দ্বিতীয় কিস্তি

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে

আকিমুন রহমান প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২৩, ০৩:৪৬ পিএম
সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে ২

২. সেই সন্ধ্যাটা যেভাবে তার সন্ধান দেয়
 

কিন্তু সেদিন, সেই সন্ধ্যা হয় হয় বিকালে, জোবেদা বেগম বাসে উঠে দেখে যে অদ্ভুত ঘটনা। মহিলা সিটগুলো মহিলাযাত্রী ঠাসা। উল্টা কিনা ছাড়া ছাড়া একটা-দুটা করে করে সিট, খালি পড়ে আছে পুরুষ-বেটাদের ওই দিকে। ধুত্তুরি তর সিটে খ্যাতা পুড়ি। জোবেদা বেগম ভেতরে-ভেতরে, বিরক্তি আর চেতে, অল্প-খানিকটা খনখনায়। থাকলে থাকুকগা খালি! কিন্তু ওই দিকে কে যায় মরতে! জোবেদায় তো যাইবোই না! তখন সে মহিলা সাইডের একটা সিটের পাশে গিয়ে ভাওমতো দাঁড়ায় এবং সিটের মাথার দিকের লোহার হাতলের মাথাটার একটু অংশকে পোক্তরকমে ধরে নেয়। যাক এখন বাস, যেতে থাকুক। এখন যত দূর পর্যন্ত দরকার পড়বে, জোবেদা বেগম দাঁড়িয়েই যেতে থাকবে। এমতেই মন স্থির করে নেয় সে। কোনো না কোনো স্টপে গিয়ে কি আর একটা কোনো সিট খালি হবে না? এইখানে এইভাবে দাঁড়ালে একটা বেশ সুবিধাই আছে। পরের কোনো-না-কোনো স্টপেজে যখন মহিলা যাত্রীদের কেউ একজন নামতে যাবে, তখনই সে ধুপুস করে সিটটা দখল নিয়ে নিতে পারবে। অতি সহজেই পারবে। সেই হিসাব মাথায় রেখেই, সে দাঁড়িয়ে থাকা। 


তবে সেই বিকালে সেই বাসের কন্ডাক্টরটার কী হয়, সে এই লেডিজরে কোনো একটা সিটে বসায়ে দেওয়ার জন্য কেমন জানি ঠ্যাঁটামি শুরু করে। অন্য অন্য বাসের কন্ডাক্টরেরা তো প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে তুলতেই লাতাফাতা হয়ে যেতে থাকে। কোন প্যাসেঞ্জারে বসল, কোনজনে খাড়া হয়ে থাকল, সেটার তদারকির টাইম তাদের কই! না, এই বিষয়ে তাদের কোনো গরজ পেতে দেখা যায়। ভাড়া আদায় করা ছাড়া আর কিছুর ধার তো তাদের কোনোজনেরে ধারতে দেখা যায় না।
 

কিন্তু এই কন্ডাক্টরটার আজকা এখন কী হলো! সে জোবেদা বেগমের দাঁড়ায়ে থাকাটাকে যেন বরদাস্ত করবে না বলেই কিরাকসম কেটে ফেলেছে। সেই কারণেই যেন সেই লোকে এই লেডিজের দাঁড়ায়ে থাকা নিয়ে কটকটানি আওয়াজ দেওয়া শুরু করেছে। “এই আফা! এই! আফনে হুদাহুদি খাড়াইয়া থাকতাছেন কেইল্লেগা? ওই ত্তো, বেটা প্যাসেঞ্জারগো সাইডে দুনিয়ার সিট খালি! হেটির কোনোটাতে গিয়া আফনে বইতাছেন না ক্যান? যান যান! বন গা অইনে।” এমত নির্দেশ-বুঝব্যবস্থা করতে করতে সে নানান দিকের ভাড়া আদায় করতে থাকে। আর জোবেদা বেগম কন্ডাক্টরের কথাগুলা না-শোনার ভাব করে দাঁড়ায়েই থাকে। আর, লেডিজ সিটের হাতলটা নানামতে শক্ত করে ধরে থাকার চেষ্টা চালাতে থাকে। “আরে লেডিজ! আফনে হোনেন না কী কইতাছি? চক্ষের সামোনে ওই ত্তো, এক লগের দুই সিটের দোনোটাই খালি পইড়া রইছে। আফনেরে তাইলে কেটায় কইছে খাড়ায়া থাকতে? আফনে গিয়া অইনে বইলেই ত্তো হয়। আহেন আহেন?” ভাড়া তুলতে তুলতে বাসের পেছনের দিকে যেতে যেতে কন্ডাক্টরে, জোবেদা বেগমের বসার ব্যবস্থা দেওয়ার জন্য একেবারে যেন মাথা-গরম অবস্থায় চলে যায়!
 

‘এই বেটাটায় অখন জোবেদার লগে এমুন বিটলামি ক্যান করতাছে? জোবেদায় কি তারে কইছে সিটের কতা? দে শান্তি মতন এই লেডিজ সিটগিলির কাছে খাড়াইয়া থাকতে! তারবাদে বইবো নে জোবেদায়, তার ভাও মতন! তুই বেটা এমন খটর খট্টস করতাছস কী কারণে?’ মনে মনে কন্ডাক্টরটাকে এমন শতজাতের আবজাব মন্দ ঝামটা দিতে থাকে জোবেদা বেগম, কিন্তু সেই লোকের ডাকাডাকি তো বন্ধ হওয়ার নাম নাই! “আহেন আফনে! এইদিগে আহেন! একটা লেডিজ হইয়া, এত্তা রাস্তা খাড়াইয়া থাইক্কা যাওন যায় নিহি? আহেন এইনে! পিছের এই খালি সিটে আইয়া বহেন। এমনে খাড়াইয়া থাকোনের কামডা কী!”
 

জোবেদা বেগম কতক্ষণ আর কন্ডাক্টরের ওই কটরমটর কথা আর উপকার করতে চাওয়ার ঠেলা-ধাক্কারে না-শোনার ভঙ্গি করে থাকবে? কতক্ষণ অমনটা করে থাকা যায়! কন্ডাক্টরের উঁচা গলার ডাকাডাকি এট্টু নি বন্ধ হয়! একটুও তো হচ্ছে না। ওদিকে পুরুষ প্যাসেঞ্জারগুলার কারবারটা দেখো। সব কয়জনের সবগুলা চোখ গটমটায়ে তাকান্তী দিয়ে আছে জোবেদা বেগমের দিকে। আছে তো আছেই। একটুও তো সেই চোখগুলা আর জোবেদা বেগমের দিক থেকে সরে যাওয়ার নাম করছে না! আবার এই যে লেডিজ সিট, এইগুলার মহিলাগুলোরও বা কী ব্যবহার! তারাও ইতিপিতি তাকান্তী দিয়ে আছেই জোবেদার দিকে। আরে! এই সব কী! এমনে তাকায়ে থাকার আছে কী! সিটের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ায়ে থাকতে চেয়ে জোবেদা বেগমে একটা মস্ত অন্যায্য কর্ম করে ফেলছে নাকি! ধুর! এতগুলা চক্ষের মিটমিটা পিটপিটা চাউনি! সহ্য করা যায় নাকি! কতক্ষণ সহ্য করা যায়! ধুত্তুরি!


অগত্যা জোবেদা বেগম ওই ফাঁকা সিটের দিকে আগান্তী দেয়। অফিস-ছুটির টাইমে, পেছনের দিকে একসাথে পাশাপাশি দুই-দুইটা সিটই এমন ফাঁকা পড়ে আছে! আশ্চর্য না? বিশ্বাস করা যায়! আশ্চর্য! সেই ফাঁকা সিটের একটাতে কোনোরকমে একটু বসে পড়তে পারলেই শান্তি। জানালা-ঘেঁষা সিটটাতে জোবেদা বেগম নিজেকে চেপেচুপে বসিয়ে নেয়। এই খালি থাকল এখন পাশের সিটটা। সেইটাতে এখন যে এসে বসে, বসুক গা। কতক্ষণের ব্যাপার আর। মহিলা সিট ফাঁকা হওয়ার লক্ষণ দেখামাত্রই তো সে ছুটবেই ওই দিকে। সমস্যা নাই তো কোনো। এই সব ভাবনা নিয়ে সিটে বসে সে। শরীরটা এইমতে তখন কিঞ্চিৎ সুস্থিরতা পায়, কিন্তু তার মন একটুও শান্তিতে থাকে না। তার মন কিনা শুধু পরের স্টপের জন্য হায়হুতাশ চালাতে থাকে। আজকে কতক্ষণ না জানি লেগে যায়, পরের স্টপটায় পৌঁছাতে! কোনো মহিলা কি আর নামবে না সেই স্টপে? লেডিজ সিট খালি হবে তো সেইখানে?


তবে পরের সেই স্টপে যে কখন গিয়ে পৌঁছাবে এই বাস, সে কথা কেউই একটু আন্দাজও করতে পারবে না। সেটা করার কোনো উপায় নাই। রাস্তা যদি ঝাড়া-সিধা জ্যামছাড়া হতো, তাইলে হয়তো লোকে বলত, পৌঁছাতে এই তো দশ মিনিট লাগবে! নাইলে লাগবে আধা ঘণ্টা! কিন্তু এই দিকের রাস্তায় কী জ্যামের জ্যামরে আল্লা! বিকালে যেন দুনিয়ার গজবটা নামে শুধু এই রাস্তাটাতেই। জ্যাম লাগার গজব!
জোবেদা বেগমের অফিস-ঘেঁষা যেই বাসস্টপ, সেটার নাম নতুনবাজার। সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার তোলার পরে, বাসকে আর গড়গড়িয়ে চলা লাগে না! চলতে হয় ধক্কুর ধক্কুর ঠোক্কর খেতে খেতে। চলতে থাকতে হয় এই এক পা এক পা করে করে। এই শেষ বিকালের টাইমের এই যে রাস্তাটা! দেখো দেখো কী চলে এইখানে রোজ! রাস্তার সামনে পেছনে বাঁয়ে-ডাইনে, সোজা-বাঁকা-তেরছা করে করে, এই টাইমে রোজ ঠেলাগাড়ি, পিকআপ ভ্যান, রিকশা, বেবি ট্যাক্সি, সাইকেল, হোন্ডা, ভেসপা, মিনিবাস, ট্রাক, লরি, ডবল ডেকার, প্রাইভেট কার আর বাসকে বাস পড়ে থাকে। এইটার ঘাড়ে যেন সেইটা চড়ে থাকে। ওইটার ভেতরে যেন এইটা ঢুকে থাকে। প্রতিটা গাড়িই কিনা নিজে আগে যাবে বলে কঠিন এক কসম যেন খেয়ে থাকে। কোনোটই কোনোটারে এক ইঞ্চি জায়গা দিতে রাজি থাকে না। ব্যস! দেখো গা তখন কী হয়! তখন কোনোটারই আর যাওন লাগে না। থাক এখন, সব কয়টায়ই আটকান্তীতে পড়া থাক। এইমতে সকল গাড়িই, সেই টাইমে, নিত্যিই থাকে ল্যাবাজ্যাবা আটকা পড়া দশায়। 


এক মিনিট যদি দুই কদম আগানোর কিসমত হয় কোনোটার, তো সেইটারে আবার তারপরেই তবদা দিয়ে বসে থাকতে হয় কমসে কম বিশ মিনিট। এমনই চলে এইখানে, রোজ। রোজ। বিকালের অফিস-ফেরতা লোকেরা রোজ এমন রাস্তারেই পায়। রোজকার মতো সেদিনও, ওই সন্ধ্যা হয় হয় মরা-বিকালে নিত্যিকার জ্যাম-ফ্যাঁসে পড়ে, আপড়-ফাঁপড় করতে থাকে জোবেদা বেগমে। আর অপেক্ষা করতে থাকে পরের স্টপের জন্য। অন্যদিন মাঝপথের কোনো স্টপের জন্যই কোনো ভাবনা-গরজ থাকে না তার। অন্য কোনো স্টপ থাকলে কি, না থাকলেই-বা কি! তারে তো নামতে হবে একেবারে সেই কিনা লাস্ট স্টপে। আর কিনা সে বসে আছে একটা লেডিজ সিটেই। তাইলে দুনিয়া এখন থাকুক গা, নাইলে মরুক গা! জোবেদা বেগমের সেই দিকে খেয়াল দেওয়ার কোন দরকার! অন্যদিন তার মন আর তার শরীরটা—ঠিক এমত এক ভাবনা নিয়ে আরামসে রাস্তা পার হতে থাকে! 


কিন্তু এই যে এই শনি-লাগা কুদিনে, এই যে কুফায় ধরা এই নিভুন্তী নিভুন্তী বিকালে; তার তো তখন পরের স্টপগুলার জন্য উতলা-বেতালা না থেকে কোনো উপায় নাই! নাই নাই! কোনো স্টপে একজন কোনো মহিলা প্যাসেঞ্জারে, নামার উদ্যোগ নেওয়া মাত্রই তো তাকে উড়ে গিয়ে পড়তে হবে বাসের ওই সামনের দিকে! তবেই তো খালি সিটটাতে বসার চান্স সে পাবে! নাকি? সেই চান্সটা পেতে কত দেরি হবে তার?
জ্যামের মধ্যে একটু-অল্প চলতে থাকা, আবার পরের মুহূর্তেই হার্ড ব্রেক করে করে থেমে যেতে থাকা বাসটা, এই যে রাহবার যেটার নাম, সেটা কিনা ঝক্কুর ধুম, ধুপ্পুর ঝক ধাককা ও ঝাঁকি খেতে থাকে অন্য অন্য দিনের মতোই। ওই ঝাঁকির ঝাপটায় ঝাপটায় ছেটকা-লেটকা হতে হতে, সেদিনও জোবেদা বেগমের ঝিমুনি আসতে থাকে অন্য অন্য দিনের মতোই। এই যে বাসে নিজেরে সেঁটে ফেলতে পারার পরে, আধাখেঁচড়া একপ্রকারের ঝিমুনি পায় জোবেদা বেগমের, সে জানে যে এই ঝিমুনি পাওয়ার মতো উপকারী আর কিছু নাই তার জন্য! অন্তত অফিস-ফেরতা টাইমে বড় কাজে দেওয়া এটা। রাস্তায় এখন থাকুক ট্রাফিক জ্যাম। নাইলে থাকুক গা দুই লাখ বছরের সমান সময়ের সিগন্যাল। নাইলে থাকুক গা বাসযাত্রীদের গোঙানি, কাতরানি, শ্বাসকষ্টের ফোঁপানি! থাকুক গা ওই সব! কিন্ত ওই সবের একটা কিচ্ছুর সাধ্য নেই তাকে ছোঁয়! 
কেমনে ছোঁবে? জোবেদা বেগমে কি হুঁশে আছে যে ওই সব কিছু তারে কাতর করে তুলতে পারবে? সেই জন্যই না প্রতি বেলায় ঝিমাতে পেরে, বোধ ও সাড়া-নড়াহীন হয়ে যেতে পেরে, বাসে তার রোজ খুব শান্তি শান্তি লাগতে থাকে! তবে এই শেষবেলার এই দিনের পরিস্থিতি তো তার জন্য ভিন্ন। সে সেদিন, নিজের শরীরটাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে যে আজ সে মহিলাসিটে নেই। তাই এই এক্ষন, একটুখানি বসতে পেছে বলেই, ঝুম ঝিমুনি দেওয়া চলবে না। কিছুতেই চলবে না। একটা মহিলাসিটে নিজেকে সেঁটে দেওয়ার সুযোগ পাবার এক গুরুতর ঠেকায় আছে সে এখন। ঝিমুন্তীতে গেলে, সেই সুযোগটারে সে ধরবে কেমনে? 
এই বিষয়টা সে অতি স্পষ্ট করে বুঝলেও, তার শরীর দেখো তার শাসানিকে একটু কিছুর পাত্তা দেয় না। পরোয়াও করে না। তার বাস রাহবার, যেই ট্রাফিক জ্যামের ভেতরে ঢুকে ধুস্তাধুস্তি শুরু করে; জোবেদা বেগমের চোখ-মুখও তখন পাতলা ধাঁচের একরকমের ঝিমুনিকে ডাক পেড়ে আনতে থাকে। 


যদিও সজাগ থাকার জন্য, জোবেদা বেগমের ভেতরটা একেকবার ধড়ফড়িয়ে উঠতে থাকে; কিন্তু পরক্ষণেই নেই হয়ে যেতে থাকে সেই ধড়ফড়ানি। পলকেই কিনা ধীর স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকে তার চোখ। চোখের পাতারা ছুপুত করে নেমে এসে চোখ ঢেকে ফেলতে থাকে। তাকাবার কোনো বাসনাই আর থাকে না জোবেদা বেগমের শরীরে। আর, তার মাথাটা টল-টল্লাত করতে করতে কাত হয়ে যেতে থাকে। আবার আচমকাই ধড়মড় জাগনা পেয়ে যায় তার শরীর। আবার সে সোজা হয়ে বসে থাকার একটা উদ্যোগ নেয়। আবার ঢলে পড়তে থাকে চোখের পাতা। আবার।


এইভাবে চলতে চলতে জোবেদা বেগমের শরীর, হঠাৎই একটা উচ্চ ধাক্কা পেয়ে যায়। বাসের কড়ারকমের হার্ডব্রেকের ধাক্কা। সেই ধাক্কাখানা জোবেদা বেগমের সমস্তটা শরীর থেকে ঝিমুনির চটকাটাকে এক ঝটকায় নাই করে ছাড়ে। ধুড়ঘুর করে নিজের কাত মাথাটাকে সোজা করে নেয় সে। দেখো রে! বিকালটা আর আসমানে নেই। সন্ধ্যাটা জানি কোন সময়ে হুড়মুড় করে নেমে এসেছে! জোবেদায় সেটা টেরও পায় নাই। ওই তো সন্ধ্যায়, বাসের বাইরের দুনিয়াটারে অল্প-আবছা অন্ধকারও করে দিচ্ছে। দেখো তো! 
বাস কি আগায় নাই নাকি? বাস দেখি থামুন্তী দিয়েই আছে! আগানী দেওয়ার একটুও কোনো ফাঁক কি বাসে পায় নাই তবে? নাইলে কেমনে কী?


ঝিমুন্তীতে থাকা জোবেদা বেগমের শরীর টের পায়নি বটে, কিন্তু তখন জ্যামে গোত্তা খেতে খেতেও বাসটা পেরিয়ে এসেছে অনেক কয়টা স্টপ। মহিলা সিট খালি কী হয়েছে! জোবেদা বেগম দেখে যে, মহিলা সিট যেই ভরা ছিল সেই ভরাই আছে। হয়তো নেমেছে কেউ না কেউ। উঠেছেও। উঠে বসে গেছে তারা, খালি হওয়া সিটে। এখন! এখন কী হবে! এখন তো তাকে এইখানে; কুঁকড়ে-মুচকে, জড়োসড়ো একটা গুজুন্তী দিয়ে রয়ে যেতে হবে হয়তো আরো বহু বহুক্ষণ। হায় আল্লা! এইটা সে কী করেছে! কেন সে নিজের ঝিমানিরে আটকান্তী দিতে পারে নাই আজকা! এইটা করল কী সেয়! ওহ! 


বাসের ভেতরে গাদাগাদি দাঁড়ানো পেসেঞ্জার কি এখন একটা দুটা? না না! অনেক অনেক। সেই কাশি, সেই চাপা কাতরানি, সেই হাঁচি ও রক্তের ছিটা উড়ে আসা নিয়ে নির্বিকার লোকসকল—বাসের মাথার দিকে লটকানো রড ধরে খাড়া হয়ে আছে। একজনের পিঠের ওপরে আরেকজন। আরেকজনের ওপরে অন্য আরেকজন। জোবেদা বেগম যখন এই দিকে বসতে আসে, তখন বাসের মাঝখানের ওই চিলতা জায়গাটা ছিল পুরা ফাঁকা। এখন দেখো, সেইখানের সবটা জুড়ে লোকের ওপরে লোক। বেশুমার লোক। লটকা-পটকা করে করে তার সকলে খাড়া হয়ে আছে। এই এত লোকরে ঠেলে পরে, জোবেদা বেগম কেমন করে সামনের মহিলা সিটের দিকে যাবে! সেটা তো হয়ে উঠেছে পুরাই অসম্ভব একেবারে! 


এই চিন্তায় থাকতে থাকতেই জোবেদা বেগম নিজের মাথা ও মুখে দুই ঝটকা তপ্ত লালা ও রক্তের গুঁড়াগাঁড়া ছিটার বাড়ি খায়। ঝিমঝিম করা ধরে তার শরীর। এত যে কষ্ট পাওয়ার মধ্যে আছে এই মানুষগুলা। এর শেষ নেই কোনো! ওষুধটা, সেই আসল ওষুধটা কবে আসবে? কবে লোকগুলা নিস্তার পাবে! নাকি লোকগুলা জীয়ন্তে মরা হয়েই শেষ করবে নিজেদের জিন্দিগি। আহা রে!


এই অসুখটা এই কয় ঘণ্টার মধ্যে, তার ভেতরেও ঢুকে যায় নাই তো! তারও অসুখটা হয়ে যায় নাই তো! খোদা! জোবেদা বেগম নিজের ডর-শক্ত শীতল আঙুলেরে, কোনোপ্রকারে নাকের ছেঁদায় ঠেকায়। নাহ! আল্লাগো! তার নাক শুকনা ঝরঝরা। হয় নাই, এখনো হয় নাই তার, ওই অসুখটা। কী রক্ষা! কেমুন রক্ষা! এটা একটা ভারি অবিশ্বাস্য বৃত্তান্ত যে, তার দেশে মেয়ে ও পুরুষ লোকসকলের যত যত অসুখ হয়ে আছে; সেই সব অসুখের কোনোটাই এই পর্যন্ত তার হয় নাই। কিছুমাত্র হয় নাই। 


কেন হয় নাই কে জানে। হয় নাই, কিন্তু হতে কতক্ষণ! এই চিন্তায় চিন্তায়ই তো সে কাহিল হয়ে আছে আজকে, বহু বহুদিন ধরে। কেন, কোন তেলেসমাতির জোরে, জোবেদায় কোনো একটা আধি-ব্যাধির কামড়েরে এখনা পায় নাই; এই ভেদের মীমাংসাটা তারে কে দেয়! কে দেবে! একটা কোনো মুরুব্বিজন নাই তার। নিজের বলতে কেউ নাই। বহুদিন ধরেই নেই। কেউ নেই তো নেই-ই! জোবেদার যেমন কিসমতে লিখন, তেমনই তো পাবে সে। সেটাই পাইছে। আপনার বলতে কেউই তার নাই সত্য, কিন্তু নিজের বুঝ-বিবেচনাটা তো তার নিজের সঙ্গে আছে। নিজের সঙ্গে নিজে বুঝ করে করে অবশেষে জোবেদায় ফায়সালা পৌঁছেছে যে, এই যে তার অসুখ না হওয়া, এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় না। এইটা কিছুমাত্র ভালো লক্ষণ না। কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে লোকের কাছে মুখ খোলা তার একদম উচিত হবে না। বিষয়খানা একদম চেপে রাখাটাই হবে সত্যকারের বুঝদার লোকের মতন করা কাজ। জোবেদায় অই বুঝদার কাজটাই করে যাচ্ছে, ভালো মতনই করে যাচ্ছে। তবে সংসারের দশজনে যেখানে রোগে ভোগা, সেখানে একলা সে সুস্থ থাকলেই-বা কী! কী লাভ তাতে!


নিজের জিন্দিগির এই সব আগড়-বাগড় বিষয় নিয়ে থাকতে গেলেই; ডরে-ভয়ে একেবারে শেষ হয়ে যেতে থাকে জোবেদায়। থাকার মধ্যে এই দুনিয়ায় আছে সে একা নিজে। একলা একখান ছোট্টমোট্ট আধা হেলে-পড়া একখান বাড়ি তার আছে বটে। তবে সেই বাড়িতে বসত করে শুধু একজন। সেইটা সে নিজে। সে-ই বাড়িতে থাকে। সে-ই বাইরে যায়। সে-ই ফিরে আসে। আর একটা কাকপক্ষী পর্যন্ত তার নিজের বলে নেই।
কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বাসে ঘটলটা কী! এই যে জোবেদার পাশের সিটটা এমনে খালি পড়ে আছে, দাঁড়ায়ে-থাকা লোকদের একজন কেউও তো সেইটাতে বসতে আসছে না! একজনের, ওই তো—দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শ্বাসের গোলমালটা অতি জটিল হয়ে উঠল! বাতাস ভেতরে নেওয়ার জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে, খাবিজাবি খেতে খেতে, ঝুঁকড়ে কাত হয়ে দম যায় যায় অবস্থা হয়ে গেল সেই লোকের। কন্ডাক্টর তারে টেনে নিয়ে বসাল ওই যে ড্রাইভারের পাশের ঢাকনা দেওয়া ইঞ্জিনের ওপরে। সেই হাঁপ-ধরা লোকের দিকে অন্যরা যেমন নজর দিল না, কন্ডাক্টরও তো দেখি জোবেদা বেগমের পাশের খালি সিটটাকে একটুও আমলে আনল না। লোকটাকে এইখানে বসানো তো চলত! নাকি বাসের ভেতরে অন্ধকার জমাট হয়ে উঠতে থাকার কারণে কন্ডাক্টরে এই খালি সিটটাকে খেয়াল করতে পারেনি!


কিন্তু অন্ধকার তো এখনো এমন কোনো কালো ঘুটঘুট্টা রকমের হয়ে ওঠেনি যে আশপাশের কিচ্ছুই নজরে আসবে না! মাত্রই না সন্ধ্যা! আর অন্য যাত্রীরাই-বা কেউ বসতে আসে না ক্যান! এই সিট এমনে ফাঁকা পড়ে থাকছে ক্যান? কেন যে থাকছে, সেটা জেবেদা বেগম বুঝতে ব্যর্থ হয়। 
বাসের এদিকে-সেদিকে দু-চারজন প্যাসেঞ্জার বেদম কাশতে শুরু করে। ফুসফুসে ইনফেকশন বাঁধানো লোকদের অই কাশির দিকে খেয়াল দেওয়ার কিছু নেই। কাশতে কাশতে কিছুক্ষণ বেহুঁশ হয়ে থাকে তারা। তারপর আপনা-আপনিই জেগে ওঠে এই রোগীরা, সবখানে। কাশির ওই খটখট্টা আওয়াজের মধ্যেই আরেক প্রকার চিল্লানি জাগনা দিয়ে ওঠে বাসের ভেতরে। “ওই ওস্তাদ! ওস্তাদ! আজান দিতাছে কিন্তুক! আজান দিতাছে! হোনছেন, ওই মিয়া-ওস্তাদ! কতা কয় না দেহি। ওই ওস্তাদ!”
‘কুত্তা খাইয়া পাগল অইছস-হালার পো! এত্তাটি ডাক পাড়োন লাগেনি, সমুন্ধীর ঘরের সমুন্ধী!’ ঘড়াৎ করে অতিজোর এক কুঁদানি ছাড়ে ড্রাইভারে। আর তক্ষন তক্ষনই বাসের ভেতরের সকলকে, সাপটে ধাক্কা মারে, কী-জানি একটা কিছু!


সেই ঝাপটার চোটে অন্য সকলের কী হয়, জোবেদা বেগম বলতে পারবে না; কিন্তু সে টের পায় যে, সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। শুধু তার চোখের সামনে লাফাচ্ছে কালো গোল বল, শুধু কালো কালো গোল্লা গোল্লা বল। আর কিচ্ছু নেই তার আশপাশে, সামনে-নিকটে।


“ওই, ওই ড্রাইভার! লাইট নিভাও। লাইট নিভাও। জলদি নিভাও কইতাছি। প্যাসেঞ্জারগো ভোগান্তি দেওনের লেইগা-সন্ধ্যাবাত্তি দেওনের খায়েস হইছে তগো! আমাগো চোউখগিলিও নষ্ট করতে চাস তরা? হালার গুষ্টি! ওই, নিভা জলদি বাত্তি! শালার ঘরের শালা!” প্যাসেঞ্জার সকলের ধামকি-গরজানি শুনতে শুনতে অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতা, বন্ধ করে জোবেদা বেগম। আতকা আলোর ঝাপটাটা আসছে বলেই যে সেইটা তার চোখে সয় নাই; এইটা সে এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে। এখন, বন্ধ চোখ খুলে, এই যে সে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। লোকেরা ওই যে দাঁড়ানো, ওই যে সব কটা সিট প্যাসেঞ্জারে ভরা। এই তো দেখতে পাচ্ছে সে।


এই যে তার পাশের সিটটা! গোড়া থেকেই সেটা যেমন খালি ছিল তেমন খালিই তো এখনো পড়ে আছে। দেখতে পাচ্ছে তো সে সেইটা। নিজের দেখার শক্তিরে পরখ করা শেষও হয় না জোবেদা বেগমের; ড্রাইভারে ফুচ্চুত করে বাতিটা নিভায়ে দেয়। বাসের মধ্যে সুপুৎ করে লাফ দিয়ে নামে এত্তোটুকু একটু অন্ধকার। সেই আঁধারেই জোবেদা বেগম দেখে কী, তার পাশের সিটটা যে খালি, সেই কথা কে বলে? ওই তো, সেইখানে বসা আছে একজন। বসে আছে জুবড়ে-জাবড়ে। বড়ো কাঁচুমাচু জড়োসড়ো করে আছে সেই লোক, তার শরীরটাকে। যেন জোবেদা বেগমের শাড়ির সঙ্গেও তার ছোঁয়াটা না লাগে! 


এটা কী ব্যাপার! এই সিটে প্যাসেঞ্জার কখন বসতে এলো! কখন বসল! এই এক্ষন না সে দেখল সিটটা খালি! চক্ষের পলকে সেই খালি সিটে প্যাসেঞ্জার আসে কোত্থেকে! দাঁড়ানোর কেউই তো বসতে আগায়নি! কেউই না! তাইলে এই লোক কোত্থেকে আসে! হাবলা-ভ্যাবলা চোখে জোবেদা বেগম চেয়ে থাকে পাশের সিটে হঠাৎ দেখা দেওয়া যাত্রীটার দিকে। তার দেশের অন্য সকল বেটাছেলের মতো এই জনের কাঁধে আর পিঠেও শিথিল রকমে ঝুলে আছে একটা উড়নী। সেলাই ছাড়া লম্বা একখান উড়নী। ঘোলাটে, মরা মরা শাদা রং সেইটার। উড়নীর প্রায় সবটাই ঝুলে আছে সেই লোকের পিঠের দিকে। দোমোড়ানো কুঁচকানো, গরিবি দশাঅলা, ফকিন্নী রকমের একখান উড়নী। সেই লোকটা বসে আছে স্থির, সটান। আর সে চেয়ে আছে নিজের কোলের ওপরে আলগোছে ফেলে রাখা নিজের হাতের দিকে। 


বাসের ভেতরে ওই যে কত নড়ানড়ি, কত রকম অসুখের কত রকম শব্দ, বাসের হার্ড ব্রেকের কারণে কড়ারকমে ধাক্কা খেতে খেতে প্যাসেঞ্জারদের নানামতে চিৎকার দিয়ে ওঠা, এই যে জোবেদা বেগমের উসখুস চেয়ে দেখা, খুব নজর করে দেখতে থাকা ও হুটপুট নড়ে ওঠা—এসবের কোনো কিছুতেই যেন নেই এই লোক। এই সমস্ত কিছুর মাঝখানে সে, কিন্তু কোনোখানেই সে যেন একটুও নেই। কোনো সে নেই এইখানে! এই লোক কি নতুন রকম অসুখেপড়া কেউ একজন!


এই লোকের আসা এরং বসা-বিষয়ক রহস্যের মীমাংসা সাধনের জন্য জোবেদা বেগমের অস্থির লাগতে থাকে। তাজ্জব হওয়া জোবেদা বেগম চোখমুখ কুঁচকে দেখেই যেতে থাকে সেই লোককে। অভব্য একটা কাজ করে উঠছে সে, এইটা বুঝেও জোবেদা বেগমে অপলক তাকায়েই থাকে সেই লোকের দিকে। তার চোখদের কিছুতেই সে সরায়ে আনতে পারে না। এই লোকটারে একটু যেন কেমন অদেশি-ভিনদেশি লাগে! কে সে! তারে দেখতে এমন অ-আপন অ-আপনা, নিদয়া নিদয়া লগে ক্যান? একটু কেমন ভেজাইল্লা ভেজাইল্লা জাতের মনে হইতাছে কেনো এরে? তাইলে জোবেদা বেগম কেন এই লোকেরে ভালোরকমে দেখে চলবে না? জোবেদার চোরোখ সেই লোকেরে দেখেই যেতে থাকে। নিষ্পলক দেখেই যেতে থাকে।
অমন সময়ে এক আচরিত কারবার ঘটে। নিঃসাড় বসে থাকা সেই লোক, হঠাৎই, চোখ তোলে জোবেদা বেগমের দিকে। এত আচমকা, এত দ্রুত, এত ঝটপটান্তী সেয় জোবেদা বেগমের দিকে তাকায়ে ফেলে যে, জোবেদা তার নিজের চোখদের আর সেই লোকের ওপর থেকে সরিয়ে নেওয়ার এক ফোঁটা সুযোগ পায় না। যেন সেই লোকের বাঞ্ছাটাই ছিল জোবেদা বেগমের চোখে-চোখ রাখার। রাখে সে। তারপর এক পলকেরও কম সময়ের মধ্যেই সে লোক তার চোখ সরিয়েও নেয়। 


কিন্তু জোবেদা বেগম কী দেখে! ওই অত্তোটুকু সময়ের মধ্যে, ওই লোকের ওই অত্তোটুকু তাকানো! তাতেই জোবেদা বেগম স্পষ্ট ও গভীরভাবেই বোধ করে যে এমন চোখ সে কখনো, কোথাও, কোনো দিন তার এই জীবনে দেখেনি! সেই চোখের মণি সবুজ। জোবেদার দেশের লোকের মতন কালচে-খয়েরারঙা না সেই মণি! চৈত্র মাসের ঝলক-বলক রোদের মধ্যে উড়তে থাকা তেজী নতুন পাতা যেমন থাকে ঝলমল ঝলমল। যেমত চিক্বন সবুজে সবুজ থাকে; এই লোকের অক্ষির মণি একদম ওই রকম! গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে জোবেদা বেগমের। সে কী সত্য দেখল, না ভুল দেখল! ধন্ধে সে খাবিজাবি খেতে থাকে। কিন্তু আর একবারও যে সে ঘাড় ঘুরিয়ে-ওই আশ্চর্য লোকের দিকে তাকায়, সেই শক্তিটা সে আর পায় না। শীতল, হিম কঠিন, পাটা-পুতার মতন স্তব্ধ শরীর নিয়ে সে বসে থাকে। থাকেই।


বাস থেকে নেমে কালো, অন্ধকার, হু হু রাস্তায় থোম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে জোবেদা বেগম। সে রিকশা খুঁজবে কী, সে না কেবল কী সব আচানক কিছু দেখতে পাচ্ছে! সে না কেবল দেখছে যে সবুজ চোখেরা চেয়ে আছে তার দিকে! আসমান-জমিন ওপর-নিচ সবখান থেকে তার দিকে তাকায়ে আছে এক জোড়া সবুজ মণি! একবার দেখছে সে সবুজ দুই চোখ। একবার দেখছে, যে, চোখ কোথায়! ঝলকাচ্ছে নতুন পাতা, টিয়া রঙা পাতা। চৈত্র মাসের দুপুর দুপুরে। আর একেই তার মনে হয়েছে কিনা চোখ! তামশা কাকে বলে! 
কী দেখতে কী না-জানি দেখছে সে! কিন্তু তার মনের ভেতরে এমন কেমন হায় হায় করছে! জোবেদা বেগমের আজকে হলো কী! কেন তার পা চলতে চায় না বাসার দিকে! কেন মনে হচ্ছে, এইখানে এই নিরালা ফুটপাতের ওপরেই সে নিজেকে খাড়া করে রাখে, বাকিটা জিন্দিগি? এমন বাসনা হইতাছে কেন তার? এমনে করলে চলে! তার কে আছে যে, তার ভালো-মন্দটার খয়খোঁজ নেবে! নিজেরে না তার নিজেই আগলায়ে রাখতে হবে! কেন রে তুমি এমুন বেজাইত্তা রকমে উতলা হও পরান? এইটা তোমার কেমুন খাসলত! এমুন কইরো না পরান। এমুন করতে নাই। 


নিজেকে এমত রকমে বুঝটুঝ দিয়ে বাসায় আনে সে সেদিন। নিত্যিকার মতোই ঘরের নিত্যকর্ম করে-টরে ঘুমাতে যায় সে। রাত্রিও পার করে। সব করে চলে সে, একদম অবিকল অন্য অন্য দিনের মতোই। শুধু খুব ভোরবেলা, তার চিলতে উঠানটাতে পোতা নিমচারাটায় পানি দিতে গিয়ে স্তব্ধ বাক্যহারা হয়ে যায় জোবেদা বেগম। সে দেখে, মাত্র এক বছর বয়সী লিকলিকে নিমচারাটা ফুলে ফুলে এক্কাকার হয়ে গেছে। সবুজ শাদা মিহি গন্ধে থম থম করছে সুনসান উঠানটুকু। 


এই এক বছর বয়সী নিমচারাটায় তাহলে ঝেঁপে ফুল এলো? এলোই তবে? এই গরিবের গরিব, একার অধিক একা জোবেদা বেগমের কালেই কিনা এই ফুল ফুটতে হইল! হায় হায়! তবে তো সে এসে গেছে! সেই সর্বনাশায় তো তাইলে পৌঁছায়া গেছে গো! 


কচি নিমচারায় এমন আতকার ওপরে ফুল ফুটুন্তীর ঘটনাটা আর কিছু না; এইটা হইল সেই যমের এসে যাওয়ার চিহ্ন। এসে গেছে সে। অবশেষে! নানি গো! নানি। আইয়া পড়ছে গো হেইটায়। ফুলেভরা নিমচারার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে, ত্রাসে-ডরে থরথরাতে থাকে জোবেদা বেগম। 


জোবেদা বেগম জানে, ওই দয়াহীন সর্বনাইশ্যায় তার দেশে এসে পৌঁছুলে, কোন প্রলয় নামবে!