আজ ১৬ অক্টোবর তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ৬৭তম জন্মবার্ষিকী। কবি ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ কালজয়ী গানটি মোংলার মিঠেখালিতে আমাদের চোখের সামনেই সৃষ্টি করেছেন। আমি সৌভাগ্যবান সেই গান নির্মাণকালের একজন প্রত্যক্ষদর্শী; কালের সাক্ষী। তাই কবির জন্মদিনে সেই গানের ভাষায় বলতে চাই, ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’।
বাংলাদেশের কবিতায় অবিস্মরণীয় এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাঁকে দিয়েছে অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
অকালপ্রয়াত এই কবি নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে। সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্যচেতনা ও অসাম্প্রদায়িকবোধে উজ্জ্বল তার কবিতা। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’ এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি উচ্চারণ করেছেন অবিনাশী স্বপ্ন ‘দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাঁকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্র প্রতীকে’। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।
মাত্র ৩৫ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। পরবর্তীকালে ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটির জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরণোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন। ‘উপদ্রুত উপকূল’ ও ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থ দুটির জন্য ‘সংস্কৃতি সংসদ’ থেকে পরপর দুবছর ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরষ্কার’ লাভ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মোংলার মিঠেখালিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ’অগ্রদূত’ ক্লাব ও গানের দল ‘অন্তর বাজাও শিল্পী গোষ্ঠী’।
বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামেই কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের সোনালি সময় অতিবাহিত করেছেন। এখানকার পাঠশালাতেই তার পড়াশুনা শুরু। পরে মোংলার সাহেবেরমেঠ গ্রামে তার নানার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘ইসমাঈল মেমোরিয়াল স্কুলে’ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর মোংলার সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তার ঝোঁক দেখা যায়।
মোংলায় প্রথম ক্রিকেট দল তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় কিশোর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নেন। হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে নিয়মিত যোগ দিতেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নবম শ্রেণির ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন রুদ্র। কিন্তু পরিবারের প্রচণ্ড বাধার কারণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও পরোক্ষভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। সমর্থন জুগিয়েছেন মুক্তির সংগ্রামকে।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কতোটা আধুনিক, প্রগতিশীল এবং দ্বন্দ্বময় বেগবান দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন, তা অনুমান করা যাবে ১৯৮৩ সালে জুন মাসের ১৮ তারিখে তার বাবাকে লেখা চিঠির কয়েকটি লাইন যদি পড়ি। তা ছিলো এরকম, “এ তো চরম সত্য কথা যে, একটি জেনারেশনের সাথে তার পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্দ্ব থাকবেই। যেমন আপনার আব্বার সাথে ছিলো আপনার। আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানের। এই দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত করতে পারি। অথবা পারি কিছুটা মসৃণ করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানি না, তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে।”
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন সাহিত্যের জ্বালানি হচ্ছে রাজনীতি। কবিতায় তার নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ”আমি কবি নই, শব্দ শ্রমিক। শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়, হৃদয়ের কালো বেদনায়।” কবি নিজেকে আর্টিস্ট কাম একটিভিস্ট মনে করতেন। দেশের অশুভ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবিদের কী ভূমিকা হতে পারে এমন এক প্রশ্নের জবাবে কবি রুদ্র বলেছিলেন, “রাজনীতি সচেতন একজন মানুষের যে ভূমিকা হবে, একজন কবিও সেই ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সংগ্রামী ভূমিকা ছাড়াও কবিকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা হলো-পাশাপাশি তাকে সংগ্রামী কবিতাও লিখতে হবে।”
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ গর্ভে থাকা অবস্থায় তার মা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন বরিশালে। সেই সময়ে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে রেডক্রস হাসপাতালে তার জন্ম হয়েছিল। ইশতেহার কবিতায় রুদ্র বলেছেন, “এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে যে-শিশুর জন্ম/দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন যে-কিশোরের/ জোস্না যাকে প্লাবিত করে/বনভূমি যাকে প্লাবিত করে/নদীর জোয়ার যাকে ডাকে নেশার মতো/ অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল/গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র/অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে/—অথচ যাকে শৃঙ্খলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে।”
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ইচ্ছা ছিলো শস্য আর স্বাস্থ্যের, সুন্দর আর গৌরবের কবিতা লেখবার। তিনি চেয়েছিলেন বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে গান গাইবেন। রুদ্র তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, “আমরা উৎসব করবো শস্যের। আমরা উৎসব করবো পূর্ণিমার। আমরা উৎসব করবো গৌরবময় মৃত্যু আর বেগবান জীবনের। কিন্তু এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে সামান্য কিছু মানুষ।—তারা সবচে’ কম শ্রম দেয় আর সবচে’ বেশি সম্পদ ভোগ করে। তারা সবচে’ ভালো খাদ্যগুলো খায় আর সবচে’ দামি পোশাকগুলো পরে।” এ কথা বলেই কবি ক্ষান্ত হননি। কবি সমাধানের পথ দেখিয়ে বলেছেন, ”একদা অরণ্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রাণী হত্যা করে আমরা অরণ্য জীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি, আজ এই সব অতিকায় কদাকার বন্য মানুষগুলো নির্মূল করে আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো। সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো। শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।”
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন তার বয়স হতো ৬৭ বছর। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে দেহত্যাগ করেছেন। বেঁচে থাকলে তার কাছ থেকে হয়তো আরও সৃষ্টিশীল শিল্পমান উত্তীর্ণ সাহিত্য আমরা পেতাম। কিন্তু যা পেয়েছি তাও বা কম কীসে। এমন কোনো গণআন্দোলন, গণসংগ্রাম নেই যেখানে রুদ্রর কবিতা আবৃত্তি হয় না। কবি রুদ্রর ৬৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে তাকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই এবং কবির ভাষায় বলি, “চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়/ চলে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী/ চলে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে।”
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের চেতনার বাতিঘর। সবুজ শ্যামল এই দেশে, শুভ হোক রুদ্রর জন্মদিন।
লেখক : আহ্বায়ক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মোংলা