হুমায়ূন আহমেদের রচনা-নির্মাণে জীবনের বিস্তারিত বিজ্ঞাপন

রজত সিকস্তি প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৩, ০৮:২৮ এএম

হুমায়ূন আহমেদের রচনার প্রধান শক্তি ঝরঝরে ভাষা না, কৌতুক প্রবণতাও না; এমনকি কাহিনির টানটান উত্তেজনাও না। নিখাদ ঝরঝরে ভাষার বুনন আর আর কৌতুকময়তার মতোন কারিশমা তাঁর লেখায় আছে ঠিকই। তবে একারণেই কেবল হুমায়ূন আহমেদ ‘গল্পের জাদুকর’ হননি। হয়েছেন উইট-বহুল লাইফস্টাইলের দরুন।

যাপনের দিক দিয়ে হুমায়ূন ছিলেন পুরোদস্তুর শহুরে। অথচ গ্রামকে বাদ দিয়ে বা ভুলে গিয়ে নয়। কথাবার্তায় চিন্তা-চেতনায় মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই তাঁর বসবাস। জীবনকে তিনি স্রেফ সাহিত্য দিয়ে ঢেকে দিতে চাননি। বরং শিল্প সাহিত্য রাজনীতি ধর্ম থেকে জীবনকেই বেশি প্রচার দেন। বড় এবং মহৎ করতে কখনোই কসুর করেননি জীবনের নিজস্ব সত্যাসত্যকে।

কখনো হিমু কখনো শুভ্র, কখনো বা মিসির আলীর সহজ-সন্ন্যাসের মধ্য দিয়ে জমিয়ে তোলেন জীবনের বটমূল। চরিত্রদের একেকজন যেনো জীবন নদীর খেয়া পারের মাঝি। ঢেউ-ঝড়-তুফান ডিঙ্গিয়ে পারাপারের একটাই মোক্ষ, জীবনের তট-দিগন্তরেখার চিত্রায়ণ।

হুমায়ূন আহমেদের গল্পে-সিনেমায় সর্বদা বিজ্ঞাপিত হয়েছে জীবন, যা জীবনবিমুখী সমালোচককে নাখোশ করবেই।

হিমু চরিত্র হলেন একজন নগর-গরীব। ঘটনাক্রমে জীবনের জমজমাট আয়োজনের বাইরে যার বসবাস। আয়রোজগারহীন, অবিবাহিত, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে মেস বাসায় বাস করেও হিমু স্নেহ-আর্দ্রতার জন্য মাজেদা খালার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। ভালোবাসার আবেশ পেতে ছুটে যান রহস্যময়ী রূপার কাছে। থানার ওসি, মেসের অনাত্মীয় সদস্য, গ্রাম থেকে আসা পুরনো অতীতের মানুষেরা, রাস্তায় পরিচয় হওয়া নামপরিচয় না জানা হঠাৎ ঝিলিক দেওয়া চেহারাগুলো নিয়েই হিমুর নাগরিক যাপন। যেনো হিমু নিজেই একটা পরিবার, বন্ধনহীনদের নিয়ে গড়ে তোলা একটা সাজানো সমাজ।

শুভ্রও তাই। তার ভেতর দিয়েও জীবনকে রূপ-রস-গন্ধ বহুল হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুভ্রেরও বসবাস জীবনের মধ্যে আগন্তুকের মতই। জীবনের গভীরে লম্বা দমের ডুব মেরে মনি-মুক্তো তুলে আনার লোক নন শুভ্র। তবু জীবনের বহিরাঙ্গের সৌষ্ঠবে মুগ্ধ পর্যটন তার।

মীরা-মৃম্ময়ী-নবনী-তিথি-রূপা জীবনের মুকুটে পালক হয়ে উজ্জ্বলতা ছড়ান। এরা কেউই হয়তো আন্না কারেনিনার আন্নার মতো নন। চোখের বালির বিনোদিনীর মতোও নন। কিন্তু নতুন জীবনের পতাকাধারী। এদের হয়তো নাই ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াই-সংগ্রাম বহুল যাপন। তবু জীবনকে গড়েপিটে চেখে দেখার আছে তীব্র আকুলতা। হুমায়ূন আহমেদ নতুন জীবনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবেই যেনো এদের সৃষ্টি করেন তাঁর রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানে।

মিসির আলী হলেন জীবনের আরেক চেহারা। অভিজ্ঞ থিতু নষ্টালজিক নাগরিক আবার নড়বড়েও। জীবন থেকে পালিয়ে বা গা বাঁচিয়ে চলেন মিসির আলি। সংসার ধর্ম রাজনীতি কোনটিতেই তার নিবিড় মগ্নতা নাই। এমনকি প্রথাবদ্ধ মধ্যবিত্তের সুখ-সমৃদ্ধি-সাচ্ছন্দ্যও তিনি নিজের জীবনে আয়োজন করেননি। গড্ডালিকার পথে না হেঁটে বেছে নেন একার সন্ন্যাস। নিজের ব্যক্তিত্ত্বকে আড়ালে রাখতে ব্যবহার করেন ‘যুক্তি-বিজ্ঞানের’ মোটা চাদরের রহস্য। অথচ কোনো কোনো কাহিনি পর্বে সেই মিসির আলীকেই আবার সাধারণ-সহজ জীবনের ব্যক্তি-পারিবারিক জটিল রসায়নের ভক্ত হয়ে ওঠতে দেখি। কাছ থেকে জীবনের উত্তাপ-উষ্ণতা পেতে জীবনেই মিসির আলীর বারবার ফেরা।

হুমায়ূন আহমেদের দ্রোহী আর বিপ্লবী চরিত্ররা হলেন নিম্নবর্গের মতি মিয়া-ওরা তিনজন-ফুলি-আঙ্গুল কাটা জগলুরা। ভদ্রস্ত-পারিবারিক আবহের বাইরের এই নিম্নবর্গের মানুষজন খুবই নিচু স্বরের অনেকটা উদ্ভট অথচ শ্রেণিগত শোষণের অর্থনৈতিক অসাম্যের এবং উচ্চবর্গের ভুল অহংয়ের বিরুদ্ধে শিল্পিত দ্রোহ আর বিপ্লবকে ইঙ্গিতে পথ দেখান। বেকারত্ব-অভাব-ধর্মকে ব্যবহার করে পীড়ন, অশিক্ষার বিরুদ্ধে বাকেরের ফাঁসি, মতি মেয়ার বেকুবিপনা, চুরি, ফুলির আহ্লাদী প্রেম, হাসান আলীর রাজাকারি, জগলুর ত্রাস যেনো অচেনা কায়দার বিদ্রোহ, কল্প-বিপ্লব!

হুমায়ূন আহমেদের শক্তির আর সামর্থের দিকটি হিসেবে আমরা শুরুতেই চিহ্নিত করেছি তাঁর উইট-বহুল চমকপ্রদ যাপনকে। হুমায়ূনের শৌখিন আধুনিক মনস্ক মেজাজই কাহিনি ও চরিত্রদের ভেতর জীবনের নিয়ন সাইন হয়ে গভীর জলের ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে বেরিয়ে আসা দ্বীপের মতো আশ্রয়-প্রশ্রয় হয়ে বিজ্ঞাপিত হয়। শিল্পকে ছাপিয়ে উঁচু করে তোলে যাপিত জীবনের ছায়া-প্রতিচ্ছায়া বহুল বট বৃক্ষকে। বেকারার হয়ে হয়তো শেষতক পাঠক-পথিক সে ছায়াতলেই মাথা গোঁজেন।

এ কথা একদম অমূলক নয় যে জীবনকে বেশি প্রচার করতে গিয়ে সাহিত্যকে হুমায়ূন আহমেদ ‘বাজারি’, ‘সস্তা’, ‘এন্টারটেইনার’, ‘অপন্যাস’, ‘গণরুচির তোয়াজ’ টাইপের করে তোলেন। কলাকৈবল্যবাদিদের দুয়ো কুড়ান লেখক ক্যারিয়ার জুড়ে। কিন্তু জীবনকে উপজীব্য করায় হুমায়ুনের গৌরব-অবমাননার সাথে জীবনের গৌরব-অবমাননা এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়। জীবনকে বা জীবনের মহাভক্ত হুমায়ূনকে যে আর কিছুর কাছে ম্লান হতে দিলে শিল্পের সাহিত্যেরও যে পায়ে কুড়াল পড়ে তা কি বিশুদ্ধ কৈবল্যবাদীগণ বোঝেন না?

‘ইসলামি’ বা ‘হিন্দুয়ানি’ কালচারকে সচেতনভাবে পাশ কাটিয়ে নিজের লেখায় হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেন জীবনের কালচারকে। ‘ইসলামিক’ কয়েন-পরিভাষা বহু বর্ণনা ও সংলাপে ব্যবহার করেন। অপরদিকে সনাতন মিথ ও চরিত্র সৃষ্টি করেন। কোথাও জেহাদি জোশের বাড়তি ধোঁয়া তোলেননি। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পও না। জীবন ও শিল্পের ওপর এই পরিমিতিবোধই সম্ভবত তার লেখাকে শেষাবধি সাহিত্যই করে তোলে। দল-মত-গোষ্ঠীর-ইজমের প্রচারপত্রে পরিণত হয়ে ওঠেনি হুমায়ুনের মুগ্ধতামুখো রচনা-নির্মাণ।

জন্মদিনে জানাই এই মহান জীবনবাদিকে শ্রদ্ধা ও মাগফেরাত!