জয় গোস্বামীর সঙ্গে পরিচয় পাগলীর মাধ্যমে। পাগলীর প্রেমে কেমন বিভোর হয়েছিলাম কৈশোরে। তারপর দেখা হলো মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ে। যৌবনেও সেই আবেশ রয়ে গেল। তারপর থেকে তার কবিতার ভক্ত পাঠক আমি। পড়তে ভালো লাগে। খুব বেশি মারপ্যাঁচ নেই। কী সাবলীল বলার ভঙ্গি। অথচ আঘাত হানে ঠিক হৃদয়ের গভীরে। তিনিই অনায়াসে বলতে পারেন—
‘পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।’
(পাঁচালি: দম্পতিকথা/পাগলী, তোমার সঙ্গে)
তাই তো বেণীমাধবের কথা ভাবতে ভাবতে পাগলীর কথাও মনে পড়ে। এক জীবনে এমন দুটি কবিতা থাকলে আর কিছু লিখতে হয় না। তারপরও বেশকিছু কবিতা দিয়ে জয় গোস্বামী জয় করেছেন পাঠকের অন্তর।
সহজ করে বলতে গেলে, জয় গোস্বামী (১০ নভেম্বর ১৯৫৪) বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত একজন আধুনিক বাঙালি কবি। পশ্চিমবঙ্গের এই কবি বাংলা ভাষার উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচিত। তার কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ। তিনি দুইবার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। ‘বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার কবিতার একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে/ হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে।’
জয় গোস্বামী প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ১৩-১৪ বছর বয়সে। নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন ১৬-১৭ বছর বয়সে। তিনি ছেলেবেলা থেকে খুব গান শুনতেন। গানের সুর থেকে বাণী তাকে খুব আকর্ষণ করতো। এই আকর্ষণেই তার অন্তর্জগতে কবিতার জন্ম হতে থাকে। ছেলেবেলায় এক অনুষ্ঠানে বনলতা সেন কবিতার আবৃত্তি শুনে কবিতার গঠন, রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা আমূল বদলে যায়। তিনি কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’ গানটি শুনেই ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’ কবিতাটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
জয় গোস্বামীর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে একাদশ শ্রেণিতে থাকাকালীন। সত্তরের দশকে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। এভাবে অনেক দিন কাটার পর দেশ পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়। এর পরপরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন পর (১৯৭৬) তার প্রথম কাব্য সংকলন ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ প্রকাশিত হয়। এটি ছিল মাত্র আটটি কবিতার একটি ক্ষীণকায় কবিতা সংকলন। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি বইটির প্রকাশনা বাবদ মোট ১৪৫ টাকা খরচ করেছিলেন। এরপর মায়ের টাকাতেই ১৯৭৮ সালে প্রকাশ করেছিলেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রত্নজীব’। এরপর কবি শঙ্খ ঘোষ তাকে প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। ফলে ১৯৮১ সালে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আলেয়া হ্রদ’ প্রকাশিত হয়।
এভাবেই ত্রিশের ওপরে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কবি জয় গোস্বামী সেই কবি; যিনি কবিতায় তার আত্মজীবনী রেখেছেন। শব্দের হাত ধরে আত্মউন্মোচিত সেই জীবনে প্রেম যেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। ১৯৮৯ সালে তিনি ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি ‘পাগলী, তোমার সঙ্গে’ কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
নিজের কবিতা সম্পর্কে জয় গোস্বামী বলেছেন, ‘আমার প্রতিদিনের জীবনে মনের ভেতর যে ভাষা জন্মায়, যে অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়, তাকে ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার জীবন হচ্ছে ধারাবাহিক বিচ্ছেদের মালা গাঁথার ইতিহাস। আমার মাস্টার মশাই, আমার মা, আমার ভাই, আমার বন্ধু, নারী, সহকর্মী, যাঁরা আমার জীবনে এসেছেন, তারা কেউ আমাকে নিয়ে সুখী নন। তারা কোনো না কোনো কারণে হতাশ বা আমাকে নিয়ে ক্লান্ত।’ তাই তো কবিতা সংগ্রহের চতুর্থ খণ্ডে বলা হয়েছে—‘একজন কবি যে কবিতা রচনা করেন, তা নেহাত লেখালেখি খেলা নয়। কবিতা তার মাথা তোলবার, বেঁচে ওঠবার ভালবাসার অনন্য অবলম্বন। তিনি মানেন, স্বপ্নের মতো কবিতাতেও সমস্তই সম্ভব। তবু কবিতার জগৎ শুধু স্বপ্নেরই জগৎ নয়। কবিতা কবির ব্যাপ্ত, বিশাল আত্মজীবনী। এক একটি কবিতা আত্মজীবনীর এক একটি পৃষ্ঠা।’(ব্লার্ব, কবিতাসংগ্রহ-৪: আনন্দ )
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশের পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শঙ্খ ঘোষ পেরিয়ে কবিতার এক নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছেন কবি জয় গোস্বামী। তার পরিধিতে তিনিই সম্রাট। এক কথায় বলা যায়, তার কবিতা চিত্ররূপময়। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তিনি। দুই বাংলায়ই তিনি সমান জনপ্রিয়। ছন্দের ভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রেমে-অপ্রেমে তিনি কবিতার যে নিটোল গৃহ বানিয়েছেন, সেখানে ছায়াকামিতায় অনায়াসে ক্লান্ত তপ্ত পাঠক-পথিক চিরকালীন বসবাস করতে পারেন। তাই হয়তো তিনি এভাবে বলে উঠতে পারেন—
একদিন বমি করেছিলাম, একদিন ঢোঁক
গিলেছিলাম, একদিন আমি ছোঁয়া মাত্র জল
রূপান্তরিত হয়েছিল দুধে, একদিন আমাকে দেখেই
এক অপ্সরার মাথা ঘুরে গিয়েছিল একদিন
আমাকে না বলেই আমার দুটো হাত
কদিনের জন্য উড়ে গেছিল হাওয়ায়
(আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো)
শুধু তা-ই নয়, জয় গোস্বামীর প্রেমের জগৎ বিচিত্র বিভায় আলোকিত। বিচিত্র রঙে সজ্জিত। বিচিত্র কারণে অনুরণিত। সেখানে যেমন আর্তি ও আকুলতা আছে; বিরহ, অভিসার, সমর্পণ, মিলন, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি আছে। আলো আছে, সাদা আছে, ভালো আছে আবার অন্ধকার আছে, কালো আছে এবং মন্দ আছে। ক্ষমার সঙ্গে সহ্য যেমন; তেমনই অগ্রাহ্যের সঙ্গে আছে প্রতিবাদ। কিশোরকাল থেকে কবি প্রেমকে দেখেছেন কখনো দূর থেকে, কখনোবা কাছ থেকে। বৈধ-অবৈধ, প্রকাশ্য বা আড়াল সব ধরনের প্রেম তার কবি চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে। কবির প্রেমচেতনা বহুরৈখিক। সেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাস সমানভাবে দোলা দেয়। তবে প্রেমের ব্যর্থতা, আশাভঙ্গ তাকে বেশি ব্যথাতুর করেছে। যে কারণে কবি অনায়াসে বলে ফেলতে পারেন—
বেণীমাধব, মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়েছিলে, আমি তখন মালতী ইস্কুলে
ডেস্কে বসে অঙ্ক করি, ছোট্ট ক্লাসঘর
বাইরে দিদিমণির পাশে দিদিমণির বর
আমি তখন নবম শ্রেণি, আমি তখন শাড়ি
আলাপ হলো, বেণীমাধব, সুলেখাদের বাড়ি।
(মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়)
জয় গোস্বামী মূলত জীবন অন্বেষক কবি। জীবনকে তিনি সাপটে ধরেছেন, জাপটে ধরেছেন। তাই তার প্রেম-অনুভূতি এত বর্ণিল, এত স্তরবিশিষ্ট। পরতে পরতে জমে পেলবতার পলি। আর সেই পলি খনন করলে উঠে আসে জীবনদায়ী স্বচ্ছ জলে। তিনি বলেছেন—
সে রেখেছে বুকে মাথা। বন্ধ চোখ। সিঁথির উপরে
আমার চিবুক রাখা। কাঁচাপাকা দাড়ি ভর্তি গালে
ওর হাতটি থেমে গেল। আমার গলায় পড়ছে ঘন, দীর্ঘশ্বাস।
শরীরে আসেনি কাম। শুধু চোখ ভ’রে এল জলে।
সে ফুঁসে উঠেছে: ‘তুমি আর কাউকে সব দিয়ে এসেছে আগেই!
(বিশ্বাস: বিকেলবেলায় কবিতা ও ঘাসফুলের কবি)
এখানেই শেষ নয়। কবিতায় তিনি দুরন্ত বেপরোয়া প্রেমকে চিনিয়েছেন আমাদের। সেখানে দাবি করেছেন পুরুষের অধিকার। জোরালো কণ্ঠে বলেছেন—
আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?
(স্নান)
একটি কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিশাল কোনো কিছুর সামনে দাঁড়ালে মানুষ যেমন বিস্মিত, অভিভূত ও নির্বাক হয়ে যায়, জয় গোস্বামীর কবিতা সমগ্রের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকের তেমনই অনুভূতি হবে। মনের ভেতরে কেবলই এসব প্রশ্নের জন্ম হতে থাকবে। একি সত্য? একি অলীক? এমন অনর্গল, এমন অফুরান—মনে হয়, একি সম্ভব? একি স্বপ্ন? দীর্ঘ কবিতা যেমন চুম্বকের মতো টেনে রাখে, দুই লাইনের কবিতাও তেমন মনের ভেতরে মৌমাছির মতো গুনগুন করে সারাদিন। প্রেমের কবিতাও যে কী বিচিত্র যখন কবি লেখেন—
ঝাউগাছের পাতা, তোমার বৃষ্টি এলে চুল ভেজানো চাই
ঝাউগাছের পাতা, তোমায় তরুণরা সব নতুন লেখা দিক
ঝাউগাছের পাতা, এবার চা খাবে না? বই নিয়ে বসবে না?
ঝাউগাছের পাতা, তোমার মিত্রাদিদি ভালো তো শিলচরে?
ঝাউগাছের পাতা, তোমায় সাগর দিলেন তলহারানো চোখ
ঝাউগাছের পাতা, তোমার নতুন নতুন পুরুষবন্ধু হোক।
(১০০টি প্রেমের কবিতা)
এই জয় গোস্বামীই আবার বলেন, চুম্বনের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙেছে—ঠোঁটের ছোঁয়ায় কপাল ভেজা। সেই কবিই আবার লেখেন, এসো আমার সীমান্তে, গায়ে গা লাগিয়ে বসো, এই একই/বেড়ার কাঁটাতার আমার পিঠ তোমার পিঠ ফুড়ে দিয়ে/আটকে রাখুক দুজনকে।
তার দুই লাইনের একটি প্রেমের কবিতার মধ্যেও রেখে যান প্রতিভার নির্ভুল স্বাক্ষর। তাই তো তার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়—
আমার হাত ফসকে প্রেম পড়ে গেল কুয়োর তলায়
ঝুঁকে কিছু দেখা যায় না
অন্ধকার থেকে তার মরণচিৎকার শোনা যায়।
(১০০টি প্রেমের কবিতা)
তার কবিতা পড়ে মনে হবে, প্রেম কখনো কখনো হাত ফসকে কুয়োর তলায়ও পড়ে যেতে পারে। তখন তিনি কেবল মরণ চিৎকার শুনতে পান। দৃশ্যকল্পের এমন অসাধারণ বিন্যাস তার কবিতাতেই সম্ভব।
সেই কারণেই জয় গোস্বামীর কবিতা পাঠককে টানে। যেমন টানে হৃদয়কে। তার কবিতা ভালোবাসতে শেখায়, উপলব্ধি করতেও শেখায়। তার মতো সহজ-সরল ভাষায় হৃদয়ের অনুভূতিকে ব্যক্ত করা যায়—তার কবিতা না পড়লে তা হয়তো বোঝাই যেত না। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অলংকারে অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ধরা দেয় প্রতিটি কবিতা। শব্দে-বাক্যে অপূর্ব সমন্বয় প্রতিফলিত হয়। সুতরাং জয় গোস্বামীর কবিতা কালজয়ী হওয়ার মাইলফলক ছুঁতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। জন্মদিনে কবিকে অপার শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাই।
তথ্যঋণ
১. প্রেমের কবিতা, জয় গোস্বামী, আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত), ২০১৫
২. জয় গোস্বামীর কবিতায় প্রেমচেতনা, রবীন বসু
৩. বৈকাল ম্যাগাজিন
৪. ১০০টি প্রেমের কবিতা, জয় গোস্বামী, প্রতিভাস, কলকাতা
লেখক : কবি ও গবেষক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়