জেন গল্প

গৌতম বুদ্ধের ঈশ্বর ভাবনা ও তাঁর উত্তর

উপল বড়ুয়া প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৩, ১০:৩৫ এএম
ছবি : সংগৃহীত

গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন কি করতেন না, তা নিয়ে পণ্ডিতজন নানা কথা বলে থাকেন। বুদ্ধের অনুসারীরা আবার অনেকে গৌতমকেই ‘ভগবান’ হিসেবে মেনে নেন। সেক্ষেত্রে পালিতে ব্যাখ্যা: ‘নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মা সম্বুদ্ধস্স’। বাংলায়: ‘ভগবান অরহৎ (নির্বাণপ্রাপ্ত) বুদ্ধকে পুজা-প্রণাম জানাচ্ছি’। এখানে ‘ভগবান’ সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আসেনি। আসেনি ঈশ্বরের প্রতিরূপ হিসেবেও। তবে শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সম্ভবত বুদ্ধের এই অভিধা হতে পারে। অবশ্য ধর্ম নিয়ে জ্ঞান অতি সীমিত হওয়ায় বিষয়টির পুরোপুরি ব্যখ্যা দিতে অক্ষম আমি। গৌতম বুদ্ধ ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কী ভাবতেন তা নিয়ে দারুণ এক বক্তব্য দিয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক গুরু ওশো। বৌদ্ধ ধর্মের আরেক ধারা জেন গল্পের খোঁজ করতে গিয়ে এক ফেসবুক পেজে তা পেলাম। বাঙলায়নে পাঠকদের উদ্দেশ্যে ইহা তারই নিবেদন—অনুবাদক।

ওশো : একদা ঘটলো কী, শিষ্যদের নিয়ে বুদ্ধ এক গ্রামে প্রবেশ করলেন। ওনাকে অনুসরণ করে এক লোক ওই গ্রামে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈশ্বরের কি অস্তিত্ব আছে?’ বুদ্ধের উত্তর, ‘না, নিঃসন্দেহে নাই’।  

ওই বিকেলে আরেক লোক এলো এবং তিনিও জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঈশ্বরের কি অস্তিত্ব আছে?’ এবার বুদ্ধ জানালেন, ‘হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে আছে’।

সন্ধ্যায় তৃতীয় এক ব্যক্তি এলো এবং তারও একই প্রশ্ন, ‘ঈশ্বরের কি অস্তিত্ব আছে?’ বুদ্ধ তাঁর চোখ বন্ধ করলেন এবং সম্পূর্ণরূপে চুপ থাকলেন। লোকটিও তার চোখ বন্ধ করলেন। এই নীরবতার মধ্য দিয়ে কিছু যেন সঞ্চারিত হলো। কয়েক মিনিট পর লোকটি বুদ্ধের চরণ যুগল স্পর্শ করলেন, নিচু হয়ে প্রণতি জানালেন, সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক বললেন, ‘আপনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।’

এখন, বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ এসব দেখে খুবই বিভ্রান্ত হয়ে বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সকালে আপনি বলেছেন, ঈশ্বর নেই। বিকেলে বললেন আছে। সন্ধ্যায় কোনো উত্তরই দিলেন না। ব্যাপারটা কী? তবে কোনটা আসল সত্য?’

বুদ্ধ যখন ঘুমোতে যাচ্ছিলেন, আনন্দ আবারও বললেন, ‘আগে আপনি আমার উত্তর প্রদান করুন; অন্যথা আমি ঘুমোতে পারবো না। আমার প্রতি আপনার আরেকটু দয়াশীল হতে হবে। সারাদিন ধরে আমি আপনার সঙ্গে আছি। ওই তিন লোক, একেকজন কী উত্তর পেয়েছে তা জানে না। কিন্তু আমি তিনটি উত্তরই শুনেছি। আমার প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন? আমি পুরোপুরি অস্থির হয়ে আছি।’

বুদ্ধ বললেন, ‘আমি তোমাকে আদৌ কিছু বলিনি। তুমিও জিজ্ঞেস করোনি, আমি তোমাকে কোনো উত্তর দিইনি। প্রথম যে লোক আমার কাছে এসেছিল সে ছিল ঈশ্বরে বিশ্বাসী, দ্বিতীয় যে লোকটি এসেছিল সে ছিল নাস্তিক, তৃতীয় যে লোকটি এসেছিল সে ছিল অজ্ঞেয়বাদী (জড়বস্তু ছাড়া ঈশ্বর নিয়ে যে কিছুই জানে না)। আমার উত্তর আদতে ঈশ্বর সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ছিল না, আমার উত্তর ছিল প্রশ্নকর্তার চিন্তার সঙ্গে কিছু করার। আমি প্রশ্নকর্তাদের উত্তর দিয়েছি, যা ছিল একেবারে ঈশ্বর বিষয়ে সম্পর্কহীন।

যে লোকটি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, আমি তাকে ‘না’ উত্তর দিলাম কারণ আমি চেয়েছিলাম ঈশ্বর নিয়ে সে তার ধারনা বাদ দিক, আমি চেয়েছিলাম সে তার ধার করা ঈশ্বর চিন্তা থেকে মুক্ত হোক। সে ঈশ্বরকে দর্শন করেনি। যদি সে ঈশ্বরের ভূয়োদর্শী হতো তবে আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতো না। তার দরকারও হতো না।

যে লোকটি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, সে আমার কাছে তার বিশ্বাসের নিশ্চয়তা পেতে চেষ্টা করেছিল। আমি তাকে হ্যাঁ-বোধক উত্তর দিতে চাইনি। আমি কারও বিশ্বাসের নিশ্চয়তা দিতে চাই না। তাই তাকে না বলতে হয়েছে। আমার তাকে অবজ্ঞা করতে হয়েছিল, অস্বীকার করতে হয়েছিল, কেবল তার বিশ্বাসকে বিনাশ করতে। কারণ প্রত্যেক বিশ্বাস সত্য জানার পথে বড় অন্তরায় (বাধা)। আস্তিক বা নাস্তিক, প্রত্যেক বিশ্বাস হচ্ছে জ্ঞানের পথে বাধা।

এবং যে লোকটির সাথে আমিও নিশ্চুপ ছিলাম, সেই ছিল সঠিক অনুসন্ধানী। তার কোনো বিশ্বাস ছিল না। অতএব, তার কোনোকিছু নির্মূল করার প্রশ্নই আসে না। আমি নীরব রইলাম। তার কাছে এই ছিল বার্তা: নীরব হও এবং জানো। জিজ্ঞেস করো না, কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। এটা কোনো প্রশ্ন নয়, যার উত্তর দেওয়া যেতে পারে। এটা অন্বেষণ নয়, তদন্ত। এক প্রকার তৃষ্ণা। নীরব হও এবং জানো।

তার জন্যও আমার উত্তর ছিল; যদিও আমার নীরবতা তাকে সেই বার্তা দিয়ে দিয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ সে তা অনুসরণ করলো। সেও নীরব হলো। আমি চোখ বন্ধ করলাম, সে-ও চোখ বন্ধ করলো; আমি অন্তঃস্থলে তাকালাম, সে-ও তাকালো, এবং তারপর কিছু অনুধাবন করলো। যার কারণে সে খুবই অতিভূত হলো, এত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। সাধারণ কারণ এটা যে, আমি তাকে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তর দিইনি। সে বৌদ্ধিক উত্তরের জন্য আসেনি; বৌদ্ধিক উত্তর সহজলভ্য ও অত্যন্ত সুলভ। তার অস্তিত্ব-সম্বন্ধীয় কিছু দরকার ছিল, সে তার স্বাদ পেয়েছে। আমি তাকে সেই স্বাদ দিয়েছি।