১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, একই সঙ্গে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানচর্চাকেও পঙ্গু করতে সচেষ্ট ছিল তারা। দুইভাবে এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ধরে জাতির মেধাবী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার মাধ্যমে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে বাঙালির আলোর পথের দিশারি শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী ও লেখকসহ পেশাজীবী বিশেষজ্ঞদের হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ২৫ মার্চ রাতে শুরু করে চালানো হয় পুরো নয় মাস। চূড়ান্ত আঘাতটি ছিল বিজয়ের আগমুহূর্তে, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।
দ্বিতীয়ত, বাঙালির জ্ঞানচর্চাকে ধ্বংস করার মানসে শিক্ষাক্ষেত্রে চালানো হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। এ ক্ষেত্রে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের গ্রন্থাগারগুলো ছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর-রাজাকারদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার এবং নানান গ্রন্থ ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে ঢাকাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি শহরেই গ্রন্থাগারগুলো আক্রান্ত হয়েছে।
২৫ মার্চ কালরাত থেকে গণহত্যার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রন্থাগার ধ্বংসের উৎসবে মেতে ওঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এরই অংশ হিসেবে ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলে বই, নোট-খাতাও ধ্বংস করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, তৎকালীন ঢাকার বিখ্যাত রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার এবং রাজা রামমোহন রায়ের পাঠাগারের দুষ্প্রাপ্য-মূল্যবান বইও কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এই গ্রন্থাগারগুলোর বই ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাতে দেখা যায়। ঢাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হানাদার বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও বই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন জেলার প্রধান ও বিখ্যাত লাইব্রেরিগুলোও পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের রোষানলে পড়ে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) কলেজ গ্রন্থাগার, বগুড়ার ১৭টি কলেজের বিজ্ঞান যন্ত্রপাতি ও বই, চাঁদপুর টাউন হল গ্রন্থাগার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণগ্রন্থাগার অন্যতম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে গ্রন্থাগার ও বইপত্র ধ্বংসের সূচনাটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল গ্রন্থাগারের বইপত্র সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। ওই রাতে আক্রমণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কয়েকটি হলের গ্রন্থাগারও কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন আবাসিক হলের রুমে শিক্ষার্থীদের অসংখ্য বই হানাদারেরা বিনষ্ট করে।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘...আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিসহিস করে ছড়িয়ে পড়ছে। অ্যাসেম্বলি হল ও পাঠাগার আগুনে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। পাশের রেল সড়কের বস্তিও জ্বলছে।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান, পৃ. ৭০)। পরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় অবাঙালি সন্ত্রাসীদের লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। ছাত্রদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে অনেক বই ও নোটও লুটের শিকার হয়।
সময় গড়ালে একসময় মুক্তিকামী বাঙালি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মে-জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হামলা শুরু হয়। জুলাই-আগস্টের বর্ষাকালে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জলের রাজা বাঙালি যোদ্ধারা বর্ষার নদী, খাল ও প্লাবন ভূমিতে গেরিলা হামলা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ধারাবাহিকভাবে বিপর্যস্ত করতে থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং ভারতে আশ্রিত লাখ লাখ শরণার্থীর অমানবিক দুঃখকষ্টের কথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক—পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠী বিশ্বকে এমনটা বোঝানোর জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করে। এর অংশ হিসেবে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর কোনো পরিবেশই তখন ছিল না। শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিল, বই ও রিডিংরুম ধ্বংসপ্রাপ্ত। হলগুলোতে ছাত্র বসবাসের পরিবেশ তৈরি করার জন্য ১৬ জুন ১৯৭১, উপাচার্যের কক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উঠে আসে যে সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের পরিবেশ কোনোভাবেই ছাত্র বসবাসযোগ্য নয়। এ জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে অনুরোধ করা হয়। (সূত্র : ড. রতন লাল চক্রবর্ত্তী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৪৭-১৯৭১), দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬৪৬) এ বিষয়ে জুলাই মাসে মর্নিং নিউজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতেও কিছু তথ্য পাওয়া যায়। চিঠিটি ছদ্মনামে পাকিস্তানপন্থী কোনো ছাত্র অথবা সেনা কর্তৃপক্ষেরই লিখে পাঠানো; তারপরও চিঠিতে শিক্ষার্থীদের বই ও নোট ধ্বংসের কিছু সত্য বেরিয়ে আসে। সেখানে ‘মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলসমূহে সংঘটিত ঘটনায় সব শিক্ষার্থীর বই ও নোট সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব গ্রন্থাগারে হামলা ও লুট
২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩২ নম্বর বাড়িতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি ধ্বংস ও লুটপাটের শিকার হয়। গ্রন্থাগারের মূল্যবান বইগুলোর প্রতি অকৃত্রিম দরদ ছিল শেখ মুজিবের; এর তীব্রতা অনুভব করা যায় তাঁর বয়ানেই। স্বাধীনতার পর সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘...বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে।...আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।’
এ নিয়ে দুঃখবোধ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবেরও। গ্রন্থাগার আক্রমণের শিকার এবং মূল্যবান বই লুট হওয়া প্রসঙ্গে বেগম মুজিব ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...জেলের সিল দেওয়া অসংখ্য বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিতে পাঁচটা-ছটা আলমারি বোঝাই বই ছিল। তার মধ্যে ছিল বিশ্বকবির অনেক অমূল্য বই। বঙ্গবন্ধু নিজেই ওগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। গত বছর হানাদার বাহিনী আলমারিসুদ্ধ বই লুট করেছে। বাইরের ঘরে রবীন্দ্রনাথের যে বিশাল প্রতিকৃতি ছিল, হানাদার বাহিনীর বুলেটের কবল থেকে সেটাও রক্ষা পায়নি। কবিগুরু, দেশবন্ধু ও নজরুলের যে মূর্তিগুলো ছিল, হানাদার বাহিনী সেগুলোও নিয়ে গেছে।’ (দৈনিক বাংলা, ৮ মে ১৯৭২)
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগারের কিছু বই ফেরত পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থাগারের লুট হয়ে যাওয়া বই ফেরত দিচ্ছেন ঢাকা কলেজের লেকচারার বেগম শাবানা। এদিন তিনি রবীন্দ্র রচনাবলীর ১৭টি খণ্ড বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা লুট হওয়া বইগুলো সদরঘাটের ফুটপাত থেকে কিনে যত্ন করে রেখেছিলেন শিক্ষক বেগম শাবানা। সে বছরের ২৯ মে দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় প্রকাশিত অপর এক ছবিতে দেখা যায়, হারুনুর রশিদ নামের একজন হকার অনেকগুলো বই বঙ্গবন্ধুকে ফেরত দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু আবেগে হকার হারুনকে জড়িয়ে ধরেন। ২৫ মার্চে শেখ মুজিবের গ্রন্থাগার লুট হওয়ার পর হারুন বইগুলো কিনে যত্নে রেখে দেন। সহজেই অনুমেয় যে, বঙ্গবন্ধুর লুট হওয়া বই ঢাকার ফুটপাতে কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।
ঢাকার রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাগার ও রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগারে হামলা ও লুট
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের রোনাষলে পড়েছিল পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ঐতিহ্যবাহী রাজা রামমোহন রায় গ্রন্থাগার। ১৮৬৯ সালে (কোথাও কোথাও লেখা আছে ১৮৭১ সাল) প্রতিষ্ঠিত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্মৃতিধন্য লাইব্রেরিটির সংগ্রহ ২৫ মার্চ রাতে এক হামালায় ধ্বংস হয়ে যায়। ওই রাতে গণহত্যার পর পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্ম সমাজ ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এরপর লুটপাট করা হয় মূল্যবান বই, পত্রিকা ও অন্যান্য সংগ্রহশালা। এমনকি পাঠাগারটির দরজা-জানালা পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায় লুটেরারা।
১৯৭২ সালের ১০ মে দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেক দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহসহ এখানে ২০ হাজারেরও বেশি বই ছিল। আড়াই শ বছর আগে খ্রিস্টান মিশনারীরা ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলা অক্ষরে যে বই ছাপানোর উদ্যোগ নেন, তার কয়েকটি কপিও ছিল এখানে। আরও ছিল রাজা রামমোহন রায়ের মুদ্রিত পুস্তকের প্রথম সংস্করণ, বেদান্ত দর্শন, পারসি ভাষায় লেখা তোফায়াতুল মোহাম্মাদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁদের সমকালীন অন্য লেখকদের রচনাবলির প্রথম সংস্করণ, গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কোরআন শরিফের প্রথম বাংলা অনুবাদ। এ ছাড়াও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা, ঢাকা নিউজ, বেঙ্গল টাইমস (বঙ্গভঙ্গের পর ইস্ট বেঙ্গল টাইমস নামে প্রকাশিত), তত্ত্ববোধিনী, তত্ত্বকোমুদি, শান্তি নিকেতন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, হিতবাদী, বসুমতি, বিচিত্রা ও ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রথম থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক বঙ্গদর্শন-এর মূলকপি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক পুনমুদ্রিত কপিও ছিল এই গ্রন্থাগারে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী ৫০ বছরের সরকারি সব গেজেট। সমৃদ্ধ ও দুর্লভ সংগ্রহশালা থাকায় এখানে শিকাগো ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে এসেছিলেন।
১৯৭১ সালের হামলায় রাজারাম মোহান রায় গ্রন্থাগারের কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি। মূল্যবান বই ফুটপাতে ও গুদামে কেজি দরে বিক্রি হয়। এমনকি এখানকার বই ও পত্রিকার পাতা দোকানের ঠোঙা বানানোর কাজেও ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে লুট হওয়া বই কেউ সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে থাকলে তা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত গবেষক বদরুদ্দীন উমরের হাতে পৌঁছানো একটি বই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে তিনি ফেরত দেন। কিন্তু গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বইটি ফেরত না নিয়ে শুভেচ্ছাস্মারক হিসেবে তাঁকেই আবার উপহার দেয়। এ নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্য, সুবর্ণ প্রকাশের প্রয়াত আহমেদ মাহফুজুল হক জাহাঙ্গীর বইটি সদরঘাট থেকে সংগ্রহ করে তাঁকে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি বইটি সংরক্ষণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনা, তাদের এ দেশীয় দোসর এবং অবাঙালি লুটেরাদের দ্বারা ঢাকার আরও পাঠাগার এবং অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ধ্বংস ও লুটপাটের শিকার হয়। হানাদার বাহিনীর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ‘রামকৃষ্ণ মিশন পাঠাগার’। ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনে ৩৫ বছর কর্মরত ছিলেন বর্তমানে চাঁদপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী স্থিরাত্মানন্দ। লেখককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘একাত্তরে রামকৃষ্ণ মিশনে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। ওই সময় গ্রন্থাগারটি লুট হয়। স্বাধীনতার পর গ্রন্থাগারের কোনো বই কারও কাছে থেকে থাকলে ফেরত দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ সময় অনেকে বই ফেরত দিয়ে যান। বিভিন্নভাবে পাওয়া বইগুলো মিশনের ভক্তদের কেউ কেউ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। পরে আরও বই কিনে গ্রন্থাগারটিকে সাজানো হয়।’
ঢাকার বাইরে গ্রন্থাগারে হামলা ও লুট
ঢাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও হানাদার বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল। এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও বই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, মধ্য এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে। শহীদ মিনার ও গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ফলে এর মূল্যবান বই ও সংগ্রহশালা চুরি ও ধ্বংস হয়। গ্রন্থাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে গ্রন্থাগারে ৩০ হাজারেরও বেশি বই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা এখানকার হাজার হাজার বই রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে।
মুক্তিযুদ্ধকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গণগ্রন্থাগারও লুটপাটের শিকার হয়। সমৃদ্ধ গণগ্রন্থগারের দ্বিতীয় তলায় ছিল পাকিস্তানি মেজর আব্দুল্লাহর মার্শাল কোর্ট। আটক অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে অকথ্য নির্যাতন এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরমধ্যে কুমিল্লার দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার ও ছাত্রনেতা নজরুল ইসলাম অন্যতম। পরে ২১ নভেম্বর নজরুলকে হত্যা করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কবি ও গবেষক জয়দুল হোসেন জানান, লুট হওয়া গ্রন্থাগারের মূল্যবান অনেক বই স্বাধীনতার পর জেলা শহরের ফুটপাতে বিক্রি হয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি বই কিনে তিনি সংরক্ষণ করেছিলেন। সেগুলো এখন আর তার কাছে নেই।
চাঁদপুর টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে। এটি নির্মিত হয় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুদানে। এরপর টাউন হল তৎকালীন মহকুমা চাঁদপুুুরের রাজনৈতিক সভা ও রাজনীতি চর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। টাউন হলে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুর্লভ সংগ্রহশালায় সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিতে সেগুন কাঠের ২২টি আলমারি বইয়ে পূর্ণ ছিল। এটি শুধু গ্রন্থাগারই ছিল না, চাঁদপুর মহকুমার জ্ঞানচর্চার প্রধান জায়গা ছিল। এখান থেকে পুরো চাঁদপুরের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। ১৯৭১ সালে লাইব্রেরির সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট বিমল বাবু। ভাষাসংগ্রামী, রাজনীতিক এবং চাঁদপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত সৈয়দ আবদুস সাত্তার ছিলেন এর সম্পাদক ও লাইব্রেরিয়ান। অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তারের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের দান করা বহু দুষ্প্রাপ্য বাংলা ও ইংরেজি বই ছিল লাইব্রেরিতে। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকা থেকে লাইব্রেরির জন্য বহু মূলবান বই সংগ্রহ করেন। তখন টাউন হল লাইব্রেরির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অজয় ভৌমিক। লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, টাউন হল লাইব্রেরি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের স্মৃতিবিজড়িত। এখানকার লাইব্রেরিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আইনস্টাইনের বইয়ের আদি সংস্ককরণসহ দুর্লভ অনেক গ্রন্থ ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাঁদপুর সরকারি কলেজে ঘাঁটি স্থাপনের পর তাদের এ দেশীয় দোসর-রাজাকারদের দৃষ্টি পড়ে টাউন হলের ওপর। রাজাকাররা টাউন হলকে টর্চার সেল বানায়। মুক্তিযোদ্ধা অজয় ভৌমিক বলেন, ‘টাউন হলে স্থাপিত ঘাঁটি থেকে রাজাকাররা যাবতীয় অপকর্ম পরিচালনা করত। পরে টাউন হল লাইব্রেরি তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। কারণ মুক্তবুদ্ধি, স্বাধিকারের যে আলোচনা ও পুস্তকগত জ্ঞানচর্চার ঠিকানা ছিল এটি। তারা জানত যে, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হয়। সেই লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি ধ্বংস করে। একই উদ্দেশ্যে আমাদের চাঁদপুর টাউন হল লাইব্রেরির মহামূল্যবান বইগুলো কিছু সের ধরে বিক্রি করে দেয়। কিছু বই বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে নেয়। মোটকথা, লাইব্রেরিটিকে শূন্য করে দেওয়া হয়।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লাইব্রেরির সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুস সাত্তার চাঁদপুর ছেড়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর চাঁদপুরে ফিরে এসে তিনি টাউন হলে যান। কিন্তু টাউন হল লাইব্রেরি তখন গ্রন্থশূন্য। তবে খালি আলমারিগুলো ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের লক্ষ্যই ছিল মূল্যবান গ্রন্থ, যেগুলো সরিয়ে ফেললে বাঙালির জ্ঞানচর্চাকে আঘাত করা যাবে। তাই আলমারিগুলো অক্ষত রেখে যায়। স্মৃতিকথায় অধ্যাপক সাত্তার লেখেন, ‘...টাউন হল লাইব্রেরির দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান বইগুলো হয়তো আর কখনো সংগ্রহ করা যাবে না। সেই ক্ষতি অপূরণীয়। মূর্খ রাজাকাররা চিরকালের জন্য চাঁদপুরবাসীকে মহাসম্পদ থেকে বঞ্চিত করল। কী কী বই লাইব্রেরিতে ছিল, তাও আর কোনো দিন জানা যাবে না। কারণ পুস্তকের তালিকাসহ সমস্ত খাতাপত্রই তারা বিক্রয় করে দিয়েছিল।’ (অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুস সাত্তার, আমার জীবন আমার দেশ, পৃ. ৩৫৪-৫৫)।
শুধু গ্রন্থাগার ও বই-ই নয়, বাঙালির শিক্ষাব্যবস্থাকেও ধ্বংস করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল হানাদার বাহিনী। শুধু বগুড়া জেলায়ই একটি ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধকালে জেলার ৬টি ডিগ্রি কজেসহ মোট ১৭টি কলেজই হানাদার সেনাদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবাঙালি ও স্থানীয় দোসর-রাজাকারদের সহায়তায় কলেজগুলোর লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞান যস্ত্রপাতি, পাঠাগারের বই ও অন্যান্য জিনিসপত্র লুট ও ধ্বংস হয়। এছাড়াও জেলার ১২৪টি হাইস্কুলে লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। এখানকার ৩৩টি মাদ্রাসাও পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক এবং গ্রন্থাগার বিষয়ক লেখক মো. রাশিদুজ্জামানের ‘বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থপ্রীতি ও ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা’ শিরোনামের লেখায় এ-বিষয়ক একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। সেখানে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধকালীন ৯ মাসে সারা দেশে ৭১৯টি জুনিয়র স্কুল, ১৯৪টি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ৩৭টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুল, ১৪৮টি বেসরকারি কলেজ, ৮টি শিক্ষাবিষয়ক সরকারি অফিস, ৭টি পিটি ইনস্টিটিউট, ২৬টি সরকারি কলেজ, ২১টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১৬টি কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট এবং ৩৫টি বৃত্তিমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দখলদার পাকিস্তাানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা যেভাবে বই ও গ্রন্থাগার ধ্বংস করেছিল, তা থেকে বোঝা যায় যে তারা কেবল বাঙালিকে হত্যা নয়, জ্ঞানচর্চার প্রধান ক্ষেত্রের ওপরও সুচিন্তিভাবেই আঘাত করেছিল। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ৬৪টি জেলার তথ্য সংগ্রহ করা হলে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই অনালোচিত এই অধ্যায় নিয়ে বিস্তৃত কাজ ও তথ্য নিশ্চিতভাবে সংশ্লিষ্ট গবেষকদের কাজে লাগবে। তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবেন মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালির জ্ঞানচর্চাকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলোর বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে যুক্ত হবে।
লেখক : গবেষক এবং সাংবাদিক