সাহিত্যে নিরীক্ষা : আশীর্বাদ বনাম অভিশাপ

মোহাম্মদ নূরুল হক প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২৩, ০৫:৩০ পিএম

সাহিত্যে নিরীক্ষা এক ধরনের চোরাবালির নাম। 

কিন্তু কেন? কারণ একেক ধরনের কাজের একেক ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতি-স্থান-কাল-পাত্রের প্রয়োজন হয়। স্বাধীনতাকামী কোনো দেশে যে-যুদ্ধের ঘোষণা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনৈতিক দলের নেতার দেওয়ার কথা, সে-কাজ কোনো সৈনিক করলে তা যুদ্ধনীতিতে বৈধ বলে গণ্য হবে না। বরং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ওই সৈনিকের বিরুদ্ধে মামলা হবে। পরিণামে তার মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। বিষয়টি অন্যভাবেও দেখা যায়। কার্তিক মাসে যেমন পাকা আম-কাঁঠালের আশা করা যায় না, তেমনি বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেও খেজুরের রস মেলে না। 

প্রকৃতি নিজস্ব নিয়মেই চলে। নিয়তি তার গতিপথ নির্ধারণ কের দেয়, তার ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থেই। প্রকৃতির এই নিয়মানুবর্তিতা-নীতিকে লঙ্ঘন করে কখনো কখনো হয়তো চমক দেখানো যায়, কিন্তু তাতে কোনো মার্গলাভ হয় না। উল্টো প্রকৃতি তার প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠে। তার রোষানল এতই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। তাই পর্বত-শৃঙ্গে যেমন মহাসমুদ্রের জলরাশির ঊর্মিমালা কিংবা ভাসমান জাহাজের দর্শন সম্ভব নয়, তেমনি অতল সমুদ্রের বিশাল জলরাশিতেও ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বা কার রেসিংয়ের আয়োজনও অসম্ভব। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম—নিয়তিও। 

প্রকৃতিতে সর্বাবস্থায়, সর্বকালেই নিয়মের রাজত্ব চলে। এর ব্যতিক্রম হয় না। তাহলে মানবজাতির চিন্তার সংসারে, কল্পনার জগতে, সৃষ্টির ভুবনে নিয়মের লঙ্ঘন হবে কেন? মানবজাতি কি প্রকৃতির শাসনবলয়ের বাইরের কোনো ব্রহ্মাণ্ডের বাসিন্দা? প্রশ্ন যত সহজ, উত্তরও তত সরল। না—মানবজাতিও প্রকৃতির নিয়মের অধীন এবং শতভাগই তার শাসনতন্ত্রের শৃঙ্খলা-পরিকল্পনার উপাদান সে। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, মানবজাতি প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির ক্রীড়নক মাত্র। অতএব প্রকৃতির শক্তিকে ‘আপাতত’জয় করে মানুষ অতিপ্রাকৃত কিংবা অবিনশ্বর সত্তায় উন্নীত হতে পারবে না। দূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের প্রভূতকল্যাণ সাধিত হলে, প্রকৃতিকে বিজ্ঞান নিজের শাসনবশে আনতে সক্ষম হলে, তখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তার কার্যকারণও নিশ্চয় ভিন্ন হবে। আপাতত অতীত-বর্তমানের দৃশ্যমান-উপস্থিত প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলাই শ্রেয়। আপাতত মানুষ যতদিন প্রকৃতির ওপর নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারছে না, ততদিন প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার পরিণাম ভয়ানক হতে বাধ্য। তাকে মনে রাখতে হবে—সে তার পরম নিয়ন্তা-নিয়ন্ত্রক প্রকৃতির কাছে অসহায় এক পুতুল ছাড়া আর কিছুই নয়। 

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—মহাসমুদ্রে জাহাজ থেকে ছিটকে পড়া কোনো ক্ষুদ্র পিঁপড়া যেমন খড়কুটো পেলে তাকে আশ্রয় করে ডাঙায় ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, বাতাস অনুকূলে—সমুদ্র শান্ত থাকলে ওই পিঁপড়া স্থলভাগের দিশা পেতেও পারে। তবে তাকে সমুদ্রের মেজাজ-বাতাসের গতিবিধি বুঝেই খড়কুটোকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকতে হবে। বিপরীত কাণ্ড করলে বাতাস যতই অনুকূলে থাকুক, সামুদ্রিক প্রাণীর উদরাগত হতে তার বেশি সময় লাগবে না। মানবজাতির মধ্যে যারা শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেন, বিশেষত সাহিত্যচর্চাকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন, তাঁদের জন্য উল্লিখিত কথাগুলো শতভাগ খাটে।

সাহিত্যচর্চার বয়স তিন যুগের বেশি হওয়ার আগে, নিজেকে যুগ-প্রবর্তকের ভূমিকায় দেখতে চাওয়া হয়তো দোষের নয়, কিন্তু ওই মহাসমুদ্রের ঝড়ের কবলে পড়া পিঁপড়ার মতোই তার পরিণতি হতে বাধ্য। তাকে মনে রাখতে হবে—ছোট একটি ঢেউই তার প্রাণস্পন্দন চিরতরে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

প্রায়ই দেখা যায়—কোনো কোনো লেখকের লেখালেখির বয়স ১০ কি ১২ বছর হওয়া মাত্রই তারা প্রচল পথকে অস্বীকার শুরু করেন। পূর্ববর্তী সমস্ত রথী-মহারথীকে তুচ্ছজ্ঞানে উড়িয়ে দেন। কালজয়ী রচনারাজিকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অস্বীকার করেন। হাজার বছর ধরে প্রবহমান স্বীকৃত আঙ্গিক-প্রকরণকে তাদের কাছে ক্লিশে, বহুল ব্যবহারে জরাজীর্ণ মনে হয়। তাই তারা চিরায়ত সমস্ত নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলকে ভেঙেচুরে নতুন আঙ্গিক-প্রকরণ প্রবর্তনে অবতীর্ণ হতে চান। কিন্তু নতুন আঙ্গিক-প্রকরণ প্রবর্তনের জন্য কী কী উপকরণ-অনুষঙ্গ সৃষ্টি করতে হবে, সেই সব অনুষঙ্গের পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাজ্ঞান কী হবে, প্রয়োগের সূত্র কেমন হবে, এসবের কোনো পরিকল্পনা তাঁদের লেখকদের থাকে না। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো—সেই নিরীক্ষার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেই নিরীক্ষা চালানোর মতো মহাজন তাঁরা হতে পেরেছেন কি না, সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার সাহস-যোগ্যতার পরিচয়ই তারা দিতে চান না। অথচ এসব যোগ্যতার প্রমাণ না দিয়েই জ্ঞানরাজ্যের স্বঘোষিত ‘ধনকুবের’বনে যান। প্রকৃত মহাজন মাত্রই জানেন, নবীন-অপ্রস্তুত কর্মবীরেরা ধনকুবের হওয়া দূরের কথা, রাস্তার পাশের ভিখারি হওয়ারও ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। তারা শিষ্টাচার মেনে এখনো হাত পেতে ভিক্ষাটুকুও চাইতে শেখেনি। কারণ শিল্পসাহিত্যের ইতিহাস ঐতিহ্যগত ও পরম্পরাগত। শিল্প-সাহিত্য কখনোই পরম্পরাচ্যুত-শেকড় বিচ্ছিন্ন কোনো প্রপঞ্চ নয়। তাই যিনি নিজেকে সাহিত্যের মহীরুহ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তাকে অতীত অস্বীকার করে নয়, বরং মান্য করেই, অতীতের ভিতের ওপরই নতুনের সৌধ নির্মাণ করতে হয়। এই নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের পর এখন প্রশ্ন উঠছে—তাহলে সাহিত্যে নিরীক্ষার কি কোনে মূল্য নেই?

উত্তরে বলবো—নিরীক্ষার মূল্য অবশ্যই আছে। এজন্য লেখককে ন্যূনতম কালপর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার অভিজ্ঞতা-প্রজ্ঞার ঝুলিকে নন্দন-জ্ঞান-দর্শনের যথেষ্ট সম্পদে ভারী করে তুলতে হবে। একইসঙ্গে তাঁকে তরঙ্গসঙ্কুল মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার সাহস-শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। ঘর থেকে উঠোনে পা রেখেই প্রশান্ত মহাসাগর পাড়িয়ে দেওয়ার ‘স্বকপোলকল্পিত’ কাহিনি শোনালে চলবে না। কাজে আসবে না দুই কদম হেঁটেই দিল্লিজয়ের কল্পকাহিনি শোনালেও। তাকে আগে চেনাপথে চলতে চলতে সেই পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি চিহ্ন আত্মস্থ করতে হবে। এভাবে চলতে চলতে একদিন চেনাজানা জগতের সীমারেখা অতিক্রম করতে হবে। চেনাপথের যেখানে শেষ হবে, সেখান থেকেই অচেনা পথের শুরু। সেটাই তাঁর নতুন পথ আবিষ্কার। সেই পথ সামনে এমনিতেই এসে পড়বে। তখন চেনাপথের অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন পথে চলতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। এভাবে নতুন পথ আবিষ্কার-নতুন পথে চলার নামই ‘নিরীক্ষা’। ব্যতিক্রমটা সাঁতার না জেনে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার মতো অপরিণামদর্শিতা। চেনা পথ শেষ করার আগে অচেনা পথে নৌকা ভাসালে সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণনাশের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

সাহিত্যে নিরীক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা চলে। কেউ যদি এমফিল বা পিএইচডি করতে চান, তাহলে তাঁকে আগে ডিসিপ্লিন ব্রেক না করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মাস্টার্স পাস করতে হবে। শুধু তা-ই নয়—এমফিল-পিএইচডিতে ভর্তির শর্তানুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর নম্বরও থাকতে হবে। এই শর্ত না মেনে কেউ যদি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর এমফিল-পিএইচডি গবেষক হতে চান, তাহলে লোকে তাঁর মানসিক সুস্থতা নিয়ে নিশ্চয় প্রশ্ন তুলবে। 

বিষয়টি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ছেলে শিশুর সঙ্গে কোনো তরুণী নারী শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুললে তাতে হয়তো তার যৌনক্ষুধা-তৃষ্ণা মিটবে। কিন্তু ওই শিশুর ঔরসজাত সন্তান কখনোই গর্ভে ধারণ করতে পারবেন না। কারণ ওই শিশু শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যতই স্বাভাবিক-সুস্থ থাকুক, তার ভেতরে তখনো শুক্রাণুর জন্ম হয়নি। ফলে নারীর ডিম্বাণুতে শুক্রাণুও প্রবেশ করবে না। আর একথা কে না জানে, ডিম্বাণুতে শুক্রাণুর প্রবেশ ব্যতীত গর্ভধারণ কখনোই সম্ভব নয়! এছাড়া এমন শারীরিক মিলনে সংশ্লিষ্ট নারী হয়তো সঙ্গমসুখ অনুভব করবেন, কিন্তু ছেলে শিশুটির জন্য তা মোটেও সুখকর হবে না। বরং এক ধরনের যন্ত্রণাদীর্ণ-ভয়াল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে সে। উত্তরকালে ছেলে শিশুটি হয় বিকৃত মানসিকতার শিকার হবে, নয়তো ধর্ষকে পরিণত হবে। মোদ্দা কথা, কোনো নারীকে মাতৃত্বের সুখ পেতে হলে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে শারীরিক মিলনে মিলিত হতে হবে। ব্যত্যয়ে কর্মনাস্তি।

সাহিত্যে নিরীক্ষার জন্য লেখককেও এই শুক্রাণুপূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মতো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। না হলে ছেলে শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক নারীর যৌনমিলনের মতো ধস্তাধস্তিতে পর্যবসিত হবে। তাঁর মধুময় সঙ্গমে পরিণত হবে না। তেমনি অপ্রস্তুত কর্মবীর, অকালপক্ব লেখকের নিরীক্ষাও আত্মপ্রবঞ্চনায় লীন হয়ে যাবে।

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না—পাণ্ডপুত্র অর্জুন যত বড় গাণ্ডীবধারীই হোক, সশস্ত্র ভীষ্ম কিংবা মহারথী কর্ণকে ধরাশায়ী করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই সারথি শ্রীকৃষ্ণের ছলনার আশ্রয় নিয়ে নিরস্ত্র দুই মহারথীর ওপর শরনিক্ষেপ করতে হয়েছিল অর্জুনকে। এছাড়া, আরও বড়সত্য লুকিয়ে রয়েছে ওই মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। মহারথী দুর্যোধন যখন যোগবলে নিজের শরকে বজ্রের মতো কঠিন করেছে, তখন গদাযুদ্ধে তাকে পরাজিত করা পাণ্ডপুত্র ভীম কেন, সম্মিলিতভাবে পঞ্চপাণ্ডবের পক্ষেও সম্ভব হতো না। সেখানেও কৃষ্ণের ছলনায় দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে ভীম। কৌরবদের বিরুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় এভাবে নিশ্চিত হয়। এই ঘটনার বর্ণনা এজন্য দিলাম যে—উপযুক্ত কাজের জন্য উপযুক্ত সময়-অনুকূল পরিস্থিতির পাশাপাশি কৌশলও থাকা প্রয়োজন। না হলে বিজয় দূরের কথা, প্রাণই দেহের খাঁচায় থাকবে না।

আরেকটা কথা—আম-কাঁঠাল পাকে বৈশাখে-জ্যৈষ্ঠে। চৈত্রের শুরুতে কোনোভাবেই আম-কাঁঠাল পাকা সম্ভব নয়। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে কোনো কোনো আমের ওপর প্রায় শুকনো ডাল এসে পড়তে দেখা যায়। তাতে ওই আমটি কদিন পরই সিঁদুর রঙ ধারণ করে। সিঁদুর রঙা আমটিকে পরিপক্ব মনে করে খেতে চাইলে তাতে বিস্বাদ তো ঠেকবেই, পরন্তু স্বাস্থ্যহানিরও আশঙ্কা রয়েছে।

সাহিত্যে যিনি নিরীক্ষা করবেন, তাঁরও বয়স সেই শুক্রাণুপ্রাপ্ত পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মতো হতে হবে—বয়স হতে হবে বৈশাখের পাকা আমের মতো। একইসঙ্গে অর্জুন-ভীমের মতো কৌশলী ও সময়ের সদ্ব্যবহারকারী হতে হবে। ডিসিপ্লিন ব্রেক না করেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এমএ পাসের পরই শর্তানুযায়ী নম্বর পেলে তবেই এমফিল বা পিএইচডি’র গবেষক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে। সাহস দেখাতে হবে। ব্যতিক্রমে পুরোটাই পণ্ডশ্রম হবে। সেই পণ্ডশ্রম সাহিত্যের কোনো কাজে আসা দূরে থাক, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজেরই কোনো কাজে আসবে না। মাঝখান থেকে সময়-মেধা আর অর্থের অপচয় হবে। সঙ্গে লোকের কাছে উপহাসের পাত্র হতে হবে।

এই সময়ে এসে অনভিজ্ঞ ও অনতিতরুণ সাহিত্যকরা নিরীক্ষা করতে এসে যে-সব কাজ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. আঙ্গিক-প্রকরণের নিয়ম লঙ্ঘন
২. যতিচিহ্ন ও নানা রকম প্রতীকের অপপ্রয়োগ
৩. গল্পকে আখ্যানশূন্য করার পাশাপাশি অর্থহীন-পরম্পরাশূন্য শব্দের ব্যবহার

লেখালেখির বয়স অর্ধযুগ হওয়ার আগেই নিরীক্ষাপ্রবণ লেখকরা প্রথম যে কাজটি করেন, সেটি সাহিত্যের প্রচলিত আঙ্গিক-প্রকরণকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিতে চান। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা আঙ্গিক-প্রকরণে পরিবর্তন আনতে হলে, যে কাজটি করা দরকার, সেটি হলো আঙ্গিক-প্রকরণের বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস আত্মস্থ করা। কিন্তু নবীন লেখকরা আঙ্গিক-প্রকরণের ইতিহাসের খোঁজটুকু না করেই কেবল প্রচলিত রীতিকে বদলে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় অনড় অবস্থানে থাকেন। এতে আসলে তাঁরা আঙ্গিক-প্রকরণের পরিবর্তন করতে পারেন না। এমনকি নতুন কোনো রীতির প্রবর্তন করাও সম্ভব হয় না। মাঝখান থেকে কিছুকাল তারা স্বঘোষিত ‘নতুন ধারার সাহিত্যিক’ খেতাবের মোহে ঘোরগ্রস্ত থাকেন। কারণ তারা সমাজের ‘দৃষ্টি আকর্ষণের’ চেষ্টায় এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, আঙ্গিক-প্রকরণে পরিবর্তন আনতে গেলে কোন কোন উপকরণের সঙ্গে কোন কোন উপকরণের সুসমঞ্জস্য ঘটাতে হবে, তার মাত্রাজ্ঞান-রূপ কী হবে, তার সংজ্ঞা-ব্যাখ্যার রূপরেখা প্রণয়ন করেন না। এসব রূপরেখা প্রণয়ন না করার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণ রয়েছে, তা হলো, প্রতিষ্ঠিত-স্বীকৃত আঙ্গিক-প্রকরণের মাত্রাজ্ঞান রূপরেখার সংজ্ঞা-ব্যাখ্যাই তারা শেখেন না। আত্মস্থ করার চেষ্টাও করেন না।


নিরীক্ষার নামে দ্বিতীয় যে কর্মটি নবীন বিপ্লবীরা করেন, সেটি হলো—যতিচিহ্ন ও নানা রকম প্রতীকের অপপ্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে তারা যেখানে দাড়ি (।) দেওয়ার কথা, সেখানে কমার (,) ব্যবহার করেন। যেখানে ড্যাশ (—) দেওয়ার কথা সেখানে ব্যাকরণনির্ধারিত যতিচিহ্নের বাইরে গিয়ে জ্যামিতিক-গাণিতিক প্রতীকের (∞,≈) প্রয়োগ ঘটান। সেমিকোলনের (;) জায়গায় ত্রি-বিন্দুর (…) ব্যবহার করেন। আবার যেখানে ত্রি-বিন্দু (…) দেওয়ার কথা, সেখানে ডটলাইনের (……) প্রয়োগ করেন। ত্রি-বিন্দুর জায়গায় ডটলাইনের প্রয়োগ এবং ড্যাশের জায়গায় সিম্বলের প্রয়োগ যে, রচনাটিকে অর্থহীন করে তুলছে, সেটি তাঁরা ভাবেন না। বরং মনে করেন এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা পুরনো ধ্যান-ধারণার বিপরীতে নতুন যুগকে আহ্বান করছেন। তারা মানতে কিংবা বুঝতে চান না, জ্যামিতিক-গাণিতিক প্রতীক কিংবা ডটলাইন যতিচিহ্নের বিকল্প হতে পারে না। ফলে এসব জ্যামিতিক-গাণিতিক প্রতীক ও ডটলাইনের ব্যবহারে বাক্য অর্থহীন জড়ভরতে পর্যবসিত পারে। 

নবীন লেখকরা দ্রুত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে সবচেয়ে ভয়ানক যে কাজটি করেন, সেটি হলো—‘গল্পকে আখ্যানশূন্য করা এবং কবিতায় অর্থহীন-পরম্পরাশূন্য শব্দের ব্যবহার’ করা। এই দলটি গল্প রচনা করতে গিয়ে গল্পের চিরায়ত রূপ নির্মাণে ব্যর্থ হয়ে গল্পকে গল্পশূন্যই করে ফেলেন। ফলে গল্পে কেবল অর্থশূন্য শব্দ-বাক্যের কঙ্কাল পড়ে থাকে। আর কবিদের দল আরেকধাপ এগিয়ে থাকে। তারা অর্থহীন-পরম্পরাহীন শব্দরাজি এমনভাবে সাজান, সেখানে তাঁদের রচিত কথিত কবিতাপাঠ শেষে পাঠক কোনো মর্ম উদ্ধার করতে না পারলে তাঁরা পাঠককে দোষারোপ করেন। নিজেদের অক্ষমতা স্বীকার করেন না। এভাবে অপ্রস্তুত কর্মবীরেরা নিজেদের অক্ষম চেষ্টার নাম দেন ‘নিরীক্ষা’।

এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম—‘সাহিত্যে নিরীক্ষা এক ধরনের চোরাবালির নাম’। এবার আসা যাক, সেই চোরাবালি প্রসঙ্গে। সাহিত্যে যারা নিজেদের মেধা-প্রতিভার শক্তির পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন, কঠিন সাধনার পথে হাঁটতে ভয় পান, চলতে গিয়ে মাঝপথেই হাঁপিয়ে ওঠেন, অথচ শর্টকাট খ্যাতি অর্জনের পথে ছুটতে চান, তারাই কেবল নিরীক্ষার নামে এসব অদ্ভুত কাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এতে অন্তত তাদের কাজগুলো গুণমানগতভাবে মূল্যায়ন নাহলেও কেবল ‘নিরীক্ষা’র মেকি ইতিহাসে তাদের নাম উচ্চারিত হবে। সেই ‘কাঙালপনা’ থেকে ‘অ্যাটেনশন সিকার’ বা ‘দৃষ্টি আকর্ষণরোগে আক্রান্ত’রা ‘নিরীক্ষা’র নামে নিজেদের মেধা-শক্তির ক্ষয় করে বেড়ান। শেষ পর্যন্ত তারা না পারেন শিল্পসফল সাহিত্য রচনা করতে, না পারেন পাঠকপ্রিয় হতে। তারা ‘নিরীক্ষা’ নামের চোরাবালিতেই একসময় তলিয়ে যান। তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। এদিক থেকে বিচার করলে সাহিত্যে নিরীক্ষা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ। আর বিপরীত দিক থেকে বিচার করলে ভিন্ন চিত্র মিলবে। অর্থাৎ যারা চেনাপথে চলতে চলতে নতুন পথের সামনে আসেন, উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত কর্মটি করেন, তাদের জন্য ‘নিরীক্ষা’ আশীর্বাদ হয়েই আসে।