যে সমাজ অর্থলোলুপ, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত; যে সমাজে সহমর্মিতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাবোধ পলাতক; অনিয়ম ও নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতাই যেখানে নিয়মে পরিণত, সেই সমাজ অসভ্য ও বর্বর হয়ে উঠতে বাধ্য। তারই এক বয়ান হাজির করেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র নির্মাতা ফারান (মোস্তফা সরয়ার ফারকী) ও অভিনেত্রী তিথি (নুসরাত ইমরোজ তিশা), এই দুজনকে নিয়েই গড়িয়েছে চলচ্চিত্রের কাহিনি। বলতে গেলে তারা নিজেদের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন, তাই অভিনয়টি অভিনয় মনে হয়নি। বরং পুরো কাজে একটা অনুচ্চ ভঙ্গি ছিল। আর ছিল নির্মাতা ফারুকীর স্বভাবসুলভ কৌতুক।
লঘু চালে ফারুকী এই ছবিতে অনেকগুলো বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ফারান ও তিথি দম্পতির সন্তান নেয়নি বহুদিন। তারা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তবে মহামারি চলাকালে তাদের মনে হলো সন্তান প্রয়োজন। কিন্তু সমাজ সন্তানহীন দম্পতির প্রতি কেমন আচরণ করে সেটির সাক্ষ্য যেমন বহন করছে ছবিটি, তেমনি সমাজে অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হলে তাকে কীভাবে অবদমিত, এমনকি অপমান ও অপদস্থ করা হয়, তারও চিত্র মেলে এই ছবিতে।
ছবিটি দেখতে দেখতে দর্শক নিজেদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুর সাথে মিলিয়ে নিতে পারবেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে তিথি যখন সন্তান ধারণ করেন, তখন এক রাতে বাজি পোড়ানোর শব্দে ফারান বিরক্ত হয়, কারণ গর্ভের সন্তানের জন্য বাজির শব্দ ক্ষতিকর। কিন্তু ফারান আন্দাজও করতে পারেনি বাজি বন্ধ করতে বলাকে কেন্দ্র করে তার এত বড় ঝামেলায় জড়াতে হবে। কারণ বাজিটি পোড়ানো হচ্ছিল এক প্রভাবশালী রাজনীতিকের বাড়িতে। আর তারই বিরুদ্ধে নির্মাতা ফারান ফেসবুকে একাধিক স্ট্যাটাস লিখেছিলেন।
এর কাছাকাছি অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। আমার সন্তান যখন মায়ের গর্ভে, তখন ঠিক পাশের ভবনে বিয়ের অনুষ্ঠান, রাত দুটা পর্যন্ত ছাদে চলছিল উচ্চস্বরে ডিজে পার্টি। স্বভাবতই আমার স্ত্রীর সমস্যা হচ্ছিল। শুধু স্ত্রী কেন, আমার বাবা স্ট্রোকের পেশেন্ট, সমস্যা তারও হচ্ছিল। আমি জানালা দিয়ে অনেক ডেকে যখন বন্ধ করতে বলেছি, তখন সেই ‘সভ্য’ লোকজনের কাছ থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে গালি: শালা ফিরিঙ্গির বাচ্চা। পরে তাদের যখন বলেছি ট্রিপল নাইনে ফোন করে পুলিশ ডাকব, তখন তারা ক্ষান্ত হয়েছিলেন।
ফারুকীর ছবিতে প্রশাসনও ক্ষমতাশালীর পকেটে। সামান্য প্রতিবাদ করলেও কত ভয়াবহ জুলুম ও মামলা নেমে আসে, সেটা আমরা কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের বেলায় দেখেছি, পুলিশের হেফাজতে থাকা লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে দেখেছি। তাদের অপরাধ ছিল কার্টুন আঁকা ও সেই কার্টুন শেয়ার করা। তো এরকম সমাজে বসে নির্মাতা নিজের সমাজের গল্পটাই বলতে চেয়েছেন নিজস্ব ঢংয়ে। অপরাধ না করেও যেভাবে ফিল্মমেকার ফারানকে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে হয়, সেটা কি আমরা দেখিনি নারায়ণগঞ্জের কল্যান্দি এলাকার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বেলায়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এক সংসদ সদস্যের সামনে দাঁড়িয়ে, সকল শিক্ষার্থীর সামনে তাকে কানে ধরে উঠবস করতে হয়েছিল।
একটি সমাজে যখন ন্যায্য কথা বলার জন্য শাস্তি পেতে হয় এবং ভয়াবহ শাস্তি, সেই শাস্তি দিতে যখন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগাতে পিছ পা হন না, তখন সেই সমাজে শিল্পীরা মরে যেতে থাকে। সেই সমাজে শিল্পী জন্মায় না। আর জন্মালেও তারা সেই সমাজ ছেড়ে অন্য সমাজে, অন্য দেশে পাড়ি জমায়। বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে কত শিল্পী-লেখক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ ছেড়েছেন তার পরিসংখ্যান করলেই ধরা পড়বে সমাজের প্রগতি। কারণ সাধারণ মানুষের হয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরেন এই বুদ্ধিজীবীরাই। কিন্তু সামান্য এই কাজটির জন্যই যখন তাকে নিঃগৃহীত হতে হয়, তখন সেই বুদ্ধিজীবী কেবল মর্মে মরে না, গোটা সমাজটাই মরে যায়। অবশ্য পোষ্য ও কোলের বুদ্ধিজীবীদের হিসেব আলাদা।
ফারুকীর ছবির শুরুর দিকটা একটু তাড়াহুড়ো ছিল, দর্শককে থিতু হওয়ার সময় দিতে চাননি পরিচালক। দ্রুত সম্পাদনার ভেতর দিয়ে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন মূল বক্তব্যে, কিন্তু ছবির দৈর্ঘ্য তো ৮২ মিনিট। আরও অন্তত ৮ মিনিট তিনি শুরুর অংশেই দিতেই পারতেন! ছবিতে শক্তিশালী দুয়েকটি দৃশ্য রয়েছে: যেমন একবারে শুরুতে থাইল্যান্ডে তিথি প্যারাগ্লাইডিং করছেন, আর বাংলাদেশ থেকে ফারান কথা বলছেন ফোনে। অর্থাৎ তিথি যত ওপরে আকাশে উড়ুক না কেন, তার সুতো বাধা বসুন্ধরায়, ফারানের কাছে। সম্পর্কের ধরনটা বোঝাতে চমৎকার রূপক ব্যবহার করেছেন নির্মাতা। আরেকটি দৃশ্য চমৎকার লেগেছে। যেখানে ফারান কারাগারে, কিন্তু ভবিষ্যৎ সন্তানের মুখ দেখার জন্য তাকে মিথ্যা মুচলেকা স্বীকার করে স্বাক্ষর দিতে হবে এবং তিনি চিন্তিত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন। পেছনে গাছের ডাল-পালা, শাখা-প্রশাখা। চিন্তার এই দৃশ্যায়নটাও বেশ সুন্দর।
সন্তানহীন দম্পতির প্রতি মানুষের বিবেচনাহীন মন্তব্য ও সমাজের দুর্নীতি কেবল নয়, ফারুকীর এই ছবি বর্ণবাদ নিয়েও কথা বলেছে। হাসপাতালের শেষ দৃশ্যে যখন একজন সেবিকা বলে ওঠে, নায়িকার মেয়ে এত কালো হয়েছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ঔপনিবেশিক জড়তার ভেতর। এই যে বিবেচনাহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, বর্ণবাদী মানুষের কথা বলেছেন ফারুকী, এটাই এখন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের চেহারা। পাশাপাশি তিনি ধর্ম পরিচয়টাকেও এক জায়গয় স্থান দিয়েছেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আজান দেওয়ার কথা বলে বাঙালি মুসলমানের চরিত্র অঙ্কন করতেও ভুলে যাননি ফারুকী। পুরো ছবিতে কারও অভিনয়ই উচ্চকিত নয়, বেশ সাবলীল, কেবল রাজনীতিবিদের ছেলের চরিত্রটি একটু ভাড়ামো বলে মনে হয়েছে। তবে ওটাকে কমিক রিলিফ ধরে নেওয়া যেতে পারে। আসলে এটা যে ধরনের ছবি, তাতে এই ধরনের কমিক রিলিফের প্রয়োজন পড়ে না।
যাহোক, এই ছবি সম্পর্কে শেষ কথা হলো: দাম্পত্য জীবনের গল্পের আড়ালে, একটি ডুবন্ত সমাজের দৃশ্যরূপ দেখিয়েছেন নির্মাতা। একারণেই চলচ্চিত্রটি যুগোপযোগী তো বটেই, দরকারিও।