নজরুল ও বঙ্গবন্ধু: স্বরূপে সংগ্রামে

রজত সিকস্তি প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৩, ০৯:১৮ এএম

ইতিহাসের দুই দুইটি চরিত্রের মধ্যে যেন একই দ্যুতি জ্বলেছে। কোনো এক অদৃশ্য জাদু বাস্তবতায় যেন রক্ত-মুক্তির ইতিহাস খুঁজে নিয়েছে এই দুই নক্ষত্র মানবকে। এক যুগের নজরুলই যেন আরেক কালের পলি-কাদা ফুড়ে মুজিব মহীরুহ হয়ে জন্মলাভ করেন। হেঁটে চলে অগ্রজের সুর-বাণীর পথ ধরে বজ্র তর্জনী উঁচিয়ে।

ইতিহাসের রাজপথে আজ যদি আমরা নজরুলের সঙ্গে কারো চলার পথের খুব একটা সরল মিল খুঁজতে যাই, তবে দেখবো তিনি আর কেউ নন, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই সবচেয়ে বেশি জোড়মিল। দুজনের দুটি পথ দুই তীর ধরে চলেছে। অথচ ইতিহাসের সমুদ্রে দুই হাতের হ্যান্ডশেক হয়েছে মুক্তির তপস্যায়। সৃষ্টির উল্লাসে।

কবি নজরুলের তপস্যা সুর আর বাণী। সুরে-বাণীতে অসুরকে কুপোকাত করে মানুষের বিজয় উদ্বোধনকে তরান্বিত করা। স্বপ্ন দেখতে শেখানো। পরাজিত, মার খাওয়া, মজলুম, দেশহীন মানুষের স্বপ্নকে তৈরি করে দেওয়া। সেই স্বপ্নের মুক্তি কাণ্ডারি মানুষ নিজেই গড়ে নেবে। কবি পথের হদিস দেবেন না ঠিক, তবে পথ চেনার দৃষ্টি, পথ চলার দৃপ্তি, পথ পাড়ি দেওয়ার ইস্পাত প্রতিজ্ঞার যোগান ঠিকই দেবেন। মেঘের ভেতর বৃষ্টি হয়ে থাকা কিংবা ফুলের মধ্যে ফল হয়ে ওঠার মন্ত্রের মতো নীরবে-নেপথ্যে থেকে। মানুষকে ধারণ করে মানুষের সত্যকে আশ্রয় করে মানুষের স্বপ্নকে জাগিয়ে মানুষেরই চির ইতিহাস নির্মাণের রূপকল্প হলো নজরুলের রাজনীতি।

বঙ্গবন্ধুর ছিলো রাজনীতিই তপস্যা। মানুষের ক্ষুধা আর রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে মাঠের রাজনীতি। তিনি কেবল স্বপ্নদ্রষ্টা নন। সারথিও বটে। মুক্তি পিপাসু মানুষকে সঙ্গী করে পথে নেমে যাওয়া। কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জন না হওয়া অবধি কদম রেখে যাওয়া। তা-ই রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার রাজনীতি তাই মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত। ক্ষমতার চেয়ে জনতার দিকে ছিলো তার তপস্যার প্রধান ঝোঁক। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মিশেল। কাব্যিক হয়েও গদ্যময়।

দুজনেরই লক্ষ্য ও তপস্যা ছিল মানুষ। স্বপ্ন ছিল—মুক্তি। দুজনই ফিরে ফিরে এসেছেন সংগ্রামের পথে। সাহসের পদ্ধতিতে। কৌশলী হয়েছেন। কিন্তু কৌশলকে বারবার অতিক্রম করেছে সাহস।

নজরুল বারবার ব্রিটিশ প্রশাসনের রোষানলে পড়েছেন, নিপীড়িত হয়েছেন, নিষিদ্ধ হয়েছেন। মানুষের কাছ থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছেন। বই পুস্তক বাজেয়াপ্ত করা হয়েছেন। কণ্ঠ রোধ করা হয়েছেন। কিন্তু দমিয়ে রাখতে পেরেছি কি!

বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। বিচ্ছিন্ন হয়েছেন পরিবার থেকে। নিজের মানুষদের কাছ থেকে। রাজপথ থেকে। কিন্তু তাকে উৎখাত করা যায়নি। জনতার আরও মর্মমূলে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। মানুষের স্পর্ধা-আবেগ-স্বপ্ন হয়ে সিনা টানটান করে দণ্ডায়মান হয়েছেন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে।

নজরুলের জার্নিও একই কায়দায়। মর্মে মর্মে ছড়িয়ে পড়েছেন। বেজে উঠেছেন সুরের ঝংকারে। বিদ্ধ করেছেন বাণীর বাক্যবাণে।    

বঙ্গবন্ধু যেমন নিজে ইতিহাস সৃষ্টি করেন; ইতিহাসও বঙ্গবন্ধুকে বাতিঘর হয়ে হাতছানি দিয়ে ডেকে নেয়। বাঙালির জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের মহাসড়ক ধরে ইতিহাসের রাখাল রাজা যেন ইতিহাসের সে অমোঘ বাতিঘরের দিকেই দ্বিধাহীন এগিয়ে গিয়েছেন। কোথাও কোনো বিচ্যুতি নেই। সত্যের সঙ্গে লুকোছাপা নাই। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। আবার গ্রহণও করেন অঞ্জলি পেতে মানুষের ভালোবাসা, দ্যুতি, সম্মানের মদিরা।

অগ্রজ নজরুলও ছিলেন ঠিক একই পথের যাত্রী। একই ভাব, একই পদ্ধতির লেনদেন। ইতিহাসকে বুঝতে দুজনের কোথাও কোনো হুজ্জত হয়নি। দুজনের স্বভাব ধর্মে ছিলো একই ধাঁচের মানবিকতা প্রেম স্বজাতির প্রতি অলিখিত প্রতিজ্ঞা। তাই হয়তো নিজেদের বিলিয়ে দিতে এতোটুকু কার্পণ্য হয়নি।

নজরুলও তার বলয়ে ইতিহাসই গড়েছেন। ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল পথকে আপন ঠিকানা করেছেন। ইতিহাসের অগ্নি-শীতল শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করেছেন। পান করেছেন যুগ-দাবীর নদী প্রবাহিত স্বপ্নের মুক্ত শরাব। তাই তার নিছক প্রেমের দ্রোহের হাস্যরসের সুর-পঙ্‌ক্তির ভেতর থেকে ঝলক দিয়ে উঠে জাতি রাষ্ট্রের উদ্বোধনী পদরেখা। যুগের হয়েও যুগ-যুগান্তের কথাই শোনায়। শিরস্ত্রাণ হয়ে উঠে স্বপ্নের পতপতে পতাকা।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নজরুলের রাজনৈতিক সংগ্রাম-দর্শনের তিনটি প্রধান ঐক্য হলো—

১. শোষিতের পক্ষে অবস্থান
২. মানুষের রাজনৈতিক সাম্য ও মুক্তির লড়াইকে প্রথম পছন্দে রাখা
৩. সংগ্রামের পদ্ধতি হিসেবে সাহস ও সততাকেই বেছে নেওয়া

বিদ্রোহী নজরুল শোষিত-নিপীড়িত  মানুষের পক্ষে কণ্ঠ তুলেছেন, হুংকার দিয়েছেন। তবে সেটা যেন শেষতক প্রেম আর দরদের চৌকাঠ অতিক্রম করে নেতার রাজসিক অবয়বে না পৌঁছে সে নিয়ে ছিলেন বেজায় সতর্ক। ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার চেয়ে প্রেমিক আর সেবক হয়ে ওঠাই ছিল নজরুলের চির আরাধ্য।

আজন্মের প্রতিবাদী বঙ্গবন্ধু নিজের ভাগ্যহত জাতির জন্য বিভিন্ন কালপর্বে লড়াই করেছেন। কখনো কর্মী কখনো সেবক কখনো দ্রোহী। নেতা হিসেবে যদিও ইতিহাস তাকে বারবার লড়াইয়ের সম্মুখে ঠেলে দিয়েছে কিন্তু নিজেকে প্রথাগত নেতা হিসেবে কখনোই জাহির করেননি। বড়জোর হয়েছেন আশ্রয়স্থল, অভিভাবক!

মানুষের রাজনৈতিক সাম্য ও মুক্তির জন্য লড়াই ছিলো দুজনেরই নিয়তি। যত প্রকারের অসাম্য ও দাসত্ব মানুষকে তার আপন মৌলিক বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে আটকে দিতে চেয়েছে, তত প্রকারের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কথা ও সুর তুলেছেন নজরুল। অর্থনৈতিক শোষণ, জাত-পাতের অসাম্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, রাজনৈতিক অনৈক্যকে মানুষের মুক্তির মহাসড়কে বাধা হয়ে উঠতে দেননি। পথ নিষ্কণ্টক রেখেছেন। এগিয়ে নিয়েছেন মহা-দুর্বিপাকের অন্ধকারেও। টলেননি। টলতে দেননি নিজের মানুষদেরও।
আপোষ না রাজপথ—প্রশ্নে বরাবরই দুজনই ছিলেন জেল-জুলুমের রাজপথেরই সৈনিক। অন্যায়কে মোকাবেলা করেছেন সাহসিকতার পথ ধরেই। লক্ষ্য ছিলো সামনে। আদর্শ ছিলো মোকাবেলার। তাই পালানোর কিংবা আপোষ-রফার পথে হাঁটতে হয়নি। যেমন আপোষহীন ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি ‘নপুংসকের প্রেমে ফাকি’র পথকে প্রত্যাখ্যান করে বারবার নিজেকে বিপদ-বন্ধুর পথে ঠেলে দেন নজরুল। গহীন সমস্যা সঙ্কুল পথে উঁচিয়ে রাখেন স্পর্ধার ‘আমামা’।

লেখক : কবি।