টু কথা ছিল।
: কথা ছিল, কয়া ফ্যাল?
: এট্টু ফাঁকে গিয়া কইতে চাই।
 চেয়ারম্যান শরীফ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বলাকে সঙ্গে নিয়ে অফিস রুমের বাইরে গেলেন। পাশেই ফাঁকা একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ক এবার কী কবি? 
বলা বলল, আমার বাড়িতে খুবই অশান্তি। আমার বন্ধু হুমাই, হুমাই আমার বাড়িতি যায় বইলা অশান্তি। আপনে তারে এট্টু নিষেধ কইরা দিতেন যদি।
: আমি তারে নিষেধ করতি যাব ক্যান? সে তোর বন্ধু, তুই কইলেই তো হয়। আমি এর মধ্যি যাব ক্যান?
: আপনি হইলেন ইউনিয়নের মাথা। আপনার এক কথায় কাম হইব। 
: হইব না। হুমাই অর্থ-বিত্তে শক্তিশালী। সে আমার কথা শুনব ক্যান? তাছাড়া আমি শুনছি, মানে লোকজন বলাবলি করে, বলার বউই নাকি তারে আছ্রয়-পছ্রয় দিছে। নইলে হুমাই এত সাহস পাইত না।
: সেই জন্যিই তো আপনের কাছে আসা। আপনে একটা বিধি-ব্যবস্থা কইরা দেন। নইলে সমাজে আর মুখ দেখাতি পারতিছি নে।
: বিধি-ব্যবস্থা মানে তো সালিস। সালিস করতি গেলি আরো লোক জানাজানি হবি, আরো মান-সম্মান যাবি। এইটা তোগের ফেমিলির বেপার। নিজেরা ফয়সালা কইরে ফ্যাল।
: আমি চেষ্টা কইরা পারি নাই বইলাই তো আপনের কাছে আইলাম। 
: কোনু লাভ নাই। তোর বউ যদি তার পক্ষে কথা কয়, কেডায় এইডা মিট করতি পাইরবে, ক? থানা-পুলিশ কইরাও লাভ হইব না। তোর বউ যদি বলতি পারে, হুমাই জোর কইরা ধর্ষণ কইরছে, তহন একটা বিচার হইতে পারে। কিন্তুক সে যদি চুপ কইরা থাকে, থানা-পুলিশের বাপেও কিছু করবার পারবি নে। বাড়ি যা, তোর বউরে বুঝা। না পারলি ঘুমায়া থাক। ঘুমাইতে ঘুমাইতে তো শরীলডা শ্যাষ কইরা ফেলাইলি।
বলাই কোথাও গিয়ে স্বস্তি পায় না। কাছের মানুষও তাকে দেখলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে। ‘মজা করে বলার বউ—ফচাত ফচাত ফচ’ কথাটা তার বুকে বন্দুকের গুলির মতো বেঁধে। যতবার মনে পড়ে, ততবার যেন একটা গুলি বেঁধে। দিনে কতবার মরে বলা, তার ঠিক নেই। খুবই ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ নিতাই তাকে দেখে চুপ করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। বলা ডেকে বলল, ও নিতাই, তুইও কি আমার সাথে কথা কবি নে? 
নিতাই থেমে তার গলায় ঝোলানো কাঠির মালাটি নাড়তে থাকে। কী বলবে বুঝতে পারে না যেন। বলা আরেকটু এগিয়ে যায় তার কাছে। নিতাই গলার কাঠি নাড়তে নাড়তে বলে, তোর সাথের বাঁড়াটারে কি জন্মের মতো ক্ষয় কইরা ফেলাইছিস? শালা ভুদাই, ঘুমায়া ঘুমায়া মর গে। 
নিতাই আর এক সেকেন্ড দেরি করে না। নিজের শিশ্ন ধরে মাটিতে বসে পড়ে বলা। তার সারা শরীরে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
এদিকে হুমায়নের আব্বা ভাবলেন, কিছুতেই হুমাইকে বলার বাড়ি যেতে দেবেন না। এর আগেও বহুবার সাবধান করেছেন। অনেক বকাঝকা গালমন্দ করেছেন। মান-সম্মান ধুলোয় মিশতে চলেছে। পারিবারিক ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। আজ স্পষ্ট করে বললেন, তুই কিছুতেই ওই বাড়ি যাতি পারবি নে। ঘরে বউ আছে, ছাওয়াল-মিয়া আছে। 
হুমাই বলল, আব্বা, এইডা আমার বিষয়। আপনি কথা কবেন না।
: কী বললি তুই? এইডা তোর বিষয়? পুরো পরিবার মুখ দেখাতি পারতিছি নে একটা কুলাঙ্গার ছাওয়ালের জন্যি। হারামজাদা, শয়তান, বেহায়া, বেলজ্জিত—তোর মতো কুলাঙ্গার ছাওয়াল পয়দা করে আজ জেবন তেতো তোতো। টাহা-পয়সা খরচা কইরে বিদ্যাশ পাঠালাম। কোনে এট্টু স্বভাব পাল্টায়ে আসপে, তা না। আরো বজ্জাত হয়া দ্যাশে আইল। আজ কোত্থাও যাইতে পারবি নে কয়া দিলাম।
হুমাই তিন ব্যাটারির টর্চ হাতে নিয়ে তোজাকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হুমায়নের ছোট তিনটি ভাই আছে। তাদের স্ত্রীও আছে। তারাও সকলে লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। ঘর থেকে বের হলেই ওই এক কথা। শুনতে শুনতে সবার কান ঝালাপালা। কিন্তু বড় ভাইয়ের ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। তবু বিনয়ের সাথে নিষেধ করেছে যে তারা অপমান সইতে পারছে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
শেষ পর্যন্ত আপসে যাবার কথা ভাবল বলা। অনুপাকে ডেকে বলল, বউ, তুই আমার একখান কথা শোন। তুই আর হুমাইরে এত লাই দিস নে। বাড়িতি আইলে দূর দূর কইরা তাড়াইয়া দিবি। তুই ছাড়া কারো ক্ষমতা নাই ওরে কিছু কয়। তুই আমার কথা শোন।
বলার কোলের মধ্যে আরো নুয়ে পড়ে বলার বউ। বলে, তুমি এত ভাবতেছ ক্যান। সে এই বাড়িতে আইলে কোনু ক্ষতি হইতাছে না। সে তোমারে ভালোবাসে, আমারে ভালোবাসে, আমাগোরে মাইয়া পূজারে ভালোবাসে। সে এই সংসারডারে দেখতাছে। তারে কেমনে মানা করি, কও? তুমি ভাইবো না। আমি তোমার আছি, তোমারই থাইকবো। 
অনুপা আদর করতে থাকে বলাকে। কিন্তু এই আদর শুকনো মনে হয়, বড় কৃত্রিম মনে হয়। এর আগেও এমন কথা বলেছিল অনুপা। সেই কথা কি সে রাখতে পেরেছে? বলা একদিন বলেছিল, তুলসী গাছডায় জল তো দিস বউ, কিন্তুক কোনুদিন পুজো করতি দেখলাম না। সবার ঘরে ঠাকুর-দেবতা থাকে, ঘরের বউরা পুজো আর্চি করে। আমাগোরে ঘরে তো পুজো দেহি না। 
অনুপা বলেছিল, তুমিই তো আমার ঠাকুর দেবতা। এমন ঠাকুর-দেবতা থাকলে আমি মাটির মূর্তিরে পুজো করতি যাব ক্যান? 
এমন কথা যে বলতে পেরেছিল, তার আদর এখন অসহ্য। বলা কোনো আত্মতৃপ্তি পাওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে।
আস্তে আস্তে ব্যাপারটা এমন হলো, সবাই যেন ভুলে গেল। হুমাই আর বলার বউ নিয়ে যেসব রসিকতা পথে ঘাটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তা যেন কোনো তুমুল বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল অথবা মহাপ্লাবনে ডুবিয়ে দিল। কেউ আর এই বিষয়টি নিয়ে মাতামাতি করে না। এমনই তো হয়। একটি ঘটনা বেশিদিন লোকের মুখে মুখে ফেরে না। তনু হত্যা নিয়ে কত হইচই হলো। সারা দেশে তুলকালাম ব্যাপার। মিটিং হলো, মিছিল হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার কী হলো তা কেউ জানতে পারল না। আবার সোনাগাজীতে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা। সারা দেশে তোলপাড়। কিন্তু তারপর সবাই নিঃশব্দে ভুলে গেছে। এটা নিয়ে আর যত্রতত্র আলোচনা হয় না। এখন হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের মামুনুল সাহেবেকে নিয়ে আলোচনা। তিনি নাকি সুন্দরী রমণী নিয়ে রিসোর্টে গিয়েছিলেন। এটাও কদিন মুখরোচক গল্প থাকবে, তারপর আবার আরেকটি। যেমন এখন হুমাই আর বলার বউ বাদ দিয়ে এলাকার মানুষ নির্বাচন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোন প্রতীক শক্তিশালী, কোন প্রতীকের প্রার্থী ভালো, প্রার্থী মন্দ—এসব নিয়ে আলোচনা। নির্বাচন শেষে হয়তো আরেকটি ঘটনা সামনে উপস্থিত হবে।
হুমাই আর বলার বউ এখনো তাদের প্রিয় কর্মটি চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোথাও কারো মুখে কোনো কথা নেই। না বলার মুখে আছে, না পাড়া-প্রতিবেশীর মুখে আছে, না হুমায়নের বাবার মুখে আছে। নির্বিঘ্নে কোনো অবৈধ কাজ করার মজাই আলাদা। সেই আনন্দ পরিপূর্ণ ভোগ করছে হুমাই আর অনুপা। এমন আনন্দে কেটে গেল একটি বছর। আজ সেই আনন্দে কে যেন বিষের তির ছুড়ে মারল। অজানা সেই তিরে বিদ্ধ হয়ে চিরদিনের মতো চলে গেল বলা। অথচ বলাকে নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। বলছে তার বউ অনুপাকে নিয়ে। খানকি, নটী, বেশ্যা—যার মুখে যা আসছে তাই বলছে। সব কথা কানে গেলেও অনুপার প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। এভাবেই কোনো কোনো মানুষ নষ্ট হয়ে যায়, এভাবেই কোনো কোনো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। তখনো বলার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে আছে উঠোনে, খেজুর পাতার পাটির ওপর।

২.
আরো বারো বছর পরের কথা। হুমায়ন তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে। মেয়ে থাকে তার স্বামীর বাড়ি পোড়াদহে। ছেলেটা কলেজে পড়ে। এখনো হুমাই আসে বলার বাড়ি। বলার বাড়ি না বলে অনুপাদের বাড়ি বলাই ভালো। কারণ, বলা তো এখন বেঁচে নেই। অনুপার মেয়েও দেখতে দেখতে বেশ বড় হয়ে উঠেছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। সে-ও মায়ের মতো অসাধারণ সুন্দরী হয়েছে। তবে অনুপা আগের মতো নেই। কিছুটা ভারী হয়ে গেছে। হুমাইকে অতটা সময় দেয় না। তুমি করে কথা বলে। হুমাই আগে দু-একবার বউদি বলত, এখন অনেক দিন ধরেই অনু বলে ডাকে। অনু বেশ আদুরে ডাক ছিল। সেই ডাকেও আজকাল একটা পানসে ভাব এসেছে। এরই মধ্যে অনুদের বাড়িতে ছনের ঘরের বদলে টিনের ঘর উঠেছে। ৫ ইঞ্চি দেয়াল দিয়ে সেমিপাকা ঘর। মেঝেটা নীট ফিনিশ করা। রান্নাঘরটাও আগের চেয়ে অনেক বড়। সেটিতে ঢেউটিনের দোচলা ঘর এবং ঢেউটিন দিয়ে বেড়া। আলাদা গোয়াল ঘর। গোয়ালও ঢেউটিনের। সেই গোয়ালভরা গরু। মোট ৫টি। বকনা একটা। একটি বাছুর থেকেই এতগুলো গরু। এগুলো দেখাশোনার জন্য ঋষিকেশকে রাখা হয়েছে। সে প্রতিদিন সকালে আসে, সন্ধ্যার পর চলে যায়। মাঠঘাটের দেখাশোনাও সে-ই করে। আর এসবই পরিচালিত হয় হুমায়নের নির্দেশে। হুমায়ন আগেও ফ্যাক্টর ছিল, এখনো ফ্যাক্টর।
হুমায়ন এলে আজকাল পূজাকে ডাকে অনুপা। বলে, দ্যাখ তো মা, তোর কাকা আইছে, কী চায় দ্যাখ।
পূজা গিয়ে কাকার সেবা করে। সেই ছোট থেকে এই কাকাকে দেখে আসছে পূজা। বাবার কথা কিছু মনে নেই। কাকাকেই ও বাবার মতো জানে। এই কাকা কত কোলে নিয়েছে, কত আদর করেছে ঠিক নেই। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে পূজা মুগ্ধ। এখন অনেকটা বুঝতে পারে। মায়ের সাথে কাকার সম্পর্কটা বুঝতে পারে। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। এত দিনের একটি গোপন গভীর সম্পর্ককে অবহেলা করার সুযোগ নেই। পূজা আজকাল এটাও ভাবতে শুরু করেছে, এই সম্পর্কটি না থাকলে হয়তো ও বেঁচে থাকত না, ওর মা বেঁচে থাকত না।
কিন্তু পূজা বেশ কিছুদিন যাবৎ লক্ষ করছে, হুমাই ওর স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। হয়তো কোনো কিছু ইঙ্গিত করে। বয়স কম হলেও বয়ঃসন্ধির সময়টাতে একটা আলাদা শিহরণ তোলা স্বাভাবিক। বিষয়টা মাকে বললে মা বলেছে, সে তোমার বাবার মতো। সেই ছোট থেকে তোমাকে কোলেপিঠে নিয়ে চলছে। অভ্যাসটা রয়ে গেছে। এটাতে মনে করার কিছু নেই। এসব কথা মেয়েকে বোঝালেও নিজের মনের মধ্যে একটা ভয় দানা বাঁধে অনুপার। অনুপা শঙ্কিত হয়েও কিছু বলতে পারে না। এই হুমাই তার জীবনে এসেছিল বলেই তো জীবনটা এত সুন্দর হয়েছে। তবু একদিন হুমাইকে সাবধান করে দিতে হবে, তুমি আমাকে নিয়ে যা খুশি করো, আমার মেয়েটার দিকে হাত বাড়িও না। জানি, তুমি চাইলে আমি না বলতে পারব না। তবু আমার অনুরোধটাকে তুমি অবজ্ঞা করো না। আমার এই মেয়েটাই আমার আশা-ভরসা। ওর জন্যই বেঁচে থাকা।
হুমাই এল বেশ ফিটফাট হয়ে। সুশীলের সেলুন থেকে ক্লিন শেভ করে এসেছে। প্রায় অর্ধেক পেকে যাওয়া চুলে কলপ লাগিয়েছে। বরাবরের মতো আজও সে হাফহাতা প্রিন্ট শার্ট পরেছে। শার্টে বড় বড় রঙচঙা ফুল। পূজা একটু খুশি হয়ে বলল, তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে কাকা। এক্কেবারে ইয়াং একটি গুড বয়। হুমাই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, তাই নাকি? তোমার পছন্দ হয়েছে?
: খুব। আমার কাকাটা সব সময় সুন্দর।
রান্নঘর থেকে অনুপা বলল, দুজনে এত কী গল্প হচ্ছে, শুনি? 
পূজা বলল, কিছু না মা। কাকা আজ খুব সুন্দর কইরে সাইজে আসছে। চুলে কলপ লাগায়ছে।
: ও আচ্ছা। কথা ক। আমি হাতের কামডা সাইরা আসি।
হুমাই পূজার থুতনি ধরে বলল, তোমার জন্যি সাইজে গুইজে আইছি।
: ক্যান কাকা?
: বা রে! তুমি অহন বড় হইছ না? 
হাতটা মুখ থেকে বুকের দিকে নিয়ে যায় হুমাই। মৃদু চাপ দেয়। পূজা বলে, কাকা আমার কেমুন জানি লাগে।
: পরথম পরথম এট্টু ঐরহম লাগে। যহন মজা পাইয়া যাইবা, দেখবা বেশি বেশি ভাল্লাগতেছে।
: না, আমার ভাল্লাগতেছে না।
: আচ্ছা এইডা ধরো, দেখবা ভাল্লাগতেছে।
পূজার হাতটা ধরে লুঙ্গির নিচে ঢুকিয়ে দেয়। বলে, এমনে কইরা ধরো—।
পূজা ওর জীবনে প্রথম একটি স্বাদ পেল। সারা শরীর কেঁপে উঠল। কী ধরল কেন ধরল, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুভব। ও জিনিসটিকে ধরে রেখে কাঁপতে কাঁপতে বলল, কাকা, আমার ভাল্লাগতেছে না।
: নাড়াচাড়া দাও, দেখবা ভাল্লাগতেছে।
তখন হুমাই একটি হাত পূজার কামিজের নিচে ঢুকিয়ে বুকে চাপ দিচ্ছে। অন্য হাতটি পূজার হাতটি ধরে আদিম নেশায় মগ্ন হয়ে আছে।
পূজা অসহায়ের মতো ডাক দিল, মা—।
পৃথিবীতে এই একটি ডাকই আছে যা সমস্ত বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। অনুপা এসে রেগে বলল, পূজারে নিয়া তুমি কী করতাছো?
হুমাই নিচু কণ্ঠে বলল, কিছুই করতাছি না। তয় করতি চাইতাছি।
ভয়ে একদিকে জড়সড় হয়ে বসে আছে পূজা। অনুপা বলল, ঠিক আছে। তোমার শখ হইছে আমারে কইতা, আমি ওরে বুঝাইয়া দিতাম। ঐটুকুন মাইয়া, এই সব বোঝে নাকি?
: দশ-বারো বছরের মাইয়াগো বিয়া হইলে তারা পারে কেমনে?
: তুমি এহনো মানুষ হইলা না হুমাই ভাই। আমার সবকিছু তোমারে দিয়া দিলাম—।
: কী দিছো তুমি আমারে? কতটুক দিছো? আর আমি তোমারে কী দিছি? এত সোন্দর একখান ঘরে বাস করতাছো ‘ভালো-মন্দ খাইতাছো, পরতাছো’। এই টাহা দিয়া আমি হাজারটা মাগির কাছে যাইতে পারতাম—।
: ঠিক আছে। তুমি গলা নামাও। আমি ব্যবস্থা করতাছি। আমি মাইয়াডারে বুঝাইতেছি। তোমার জন্য এতই যহন পারছি, আর এইটুকু পারতাম না?
ফজরের আজান শেষ হতেই একটা চিৎকার শুনতে পেল তোজাম্মেল। তোজা তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। মনে হলো হুমাই চিৎকার দিয়েছে। বাড়ির দিকে এগিয়ে এল সে। উঠোনে যেতেই দেখতে পেল, অনুপার হাতে রক্তাক্ত বঁটি আর পূজার হাতে রক্তাক্ত রামদা। উঠোনে তখনো বৈদ্যুতিক বাতির আলো ঝলমল করছিল। দুজনকে ভয়ংকর অবস্থায় দেখতে পেয়ে তোজা পড়িমরি করে ছুটল মাঠ বরাবর। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগল, খুন, খুন।
অনুপা আকাশের দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, আমি খুন করছি। কেনা বান্দির বন্দিদশা থিকা মুক্তি পাইতে, আমি খুন করছি।
পূজাও তার উল্টো দিকে ফিরে আকাশের দিকে মুখ তুলে চেঁচিয়ে বলল, আমি খুন করছি—। আমার সতীত্ব বাঁচাইতে আমি খুন করছি।