১. সন্ধ্যার আজব বিত্তান্তখানা ঘটার আগে!
এক সন্ধ্যায়, একপ্রকারের বেশ আজব এক বিত্তান্ত ঘটেছিল। সেই বিত্তান্তের আঁতিপাঁতি বয়ান রচনার মধ্য দিয়েই এই কাহিনি শুরু হতে যাচ্ছে। তবে আমরা যেন এই কথাখানা স্মরণে রাখি, সেই যে সন্ধ্যায় সেই ঘটনাটা ঘটেছিল; সেটা কিন্তু বিশেষ কোনো দূর আমলের সন্ধ্যা না। এই তো অনেক নিকট-কালেরই কথা-উপাখ্যান এইখানা। ১৩৯৫ বঙ্গ সন তো বেশি দিন আগে আমাদের দুনিয়া থেকে চলে যায় নাই। তাই না?
ওই ১৩৯৫ বঙ্গ সনের বৈশাখের মাসের ঘটনা এইটা। সেই বৈশাখ মাসের এক সন্ধ্যা হয় হয় বিকালের কালে জোবেদা বেগম বাসে উঠে দেখে, খোদা খোদা! বাসের মহিলা সিটের একটাও তো খালি নাই! তার দেশের যে বড় টাউনটা আছে, সেই টাউনের এই মাথা-সেই মাথা ধরে চলাচলতি করার বাসগুলাতে; মহিলাদের জন্য আছে আলাদা সিটের বন্দোবস্ত।
একটা-দুটা সিট না, পোক্তরকমেই বরাদ্দ আছে আস্ত নয়-নয়টা সিট। সেই নয়খানা সিটে পুরুষ প্যাসেঞ্জাররা, কদাপিও বসতে যায় না। তবে পুরুষপোলাদের জন্য রাখা বাকি সিটগুলাতে কিন্তু মহিলা প্যাসেঞ্জারের বসতে নিষেধ নাই। মহিলা সিটে জায়গা পেলে তোমার ভালো। না পেলে বাসের এদিক-ওদিকের ফাঁকা সিটে বসতে তোমার মানা নাই।
অন্য অন্য দিন, প্রায় সকল বাসেই, দুই-চারটা সিট ফাঁকাই পড়ে থাকে এই দিকে, এই মহিলা সাইডে। বরাবরই খালি পড়ে থাকেই। বরং গুদুর-মুদুর লোকঠাসা হয়ে থাকে অন্যগুলা, ওই সেই পুরুষ পোলাদের বসার সিটগুলা। আজকে দেখো কেমন উল্টা বিষয়! সিট কিনা খালি পড়ে আছে সেই পুরুষপোলাদের দিকে। এদিকে-সেদিকে, একটা দুটা করে করে সিট, খালিই পড়ে আছে ওইখানে। আর এই দিকে মহিলা সিটের দশাটা দেখছ! তিন আসনের একেকটা সিটে বসা দিয়ে আছে চারজন-পাঁচজন করে লেডিসে। এক মহিলার কিনারে যেন আরেক মহিলায়, নিজের শরীররে খ্যাতা-তেনার মতো করে ঠেসে-গুঁজে দিয়ে রেখেছে।
তার নানির বাড়িতে যেমন কাপড়-সিদ্ধ করার দিনে, মামানি নাইলে খালারা যেমনটা করত প্রতিবার, লেডিস সিটের মহিলাগুলাও যেন সেই একই ধারার কারবার করে চলছে এই টাইমে। তাদের কীর্তিকাণ্ড দেখে সেই পুরানা কথা জোবেদা বেগমের স্মরণে না এসে পারে নিকি! কত না পুরানা আমলের কথা, কিন্তু এমন ফট্টাত ফট্টাত স্মরণে আসে তার! মনে হয় য্যান, এইত্তো বিষয়খান গত তরশুর বিষয় মাত্র। কী করত তারা, মামানি নাইলে খালারা? তারা করত কী, মস্ত পাতিলের ভেতরে দুনিয়ার খ্যাতা আর কাপড়-তেনা একটার ভেতরে আরেকটা, বেধুম গোঁজা দিয়ে চলত। চেপে ঠেসে গুঁতায়ে-গাতায়ে, গোঁজার ওপরে গোঁজা দিতেই থাকত। তবেই সেই কাপড়ের পাতিলার, চুলার ওপরে বসার, ভাগ্য হতো। লেডিস সিটের মহিলাদের আজকা এইটা কী কারবার! গাদাগাদি, ঠাসাঠাসির তো কোনো কমতি রাখে নাই তারা আজকা!
ওই যে পুরুষপোলাদের সাইড, সেইখানে তো কম সিট খালি পড়ে নাই! অনেকগুলাই তো খালি পড়ে আছে! এই দিকে আইসা বসো তোমরা? আজকা তোমরা সেই দিকে না গিয়া; নিজেরা একের ওপরে আরেক জাঁতা দিয়া পড়ে থাকতাছো! ক্যান? আজকা তোমরা এমন করতাছো ক্যান? যাও না পুরুষপোলাগুলার সাইডে!
অন্য মহিলারা সেই দিকে যাক বা না যাক, কিন্তু এখন সে নিজে কী করবে? জোবেদা বেগমে নি যাবে ওই পুরুষপোলাদের সিটের সাইডে? যাবে বসতে?
না! পারতে যাবে না সে। উল্টা সে বরং লেডিস সিটের যেকোনো একটা হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়ায়ে থাকবে। দাঁড়ায়ে থেকে থেকেই সমস্তটা রাস্তা শেষ করবে; কিন্তু বেটাগো সাইডে সে যাবে না কিছুতেই। না না! এমন না যে মাতারি প্যাসেঞ্জার পেলেই পুরুষ প্যাসেঞ্জারেরা গুঁতা দিয়ে ঠেস দিয়ে নইলে যেইনে-সেইনে হাতের ঝাপট দিয়ে দিয়ে জ্বালা-অপমানি করে একশেষ করবে! পুরুষবেটাগুলা অমনটা করত একসময়। সেই অনেককাল আগে, অমন করে অশান্তি দিয়ে দিয়ে বেটিমাতারিদের জ্বালায়ে নান্দিনাশ করত এই বেটাছাগলাগুলো। কিন্তু সেইটা হইলো বহুত পুরানা আমলের কাহিনি।
এখনকার কাহিনি অন্য। এখনো যে অরা আর অমনে অমনে মাতারিদের হেনা-তেনা করতে যায় না, সেইটা কিন্তু না! করতে যায় করতে চায়। কিন্তু আফসোস! অরা বজ্জাতি করতে চাইলে কী, অগো শরীরেই অগো এখন বাগড়া দিয়ে থোয়। ফলে কিনা মহিলা প্যাসেঞ্জারগো লগে বেশিক্ষণ পোংটামিটা করার তাগদটা পায় না অরা আর। এখন দেখো পুরুষগুলা নিজের নিজের শরীরের জ্বালা-যাতনারে নিয়ে তড়পায়েই কূল পায় না! অধিকাংশ সময়ে মহিলা প্যাসেঞ্জার তার পাশের সিটে আছে কি নাই, সেইটাই তো হুঁশে রাখতে পারে না। মাতারি প্যাসেঞ্জারের লগে লাগাতার বিটলামি করার অবস্থা এগো অখন একটু কমই আছে, কিন্তুক তা-ও খাসলত তারা ছাড়তে পারে কই!
ওই সব সিটের কোনোটাতেই, জোবেদা বেগম, পারতপক্ষে বসার জন্য যায় না কখনোই। নানা রকম ঝুটঝামেলা হয় তার, অইখানে বসলে। সেইখানে একেকজন পুরুষ-প্যাসেঞ্জারের বসার রকমটা যেমন একেক রকম আল্টাপাল্টা, তেমন তাদের একেকজনের শরীরের আধি-ব্যাধিও একেক রকম বিটলা-টিটলা। সেই আধিব্যাধি-মোড়ানো আর লুকপুকা বাঞ্ছাঅলা দেহগুলার লড়ালড়ি, কাঁকনি, গুঁতা ও মোচড়-দেওয়ার লালচ-বাঞ্ছা, জোবেদা বেগমের সয় না একেবারেই।
অন্য মহিলারা দেখো গা; ওই সব সিটে কত সুন্দর, ধুপ্পুরধাপ্পুর করে বসে পড়তাছে। তারবাদে রাস্তা পার হয়ে যাইতাছে, মাইলকে মাইল। অই যে তারা অইখানে বসে আছে, সেই সময়ে না তাদের কোনোজনের মুখে-চোখে কোনো রাগ-তাপ-বিরক্তি-কুঁচকানির চিহ্ন দেখা যায়, না তাদের কারও শরীরে জাগনা থাকার কোনো ছাপ-লক্ষণ দেখা যাইতে থাকে। যেন অইগুলা সব ঘুমান্তী দিতে থাকা শরীর। ঠেকায় পড়েই না তখন যেন, শোয়ার বদলে বসুন্তী দিয়ে আছে; বেটা প্যাসেঞ্জারদের সিটে।
এমন প্রকারে, ওইখানে ওই পুরুষ-প্যাসেঞ্জারের সিটে, মহিলা-প্যাসেঞ্জাররা বসে থাকে। যেতে থাকে, যেতে থাকে; তারপর নিজের স্টপেজ আসামাত্রই ঠুপ করে ওঠা দিয়ে, হুটটুট পাওয়ে; নেমে যায় একেকজনে। কেমনে যে এই মহিলারা—এমন উদাসরকমে, এমন বিকারছাড়া মুখে, ওইখানে বসে থাকার কর্মখানা করে উঠতে পারে, জোবেদা বেগম সেইটা বোঝার চেষ্টাচরিত্র কিছু কম করে নাই। কিন্তু এই এত দিনেও সে সেইটা কিছুমাত্র বুঝে উঠতে পারে নাই।
অথচ ওই সিটে কোনো কারণে যদি তারে বসা লাগে, তখন জোবেদা বেগমের কী হয়? আল্লা গো! তখন কঠিন ঝামেলা হইতে থাকে তার। মহিলা সিটের বাইরে সে কি শান্তিমতো বসার চেষ্টাটা কোনো দিন করে নাই? বহুত চেষ্টা করেছে। সে বহুত চেষ্টা চালিয়েও শান্তিহালে সেইখানে, বসে থাকতে পারে নাই, কোনো দিনও। সমস্যা কী! কী তার সমস্যা?
সমস্যা কি একটা-দুইটা! সমস্যা আছে বহুত।
এই যে জোবেদা বেগমের দেশ! তার এই দেশে, আজকে বহু বহু কাল হয়, রোগবালাইয়ের ধুন্দুমার আসা-যাওয়া ও থাকাথাকি চলছে। বহু বহুদিন ধরে চলছে। বহুদিন হয়, তার দেশের বেটা-মাতারিরা, পোলাপাইন-আণ্ডাবাচ্চারা নানা রকম অসুখে জরজর, জবজবা। ইহইরে! আধিব্যাধি, বিমার-বালাইয়ের যদি কোনো সীমাসংখ্যা থাকত, এইনে! কত যে বিমার কত যে আলাই-বালাইয়ের তলে আছে লোকসকলে! আহা! এইটা কেমুন জিন্দিগি তাগো সগলতের!
এই যেমন, দেশের বহু বহু পুরুষপোলার হয়ে আছে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার রোগ। নাক দিয়ে সর্দির পানির মতন রক্ত নামতে থাকে তাদের, দরদর দরদর দরদর। সর্বটাক্ষণ নেমেই চলছে। একটু কোনো বিরাম-বিরতি-থামুন্তী নাই। পড়ছে। পড়তাছেই। যাদের এই রক্ত পড়ার অসুখটা হয়, তাদের নাক থেকে কি শুধু এই রক্তই পড়তে থাকে? না না। সেইটার লগে থাকে হাঁচির সমস্যা। দুম্মাদুম্ম ফটস ফটস হাঁচতে থাকে বেটামানুষগুলা। পলকে পলকে, হুড়ুম-দুড়ুম হাঁচি।
বাসে বসা, নাইলে দাঁড়ানো, পুরুষ প্যাসেঞ্জারগুলা বাসের মধ্যে একদিকে ঝক্কর-বক্কর ঝাঁকুনি পেতে থাকে, আরেক দিকে হাঁচতে থাকে। আহারে হাঁচি! ঘাচ্চুর ঘক্কুর হাঁচি। সেই হাঁচি সামলাতে গিয়ে কেমন যে বিপাকে পড়তে হয়, বেটাপোলাগুলাকে। একদিকে নাক থেকে দরদরানো রক্ত পড়ার বিষয়খান তো আছেই। সেই রক্ত-পড়ারেই তারা মুছবে, না হাঁচিরে আটকানি দিবে!
নাকের রক্ত মুছে নিতে গিয়ে তারা হাঁচিকে আটকাবার ফুরসত পায় না। হাঁচিরে সামলান্তী দিতে গিয়ে নাকের দরদরানি রক্তরে মোছার কর্মে গাফিলতি চলে আসে। ইশ! কেমন যে আব-জাব, ছটকানো-ল্যাগঠানো অবস্থা রে! তখনকার দশাটা যদি দেখো গো তুমি! সহ্য করতে পারবা না। সেইটা সহ্য হয় না। বেটাগুলার যাতনা বরদাস্ত হইতে চায় না। আহহারে! হায় হায়!
একদিকে কিনা বাসটায় হাচুড়-পাচুড় ঝাঁকনি খাইতাছে। সেই ঝাঁকনিরে সামলে নিতে নিতে বেটাগুলায় কোনহাতে কী করবে! না একহাতে তারা সামলান্তী দিবে হাঁচিরে! না মুছতে থাকবে নাক দিয়ে পড়তে থাকা রক্তের নহর রে!
তখন কী হয়! বাসের ঝাঁকুনির ঠেলায় বেটাগুলার হাঁচির দমক যেন দশ গুণ বেড়ে যায়। তারা একেকজনে হাট্টুস-ঘাক্কুস আওয়াজ তুলে তুলে হাঁচতে থাকে, আর তাদের মুখ থেকে রক্তমেশানো পিছলা পিছলা লালা ছিটকে-ছুটকে বের হয়ে আসতে থাকে। আসে তো আসে, সেই পিছলা-তপ্ত-লাল কিনা উড়ে-ধুরে গিয়ে গিয়ে পড়তে থাকে আশপাশের সকলজনের উপরে।
তখন কেউ কেউ হয়তো নিজের হাঁচি ও রক্তঝরারে সামলান্তী দেওয়ার চেষ্টা চালাতে চালাতেই চিল্লায়ে ওঠে, “আরে মিয়ারা! এমনে রক্ত দিয়া ভিজাইয়া তো দুনিয়া নাশ কইরা ফালাইতাছেন! কোনো আক্কল নাইক্কা আপনেগো? মোখে রোমাল ধরেন না ক্যান? রোমাল ধরেন, রোমাল ধরেন!”
কিন্তু অসুখঅলারা জানে, মুখে রুমাল চেপে কোনো ফায়দা নাই। রক্ত ও লালার ঝাপটা, তাদের রুমালকে অল্পক্ষণের মধ্যেই ভিজে গদগদা করে ছাড়ে। “ওই ভিজা স্যাতলা রুমাল নি পারে রক্ত-হাঁচিরে আটকান্তী দিতে! তাইলে মোখে রোমাল ধইরা ফল কী! আজাইরা চেষ্টায় লাভ আছে নি কোনো!” এই কথা তারা সকলজনেই জোর বিশ্বাস করে বলে, কেউই আর মুখে রুমাল চাপার কোনো গর্জ পায় না। তারা খোলা মুখে হাঁচতে থাকে, আর রক্তপিচ্ছিল লালারে সবদিকে ছটকায়ে দিতে থাকে।
বহুকাল হয় এই অসুখটা দেশের প্রায় সকলের শরীরে বিরাজ করা ধরেছে। পুরুষপোলাদের শরীরে তো আছেই, বেটী-মাতারিগো শরীরও রেহাই তো পায় নাই। প্রথমে অল্প কয়েকজনের ছিল, ধীরে ধীরে হাজার-বিজার জনকে ধরে নিল এই বিমারে। এখন হয়তো দুই-চারজনেরে ধরা বাকি আছে, কিন্তুক তাদের ধরতেই বা আর কয়দিন! জোবেদা বেগম কি জানে না যে পুরুষ সিটে বসলে, সারাটা পথ, অই রক্ত ও লালার ঝাপটা খেতে খেতে যেতে হবে!
মাতারিদেরও তো এই একই অসুখ হয়ে আছে? কিন্তু দেখ তারা সবকিছুই কেমন চেপেচুপে রেখে চলতে জানে! যত রক্তই দরদরাক আর যত কিনা হাঁচিই পাক, তারা সবটাই চেপে ফেলতে পারে। লালা-রক্তরে দশ মুড়া ছড়ায়ে-ছিটায়ে তারা গ্যাঞ্জাম বাধায় কম। পুরুষপোলাগুলা, কী কারণে, অমন চেপেচুপে সামলে রাখতে পারে না? ক্যান তারা তাগো আশপাশটা রোগের নানা আলামত দিয়ে সয়লাব করে ফেলেই ফেলে?
নাক দিয়ে রক্তপড়ার অসুখটা এখনো দেশের সকলের হয় নাই বটে; কিন্তু অন্য একটা বিমার তো কোনো-একটা পুরুষ-শরীরকেই ধরতে বাকি রাখে নাই। সর্বপুরুষদেহে ওই ব্যাধি জাগুন্তী দিয়ে আছে। দেখো রে খোদা! দেখো!
ওটা কোন অসুখ? ওইটা শরীরের চামড়ার অসুখ।
এই অসুখটায় আচমকার উপরে হুমদাম করে এসে হাজির হয় না। সে আসে বড়ো রয়-সয় করে করে। আসে আস্তে-সুস্থে। এইটায় এসে প্রথমে, এই দেশের বেটাগুলার শরীরে জাগনা দেয়। প্রথমে কী হয়! প্রথমে চামড়ায় গোলামতো লাল ছোপ ধরে। লাল লাল ছোপ। সেই ছোপ বহুদিন ধরে পড়ে থাকে সাড়া-শব্দহীন। তারপর অনেক ধীরে, সেই ছোপে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ফুসকুড়ি মাথা তোলে একদিকে, আরেক দিকে দেখা দেয় জ্বলুনি আর চুলকানি। দাউ দাউ দাউ দাউ কুটুর কুট কুটুর কুট। কিন্তু যতই চুলকানো যাক, আর কিনা যতই ওষুধ লাগানো যাক, কিছুতেই কোনো আরাম তো আসে না। বরং দিনে দিনে দেখ সেই শুকনো লাল ছোপগুলা নিকি হয়ে ওঠে থকথকা ঘা। উহহুরে! এই যে অসুখখানা, এর নিদানের জন্য হাজারে হাজার ক্যাপসুল আর অ্যান্টিসেপটিক মলম না দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলা বাজারে আনতাছে? কিন্তু আনলে কী! একটা কোনো ওষুধেও কি কোনো সুফল আসছে? কে বলে সেই কথা! আসে নাই।
এই তো নিত্যদিন, জোবেদা বেগম নিজ অক্ষির সম্মুক্ষে দেখতে থাকে আলাই-বালাইয়ে জরজরো বেটামানুষগুলার হিড়জিড়ানি কাঁপাকাঁপি। বাসে চড়া বেটালোকগুলা, থেকে থেকে নাকের রক্ত মোছে। হুড়মুড় হাঁচে। আর মুখ ঘাড়, গলা, হাত ও হাতের আঙুলে হাওয়া গোলচক্কর, ছলবলে ঘা-গুলারে নানামতে চুলকাতে থাকে। রক্ষা এই যে চামড়ার এই অসুখটা শরীরের অই কয়টা জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও হয় না। নাইলে না আরও বেশি চুলকানি নিয়ে আরও বেদিশ হতে হতো পুরুষ-শরীররে!
কিন্তু যেটুক্ক জায়গাতেই এই ঘাওয়ের-বিমারটা আছে, সেইটুকের যন্ত্রণারই সীমা নাই। চুলকানি ও জ্বলুনিতে অস্থির হয়ে গিয়ে কোনো কোনোজনে করে কী, ঘাওরে হয় গুঁতাতে থাকে, নাইলে ঝাপটা চাপড় মারতে থাকে। কোনো কোনোজনে ঘাওয়ের কামড়ানিরে নিজ নখ দিয়ে সামাল দিতে না পেরে; চাবির মাথা নাইলে পকেটের চিরুনির দাঁত দিয়ে গুঁতানি দিয়ে চলে। কেউ কেউ নিজের হাত আর আঙুলের ঘাওয়েরে নিজেই কামড়াতে থাকে, একটু পরপর। আর গোঙাতে থাকে।
সেই গোঙানিগুলার কোনো কোনোটা পাতলা-সরু। কোনোটা একটানা, কোনোটা ছাড়াছাড়া, কোনোটা ঘুস ঘুসা, চাপা। বাসের মধ্যেই কেউ কেউ গোঙাতে গোঙাতে হঠাৎ দাঁতি যায়। টলে পড়ে পাশের জনের ওপর। পাশের জন ফিরেও দেখে না যে, দাঁতি-খাওয়াজন আছে না গেছে! তার নিজেরই বলে টাটানি-পোড়ানি, রক্ত মোছামুছির শেষ নেই। অপরেরটা দেখে কখন!
এই অসুখের একটা আশ্চর্য ব্যাপার আছে! এর অতি তাজ্জবের বিষয়টা হলো এই যে দেশের কোনো স্ত্রীলোকের চামড়ায় এই রোগ ধরা দেয় নাই। এই দেশের মেয়েলোকেরা আধিব্যাধি শূন্য না। তবে চামড়ার বালাইটা তাদের শরীরে আসে নাই। সেইটা আসছে শুধু পুরুষপোলাদের দেহে। পণ্ডিত বলো কি ডাক্তার বলো বা হেকিম, কবিরাজ, গায়েবি-বালা তাড়ানে-অলা বলো, তাদের কেউই এই রোগের কারণটারে বার করে উঠতে পারে নাই। বহু চেষ্টাচরিত্র করেও কোনোজনে, এই রোগের কারণ নির্ণয়ে সমর্থ হয় নাই।
এইটা জানতেও কেউই সমর্থ হয় নাই যে শুধু পুরুষপোলাগণের দেহেই কেন এই ব্যাধি বিরাজ করে চলে! নারীশরীর কোন কারণে এই ব্যাধিদংশনমুক্ত! কীভাবে!
শেষে কবিরাজসকলে অনুমান করে যে নারীগণের পরনের পোশাকখানই তাদের এই রোগের কামড় থেকে রেহাই দিয়ে চলছে।
দেশের বেটিমানুষের শরীরে কোন পোশাক থাকে?
তাদের সকলের শরীরে থাকে সেলাইহীন দীর্ঘ একখানা বস্ত্র। সেই সেলাইহীন কাপড়টাই কিনা নানামতে মাতারিগণের অঙ্গরে জাবড়ে ধরে রেখে, তাদের রক্ষা করে চলছে ওই চর্মরোগ থেকে। সেই কারণে এখন কবিরাজেরা, জোবেদা বেগমের দেশের পুরুষদেরও সেলাই না করা, লম্বা বস্ত্রখণ্ড দিয়ে সর্বক্ষণ নিজের নিজের শরীরে জড়ায়ে রাখার জন্য জোর পরামর্শ দিয়ে চলছে। আবার দেখো, পুরুষেরা কিন্তু সেই পরামর্শরে অবহেলা দেয় নাই। উল্টা তারা সেই হিতকথারে মেনে চলাও শুরু করেছে।
কিন্তু দীঘল সেলাই ছাড়া কাপড়ে শরীররে জড়ালে কি, বেটালোকের চামড়ার রক্তাক্ত ফুসকড়ি যেমন ছিল, তেমনই বিরাজ করতে থাকে। কোনো উপশম আসে না। এমন চর্মরোগ নিয়ে বেটাছেলেরা হাঁটে-লড়ে-ডিউটিতে যায়—অন্যবিধ কর্ম করে। ওফ! এইটা কেমন জিয়ন্তী! এইটা না জিয়ন্তে মরণদশা! এই ব্যামোর নিদান নাই ক্যান!
দেশের ঘরে ঘরে আর কি কোনো বিমার-ব্যাধি নাই?
নাই কে বলে?
আছে তো। বহুমূত্র রোগটাও আছে। তয়, এই বহুমূত্রের আধি-জ্বালা কেবল দেশের বেটাছেলেদেরই আধিজ্বালা না কিন্তু! মেয়েমানুষেও এই রোগেরে পেয়ে আসছে এখন, বহু বহুদিন হয়। দরকারের আনা-যানার কর্ম যখন করা লাগে, তখন দেশের মাতারিরা করে কি; বাসে ওঠার দুই ঘণ্টা আগে থেকে নির্জলা উপোস দেওয়া শুরু করে। দাঁতে পানি ছোঁয়ানো তো দূর, একটা কুটা পর্যন্ত তারা দাঁতে লাগায় না।
কিন্তু পুংরোগীরা কেমনে অত বিধি-টিধিরে মানাগোনা করে! অত মানা-গোনা করার কিছু আছে? নাই তো! পথে পথে মূত্রত্যাগ করে নেওয়ার সুবিধা কি তাগো নাই? সেটা করতে কি কোনো অসুবিধা আছে! কোনো অসুবিধা যে নাই, সেইটা তারা জানে। তার ওপরে, দেশের রাস্তায় রাস্তায় কত না প্রকারের ট্রাফিক জ্যাম আছে, সিগন্যাল আছে। ওপরওয়ালাদের আসা-যাওয়ার ঘটনা আছে। রাস্তায় তো থামাথামির কোনো শেষ নাই!
সেই সব সময়ে কী হয়? হয় কী, পুরুষপোলা প্যাসেঞ্জারেরা যেমন-তেমন; বাসের ড্রাইভারেরা সুদ্ধা, ইঞ্জিন স্টার্ট রেখেই পেশাব করতে নেমে যায়। যত্রতত্র নেমে যায়। বহুমূত্র রোগঅলা প্যাসেঞ্জারেরা তো যায়ই। সেই সব ব্যাধিঅলা পেশাব চাপার প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষরক্ষা করতে পারে না কিনা; সেই কারণে চলতি পথেই তাদের পেশাব ছলকে পড়ে যেতে থাকে। তিরতিরায়ে-পড়া অর্ধেকটা পেশাবে ভিজে যেতে থাকে রাস্তাঘাট ফুটপাত নাইলে সিঁড়ি-চাতাল নাইলে বাসের ভেতরের চিলতা ফাঁকটা। বাকি পেশাবটুক লোকে নামিয়ে দেয় রাস্তার এই বা সেই কোণে। পেশাবের কটু ঝাঁজে, বিটকেলে গন্ধে গন্ধে সয়লাব হয়ে থাকে দেশের সবটা বাতাস। সয়লাব হয়ে আছে আজকা কত বচ্ছর যাবৎ! সেই গন্ধের খোঁয়াড়ের মধ্যে থেকে থেকেই সর্বজনে চলে-ফেরে। কারোরই কোনো অসুবিধা হয় না। হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে যে।
পুরুষ সিটে বসলে এই সবকিছু চক্ষের ওপরে ঘটতে দেখতে হয়। সেই দেখারে জোবেদা বেগমের সহ্য হয় না। সহ্য হয় না। বাসের মহিলা সিটগুলা হইলো সামনের দিকের একপাশে। সেইখানে কোনোমতে বসে পড়ে, চোখ-মুখ বুজে রাখে সে। তখন সবকিছুর মধ্যে থেকেও, নিজেকে তার কোনো কিছুতে না-থাকা একজন বলেই মনে হতে থাকে। তখন নিজেরে তার বড় নিস্তার পাওয়া নিস্তার পাওয়া লাগতে থাকে। সেই জন্যই না সে, বাসে উঠেই ধচমচিয়ে ছোটে মহিলা সিটের দিকে।
রোজ বাসে করে তাকে অনেকখানি রাস্তা পার হতে হয়। অফিসে যখন যায়, তখন সে নামে মাঝামাঝির একটা স্টপে। সেই স্টপটাও তার বাসা থেকে অনেক দূরের জায়গা। আঠারো কিলোমিটার দূরের জায়গা।। আর অফিস-ফেরতা জোবেদা বেগমকে আসতে হয় টাউনের একেবারে শেষ মাথায়। ওইটাই থাকে বাসের শেষ স্টপ। অফিস যাবার সময় মহিলা সিট পেতে জোবেদা বেগমের কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ফেরার পথে নিত্য সে বাসে ওঠে, উৎকণ্ঠিত চোখ ও কাতরাতে থাকা অন্তর নিয়ে। মহিলা সিট ফাঁকা আছে কি নাই! ফাঁকা আছে তো! নাকি! এবং রোজই ফেরার পথে, একটা না একটা মহিলা সিট তার জুটেই যায়। তাইলে তখন, যত ভয়ংকর ট্রাফিক জ্যামই তার বাসকে, কপ করে কামড়ে ধরুক না কেন; সে স্বস্তিতেই থাকতে পারবে!
মহিলা যাত্রীদেরও নাক থেকে রক্ত চুইয়ে নামে, হাঁচির ঝাপটা আসতে থাকে বিরামহীন। কিন্তু তারা তাদের লম্বা আঁচল দিয়ে, চেপে রাখতে জানে, নিজের নিজের নাক-মুখ। খুব কায়দা করে চেপে রাখতে জানে বলেই তাদের লালা ও রক্তের ঝাপটা, কোনো দিকেই ছড়ায় না। একটুও ছড়ায় না। তবে তারা হাঁপায়। খুব হাঁপাতে থাকে। নিশ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার সময়ে, তাদের নাকের ভেতরে আওয়াজ ওঠে—ফপর ফপ, ফপর ফপ।
তাদের কেউ কেউ একা মুখেই পিনপিন করে কাঁদতে থাকে। প্রতি বেলাই জোবেদা বেগম তাদের কাউকে কাউকে কাঁদতে শোনে ও দেখে। তারা ব্লাড প্রেশারের রোগী। রক্তরা তাদের শরীরের ভেতরে খালি চিমটি দিতে থাকে। খুব পেরেক-চোখা চিমটি। আহ্ আহ্ আল্লা! কত কত হাই ডোজের ওষুধ-এমনে-সেমনে খেয়ে চলছে তারা! কিন্তু তাতে কী লাভ! কোনো ফলই যে ফলছে না! কিছু না!
এই সব জ্বালাপোড়ায় ছটফটাতে থাকা মহিলা যাত্রীদের কাছে-কিনারে নিজেকে রেখেও, একটুও অস্বস্তিতে থাকে না জোবেদা বেগম। কারণ তারা বেবুঝ, বেসামাল কেউ না। কিন্তু পুরুষ যাত্রী! আল্লা রহম দেও! রোগবালাইয়ে ছ্যারাভ্যারা, বেবোধা সেই বেটাসকলের পাশে বসে বালাই-ব্যাধির ঝাপটা খাও, ট্রাফিক জ্যামের কামড়ানি খাও! খেতে খেতে নিজেরে থ্যাতলা-ছ্যাতলা করতে থাকো! এইমতে পার করো তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। তবে যদি তুমি পৌঁছাতে পারো নিজের স্টপে। এতখানি সময় নানা পুরুষ যাত্রীর নান পদের হাঙ্গামার মধ্যে থাকার মনের জোর জোবেদা বেগমের নাই। সেই জন্যই, প্রতি বেলায়ই, সে হাঁচড়-পাচড় ছোটে মহিলা সিটের দিকে। পেয়েও যায় যেকোনো একটা; এবং সেইটাতে বসে পড়ে নিজেকে একদম নেই করে ফেলে সে।
(চলবে)