‘আমাকে যখন কেউ ছাড়া-ছাড়াভাবে একাত্তর সম্পর্কে কিছু লিখতে বলেন কিংবা কোন মন্তব্য করতে বলেন, আমার ভীষণ রাগ ধরে যায়। কারণ একাত্তর সালে যা কিছু ঘটেছে, আমি যা কিছু দেখেছি, যে সকল ঘটনা এবং কর্মকাণ্ডে আমি এবং আমার বন্ধুরা অংশ নিয়েছি, আমার জাতির যে জাগরণ, যে প্রতিরোধ, যে দৃঢ় সংকল্প, মৃত্যুর যে সরল প্রস্তুতি, জয়ের যে নেশা, যে আত্মত্যাগ, যে বোকামি এবং উন্মাদনা আমি দেখেছি সবকিছুকে একটা বিরাট সত্তার অবিভাজ্য অংশ মনে হয়। চোখ বুঁজে একাত্তরের কথা চিন্তা করলে আমার কানে মহাসিন্ধুর কল্লোল ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।’
আহমদ ছফা (২০০৯: ৭১)
১.
১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামে যাঁহারা আত্মদান করিয়াছেন তাঁহাদের সংখ্যা লইয়া বিতর্ক আমাকে সাজে না। এই আত্মদানকারী বা শহিদদের সংখ্যা এক কথায় অগণিত। শহিদদের মধ্যে আবার নানান বর্গ বা শ্রেণীভেদ করা হয়। একটি বর্গের নাম শহিদ বুদ্ধিজীবী। কে বুদ্ধিজীবী বা কে বুদ্ধিজীবী নয় কে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই বিভাগীয় তর্কেও আমার কোন কিছু করার নাই। আমার আছে দুঃখ মাত্র। দুঃখের মধ্যে আছে আরো দুঃখ। যেমন লক্ষ লক্ষ নারীর বলা হয়, মান-সম্মান বা ইজ্জতের দুঃখ। মনে হয় যেন নারীর আত্মত্যাগ মাত্র ইজ্জত দেওয়ার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা সংকীর্ণ এই প্রকল্পের প্রতিবাদ বিশেষ।
‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে ২০১১ সালে বাংলা একাডেমী যে বইটি প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহা হইতে জানিলাম, “মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে মিরপুরে বাঙালি আর অবাঙালিরা দুই ভাগে বিভক্ত (হয়েছিলেন)। শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা স্বাধীনতার আন্দোলনে বাঙালিদের উজ্জীবিত (করেছিলেন)। প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে নিজ বাসভবনে মা ও দুই ভাইসহ তাঁকে হত্যা করে অবাঙালিরা।” (রোজী ২০১১: প্রথম ফ্ল্যাপ)
মেহেরুন্নেসা জন্মিয়াছিলেন ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট তারিখে কলিকাতার খিদিরপুরে (মতান্তরে দিল মনোয়ারা মনু লিখিয়াছেন ১৯৪২ সালে) আর প্রাণদান করিয়াছিলেন ঢাকার মিরপুরে ১৯৭১ সালের ২৬-২৭ মার্চ নাগাদ মানে মাত্র তিরিশ কি আটাশ বছর বয়সে। তাঁহার জীবন কাহিনীর যেটুকু ইশারা পাওয়া যায় তাহাতেই প্রকাশ তিনি সংগ্রামে অকাতর ছিলেন। এই সংগ্রামের শুরু একান্ত শৈশবেই। (রোজী ২০১১: ২৫; মনু ২০১১: ৫১)
কাজী রোজী তাঁহার চরিতকর্ত্রী লিখিতেছেন, “কিশোরী বয়সের সূচনা থেকেই কবি মেহেরুন্নেসা তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বাবাকে দুই জায়গায় কাজ করতে হতো খিদিরপুর এবং ভবানীপুরে। বাবাকে সাহায্য করার জন্য তিনি বাবার কয়লার দোকানে বসতেন কয়লা বিক্রি করতেন। সে সামান্য হিসাব তিনি শিখেছিলেন হাতে গুনে গুনে সেই শিক্ষা দিয়েই হিসেব করতে পারতেন।” (রোজী ২০১১: ১৫)
মেহেরুন্নেসা বাবার পরিবারের সহিত কলিকাতা হইতে ঢাকায় আসেন ১৯৫০ সালে। বলা বাহুল্য, শরণার্থী পরিচয়ে। সেই কাহিনী অলিখিতই রহিল। ঢাকায়ও তাহাদের সংগ্রামের শেষ হইল না। কাজী রোজী জানাইতেছেন: “তাঁর সারাক্ষণের চিন্তা ছিল কিভাবে সংসারকে সাহায্য করা যায়। অল্প বয়সেই একটু একটু লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় কাজ খুঁজতে থাকলেন। বাবা তখন ছোটখাট ব্যবসার চেষ্টা করছিলেন। যৎসামান্য সেই আয় দিয়ে বাসা ভাড়া করে ঢাকা শহরে বসবাস করা খুবই কঠিন ছিল। মেহেরুন্নেসা কিছুদিন (ইউসিসে অর্থাৎ মার্কিন সংস্কৃতি কেন্দ্রে) কপি রাইটারের কাজ নিলেন। এরপর অনেক চেষ্টা করে বাংলা একাডেমীতে কপি রাইটারের কাজ নিলেন। এখানে দীর্ঘদিন কাজ করেন তিনি।” (রোজী ২০১১: ১৫)
তাঁহার জীবনকথার শেষাংশ এই রকম: “১৯৫০ সালের পর থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় নানাজনের বাসায় ভাড়া থাকেন মেহেরুন্নেসার মা-বাবা এবং ভাইবোন। ১৯৬৫ সালে অনেক চেষ্টার পর কিস্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে মিরপুরে ৬-ডি, ১২/৮-এর বাড়িতে সবাই মিলে বসবাস শুরু করেন। এটাই হয় কবি মেহেরুন্নেসার স্থায়ী ঠিকানা।” (রোজী ২০১১: ১৫)
এই ঠিকানাতেই কবির জীবনাবসান হয়।
বেগম সুফিয়া কামাল ‘মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি মর্মস্পর্শী কবিতায় তাঁহাকে ‘প্রথম শহীদ বাংলাদেশের মেয়ে’ বলিয়া সংবর্ধনা জানাইয়াছিলেন। কবিতাটি কাজী রোজী সম্পাদিত সংকলনে ছাপা হইয়াছে। কবিতার পুরোটাই উদ্ধৃত করার যোগ্য। এই নিবন্ধের শিরোনাম আমি বেগম সুফিয়া কামালের লেখা হইতে ধার করিলাম। তবে মাত্র বাক্য-প্রকরণটা গদ্যে অনুবাদ করিবার পর।
কুমারী কিশোরী শাহানা রঙে মেহেদী লাগেনি হাতে
জালিম কাফের পিশাচেরা সেই হাতে, অসহায়া মেয়ে মোর!
শাণিত ছুরিকা হানিয়া কণ্ঠে তোর
তাণ্ডবলীলা শুরু করেছিল, রক্তবসনা তুই
পূতপবিত্র একমুঠি ফুল, শেফালী, চামেলী, জুঁই।
ভালবেসেছিলি এই ধরণীরে, ভালবেসেছিলি দেশ
তাই বুঝি তোর কুমারী তনুতে জড়ায়ে রক্তবেশ
প্রথম শহীদ বাংলাদেশের মেয়ে
দুটি ভাই আর মায়ের তপ্ত বক্ষরক্তে নেয়ে
দেশের মাটির ’পরে
গান গাওয়া পাখি, নীড়হারা হয়ে
লুটালি প্রবল ঝড়ে।
ঝড় থেমে গেছে, বাংলাদেশের কেটেছে অন্ধকার
সোনাঝরা এই রোদের আলোকে তুই ফিরিবি না আর।
(কামাল ২০১১: ১)
২. মেহেরুন্নেসার লেখা কবিতা প্রথম ছাপা হইয়াছিল ১৯৫৪ সালে, ‘বেগম’ পত্রিকায়। তবে প্রকাশ থাকে যে ১৯৭১ সালে শহিদ হইবার আগ পর্যন্ত তাঁহার কবিতার কোন কাব্যগ্রন্থ ছাপা হয় নাই। ‘বেগম’ সম্পাদক (অথবা সম্পাদিকা) নূরজাহান বেগম সাক্ষ্য দিয়াছেন: “এই পর্যায়ে (মেহেরুন্নেসা) ছিল মোটামুটি ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। আর সে সময়কার বাঙালি কবিদের ইসলামী ভাবধারার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্ত ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা। ফলে ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন কবিদের অনুসরণে মেহেরুন্নেসার কবিতায় মরুভূমি, কাফেলা, খেজুর গাছ প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করে।” (বেগম ২০১১: ৪৭)
নূরজাহান বেগমের মন্তব্য: “মেহেরুন্নেসার প্রগতিশীল কবি-মানসের পক্ষে এটা কেমন বিসদৃশ ঠেকতো। সম্ভাবনাসমৃদ্ধ একটি প্রতিভা এভাবে কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন থাকবে আমি তা চাইনি। তাই একদিন তাকে বললাম ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে: তোমার চারপাশে যে জগত, প্রতিনিয়ত যার সাথে তোমার সম্পর্ক, সেই পরিবেশকে নিয়ে লেখ: সহজ সরল সুখ-দুঃখময় নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতার চেয়ে বড় আন্তরিকতাপূর্ণ আর কিছু হতে পারে না।” (বেগম ২০১১: ৪৭)
এই অযাচিত উপদেশ কিংবা পরামর্শে তৎক্ষণাৎ কাজও হইয়াছিল। নূরজাহান বেগম লিখিতেছেন: “আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, পরের কবিতাটিতে মেহেরুন্নেসা সম্পূর্ণরূপে আধুনিক, সব রকমের কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত।” (বেগম ২০১১: ৪৭)
বলা হয়তো বাহুল্য, তবু বলি সম্রাজ্ঞী নূরজাহান বেগমের অনাধুনিক নাম ছিল মেহেরুন্নেসা। মোগল সম্রাজ্ঞী হইবার পর তাঁহার আধুনিক অর্থাৎ সব ধরণের কৃত্রিমতামুক্ত নামটা দাঁড়াইয়াছিল নূরজাহান বেগম। তাই ইতিহাসের অনেক ঘটনাই দুইবার ঘটিয়া থাকে দার্শনিকদের এই রকম অনুমান অকারণ নয়। কবি মেহেরুন্নেসাকেও আধুনিক হইবার প্রেরণা দিয়াছিলেন সম্পাদক (অথবা সম্পাদিকা) নূরজাহান বেগম। এই আধুনিকতা আবার প্রহসন হইল কিনা, সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
মেহেরুন্নেসার কবিতা যে “সম্পূর্ণরূপে আধুনিক, সব ধরণের কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত” হইয়া উঠিতেছিল তাহার প্রমাণ অনেক কবিতায় পাওয়া যায়। এই আধুনিকতার প্রকাশ “(তাঁহার) চারপাশে যে জগত, প্রতিনিয়ত যার সাথে (তাঁহার) সম্পর্ক” সেই পরিবেশের মধ্যেই খুঁজিলেন তিনি। তাহা খুঁজিয়াও পাইলেন “সহজ সরল সুখ-দুঃখময় নিজস্ব পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে”। ‘আব্বার স্মরণে’ নাম দেওয়া একটি কবিতায় সেই আপন আধুনিকতার প্রকাশ পরিচ্ছন্ন দেখিতে পাইলাম। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, কবিতাটি কোন বছর লেখা হইয়াছিল জানিতে পারি নাই। এই নিটোল কবিতাটি আমি সম্পূর্ণ তুলিয়া লইলাম এখানে। অবশ্য বাংলাদেশের আধুনিকতা কিংবা পরাধুনিকতা ব্যবসায়ীগণ ইহাকে ‘আধুনিক’ বলিবেন কিনা আমি নিশ্চিত নই।
কান্নায় ভেঙে পড়িনি তো আমি, ভাঙেনি আমার মন
তুমি চলে গেলে রোগজর্জর, যে স্মৃতি নীরবে ফেলে
নশ্বর দেহ দাফন করেছি, পাঁজরের ব্যথা ঠেলে
খোদার সমীপে আরজু আমার আজ শুধু তা অগণন
জান্নাতি এক শিরিন হাওয়ায় যেন তুমি পাও সুখ,
শান্তির সুধা রোশনিতে খোদা ভরে দিক তব বুক।
আব্বা আমার শোন
তোমার মরণে আমি একফোঁটা অশ্রু ফেলিনি কোনো
খোদার বান্দা, তুমি চলে গেছো, দুঃখ করিনি তাতে
তুমি রেখে গেছো আমাকে মহান আল্লাহর হেফাজতে।
জান্নাত হতে আব্বা আমার, এই দোয়া শুধু দাও
সত্য ন্যায়ের পথ হতে যেন ফিরি নাকো এক পাও।
ধর্মে ও জ্ঞানে আর ঈমানের মাঝে যেন বেঁচে থাকি
যতদিন খোদা এই দুনিয়ায় হায়াতে রেখেছে বাকি।
তুমি চলে গেছো, কাঁদবো না আমি কবরের মাটি দেখে
নশ্বর স্মৃতি ধরার ধুলিতে জানি যে বিলীন হবে,
তোমার শূন্য শয্যাকে দেখে কান্নার কলরবে
কাঁদবো না আমি বুকের পাঁজরে বেদনার ছবি এঁকে।
আব্বা আমার শোন
তুমি নেই আমি ভাবতে পারি না, ভাবে না আমার মনও
খোদার সমীপে আরজু আমার আজ শুধু সীমাহীন
জান্নাতি খোশ জমিনের বুকে হও তুমি সমাসীন।
আল্লাহর কাছে আমার জন্যে একমুঠো দোয়া চাও
মাটিতে বন্দী দুলালীর তুমি লক্ষ সালাম নাও।
(রোজী ২০১১: ১১১)
৩. আমাদের বিদগ্ধ সাহিত্য-বিশারদগণ কি বলিবেন, জানি না। আমার বিচারবুদ্ধি সামান্য। তবু সাহস করিয়া বলিব এই কবিতা সামান্য নয়। এই কবিতায় কৃত্রিমতার আবর্জনা নাই। মরুভূমি, কাফেলা, খেজুর গাছ কিছুই নাই। আছে শুধু ‘জান্নাতি এক শিরিন হাওয়া’ কিংবা ‘জান্নাতি খোশ জমিনের বুক’। যাহাকে বলে উক্তি এবং উপলব্ধির সাক্ষাৎ সম্বন্ধ তাহার নমুনা এই কবিতা। আমি যথার্থ খবর রাখি না, দেশের পাঠ্যপুস্তক সংকলন যাঁহারা করেন এই কবিতায় তাঁহাদের চোখ পড়িয়াছে কিনা জানি না। এই কবিতা সর্বসাধারণের পাঠ্য হইতে পারে। সংহত, নিষ্কাম, নির্মোহ বলিতে যাহা বোঝায় এই কবিতা তাহাই। মহাকবি জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতার সহিত ইহার তুলনা করিবেন আর দেখিবেন, বলিবেন বাংলা কবিতার অগ্রগতি কতদূর হইয়াছে।
উক্তি তো শুনিলাম। এখন একটু উপলব্ধির উপকথা শুনিলে মনে হয় বিশেষ ক্ষতি হইবে না। কবির এককালের সহকর্মী বেগম মকবুলা মনজুর লিখিয়াছিলেন, তাঁহারা দুইজন একসময় বাংলা একাডেমীতে কপি লেখার কাজ করিতেন। মহীয়সী মকবুলা মনজুরের কথায়, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। ক্লাসের ফাঁকে অথবা শেষে আসতাম বাংলা একাডেমীতে। মেহেরুন্নেসা আসত কোন্ যেন পত্রিকা অফিস থেকে প্রুফ দেখার কাজ সারা করে। পৃষ্ঠাপ্রতি পঁচিশ পয়সা হিসাবে লেখা, প্রতি পৃষ্ঠায় কমপক্ষে ষোলো লাইন লেখা চাই। আমার ভালো লাগতো না, ক্লান্তি বোধ করতাম। কিন্তু কি অক্লান্ত ছিল মেহেরুন্নেসা! বাঁ হাতে কলম ধরে বাঁকা বাঁকা হরফে লিখে চলত। ... মেহেরুন্নেসার বাবা ছিলেন চিররুগ্ন মানুষ। আয়-উপার্জন তাঁর কখনোই যথেষ্ট ছিল না। টানাটানির সংসারে অষ্টাদশী কন্যা মেহেরুন্নেসাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল বাবাকে সাহায্য করতে। তার সেই স্বপ্ন দেখার বয়সে যখন কবিতার ফুল ছড়াবার কথা, তখনই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার।” (রোজী ২০১১: ৪৮)
মকবুলা মনজুর মহাশয়া কয়েকটি গুরুতর প্রশ্নও তুলিয়াছিলেন, সেই ১৯৭২ সালেই তুলিয়াছিলেন। তখন উত্তর মেলে নাই। এখনও মিলিবে না, আমি জানি। বেগম মনজুর সম্প্রতি নিজেও পরলোকগমন করিয়াছেন। তিনি ১৯৭২ সালে অপূর্ব লিখিয়াছিলেন, “শুধু বাংলা একাডেমীতে কপি লেখার কাজই নয়, ওকে দেখেছি একাধিক অফিসে প্রুফ দেখতে, ছোটখাটো ফিচার লিখতে। আর কবিতা লেখার তো বিরাম ছিল না। তখন ওর ভাই দুটো বড় হচ্ছিল। ওদের পড়াশোনার জন্য খরচ বাড়লেও পড়াশোনাতে কখনই ওদের নিষ্ঠা ছিল না। তার উপর বাবা একেবারেই অক্ষম হয়ে পড়াতে সংসারের পুরো দায়িত্বই এসে পড়েছিল বলে পাকাপাকিভাবে চাকরিতে নামতে হলো মেহেরুন্নেসাকে।... চাকরি এবং লেখা দুটো কাজ এক সাথে করেও কেন মেহেরুন্নেসার অভাব দূর হয়নি? এ প্রশ্ন অনেকেই করত সে সময়ে। এর জবাব আমার জানা। মেহেরুন্নেসা ছিল অবহেলিত প্রতিভা। তাই তার প্রচুর কবিতা ছাপা হলেও কবিতার মূল্য সে পায়নি অর্থাৎ যোগ্য সম্মানী পায়নি। বহু সুপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়েছে, কিন্তু সেই সব পত্রিকা একটা পয়সাও দেয়নি তাকে। কেন দেবে? মেহেরুন্নেসা যে অনেক পথ হেঁটে ধুলো পায়ে এসে পত্রিকা অফিসে কবিতা পৌঁছে দেয়। যাঁদের কবিতার জন্য বিল করা হতো, পত্রিকা অফিসে এলে যাঁদের সম্ভ্রমে আপ্যায়িত করা হতো, মেহেরুন্নেসা তাঁদের দলে পড়বার মত নয়।” (রোজী ২০১১: ৪৮-৪৯)
উদ্ধৃতি সুদীর্ঘ হইয়াছে, সন্দেহ নাই। তারপরও আর একটি উদ্ধৃতির আশ্রয় লইয়া এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের উপসংহার করিতেছি। ইহাও বেগম মকবুলা মনজুরের লেখা হইতে লওয়া হইল: “মেহেরুন্নেসা শহীদ হয়েছে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেবার, মাতৃভাষাকে ভালোবাসার অপরাধে সে প্রাণ দিয়েছে ঘাতকের ছুরির ফলায়। কিন্তু আমরা যারা তখন বেঁচে গিয়েছি, আমরা যারা এখনও বেঁচে আছি তারা কি করেছি তার স্মৃতির সম্মানে? রাজা আসে রাজা যায়, কিন্তু হতভাগ্যদের ভাগ্য এক জায়গাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। বেঁচে থাকতে মেহেরুন্নেসা যোগ্য স্বীকৃতি পায়নি, মরণেও পায়নি শহীদের যথার্থ মর্যাদা। তার জন্য আমরা কিছুই করিনি। কোনো একটি শিক্ষা কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নাম অথবা কোনো মহিলা ছাত্রীনিবাস কিংবা কোনো সড়কের নামফলকে কখনও কারুর দৃষ্টিগোচর হয়নি মেহেরুন্নেসার নাম।” (মনজুর ২০১১: ৫০)
৩ ডিসেম্বর ২০২৩
বানানরীতি লেখকের নিজস্ব
দোহাই
১. আহমদ ছফা, ‘একাত্তর: মহাসিন্ধুর কল্লোল’, সলিমুল্লাহ খান (সম্পাদিত), বেহাত বিপ্লব ১৯৭১, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী ও এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০০৯), পৃ. ৭১-৮৯।
২. কাজী রোজী (সম্পাদিত), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০১১)।
৩. দিল মনোয়ারা মনু, ‘সংগ্রামী কবি মেহেরুন্নেসা’, কাজী রোজী (সম্পাদিত), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬-৪৭।
৪. নূরজাহান বেগম, ‘কবি মেহেরুন্নেসা একজন সংগ্রামী শহীদের নাম’, কাজী রোজী (সম্পাদিত), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৬-৪৭।
৫. মকবুলা মনজুর, ‘মেহেরুন্নেসা এক বিস্মৃতি কবির নাম’, কাজী রোজী (সম্পাদিত), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮-৫০।
৬. সুফিয়া কামাল, ‘মেহেরুন্নেসা’, কাজী রোজী (সম্পাদিত), শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১।