বই আলোচনা

আকিমুন রহমানের দ্যুতিজড়ানো অন্ধকার ভুবন

মোহাম্মদ আলি প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৩, ০৬:৩৩ পিএম

মানবাংলা বনাম আঞ্চলিক বাংলা—এ দুইয়ের মিলন

সাধু রীতি ছেড়ে চলিত রীতিতে ঢোকা বাংলা সাহিত্যের রসবদলের ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য পর্ব তো অবশ্যই—এ কথা মেনে এখন বলা যায়, অনেক তো হলো এ সর্বজনগ্রাহ্য মানবাংলা, যা কিনা দুই বাংলার মধ্যবর্তী এক অঞ্চলের স্বাদু বাংলাকে উপজীব্য মেনে; এবার আরও গভীরে ঢোকা যাক আঞ্চলিকতার হৃদয়ের ভেতর। সোজা কথা, আমাদের দেশের এত এত বিচিত্র আঞ্চলিক ভাষার মধ্য থেকে যেকোনো একটি দুটি কিংবা একাধিককে মিলিয়ে কোনো বর্তমান রীতি দাঁড় করানো যেতে পারে কিনা, সে-চিন্তা করার সময় চলে এসেছে বাংলা সাহিত্যভুবনের। অনেকে সে-চেষ্টা করছেনও হয়তো। নিজের পাঠজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের দেশীয় অনেক অনেক জনপ্রিয় ও একই সঙ্গে মননশীল লেখক রয়েছেন, যারা এই মানবাংলায় লিখতে গিয়ে নিজের ট্রেডমার্ক বা একান্ত গদ্যভাষাটা আবিষ্কার করতে পারেননি সারা জীবন কিংবা সে-চেষ্টায় তাঁরা যাননি। যার কারণে একই গদ্যভাষায় বা ভাষারীতিতে উপন্যাস, ছোটগল্প, এককথায় কথাসাহিত্য দিন দিন একঘেয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে উঠছে, সেটা সবাই অনেক দিন আগে থেকে অনুধাবন করে আসছেন নিশ্চয়ই। চলিত রীতি বা মানবাংলা থেকে আঞ্চলিক বাংলায় চলে আসাটাও এখন সময়ের প্রয়োজনে দরকার বলে মনে করি।

একজন শিল্পীর জীবন-অভিজ্ঞতা, তাঁর সৃষ্টিশীলতা, তাঁর অভিনবত্ব কেন এক মানবাংলার মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটাতে হবে? আর কি কোনো উপায় নেই? মানবাংলা তো কৃত্রিম এক ভাষা, যে ভাষায় খোদ বাংলাভাষীর অধিকাংশই কথা বলে না। এত এত আঞ্চলিকতা, এত এত বিচিত্র রস বাংলার উদরে আছে, তাকে তো প্রযত্ন করতে হবে এবং সেটা প্রবলভাবে করার সময় এসে গেছে নতুন নতুন ভাষারীতি তৈরির জন্য। অনেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন সে-চেষ্টা নিয়ে। সমালোচিত হচ্ছেন, বিরূপ মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন, অবহেলিত হচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা নতুন ভাষারীতি ও ভাষাস্বাদের নিশ্চিতির জন্যই করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে জানি আছে দেশজ মূল্যবোধের প্রতি চিরনিষ্ঠা, জাতীয়তাবোধ, আর ভূ-ভাষারাজনীতি ও তার মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রচেষ্টা। কথা হলো, কেন এত কথা রসসাহিত্যের ভাষারীতি নিয়ে? আকিমুন রহমানের উপন্যাস ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ পাঠ করে এ রকম উপলব্ধির জন্ম নেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যথাসময়ে আঞ্চলিক ভাষা ও কথাসাহিত্যে এর প্রয়াগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাবে; এবার উপন্যাসটির গল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয়টি ঘটুক।

উপন্যাস তো বড়সড় একটা গল্পই শেষ পর্যন্ত। সেই উপন্যাসের শরীর থেকে গল্প হাওয়া করে দিলে তার মর্যাদা কী থাকে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন অবশ্য। কারণ মোটা দাগে আশি দশক থেকে বাংলা রসসাহিত্যে নতুন ভাষারীতি আবিষ্কারে আমাদের এপারের সাহিত্যিকদের যে দুর্মর চেষ্টা, তার সফলতার-বিফলতার হিসাবও ইঙ্গিতে পেয়ে যাব এ উপন্যাস তথা আকিমুন রহমানের রসসাহিত্যের অভিনব ভাষারীতির আবিষ্কারে ও তার সার্থক প্রয়োগে। জ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক ও সমালোচকরা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, বইয়ের মলাট কিংবা লেখকের নামপরিচয়ের অংশ সরিয়ে দিয়ে কোনো একজন পাঠককে যদি বলা হয়, এটা কার লেখা, বলতে পারো? তখন তা পাঠ করে যদি পাঠক ঐ লেখকের নামটা বলতে পারে, তাহলে বোঝা যাবে, লেখকের লেখার ভাষায় নির্দিষ্ট একটা অভিনবত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যেটি দিয়ে তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। বাংলাসাহিত্য তন্ন-তন্ন করে পাঠের মাধ্যমে এ সাহিত্যের একনিষ্ঠ গবেষক অধ্যাপক ড. আকিমুন রহমান রসসাহিত্যে তাঁর নিজের সেই স্বাতন্ত্র্য দাঁড় করাতে পেরেছেন।

 

আখ্যান

১৩৩০ বঙ্গাব্দের এক ‘চৈতমাইস্যা দুপুরের কালে’র ভীষণ ব্যস্ত সময়ে এক ‘অশৈলী বৃত্তান্ত’ ঘটে যায় ‘নিরিবিলি, নিরাছাড়া’ গ্রাম দেওভোগে। আচানক গায়েব হয়ে যায় ‘লয়লক্ষ্মী আর ঢক চেহারার’ চতুর্দশী মেয়ে জুলেখা—মা-বাবার আদরের মণি জুলি। ‘ময়মুরুব্বিরা’ আগেই বলে গেছেন, ‘চৈতমাসের দুপুরের কালেরে কোনো অবস্থাতেই হালকাভাবে নিবা না! জানবা, এই সময়খানেই আসমানে-জমিনে নানা জাতের সব বান-বাতাস আনাগোনা চলে! বান-বাতাসে ঠিক অই সময়েই মানুষের অনিষ্ট করার জন্য একেবারে একপায়ে খাড়া হয়ে থাকে।’ ময়মুরুব্বিরা তো আর এমনি এমনি বলেন না, তার কারণও আছে; ১৩৩০ সনে ঘটে যাওয়া জুলির অন্তর্ধানের অনেক আগে দেওভোগ গ্রামে ঘটে গিয়েছিল এই বান-বাতাসের খেলা, সর্বনাশা চৈত্রমাসের এমনই সময়টাতে! দেওভোগের জমিদার আতকার মধ্যে গত হলে এতবড় জমিদারবাড়িতে থাকে কেবল বিধবা জমিদার-বউ আর জমিদারের পুরুতঠাকুর ও তার স্ত্রী ঠাকুরনীদিদি। 

এই বিধবা জমিদারবউ ব্রত-পূজা-উপোস করার পরও গ্রামের রায়ত-পরিবারের মেয়েরা সাব্যস্ত করে তার একটা দোষ আছে। কী সেই দোষ? তার দোষ, সে বিধবার সাদা বেশে থােক না, ‘সদাসর্বদা তার পরনে দেখা যায় নানান বাহারি শাড়ি-কাপড়। জমিদারপতি জীবিত থাকতে যেমন সাজ-পোশাক ছিল তার! রাঁড়ি-দশায়ও তার তেমনই আছে। অঙ্গের অলংকার আছে অঙ্গজোড়া! ঝলমল ঝলমল! মাথার চুলের ঢলও মাথায়ই আছে। পায়ের আলতা নিত্যি পায়ে শোভা পাচ্ছে।’ সে কী করবে, এ শূন্য এ-বাড়িতে তার নাকি ‘কেমুন ফাঁপড়-ফাঁপড় লাগা ধরে’। গ্রামের নারীদের এই অলক্ষ্মীপনা অসহ্য লাগলেও তারা ভালোবেসে যায় জমিদারবউকে। কিন্তু ঠাকুরনীদিদির অনুরোধে গ্রামের বউঝিরা তার সঙ্গে গালগল্প করতে গিয়ে একদিন তাকে চৈত্র মাসের দুপুরে পুকুরঘাটলায় কোনো কারণ ছাড়াই মরে পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে। একে তো জমিদারের মৃত্যু নিয়ে গ্রামবাসীদের কানাঘুষা রয়েছে যে, সে শাশ্বত—কায়া বদল করেছে মাত্র। জমিদারের আচানক মৃত্যুজনিত লোকশ্রুতি, জমিদারবউয়ের হঠাৎ মুত্যু আর ঠাকুরনীদিদি ও তার স্বামীর তীর্থে যাওয়ার নাম করে অন্তর্ধান গ্রামবাসীকে হতবিহ্বল করে দেয়। এসব ঘটনার পর থেকে জনশূন্য জমিদারবাড়ির আশপাশে কেউ সাধারণত যায় না, যায় শুধু শুকনো চৈত্রমাসের সময়-কয়টি ছাড়া। কেননা আশপাশের সব জলা তখন পানিশূন্য। কেবল এ বাড়ির পুকুরেই থাকে ঢলঢলা পানি। গ্রামের মেয়েরা পানি আনতে গেলে কখনোই কেউ একলা যায় না। সঙ্গে দু-তিনজন তাদের থাকতেই হয়। ময়মুরুব্বিদের আশঙ্কার কথা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না! ঠিক শ’খানেক বছর পর গ্রামের সবচেয়ে ঢক চেহারার মেয়ে জুলি ঘটনার পাকে পড়ে গোসল করতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় আচানক। আর মূল ঘটনার শুরু হয় এখান থেকেই।

মূল ঘটনা শুরু হয় এখান থেকে ঠিকই তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হাপিস করে দিয়ে আরেকজনকে হাজির করা হয় সে ভূমিকায়, সে গ্রামের ‘ঘাউরা পোলা’ ইউসুফ—ইসুফ মিয়া। জুলেখার প্রেমিক সে। উপন্যাসে ইসুফের আকস্মিক উদয় হয় না। ঘটনার ফাঁদে ফেলে, জুলির অন্তর্ধানের সূত্র ধরে তাকে আনা হয়। আনা হয় উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝির একটু আগে। জুলি অন্তর্হিত হয় উপন্যাসের শুরুতে। এরপর চলে দেওভোগ গ্রামের সর্বনাশা সেই চৈত্রমাসের ঘটনা। প্রেমিক ইসুফের আবির্ভাবের আগে কয়েক বছর পেছনে গিয়ে চলে জুলিচরিত্রের দীর্ঘ বয়ান। জুলি যখন দিনেদুপুরে গায়েব হয় যায়, ক্ষণকাল পরে চলে তার তালাশি। কোনো বিন্দুমাত্র সূত্র মেলে না দিনভর। শেষে পরদিন ফজরের নামাজর পরপরই গ্রামবাসীরা বৈঠকে বসে গ্রামের কোমলমতি ইমামের নেতৃতে। এখানে কেউ একজন জুলির চরিত্রে কালিমা লেপার চেষ্টা করলে ইসুফের উত্থান ঘটে উপন্যাসের মধ্যে এবং একেবারে শেষ পর্যন্ত চরিত্রটির বিকাশ ঘটে সাবলীল গতিতে।

সেদিনের সে সভায় অনুমান করা হয় জুলিকে ধরে নিয়ে যেতে পারে কেবল বাইদ্যারাই। তাদের সম্বন্ধে বদনাম আছে, তারা ছোট ছোট বাচ্চাকে পেলে হাপিস করে দেয় নিমিষে। খবর মেলে, তারা আছে এখন পাশের এক গ্রামে। সেই তথাকথিত অপহরণকারী বাইদ্যাদের খুঁজতে ইমামের একমাত্র অভিযানসঙ্গী হয় ইসুফ মিয়া। যাত্রাকালেই প্রাজ্ঞ ইমাম বুঝে ফেলে ইসুফ মিয়ার বুকে জ্বলছে জ্বলুনি-পোড়ানি এবং সেটা কার জন্য সেটা বুঝতে বাকি থাকে না মোটেও। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ ও প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ ইসুফ যখন জানতে পারে বেদেরা সেই গ্রামে কখনোই আসেনি, প্রচণ্ড হতাশায় মুষড়ে পড়ে সে। শীতলক্ষ্যার পানিতে বেদিশা হয়ে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে নিজের জীবনটাই আরেকটু হলেই ভাসিয়ে দিয়েছিল সে। সে-যাত্রায় রক্ষা পেলেও বাড়ি ফিরে বিছানায় পড়ে যায় সে গুটিবসন্তের কবলে পড়ে। এর পরই শুরু হয় ইসুফ-জুলেখার প্রথম যৌবনের প্রথম দেখায় ভালোবাসার নিটোল যাত্রা এবং সেটি ইসুফ মিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে, ঔপন্যাসিকের বয়ানে, একটু পিছনে ফিরে। এ প্রেম বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর, নিরাছাড়া গ্রামজীবনের হদয় থেকে উৎসারিত প্রেম। ঘাত-প্রতিঘাত আছে তার, কিন্তু কোমল সে প্রেম। মানুষের নিবিড়তম আবেগের প্রেম। ২০৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসে ১০০ পৃষ্ঠা ধরে চলে সে প্রেম। ঔপন্যাসিকের গল্প বলার দুর্ধর্ষ রীতির কারণে-ধরনে তা পাঠকের মনে যে চিত্তচাঞ্চল্য জাগিয়ে দেয়, তা অবর্ণনীয়। অনুভূতির চাষবাসের এ জায়গাটাতেই আকিমুন রহমানের ঋদ্ধি, তাঁর কারু-কারবারের সফলতা।

আখ্যানের শুরু বঙ্গাব্দ ১৩৩০ সালে এবং সেটি গিয়ে শেষ হয় এর কিছুকালের মধ্যেই। কিন্তু ঔপন্যাসিক আমাদের নিয়ে যান তারও আগে দেওভোগ গ্রামে আগে কী ঘটেছিলো তার একটা ইতিহাস বয়ান করে। ইতিহাস বলে যান নিজ নিয়মে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, লেখক খুব গভীরভাবে ঘটনার একটা যোগসূত্র আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে যান কৌশলে। জুলির অন্তর্ধানের সাথে সেই ঘটনার যোগসাজস আছে বলে আমরা মনে করি কিন্তু ঔপন্যাসিক কেবল সেখানে ইঙ্গিতই দিয়ে যান, বেশি কিছু বলেননি। উপন্যাসটি পাঠে পুরাতনি গ্রাম দেওভোগের নাম নিয়ে কেমন একটা শিরশিরে আগ্রহ জেগে উঠবে আমাদের মনে। আমরা ভাবতেই পারি, তাহলে দেবতাকে ভোগ দেওয়ার জন্যই জুলির হঠাৎ এই নাই হয়ে যাওয়া? সাধুপুরুষ জমিদারের কায়া বদলের সাথে, তাকে ভোগ দেয়ার সাথে জুলির অন্তর্ধানের কোথায় যেন একটা অনুল্লেখ মিল রয়ে গেছে উপন্যাসজুড়ে। জুলি, জমিদারের মৃত্যু, জমিদারবউয়ের হঠাৎ মৃত্যু, পুরুতঠাকুর ও ঠাকুরনীদিদির অন্তর্ধান—সব মিলিয়ে ‘অলৌকিকের অস্পষ্ট আলো আর দ্যুতিজড়ানো অন্ধকার-ভুবন’-কেই যেন সাক্ষ্য দেয় প্রবলভাবে।

 

লক্ষণ

যদি বলি, বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব অনুভূতির চাষবাসের জমি এই ‘সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন’, তাহলে খুব একটা আতিশয়োক্তি হবে না। উপন্যাসটিতে প্রমিত বাংলার ঝংকার বাদ দিয়ে বেশি বেশি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এবং সেটি লেখকের বয়ান পর্যন্তও বাদ যায়নি। অশৈলী বৃত্তান্ত, হুমহুমা, পরস্তাব, বানবাতাস, লড়ালড়ি, মাতারি, হাতরথ, ধুছমুছ, সাব্যস্ত, চেত, তরিজুত, সিজিলমিছিল, তুক্ষার, ভরাপুরা, নিরাছাড়া, শান্তিহালে, কাজকাম, তাইলে, পুষ্কুনি, হাড্ডি, ফাতরামি, পুরুষপোলা, দূরকাইল্লা দিনে, ডর, সুরুজ, চান্দি বরাবর, রান্ধনঘর, অগ্রাহ্যি, আওভাও— এরকম শয়ে শয়ে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে উপন্যাসজুড়ে। লেখক আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার করেন মানবাংলার সংস্কৃতপ্রধান শব্দের সাথে বেশ কায়দার সাথে, যেখানে দুটা বিষয় যুগপৎ ঘটে : এক. বাক্যে মানবাংলার শব্দঝংকারের হ্রস্যতা আর সেই সাথে সমতা রেখে, সাযুজ্য রেখে আঞ্চলিক শব্দের যথাযথ ব্যবহার। এই কৌশল লেখকের একান্ত কৌশল বলেই মন করি। আঞ্চলিক শব্দের বেশি বেশি ব্যবহার উপন্যাসকে একঘেয়ে ও জটিল, দুর্বাধ্য করে ফেলতে পারে বলে অনেক জ্যেষ্ঠ ও বড়মাপের সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার না করে মানবাংলা দিয়ে কাজটি চালিয়ে নেন অনেক সময়; শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ সেরকম একটি কীর্তি। আবার আঞ্চলিক শব্দের অতি-ব্যবহারে পাঠকের মধ্যে অস্বস্তির জন্ম দিতে পারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘খোয়াবনামা’ পাঠ করে। এই দুই প্রকল্পের মাঝখানে আকিমুন রহমানের মধ্যবর্তী অবস্থান বাংলাসাহিত্যের ভাষারীতিতে অভিনব একটা কীর্তি যোগ হয়েছে স্পষ্টতই। ভাষারীতির ব্যাপারে আরেকটা বিষয় বলার আছে; তা হল : আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার যে কৃত্রিমভাবে খাটানো হয়েছে বাক্যে তা নয়, সে-সাথে যোগ হয়েছে তাঁর একটি অদ্ভুত ও অপূর্ব কৌশল; সেটি চরিত্রসংলাপ, লেখকবয়ান এবং এ দুয়ের মিলনে তৃতীয় এক অভিব্যক্তি, যেটি অনেকটা স্বগতোক্তি কিংবা পাঠকের মনের ভাষাও যেটিকে বলা যায়, তার উদ্ভাবন।  

‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ উপন্যাসটিতে আঞ্চলিক ভাষা ও আঞ্চলিকতার মনোরম বর্ণনা আছে, আছে এতে দারুণ সব অভিব্যক্তি। মায়ের সন্তানবাৎসল্যের আকুল-করা অপরূপ অনুভূতির প্রকাশ বইটিকে একেবারে ‍‍`বাংলাদেশি উপন্যাসে‍‍`র স্বাদ এনে দিয়েছে। জুলিকে বিয়ে করবে শুনে ইসুফ মিয়ার ওপর নিদারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে ভর্ৎসনা করে শুরু করে তার মা। কিন্তু যখন জুলির অন্তর্ধানে অসুখে জর্জরিত সন্তানকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনে মা, তখন তার অসাধারণ অভিব্যক্তিটা এ-প্রসঙ্গে না আনলেই নয়। স্মর্তব্য, কাহিনির মধ্যকার চরিত্রের সংলাপ আর লেখকের বর্ণনার ভাষা যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রায়, সেখানেই স্বাতন্ত্র্য কীর্তি রেখে যান আকিমুন রহমান :

‘‘এত যে পুতের সেবা-যত্ন-গোছ-গাছে ডুবে থেকেছে ইসুফ মিয়ার মায়ে, তা-ও নি তার কিছুমাত্র রেহাই মিলেছে!

প্রতিটা দণ্ড ছোবল দিতে দিতে তার অন্তর তারে কী বলেছে : ‘তর তেনে বড়ো জালেম দুনিয়ার আর কোন মায়? আর কোনো মায় না! তুই খালি একলা এক পিশাচ! এতা সগল অনিষ্টি ক্যান আইছে সংসারে? ক্যান আইছে ইসুফ মিয়ার মায়? আইছে খালি এই তর কারোণে! তুই কি গভ্ভধারিনী না ডাইন? ক! তুই কী?’

‘হ! হ! ইসুফ মিয়ার মায়ের তেনে পাপিষ্ঠ, জালেম মা, আর এই মাটির সংসারে জনম নেয় নাইক্কা! মায়ে নিজ হস্তে মারছে নিজের পোলারে। নিজ হস্তে কোরবানি দিছে পুতের সাধ-আল্লাদরে! হ! এইটা সত্য!’’

বাঙালির লোকবিশ্বাস, জনশ্রুতি, চিরায়ত সংস্কারকে ভিত্তি ধরে উপন্যাসের কাহিনিকে প্রাণ দেন লেখক। ভোমরা যে মানুষকে গুপ্তকথার জানান্তি দেয়, বেদেদের ধূলিপড়া যে বিষম-ভয়ানক কাজ দেয়, বাছুর বিয়ানোর পর গাভীর প্রথম দুধে যে মানুষের অধিকার নেই, আগে যে পাড়াপড়শিকে দুধ দিয়ে তবেই না নিজেদের খাওয়া চলে, পানির গভীরে থাকা মাছেদের অনুনয়-বিনয় করে মানত করা—এ সবই বাঙালির আবহমান কালের সংস্কৃতিসাক্ষ্য। চৈতমাসের দুপুরে জমিদারবউকে সঙ্গ দেয়ার জন্য গ্রামের রায়ত-পরিবারের দুই নারী যখন পথ চলছিল, বেগুনি রঙের আকন্দের ঝোপের ওপর কালো ভোমরা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা। এ অবস্থায় তাদের কিছু ক্রিয়াকর্মের নিটোল বর্ণনা আছে আখ্যানটিতে :

‘‘ভোমর যে মানুষের ভবিষ্যৎকালের গুপ্তকথা জানানি দিয়ে যায়, এটা দেওভাগ গ্রামের সকেলই চিরকাল ধরেই জানে। সেই কারণে ভোমরা দেখলেই দাঁড়ায়ে পড়ার বিধি আছে এই গ্রামে। ...কিন্তু যেই গুপ্তসংবাদ ভোমরারা মানুষেরে জানানি দেয়, তার মর্ম বোঝা সহজ কাজ না। ...যদি এই আওয়াজ টানা গোঙানির মতন হয়, তাইলে সংবাদ আসবে শুভ। যদি সেই আওয়াজ কেমন একটু ছাড়া-ছাড়া, থামা-থামা হয়; কানে যদি তারে মিঠা-মিঠা, গুনগুন শোনায়, তাইলে জানবা বিষয়টা সুবিধার না।

‘আজকা তাইলে কি সংবাদ আনছো রে ভোমরা?’ নিঃশ্বাস বন্ধ করে তারা দুইজনে কান পাতে ভোমরার ডাকে। আর, তাদের অন্তরে ধুম জপতে থাকে—‘ও ভোমরা! ভোমরা রে! গোঙানি দেও। মিঠাসুর দিও না রে! ওরে ভোমরা, গোঙানি দেও।’’

চৈত্রমাসের এক খরখরা, জনমানবশূন্য জামদারবাড়ির পুকুরে গোসল করতে গিয়ে জুলি যখন আচানক গায়েব হয়ে যায়, এর ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই পুরো গ্রাম এক হয়ে জড়ো হয় পুকুরপাড়ে। জুলিকে তোলার জন্য জাল ফেলা হয় সেখানে। কিন্তু জুলিকে তো আর পাওয়া যায় না। তখন গ্রামের মা-চাচিরা মানত দেয় পুকুর থেকে উঠে আসা মাছদের :

‘‘জালের সব মাছই কি ঝাড়া খেয়ে ঝপাঝপ গিয়ে পানিতে পড়ে? না তো!
দুই চারটা মাছ তো এদিক সেদিকে ছটকা খেয়ে খেয়ে মাটিতে গিয়েও পড়তে থাকে।
সেই মাছেদের আস্তে-সুস্থে মানকচুর পাতায় তুলে, সেই মানকচুর পাতাখানরে ঘেরাও দিয়ে বসে মা-চাচিরা। তাদের কিছু টোটকা করার আছে।

‘পাতালের মাছরে! তোমরা তো আবার যাইবাগা পাতালে। যাওনের আগে তোমরারে মাছ, এই শনির দশায় পড়া মানুষগিলির মিন্নতিখান শুইন্না যাও!’ মা-চাচিরা একজন একজন করে মাছদের মিন্নতি করতে থাকে। ‘পাতালের মাছ, অত্তলের মাছ, গহীনের মাছ রে! বাবাসগল, তোমাগো মিন্নতি মেই। পুষ্কুনির কোনা-খামছিতে যুদি ঝুলেখারে চক্ষে পড়ে তোমাগো, অক্ষণ অক্ষণ আইসা সন্ধানটা দিয়া যাইও ধনেরা।
তারপর তারা আলগোচ্ছে সেই মাছ রাখা মানকচুর পাতা নিয়ে পানিতে চুবায়। আর নানারকমে মাথার কিরা দিতে থাকে মাছেদের। সেই কিরা শুনতে শুনতে মাছেরা একেকটায় এককরকমে পানির তলে ডুব দেয়।’’

অন্তর্হিত জুলেখার সন্ধানে গ্রামবাসীরা একত্রিত হলে কেউ একজন সাব্যস্ত করে, বাইদ্যারা তাদের ভয়ানক ধূলিপড়া দিয়ে জুলিকে ধরে নিয়ে গেছে হয়তো। লেখক ও চরিত্রের ভাষ্য :

‘‘বাইদ্যাদের সকল টোনার বড়ো টোনা হচ্ছে এই ধূলিপড়া। এক মুষ্টি ধুলার মধ্যে তন্ত্রমন্ত্র পড়ে ফুঁ দেয় তারা। ফুঁ দিয়ে সেই ধুল যার দিকে ছিটায় তারা, সে সঙ্গে সঙ্গে বেবোধা হয়ে যায়।

‍‍`...সব্বোনাশরে! ধূলিপড়া দিয়া থাকলে জুলেখারে নিতে আর ঝামেলা কী হইছে বাইদ্যানিগো? দেখোগা! কোনোরকম ঝামেলাই হয় নাইক্কা। অরা জুলেখারে ধূলিপড়া দিয়া কোনোরকমে খালি কইছে, আয়! আমাগো লগে লগে আয়! জুলেখায় বেবোধা হইয়া, সোন্দর, তাগো হুকুমমেেতান তাগো পিছে পিছে গেছে গা! হায় হায় হায়! তাইলে তো ভীষণ গজইব্বা কাম অইছে!’’

 

ভাষাচিন্তা

আকিমুন রহমানের গদ্যভঙ্গিতে একটা আশ্চর্য সারল্য ছাড়াও পাওয়া যায় ভিন্ন একটা রসের স্বাদ; তা তাঁর চরিত্রগুলোর সংলাপ ও তাদের সংলাপপ্রায় অভিব্যক্তি এবং লেখকের বর্ণনায় তাদেরই নিজের মতো করে বিবৃতি :

‘‘হায় হায় গো দিদি! আমরা জমিদারঠাকুরের চরিত্র লইয়া কথা কমু? চরিত্র নিয়া কথা কই না গো! এই ছোট মোখে এতা বড়ো সাহস হয় নাই গো দিদি!’ ডরে আর শরমে গ্রামের মা-বোন সকলের কলজার পানি শুকায়ে যায়। হায় হায় ঠাকুরনীদিদিয়ে এটি কী কয়! 
তাদের কথা দিদিয়ে যেনো গ্রাহ্যিই করে না। সে আপনা মনে আপনা কথা বলেই যেতে থাকে : ‘কায়া বদলির পর বৌদিদির কাছে জমিদার ঠাকুরে অহন নিত্য নিশিকালে আহে। তোমাগো সেয় পাইলোই কয়; আর দেখলোই কই, কও? তোমরা কোনোজনে কি নিশিকালে গেছো ঠাকুর-বাড়িতে? যাও নাই।তাইলে বোন পরানে এমুন পুন্নিমানরে কুকথা কইতাছো? সেয় কি ভূত-পেরেত যে সেয় অমঙ্গল দিবো তোমাগো?’

‘আর দেখো তারা কেমন বুদ্ধিনাশা! এমুন ভালা জিনসরে ভালা চক্ষে দেখার ক্ষ্যামতাখানও তাগো নাই।’ এমুন বুদ্ধির কপালে মুইড়া পিছা!’ মা-বৌয়েরা শরমে দগ্ধাতে থাকে।’’ 
....

‘‘পিছনে পিছনে ওই দুজনকে আসতে দেখে ঠাকুরনীদিদির আত্মায় য্যান পানি পায়। হনহন কদমে একলা যেতে যেতে, 
ভেতরে ভেতরে তার বড়ো বেতালা লাগছিলো। ‘অখন বাড়িতে গিয়া একলা হাতে সে রান্ধনঘর সামলাইবো না বৌদিদিরে 
আগলাইবো! কোনটা থুইয়া কোনটা করবো সেয়!’ মনে মনে বেদিশা হয়ে সে জপতে থাকে দয়ালের নাম। ‘দয়াল তুমি জানো! 
দয়াল ঠাকুর! তুমি সহায় না হইলে আমার সাধ্যি নাই কিছু করি দয়াল!’

দেখো দয়ালের কী দয়া! কেমন সুন্দর দুইজনেরে পাঠাইয়া দিছে সে—পিছনে পিছনে!’’

অলৌকিকের অস্পষ্ট আলো আর দ্যুতিজড়ানো অন্ধকার-ভুবন

‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ আখ্যানটির গল্পের শরীরের মধ্যে তথাকথিত ‘যাদুবাস্তবতা’ রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। আচানক কোনো অলৌকিকতার প্রদর্শন এখানে নেই; তত্ত্ব মেনে গল্পের শরীরে যাদুবাস্তবতা ঢেলে দেয়ার দাসত্বও এখানে নেই। বাংলাদেশের গ্রামজীবনের মধ্যকার চির-আচরিত জীবনধারার মধ্যেই আচানক একটি কিশোরী মেয়ের নাই হয়ে যাওয়া মানেই যে লৌকিকতার বাইরের কোনো ঘটনা, তা হয়তো নয়। উপন্যাসের শেষে আমরা কিন্তু ঠিকই একটা বার্তা পেয়ে যাই লেখকের মুখ থেকে যে : ‘অথচ একদিন জুলেখা ফিরে আসবেই—দেওভোগ গ্রামে।’ তখন বইয়ের ফ্ল্যাপে দেয়া কিছু কথা গুনগুন করে বাজতে থাকে মনে : ‘এ-উপন্যাসের আদি পর্বে বাস্তবতার মৃত্তিকায় যে গল্পের উদ্গম ঘটেছে, তার প্রপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে লৌকিক জগতের সীমানার বাইরে; অলৌকিকের অনেক অস্পষ্ট আলো এবং অনেক দ্যুতিজড়ানো অন্ধকারের ভুবনে।’ ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ উপন্যাসটির অন্ত পর্বে হয়তো আমরা সেই অস্পষ্ট আলো এবং অনেক দ্যুতিজড়ানো অন্ধকারের ভুবনের পরিচয় পাব।

 

প্রেমোপাখ্যান : ইসুফ-জুলেখা

‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ শেষ পর্যন্ত কিন্তু প্রেমের উপন্যাসই। উপন্যাসটির সাথে সামান্য মিল রয়েছে লেখকের ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’র সাথে। দুটির বিষয়ই প্রেম—দুজনের নবযৌবন প্রাপ্তির সূচনায় প্রেম, একেবারে প্রথম দেখায় প্রেম। প্রথম দেখার পর থেকে দুজনের যে অদম্য বাসনা পরস্পরকে দেখার, তা ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিনে’ যেভাবে গড়ে তুলেছেন লেখক, তা অনির্বচনীয় একটা অনুভূতি মনের মধ্যে দোল দিয়ে যেতে পারে। প্রধান চরিত্র জুলিকে একপাশে রেখে ইসুফ মিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার প্রেমের তীব্র প্রকাশ আমরা দেখতে পাই এখানে। এর বিপরীত চরিত্র-অভিব্যক্তি পাই ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’-তে; সেখানে মূলত প্রেমিকা শিরি’র দৃষ্টিভঙ্গিতে নামপুরুষে চলতে থাকে প্রেমের কাতরতা। যদিও উপন্যাসদুটির সময় ও স্থান ভিন্ন—একটি ১৩৩০ বঙ্গাব্দের, আরেকটি ১৯৭২ সালের, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের; একটি চিরায়ত গ্রামের, অন্যটি মফস্বল শহরের প্রেক্ষিতে। আরেকটি বিষয়ে মিল রয়েছে উপন্যাসদুটিতে, সেটি বিশ্বখ্যাত প্রেমোপাখ্যান শিরি-ফরহাদ ও ইসুফ-জুলেখা থেকে উপন্যাসদুটির কেন্দ্রীয় চরিত্রনাম নেয়া।

প্রেমোপাখ্যানগুলো থেকে চরিত্রনাম নেয়ার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক হয়ত শুরুতেই একটা ইঙ্গিত দিয়ে বলে দিতে চান যে, এটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেমের উপন্যাসই। মা-বাবার প্রাণমণি, কোমল হৃদয়ের জুলি বেড়ে ওঠে নিম্নবিত্ত অথচ আর্থিক অনটন নেই, এমন পরিবারে। অন্যদিকে সচ্ছল পরিবারের ছেলে ইসুফ, সেও মায়ের নয়নমণি। জুলির প্রেমে সামান্যতম বাধা আসলে ‘ঘাউরা’ সে হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু তার অন্তর বড়ো পরিষ্কার। বড়শিতে কীভাবে মাছ আটকাতে হয়, তা দেখিয়ে দেয়া, জুলির মায়ের চোখ এড়িয়ে তাকে দেখতে আসা, গ্রামের বিস্তীর্ণ বিলে শাপলা তোলার ছলে সম্পর্কের দড়িকে শক্ত বাঁধনে বাঁধা, মৌমাছিকে কায়দা করে কীভাবে দুহাতের তালুতে হাতে বন্দি করা যায়, তার শিক্ষা দিতে গিয়ে জুলির হাতে হুল ফোটা— এসবের রোমাঞ্চকর বর্ণনা আছে উপন্যাসটির পাতায় পাতায়। জুলির অন্তর্ধানের আগে মায়ের কাছে সে বিয়ের প্রসঙ্গ পাড়লে মা যখন প্রবল ঘৃণায় তা প্রত্যাখ্যান করে, তখন আমাদের হৃদয়ও ভেঙে যায় ইসুফ মিয়ার মতোই। জুলির অন্তর্ধানের অব্যবহিত পরে ইসুফের রোগশয্যায় ছেলের করুণ দশা দেখে মায়ের করুণ আত্মোপলব্ধি আমাদের চোখকেও করুণ করে দেয়। আর ইসুফ মিয়ার বুকের মধ্যে থাকা জুলি-হারানোর বেদনা আমাদেরকে তাদের অক্ষয় প্রেমের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয় ক্ষণে ক্ষণে। উপন্যাসটিতে ইসুফ মিয়ার কাছ থেকে জুলিকে সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক যেন আমাদের এই ইঙ্গিত দিয়ে যান, প্রকৃত প্রেম যেন ক্ষণস্থায়ী, অধরা এ ভুবনে। অনেক যত্ন, অনেক সময় আর অনেক ঘাতপ্রতিঘাত সয়ে তাকে লালন করে যেতে হয় নিত্য। আমাদের দেশীয় ইসুফ-জুলি, বিশ্বলোকশ্রুতির ইউসুফ-জুলেখার সমার্থক হয়ে ওঠে ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’-এর গল্প বলা ও এর অন্তস্থিত বক্তব্যের কারণে। একথা বললে বেশি বলা হবে না যে, বিরহ যাপনের মধ্য দিয়ে প্রেমের গভীরতর উপলব্ধির যে সাক্ষ্য আছে উপন্যাসটিতে, তা শুধু নিতান্তই এক প্রেমের উপন্যাস হিসেবে নয়, বাংলা উপন্যাসের ধারায় এটি হয়ে উঠেছে এক যথার্থ ও সার্থক রসসাহিত্য।

 

আঙ্গিক

সরল আঙ্গিকে ঘটনা বর্ণনা না করে প্লটকে একটু ভেঙেচুরে, আগে-পরে করে নিয়ে গল্প বলতে ভালোবাসেন কথাসাহিত্যিক আকিমুন রহমান। বর্তমানকে ভবিষ্যতের জন্য শিকেয় তুলে রেখে, আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে অতীত কোনো ঘটনাকে বিবৃত করে আবার বর্তমানে ফিরে আসা তাঁর একটা টেকনিক বটে, যেখানে বর্ণিত কাহিনির অনিশ্চয়তা আমাদেরকে পুরা আখ্যানটিকে পড়ে শেষ করার জন্য ব্যগ্র করে রাখে। ঠাকুরনীদিদি ও পুরুতঠাকুরের হঠাৎ অন্তর্ধান আমাদেরকে বেদিশা করে দেয় এই ভেবে যে, তবে কি ঠাকুরনীদিদিই মেরে ফেলে জমিদারবউকে? নইলে অমন বেদিশার মতো লাগছিল কেন তাকে, যখন মহিলা-দুজন জমিদারবউকে ঘাটে পড়ে থাকতে দেখেছে। পুরো উপন্যাসজুড়ে এর কোনো বিহিত নেই, ছায়াপাত নেই। কিন্তু ঘটনার অনিশ্চয়তা আমাদের মনে ঠিকই রেখাপাত করে যায়— কিশোরী জুলি হঠাৎ কোথায় উধাও হলো? আর ঠাকুরনীদিদিই-বা তার স্বামীসহ আতকা তীর্থে যাবার নাম করে হাওয়া হয়ে গেল? আর কেন ফিরল না তারা দেওভোগ গ্রামে! আখ্যানশুরুতে প্রধান চরিত্র থাকে জুলি, এরপর মাঝামাঝির একটু আগে হয় ইসুফ। এ দুজনের মাঝে দেওভোগ গ্রামের গল্প বলতে গিয়ে গ্রামের বিভিন্ন চরিত্রসহ ঠাকুরনীদিদিকে (জমিদার, জমিদারউ আর পুরুতঠাকুর প্রায় অলক্ষে) প্রধান চরিত্রের ভূমিকায় দেখতে পাই আমরা। জুলির নিরুদ্দেেশের সূত্র ধরে আসে মসজিদের পাজ্ঞ ইমাম এবং ইসুফ। এরপর ফ্ল্যাশব্যাকে ইসুফ-জুলেখা কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপায়ণ করে, তাদের ‘প্রথম দেখায় প্রেমে’র গল্প চলতে থাকে। সবার শেষে ইসুফ ও তার মা এসে প্রধান চরিত্রের রূপ ধারণ করে। এভাবে, উপন্যাসের প্রাণ যে গল্প, তাকে প্রাধান্য দিয়ে, কাহিনিকে একের পর এক ভেঙে ফেলে আর গল্প বলার দক্ষতার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আমাদের পাঠ-কে যেরকম অনুপম ফাঁদে ফেলেন, তা রসসাহিত্যের ধারায় এককথায় অপূর্ব, অনন্যসাধারণ একটা সৃষ্টি বলে মনে হবে আমাদের কাছে।

 

লেখক: ব্যক্তি ও তাঁর কীর্তি

অধ্যাপক ড. আকিমুন রহমানের বর্ণাঢ্য সময় কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীষণ ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক। ভারত ও ইওরোপের বেশ কয়েক বছরের প্রবাসজীবনে ছিলেন গবেষক। বেশকটি বিখ্যাত গবেষণাকীর্তি আছে তাঁর বাংলাসাহিত্যসংস্কৃতি অঙ্গনে। এত কিছুর পরও রসসাহিত্য বা কল্পসাহিত্যের কীর্তনিয়া বলেই মনে করেন নিজেকে। বাবার চাকরিসূত্রে ছোটবেলায় বড় হয়েছেন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আর শেষে নারায়ণগঞ্জের নিভৃত পল্লী দেওভোগে, মায়ের বড়িতে। একের পর এক লিখে গেছেন বাংলাদেশের গ্রামকে নিয়ে, তার লোকজীবন, প্রেম, বিশ্বাস, কল্পকথা, লোকবিশ্বাস, সংস্কার নিয়ে। আর সবচেয়ে বড় যে কাজটি তিনি ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিনে’ করেছেন, তা হচ্ছে, এ উপন্যাসে মানুষের নোংরামিকে তিনি দেখাতে চাননি। মানুষের হৃদয়ের কার্পণ্য দেখাতে চাননি। এখানে নেই পরিবার ও সমাজে কাউকে অভিযোগ করার বিষয়টি পর্যন্ত।

এখানে আছে প্রাকৃত বাংলার মধুক্ষরা জীবন, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও মানুষের হৃদয়ের কাতরতার অভিব্যক্তি, মানবমানবীপ্রেমের সারল্য, আর আছে যূথবদ্ধতার সাক্ষ্য। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর আজন্ম লালিত ইতিবাচক ধারণা থেকেই তিনি হয়ত এ-কাজটি করেছেন উপন্যাসটিতে। হয়তো তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ ও ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’র ভেতরে পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নেতিবাচক তথা মানুষের সীমাহীন বর্বতার কথা লিখে লিখে। জনপ্রিয় এ-দুটি উপন্যাসের পর তিনি হয়ত বাঙালিকে আর বাংলাদেশকে আঁকতে চেয়েছেন ভালোবাসার নিরুপদ্রব চোখ দিয়ে, ছোটবেলায় পরিচিত সেই সরল-লক্ষ্মী গ্রামকে, বাঙালির আবহমান কৃষ্টিকে সাজাতে চেয়েছেন তাঁর আখ্যানগুলোর মধ্য দিয়ে। ‍‍`সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ পাঠে মোটা দাগে তাঁর সম্পর্কে একটি মন্তব্য করা যেতে পারে, তা হল—বাঙালির সারল্য ও অনুপম দেশাচার আকিমুন রহমানের কল্পসাহিত্যের পোশাক। কাহিনি তাঁর শরীরের আবরণ। বাঙালির লোকবিশ্বাস, জনশ্রুতি, চিরায়ত সংস্কার তাঁর মাংস। হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে উৎসারিত দেশপ্রীতি তাঁর শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত রক্ত।

আবার ফেরা যাক ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিনে’র সেই ফ্ল্যাপের অংশটিতে, যেখানে মুদ্রিত আছে : ‘এ-উপন্যাসের আদি পর্বে বাস্তবতার মৃত্তিকায় যে গল্পের উদ্গম ঘটেছে, তার প্রপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে লৌকিক জগতের সীমানার বাইরে; অলৌকিকের অনেক অস্পষ্ট আলো এবং অনেক দ্যুতিজড়ানো অন্ধকারের ভুবনে।’—অলৌকিকতা এখানে একটাই, জুলির নাই হয়ে যাওয়া। লৌকিক জগতের সীমানার বাইরে যদি কিছু ঘটে থাকে, তা পাঠকের চিন্তার অনুরণন হয়ত। ‘অস্পষ্ট আলো’ এখানে জুলি ও পুরুতঠাকুর-ঠাকুরনীদিদি জুটির অন্তর্হিত হওয়া আর বেদেদের হাতে জুলির অপহৃত হয়ার সম্ভাবনা। আর গল্পের ডালপালার অনেকরকম অনিশ্চয়তা-সম্ভাবনা হয়ত এখানে ‘অনেক দ্যুতিজড়ানো অন্ধকারের ভুবন’।

........................
আকিমুন রহমানের উপন্যাস ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’ (প্রথম প্রকাশ : ২০১৬)
খড়িমাটি সংস্করণ ২০২০
মূল্য : ৩৫০ টাকা