টরন্টো টকিজ ৬

সিনেমার মাধুরী, সিনেমার মদিরা

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৩, ০৭:১৩ এএম

সকাল পৌনে সাতটায় বেরোতে গিয়ে দেখি সন্ধ্যার আকাশের মতো অন্ধকার করে সূর্য ঢেকে রেখেছে টরন্টোর মেঘমালা। শুধু তা-ই নয়, সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এই ঝিরঝির বারি মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেন জানি শচীনকর্তাকে মনে পড়ল। কানে এয়ারফোন গুঁজে শুনতে শুনতে বাসে উঠলাম। মেইন স্ট্রিট পাতাল রেলস্টেশনে এক আরব লোক সুন্দর তালযন্ত্র বাজান, কেমন জলতরঙ্গের আওয়াজ বের হয়। পাশে পেতে রাখা কাপড়ে পড়ে থাকে নানা আকারের মুদ্রা। এখানকার ভিক্ষুকরা শিল্পী, অথবা ভিক্ষা করতে হলে শিল্পচর্চা করতে হয়, বিশেষ করে সংগীতচর্চা। পশ্চিমে এই রীতিটা বেশ জনপ্রিয়। আমারও ভালো লাগে। শুধু শুধু হাত পাতা কেন? পথচারীর চিত্তকে আহ্লাদিত করে পয়সা নিলে বোধ করি গ্লানি থাকে না। আর প্রতিদিন সুরের মূর্ছনা কানে নিয়ে হয় মানুষ কর্মদিবস শুরু করেন, নয়তো ক্লান্তি ভুলে বাড়ি ফেরেন। খারাপ কি!


আমি শচীনকর্তাকে শুনতে শুনতে কিং স্ট্রিট ওয়েস্ট রোড ধরে এগোচ্ছি স্কশিয়াব্যাংকের দিকে। আজও দক্ষিণ কোরিয়ার ছবি দেখব। দেশটির ছবি স্বীকার করতেই হয়, অন্য মাত্রা যোগ করে চলেছে বিশ্বের চলচ্চিত্রে। বাইয়ুন সেয়াংমিন পরিচালিত ছবিটির নাম ‘বারগেইন’। আমি যখন থিয়েটারের নিচে এলাম, তখনো মূল ফটক খোলেনি আর বাইরে পড়ছে বৃষ্টি। পাশের দরজা দিয়ে ওপরে থিয়েটার হলের লাগোয়া রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। দু-একজন করে অনেকেই এসে বসছেন সেখানে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ফোন দিলেন একাত্তর টিভির সাংবাদিক পার্থ সনজয়। ওনার টিফ-সংক্রান্ত প্যাকেজের জন্য কিছু জিভি ফুটেজ পাঠিয়েছিলাম আগের দিন। উনি জানতে চাইলেন ফুটেজগুলো বেল লাইটবক্সেরই কি না। ওখানেই ১৩ সেপ্টেম্বর প্রদর্শিত হবে বঙ্গবন্ধুর ওপর করা বায়োপিক ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব নেশন’। পার্থ আরও জানতে চাইলেন ছবিটি টিফের কোন বিভাগে দেখানো হবে। আমি জানতাম, তা-ও প্রিয়াংকাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে পার্থকে জানালাম, মার্কেট স্ক্রিনিং বিভাগে। ওখানে টাকা দিয়ে হল ভাড়া করে যে কেউ ছবি দেখাতে পারেন। অনেকটা কানের মার্শে দ্যু ফিল্মের মতো। অর্থের বিনিময়ে হল ভাড়া করে ছবি দেখানো হলে ‘টিফে বা কানে ছবি দেখানো হয়েছে’ বলে গর্ব বা গৌরব করার কিছু নেই। উৎসবগুলো এই আয়োজন রাখে কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য। কারণ তারা জানেন, দুনিয়ায় অনেকেই আছেন, যারা মূল উৎসবে সুযোগ না পেলেও, সাইড লাইনে থেকে বাইরের পরিবেশক ধরার জন্য হল ভাড়া নিয়ে ছবি দেখাতে আগ্রহী। কারণ উৎসবে অনেক দেশের পরিবেশক অংশগ্রহণ করেন। এ জন্যই আলাদা একটা জায়গা করে দিয়েছে উৎসব কর্তৃপক্ষ, সেখানে যে যার প্রয়োজনমতো পয়সা দিয়ে হল ভাড়া করে ছবি দেখায়। এতে হীনম্মন্যতায় ভুগে সঠিক তথ্য গোপন করার কিছু নেই।      
 

পার্থর সঙ্গে কথা শেষ করে হলে গিয়ে বসি। কয়েক মিনিটের মাথায় শুরু হয় দমবন্ধ করা ‘বারগেইন’। হাই-অক্টেন ধরনের এই ছবিতে একমুহূর্তের জন্যও ক্যামেরায় কাট হয়নি। টানা চরিত্রদের অনুসরণ করেছে ক্যামেরা। প্রোডাকশন ডিজাইন দেখার মতো। পুলিশের এক গোয়েন্দা এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাতে হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে। গোয়েন্দার দাবি, মেয়েটিকে কুমারী হতে হবে, নয়তো সে প্রতিশ্রুত টাকা দেবে না। মেয়েটি কুমারী নয়, তাই কম টাকাতেই সে শয্যায় যেতে রাজি হয়। কিন্তু তখনো গোয়েন্দা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে একটু পরে। সে আসলে ফাঁদে পা দিয়েছে। যৌনতা বিক্রির নাম করে বিভিন্ন লোকেদের হোটেলে আটকে, তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চোরাই বাজারে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে এক ভয়ংকর চক্র। মেয়েটি সেই চক্রেরই সদস্য। গোয়েন্দা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলে যায় নিলামের টেবিলে। সেখানে তার হাত-পা-চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় কিডনি, ফুসফুস, চোখ সব বিক্রির দরদাম চলতে থাকে। কিন্তু এমন সময় এক তীব্র ভূমিকম্পে ধসে পড়ে হোটেল ভবন। শুরু হয় সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হওয়ার লড়াই। স্বার্থপরতাই সেখানে প্রকট হয়ে ওঠে। সবাই সবার মাথায় পা রেখে বের হতে চায় কংক্রিটের জঞ্জাল থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এই ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ বের হতে পারছে না। 
 

সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে ডিজাস্টার মুভি, কিন্তু মেটাফোরিক্যালি দেখলে বোঝা যায় মানবজীবন এক ধ্বংসস্তূপ, সারা জীবন মানুষ সেখান থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু মুক্তি মেলে না। পালানোর পথও খোলা থাকে না। বুদ্ধ দর্শন প্রভাবিত এই ছবিতেও আর দশটা দক্ষিণ কোরিয়ার ছবির মতো হাঙর-প্রমাণ ঋণ ও রক্তারক্তি আছে। এসব বাণিজ্যিক উপাদান বাদ দিলে ছবিটি মন্দ নয়। 
 

সিনেমাটি শেষ করে থিয়েটারের বাইরে এসে দেখি তখনো মন্থরগতিতে বৃষ্টি পড়ছে। আজ নতুন এক জায়গায় যেতে হবে, কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং সেন্টার, সিবিসি। বেশি দূরে নয়, আট মিনিটের হাঁটা পথ। সেখানকার গ্লেন গৌল্ড স্টুডিওতে আনন্দ পটবর্ধনের কথোপকথন আছে। টিফ এই আয়োজনের নাম দিয়েছে ভিশনারিজ। নতুন এক জায়গা খোঁজার মিশনে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। গিয়ে দেখি সেখানে চলছে ব্রিটিশ পরিচালক লুসি ওয়াকারের টক। এরপরই আনন্দের কথাবার্তা শুরু হবে। মোবাইলে দেখি প্রিয়াংকা বলছেন তিনি এখানেই আছেন। লুসির কথা শেষ হলে ভেতরে গিয়ে বসি। প্রিয়াংকা আবারও নিশ্চিত করলেন বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক মার্কেটি স্ক্রিনিং বিভাগেই দেখাবে। কানকথা থেকে শোনা যাচ্ছে, লোকে নাকি একে অফিশিয়াল স্ক্রিনিং বলছে। এই তথ্যটি ভুল। 
 

যাহোক, আনন্দকে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন ফেস্টিভ্যালের প্রোগ্রামার থম পাওয়ার্স। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের টকে পাওয়ার্স সে রকম কোনো পাওয়ারফুল প্রশ্ন করতে পারলেন না। যদিও আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তিনি দেখেছেন বোঝা গেল। আমিও আনন্দের ‘ইন দা নেইম অব গড’ (১৯৯২) ও ‘ফাদার, সান অ্যান্ড হলি ওয়ার’ (১৯৯৪) ছবি দুটি দেখেছি। আর আগের দিন তো নতুন ছবিটিই দেখলাম। আনন্দ নিজেকে এক্সিডেন্টাল ফিল্মমেকার বলেন। তিনি মনে করেন চলচ্চিত্র নিজেই নিজের কথা বলবে, আর চলচ্চিত্র হবে সাধারণ মানুষের মুখপাত্র, এলিটদের নয়।
কথোপকথনে আনন্দ জানালেন তিনি ছবি তৈরি করেছেন, আর সেই ছবি পাবলিক স্ক্রিনিংয়ের জন্য আইনি লড়াই করেছেন বছরের পর বছর। যেমন ‘বোম্বে: আওয়ার সিটি’ (১৯৮৫) ছবিটির জন্য আনন্দ জাতীয় পুরস্কার পান। কিন্তু ছবিটি জাতীয় টিভিতে যখন দেখাতে পারছিলেন না, তখন দ্বারস্থ হন আদালতের। সেই মামলায় তিনি জয় পেয়েছিলেন। এমন আরও উদাহরণ রয়েছে তার জীবনে। এসব শুনে পাওয়ার্স প্রশ্ন শুধালেন, এত ঝঞ্ঝাট করে ছবি না করে, অন্য কিছু করার কথা মনে আসেনি? আনন্দ জানালেন, ছবি করার ভেতর দিয়ে তিনি সমাজের বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদিতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আর চলচ্চিত্র মাধ্যমটি তার কাছে মনোমুগ্ধকর। এখানে আমি তার কথায় ঋত্বিকের ভঙ্গি খুঁজে পাই। চলচ্চিত্রের চেয়ে আরও কোনো শক্তিশালী মাধ্যম পেলে চলচ্চিত্র ছেড়ে সেই মাধ্যমেই কথা বলবেন আনন্দ। তিনি তৎপরতা চালানো নির্মাতা। দর্শককে তিনি নিষ্ক্রিয় বিনোদন দিতে চান না, বরং সুবিন্যস্ত তথ্য ও যুক্তি পরিবেশন করে সক্রিয় করতে চান।
 

৪৮তম টিফে কথা বলছেন আনন্দ পটবর্ধন। ছবি: লেখক

আমি টরন্টো আসার আগে আনন্দের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে ছবি নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, চলচ্চিত্রে শিল্প হিসেবে যা দেখা যায়, তার সবটুকুই তিনি করেন সম্পাদনার টেবিলে। আনন্দের কাজ সম্পর্কে যারা খোঁজ রাখেন, তারা জানেন, তিনি বছরের পর বছর ধরে ছবি সংগ্রহ করতে থাকেন। তারপর সেসব ছবি প্রবন্ধের মতো করে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন নতুন নতুন প্রজেক্টে। প্রামাণ্যচিত্রে তার বয়ানরীতি আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হয়। সূত্রধর আনন্দের ন্যারেটিভ স্টাইল নিয়ে কথা বললে আমার ভালো লাগত। কিন্তু তিনি নতুন ছবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলেন। স্বাভাবিক, পৌনে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে আর কী-ই বা বলা যায়! তবে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকা উচিত ছিল। তাহলে বর্তমানের ভূরাজনৈতিক অবস্থায় ভারত ও এর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সম্পর্কে অহিংস ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবে বিশ্বাসী আনন্দের দৃষ্টিভঙ্গিটি জানা যেত।
 

অনুষ্ঠান শেষে আনন্দকে জানালাম তার নতুন ছবিটি নিয়ে সামান্য একটু আলাপ করেছি, সেটা প্রকাশও হয়েছে, তখন তিনি লেখাটি পাঠাতে বললেন, তড়িৎ-ঠিকানাও দিলেন। আমি পাঠাব বলে বিদায় নিলাম। প্রিয়াংকার কর্মস্থল লাইটবক্সের চতুর্থ তলায়। আমি যাব ওটার নিচতলায়, বইয়ের দোকানে। প্রিয়াংকা চলে গেলে আমি একটি বই কিনলাম: ব্যালট্রুশাট ও এরিকসন সম্পাদিত ‘ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকিং অ্যারাউন্ড দ্য গ্লোব’।
 

বই কিনে মনের আনন্দে লাঞ্চ করলাম সবুজ সালাদ আর চিকেন দেওয়া র‍্যাপ, মানে রুটির রোল আরকি। খেয়ে হাঁসফাঁস দশা। বিশাল বস্তু। এর আগে একদিন বারবিকিউ পর্ক বার্গার খেয়েও একই দশা হয়েছিল। এ জন্য দুপুরে ফলটল খেয়ে থাকাই শ্রেয়। শরীর হালকা থাকে। খাওয়া শেষ করে আবার স্কশিয়াব্যাংক। রোদ উঠে গেছে। এবার দেখব ভারতীয় ছবি: তারসেম সিং ধান্দওয়ার পরিচালিত ‘ডিয়ার জেসি’। ছবিটি কেন টিফে স্থান পেয়েছে, তা শুরু হওয়ার পরই বোঝা গেল। ছবির এক চরিত্র জেসি থাকে কানাডা। আর আরেক চরিত্র মিঠু থাকে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামে, সে শিখ। তো কানাডায় নাকি ভারতের পর সবচেয়ে বেশি শিখ জনগোষ্ঠী বাস করে। এখানে এই ছবি দেখার দর্শক আছে। বিষয় কিছুই নয় মিঠু ও জেসির প্রেমকাহিনি। তবে সেটা করুণ। জেসির ধনী পরিবার দরিদ্র ও অটোরিকশাচালক মিঠুকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা অনার কিলিংয়ের পথ বেছে নেয়। জেসিকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়। আর মিঠুকে জখম করা হয় মারাত্মকভাবে। করুণ এই প্রেমকাহিনিকে তুলনা করা হয় রোমিও-জুলিয়েটের সঙ্গে। প্রথম থেকে অর্ধেক পর্যন্ত ঢিমে তালের গতানুগতিক প্রেমের গল্প মনে হলেও, পরে চিত্রনাট্যের দৌলতে ছবিতে কিছুটা প্রাণ সঞ্চার হয়। শেষভাগে ছবিতে উঠে আসে ভারতের ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীদের ভেতর থাকা মৌলবাদী চিন্তা ও পশ্চাৎপদতা। কানাডাপ্রবাসী হলেই সবাই প্রগতিশীল বা যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে না। পুরোনো সংস্কারের নামে তারা খুনের মতো জঘন্য কাজও করতে পারে।
 

ষষ্ঠ দিনের কার্যক্রম এখানেই শেষ করে বাসার পথ ধরি। উৎসব প্রায় অর্ধেক শেষ। কত বর্ণ-গন্ধ-ছন্দের ছবি যে দেখা হলো এই কদিনে। কত চিন্তা, কত মানুষের মেধা, শৈল্পিক প্রচেষ্টা, শত শত মানুষের শ্রম দিয়ে বানানো চলচ্চিত্র। আমরা দেখছি, আনন্দিত হচ্ছি, বেদনাবোধ করছি, বিরক্ত হচ্ছি, চিন্তিত হচ্ছি। এমন শিল্পের প্রতি কেউ আকৃষ্ট না হয়ে থাকতে পারে? আমি শুধু আকৃষ্ট নই, বলা যায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। চলচ্চিত্রের শক্তি আসলে এখানেই যে একে দেখে যত সহজে বোঝা যায়, তত সহজে একে ব্যাখ্যা করা যায় না।