ব্রাহ্মণক্ষত্রিয় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন : নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার চার মিথ বিশ্লেষণ

আরিফ রহমান প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৩, ০৯:০০ এএম

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় পঞ্চাশের অধিক মিথের উল্লেখ আছে। এই প্রতিটি মিথের পেছনে একটা করে গল্প আছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এই মিথগুলোর মধ্যে আবার ইন্টারকানেকশন আছে। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই খুব আগ্রহ নিয়ে সেই কানেকশনগুলোর খোঁজ করছি। আজকের এই লেখায় আমরা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় উল্লেখিত চার মিথলজিক্যাল ক্যারেক্টারকে নিয়ে আলোচনা করবো।

এবছর বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের ১০০ বছর পার হলো। সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকা ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার নজরুলের ‍‍‘বিদ্রোহী‍‍’ কবিতাটি প্রকাশ করে। নলিনীকান্ত সরকার সেসময় বিজলী পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। ‍‍‘বিদ্রোহী‍‍’ কবিতা প্রকাশনার দিন বিজলী পত্রিকা পরপর দুই বার ছাপতে হয়েছিল, যার সংখ্যা ছিলো ২৯ হাজার।  বিজলী পত্রিকা মারফতেই বিদ্রোহী কবিতাটা ভাইরাল হয়। কবি বন্ধু মুজাফফর আহমদ জানান ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ বিদ্রোহী পড়েছিলেন। এটা ছিলো একসঙ্গে দুটো রেকর্ড। প্রথমত একটা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা একই দিনে দুইবার ছাপতে হয়েছিলো। দ্বিতীয়ত মাত্র এক দিনের মধ্যে বাংলা কবিতা একটা লম্ফ দেয়।

বিদ্রোহী কবিতাটা ১৪৯ লাইন দীর্ঘ। কবিতার শব্দ সংখ্যা ৮০৪। আমি এখন পর্যন্ত কবিতাটি থেকে ৫২টি মিথলজিক্যাল চরিত্র খুঁজে পেয়েছি। ক্রমান্বয়ে আরও খোঁজ করছি। আজকের আলাপে উঠে আসবেন মহর্ষি ভৃগু এবং তাঁর বংশের আরও তিন সদস্য জমদগ্নি, পরশুরাম ও বিশ্বমিত্র। এই চারজনকে নিয়ে আলাপ করতে আমরা দেখতে পাবো পুরাণের গল্পের আড়ালে নজরুলের সমকালীন বিশ্বকে দেখার নানাবিধ রূপ। দেখবো সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানকে নজরুল কীভাবে একটা ইন্টালিজেন্ট আর্মির কনসেপ্টে থিওরাইজ করার চেষ্টা করেছেন, কিভাবে উনি পুরাণের ক্যারেক্টার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটা যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন।

এক.

আমি বিদ্রোহী ভৃগু-
ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা 
খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় ভৃগু এক নটরিয়াস ক্যারেক্টার। ভগবানে বুকে ঋষি ভৃগু এমনভাবে কোষে লাথি মেরেছিলেন যে ভগবান সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেন না। আজকে আমাদের আলোচনার ক্যারেক্টার তাই ভৃগু। এরপর একে একে ভৃগুর নাতিপুতিদের খুঁজে পাওয়া যাবে কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে আমাদের আলাপে।

ভৃগু একজন গুরুত্বপূর্ণ ত্যাঁদড় ঋষি ছিলেন। তিনি ছিলেন সাতজন মহান ঋষি, সপ্তর্ষিদের একজন।

একবার সকল মুনি ঋষিরা মিলে এক মহাযজ্ঞ করতে বসেছেন। দীর্ঘ যজ্ঞের শেষ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করা হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে শ্রেষ্ঠ ভগবান?

আপনারা জানেন হিন্দু ট্রিনিটিতে তিনজন কেন্দ্রীয় ভগবান বিরাজ করেন। প্রথমজন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, দ্বিতীয়জন ধ্বংসকর্তা শিব আর তৃতীয়জন সাস্টেইনর বা পালনকারী বিষ্ণু। এবারে শ্রেষ্ঠ ভগবান নির্বাচনের প্রশ্নে ঋষিদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিলো। তো সব মুনি ঋষিরা ঠিক করলেন কেউ একজন গিয়ে যাচাই করে আসবে কোন দেবতা সর্বোচ্চ অর্ঘ্য পাবার যোগ্য, কিন্তু কোনো ঋষিরই যাচাই করতে যাবার সাহস নেই। তখন এগিয়ে এলেন মহর্ষি ভৃগু। তিনি গেলেন ভগবানকে পরীক্ষা করতে।

বোঝেন ঠ্যালা ভগবানকে পরীক্ষা করবে মানুষ!

ভৃগু প্রথমে গেলেন সত্যলোকে। সেখানে ব্রহ্মার বিরাজ। ভৃগু সেখানে পৌঁছে দেখলেন, ব্রহ্মা তখন নারায়ণের স্তব করছেন, চার মুখে বেদ পাঠ করছেন। ভৃগু তাকে প্রণাম করলেন। কিন্তু মগ্ন ব্রহ্মা তা খেয়ালই করলেন না। কথিত আছে ভৃগু তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ভগবানকে অভিশাপ দিলেন যে, ‘আপনি ভক্তের দিকে ফিরেও তাকালেন না! কলিযুগে আপনার কোনো মন্দির হবে না, মানুষ কখনো আপনার পুজো করবে না!’

তারপর তিনি গেলেন কৈলাশ পর্বতে মহাদেব শিবের কাছে । সেখানে গিয়ে একই ভাবে মহাদেবকে প্রণাম করলেন ভৃগু। এবারও ভৃগু দেখলেন, শিব ধ্যানমগ্ন। ভৃগু তাকে নাম ধরে ডাকলেন বটে, কিন্তু সে আওয়াজ শিবের কানে পৌঁছালো না। তখন ক্ষিপ্ত ভৃগু শিবকে অভিশাপ দিলেন, ‘কলিযুগে আপনি কেবল লিঙ্গ রূপে পূজিত হবেন!’

তখন ভৃগু রওনা দিলেন বৈকুণ্ঠের দিকে। সেখানে বিরাজ করছেন বিষ্ণু ভগবান। ভৃগু গিয়ে দেখলেন, বিষ্ণু শয্যায় শয়নরত অবস্থায় বিরাজমান। আগের মতোই ভৃগু এবারও ডাকলেন, আগের দুজনের মতো বিষ্ণুও তাকে কোনো উত্তর দিলেন না। এবার ক্লান্ত, বিতশ্রদ্ধ, ক্ষিপ্ত ভৃগু আর কোনো অভিসম্পাতের ধার ধারলেন না। ভৃগু সজোরে শায়িত বিষ্ণুর বুকে লাথি মেরে বসলেন। লাথি দেওয়ার এই ঘটনার পর ভগবান বিষ্ণুর ঘুম ভেঙে গেলো এবং তিনি ভৃগুর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ব্যথা লাগেনি তো!’

এটা শুনে ঋষি ভৃগুর ক্রোধ প্রশমিত হলো এবং তিনি যজ্ঞস্থলে এসে ঘোষণা করলেন ভগবান বিষ্ণুই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং কলিযুগে সব রূপে, সব অবতারে তিনি পূজিত হবেন। ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে বিষ্ণুমূর্তিতে ভৃগুর পায়ের ছাপ আজও জাজ্বল্যমান দেখতে পাওয়া যায়!

দুই.

কলিযুগ থেকে বিষ্ণু যেমন সব অবতাররূপে পূজিত হচ্ছেন আজও, ঠিক একই কায়দায় নজরুলও বিদ্রোহীতে বিষ্ণুর অধিকাংশ অবতারদের টাইমলাইন এনেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। সেটা অন্য কোনো দিনের আলাপ। আজকের আলাপ আমাদের আগাবে ঋষি ভৃগুর বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে। বিদ্রোহী কবিতার নানা জায়গায় ঋষি ভৃগুর দুইজন প্রত্যক্ষ আর একজন পরোক্ষ বংশধরের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং আমার মনে হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে একই বংশের চার চরিত্রকে নিয়ে আসার পেছনে নজরুল একটা প্ল্যান ছিল, তিনি একটা বিশেষ রূপকল্প হাজির করতে চাইছেন।

তো মহাঋষি ভৃগুর পুত্রের নাম ছিলো চ্যবন। চ্যবনের দুই পুত্র—আপ্রবান এবং দধীচি। আপ্রবানের পুত্র ঔর্ব। ঔর্বের পুত্র ঋচীক। ঋচীকের পুত্র জমদগ্নি। জমদগ্নির পুত্র পরশুরাম। এই বংশ লতিকায় উল্লেখিত জমদগ্নি আর পরশুরাম এই বাপ-ব্যাটার উল্লেখ বিদ্রোহী কবিতায় পাওয়া যায়। তো জমদগ্নিতে ঢোকার আগে আমরা একটু জমদগ্নির বাপ ঋচীকের খোঁজ নিয়ে আসি।

ঋচীকের উল্লেখ বিদ্রোহীতে নেই কিন্তু ঋচীকের হাত ধরে বিদ্রোহীর একজন খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিশ্বমিত্রের গল্প উঠে আসবে। সেই গল্পটা আগে বলে নেই। তো মহর্ষি ঋচীকের স্ত্রী সত্যবতীর গর্ভে মহর্ষি জমদগ্নির জন্ম হয়। মহাভারতের বনপর্বে বলা আছে, ঋচীকের সঙ্গে গাধীরাজের কন্যা সত্যবতীর বিয়ে হয়। ভৃগু নিজে ছিলেন ব্রাহ্মণ ফলে তার বংশও ছিলো ব্রাহ্মণ। এদিকে গাধীরাজ ছিলেন ক্ষত্রিয়, ফলে তার কন্যা সত্যবতীও ছিলেন ক্ষত্রিয়।

তাদের বিয়ের অনেক বছর পর একদিন ঋচীক-সত্যবতীর ঘরে তাদের প্রো-প্রো-প্রো-শ্বশুর, ভগবানের বুকে লাথি মেরে বিখ্যাত হওয়া সেই ভৃগু ঘুরতে আসলেন। ঋচীক-সত্যবতী দম্পতি মনপ্রাণ দিয়ে মহর্ষি ভৃগুর সেবা করতে লাগলেন। মহর্ষি ভৃগু সত্যবতীর সেবায় প্রসন্ন হয়ে সত্যবতীকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। তখন সত্যবতী নিজের ও নিজের মায়ের জন্য ভৃগুর কাছে পুত্র প্রার্থনা করলেন।

এবারে মহর্ষি ভৃগু শুচি-শুদ্ধ হয়ে আলাদা আলাদা ভাবে সত্যবতীকে ও তার মাকে দুই বাটি পায়েস দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার ও তোমার মায়ের জন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অনুসন্ধান করে এই দুই ভাগ পায়েস এনেছি। তোমরা ভক্তি সহকারে এই পায়েস খাবে।’ এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন। এদিকে সত্যবতী ও তার মায়ের পায়েস খাওয়া নিয়ে গোলমাল হয়ে গেলো হিন্দি সিরিয়ালের মতোন। সত্যবতীর মা ভেবেছিলেন উনি যদি কন্যার পায়েস খেতে পারেন উনি ক্ষত্রিয় গাধিরাজের স্ত্রী হলেও তার সন্তান হবে ব্রাহ্মণ। পায়েস গেলো বদলে। মায়ের জন্য নির্ধারিত পায়েস খেয়ে ফেলেন সত্যবতী এবং সত্যবতীরটা খেয়ে ফেলেন তার মা।

বহুদিন পর মহর্ষি ভৃগু ধ্যানে বসে সেই বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরে সত্যবতীর কাছে এসে বললেন, ‘কন্যা, তোমরা বিপরীতভাবে পায়েস ভক্ষণ করেছো। তোমার মা এর জন্য দায়ী। তিনি তোমায় ঠকিয়েছেন। সুতরাং তোমার পুত্র ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয় হবে, আর তোমার মাতার পুত্র ক্ষত্রিয় হয়েও ব্রাহ্মণ হবে।’ তখন সত্যবতী তার প্রো প্রো প্রো শ্বশুর ভৃগুর কাছে অনুনয় করে বললেন, এই অভিশাপ যেন তার পুত্রের গায়ে না লেগে নাতির গায়ে লাগে, সত্যবতী বললেন, ‘পিতা, আমার পুত্র যেনো এমন না হয়, আমার পৌত্র যেন এমন হয়।’ তখন ভৃগু সত্যবতীকে ‘বেশ, এমন-ই হবে’ বলে প্রস্থান করলেন।

তারপর নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সত্যবতী এক পুত্রের জন্ম দিলেন। সেই পুত্রই জমদগ্নি। তপস্যা ও বেদাধ্যায়ন করে জমদগ্নি বহু ঋষি-তপস্বীদের অতিক্রম করেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতায় এই জমদগ্নির উল্লেখ আছে। নজরুল লিখছেন:

আমি হোম-শিখা, 
আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, 
আমি অগ্নি।

তিন.

আমরা এই জমদগ্নির কাহিনীতে যাওয়ার আগে একটু দেখে আসি সত্যবতীর মা গাধিরাজের স্ত্রী, যেই নারী পায়েসকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন তার বাচ্চার খবর কী? তো সত্যবতীর মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত মহাঋষি বিশ্বমিত্র। যিনি ক্ষত্রিয় রাজা হলেও পরবর্তীকালে দীর্ঘ তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মণ্য প্রাপ্ত হন। বেদে বলা হয়েছে বিশ্বমিত্র এবং জমদগ্নির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিলো। একাধিক কাহিনী থেকে জানা যায় বিশ্বামিত্র আর জমদগ্নির সমবয়স্ক ছিলেন।

সেটা হওয়াই স্বাভাবিক কারণ মা-মেয়ে একসাথে প্রেগন্যান্ট হয়ে দুই ঘরে দুই ছেলে জন্ম দিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্বমিত্র আর জমদগ্নির সম্পর্কে মামা-ভাগিনা হলেও তারা ছিলেন সমবয়সী। এবারে দেখা যাক বিদ্রোহী কবিতায় বিশ্বমিত্র কেমন ভাবে এসেছেন:

আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!

এই লাইনের দুর্বাসাকে নিয়ে আমরা অন্য কোনদিন আলোচনা করবো। আমরা দেখবো কীভাবে দুর্বাসার ক্ষ্যাপামির কল্যাণে সমস্ত দেবতারা শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন, কীভাবে অসুরগণ স্বর্গলোক দখল করে ফেলেছিলেন, কীভাবে বিষ্ণু কূটনীতি করে সমুদ্রমন্থনে অসুরদের ন্যায্য অমৃত বিতরণে বাধা দিয়েছিলেন এসব ইন্টারেস্টিং অন্য কোনো সময়ের জন্য রাখা থাক। আমাদের আজকের আলোচনা বিশ্বমিত্রকে নিয়ে

আসলে পুরাণে বিশ্বমিত্রের এতো বেশি গল্প আছে যে খ্যাপা দুর্বাসাকে ছাড়িয়ে যাবে। উনি প্রতিটা পুরাণে ফিরে ফিরে এসেছেন। রামায়ণেও তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিশ্বমিত্র ঋগ্বেদের অন্যতম রচয়িতা হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে বেদের ভেতরেই। সমস্ত বেদের সার যে গায়ত্রী মন্ত্র, সেই গায়ত্রী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিও বিশ্বমিত্র। এবং এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ তিনি কিন্তু জন্ম থেকে ব্রাহ্মণ ছিলেন না। ভৃগুর আশীর্বাদে গাধিরাজের স্ত্রীর ভুল পায়েস খাওয়ার ফলাফলে ক্ষত্রিয় বিশ্বমিত্র একদিন না একদিন ব্রাহ্মণ হবেন এটা হয়তো সবার জানা ছিল, কিন্তু বিশ্বমিত্রে জন্য এই পথ মোটেও সহজ ছিলো না।

একজন ক্ষত্রিয় হয়ে ব্রাহ্মণত্ব পাবার জন্য তিনি এমন কিছু নাই যেটা করেন নাই, কিন্তু সবকিছুর শেষে দেখা যেতো সামান্য অহংকার, সামান্য ক্রোধ, সামান্য লোভ ইত্যাদির কারণ তাঁর আর ব্রাহ্মণত্ব পাওয়া হতো না। এই ঘটনাকে সামনে এনে অনেক হিন্দু সংস্কারক দেখিয়েছেন ব্রাহ্মণত্ব বিষয়টা বংশপরম্পরায় আসে না, এটা অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মতোন। বংশের কারণে কেউ শিক্ষক হয় না, বিদ্যায় হয়। তবে বংশক্রমে হয়তো তাঁর পক্ষে জ্ঞানলাভ সহজ হতে পারে কিন্তু বিশ্বমিত্রের মতোন সাধনার পরীক্ষা দিয়েই তবে ব্রাহ্মণ হতে হয়। পুরাণ থেকে জানা যায় ভৃগুর বর পাওয়ার পরেও পরীক্ষা কিন্তু বিশ্বমিত্রকে কম দিতে হয়নি।

আপনাদের মনোটনি না দেওয়ার জন্য আমি বিশ্বমিত্রের কেবল কয়েকটা গল্প ছুঁয়ে যাচ্ছি।  

রাজা বিশ্বামিত্র একবার তাঁর সেনাবাহিনী ও শত ছেলেকে নিয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বশিষ্ঠ সবাইকে পূর্ণ তৃপ্তিসহকারে ভোজন করান। একটি সাধারণ আশ্রমে এতো বিপুলসংখ্যক লোকের খাদ্য সরবরাহ এতো অল্প সময়ে কীভাবে হল এই বিষয়ে বিশ্বমিত্র আগ্রহী হয়ে জানতে পারেন বশিষ্ঠের কামধেনু নামের একটা গাভী আছে (কামধেনু বোরাকের মতো একটা প্রাণী, এই প্রাণীর মুখ মানুষের মতো আর দেহ গাভীর মতো) তো এই গাভীর সাহায্যে যখন যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়।

বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের কাছে কামধেনুকে উপহার হিসেবে চান। বশিষ্ঠ তা দান করতে অস্বীকার করেন এবং দুজনের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ ও তীব্র বিবাদের সৃষ্টি হয়। বিশ্বমিত্র তার সুদক্ষ সৈনিকদের সহায়তায় বলপূর্বক কামধেনুকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ঋষি বশিষ্ঠ তার কামধেনুর সাহায্যে অসংখ্য সৈন্য সৃষ্টি করে বিশ্বমিত্রের সৈন্যদলকে ধ্বংস করে ফেলেন। এরপর বিশ্বমিত্রের ছেলেরা বশিষ্ঠকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলে মহর্ষি বশিষ্ঠ বিশ্বমিত্রের শতপুত্রকে দগ্ধ করে ফেলেন।

বিশ্বমিত্র সৈন্যবিহীন অবস্থায় ও শতপুত্রের মৃত্যু শোকে কাতর হয়ে নিজ রাজধানীতে ফিরে এসে অবশিষ্ট এক পুত্রের কাঁধে রাজ্যের শাসনভার প্রদান করে বনে গমন করেন ও মহাদেবের কঠোর তপস্যায় মনোনিবেশ করেন। দীর্ঘ তপস্যার পর মহাদেব বিশ্বমিত্রের তপস্যায় অতি সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদানে উপস্থিত হলে বিশ্বমিত্র তার কাছ থেকে ধনুর্বিদ্যা আয়ত্ত করে নেন। এরপর বিশ্বমিত্র আবারও মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে গিয়ে যুদ্ধ লাগিয়ে দেন এবং আবারও বশিষ্ঠের কাছে বাজেভাবে পরাজিত হন।

এই ঘটনার পর বিশ্বমিত্র বুঝতে পারেন অস্ত্রবলের চেয়ে ব্রহ্মবলের শ্রেষ্ঠত্ব বেশি। যেখানে বিশ্বমিত্র নিজে একজন রাজা সেখানে সামান্য একটা আশ্রমের পুরোহিতে কাছে তিনি বারবার নাজেহাল হচ্ছেন। এই উপলব্ধি করে বিশ্বমিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করার জন্য চেষ্টা করতে মনস্থির করলেন। সেজন্য তিনি দক্ষিণে গমন করে কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। বিশ্বমিত্রের দীর্ঘকালের কঠোর তপস্যায় পরিতুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তার কাছে আসেন ও ঋষিত্ব প্রদান করেন। কিন্তু ব্রাহ্মণত্ব নয়। বিশ্বমিত্র এতে পরিতুষ্ট না হয়ে আরও উগ্র ধ্যানে প্রবৃত্ত হন। এ সময়ে দেবতা ইন্দ্রের নির্দেশে মেনকা নামের অপ্সরা বিশ্বমিত্রকে বিমোহিত করতে সক্ষম হন। পরে চৈতন্য ফিরে পাওয়ার পর বিশ্বমিত্র মেনকাকে বিদায় দিয়ে অত্যন্ত বিষণ্নচিত্তে উত্তরদিকে গমন করেন এবং হিমাচলে কৌশিকী নদীর তীরে কঠোর তপস্যা শুরু করেন।

বহুদিন তপস্যা করার পর ব্রহ্মা আবারও বিশ্বমিত্রের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে মহর্ষিত্ব প্রদান করেন। কিন্তু ব্রহ্মণত্ব নয়। ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তোমার সিদ্ধিলাভের বহু বিলম্ব আছে, কারণ তুমি এখনও ইন্দ্রিয় জয় করতে পারো নাই।”

এ কথা শুনে বিশ্বমিত্র আবারও উগ্র-তপস্যায় প্রবৃত্ত হন। এ সময়ে বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করার লক্ষ্যে আরেক অপ্সরা রম্ভাকে পাঠানো হলে বিশ্বমিত্র ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তাকে অভিশাপ দিয়ে ফেলেন। কিন্তু ক্রোধের কারণে তার ধ্যান আবারও নষ্ট হয়ে যায়।

বিশ্বমিত্র এবারে পূর্বদিকে গিয়ে তপস্যা করতে লাগলেন। বহুবর্ষ পরে ব্রহ্মা উপস্থিত হয়ে তাকে অবশেষে ব্রাহ্মণত্ব প্রদান করেন। এবং তার কষ্টের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বেদ লেখার দায়িত্ব পান।

তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বমিত্র চরিত্রটা হচ্ছে নিজেকে নিজে ক্রমাগত সংশোধন করবার একটা উদাহরণ।

চার.

নজরুলের বিদ্রোহীতে বিশ্বমিত্রের কাহিনী জানার পর এবারে জানা যাক বিশ্বমিত্রের ভাগিনা জমদগ্নির কাণ্ডকীর্তি। প্রথমে দেখি নজরুল কী সূত্র দিয়েছেন—

আমি হোম-শিখা,
আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, 
আমি অগ্নি।

মহর্ষি জমদগ্নিও বেদের আলোচিত এক চরিত্র, দেবতাদের উনিও মাইরের ওপর রাখতেন বলে জানা যায়। উনিও প্রচণ্ড ক্রোধের জন্য বিখ্যাত। জমদগ্নি ছিলেন বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার মহাতেজস্বী পরশুরামের পিতা। এই পরশুরামের উল্লেখও বিদ্রোহীতে আছে/ তো জমদগ্নির তিনটা গল্প শুনবো আমরা। প্রথম গল্পটা জুতা আবিষ্কারের গল্প!

একদিন জমদগ্নি তীর-ধনুক দিয়ে লক্ষ্যবিদ্ধ করবার অভ্যাস করছিলেন। তাঁর স্ত্রী রেণুকা লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরগুলি সংগ্রহ করে এনে আবার জমদগ্নিকে দিচ্ছিলেন। বেলা গড়িয়ে সূর্য ধীরে ধীরে মধ্যগগনে এসে পৌঁছায়। প্রখর রৌদ্রের  মধ্যে তীর সংগ্রহ করতে করতে রেণুকা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। পাছে কষ্টের কথা বললে স্বামী ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ দেন, সেই ভয়ে কিছু বলতেও পারেন না। খালি পায়ে চলতে চলতে রেণুকার পা-দুটো যেন পুড়ে যেতে লাগল। বাধ্য হয়েই রেণুকা একটি বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে খানিক বিশ্রাম করলেন। ফলে তীর কুড়িয়ে আনতে খানিক দেরি হল। জমদগ্নি রেণুকাকে বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, রেণুকা ভয়ে ভয়ে স্বামীকে বলেই ফেললেন নিজের কষ্টের কথা। এতক্ষণে জমদগ্নির হুঁশ হলো আর খুব রাগও হলো। আর তাঁর যতো রাগ সব গিয়ে পড়ল মাঝ আকাশে জ্বলতে থাকা সূর্যদেবের ওপর। জমদগ্নি রেগে গিয়ে সূর্যকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন ।

সূর্য ভয় পেলেন ঋষির ক্রোধ দেখে। তারপর ব্রাহ্মণের বেশে এসে দাঁড়ালেন জমদগ্নির সামনে। ক্রুদ্ধ জমদগ্নিকে ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণ ধীরে ধীরে বোঝাতে লাগলেন সূর্যের প্রয়োজনীয়তা কতোখানি। বলতে লাগলেন সূর্যই এ জগতে প্রাণের উৎস; সূর্য বস্তু থেকে যে রস শোষণ করে, বর্ষাকালে সেই রস-ই বর্ষণ করে ইত্যাদি। এ সকল কথার মধ্যেই জমদগ্নি কিন্তু ব্রাহ্মণবেশী সূর্যকে চিনে ফেললেন এবং বেশ ক্রুদ্ধ হয়েই তাঁকে বললেন, ‘রেণুকার যতো কষ্ট হয়েছে তার জন্য শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। মধ্যাহ্নে তুমি যখন মাঝ আকাশে থাকবে তখন তোমাকে আমি অবশ্যই শাস্তি দেবো।’

সূর্য তখন জমদগ্নির শরণাপন্ন হয়ে প্রাণ ভিক্ষা করলেন। জমদগ্নি সূর্যকে প্রাণ দান করে বললেন, ‘বেশ, তোমাকে বধ করব না। কিন্তু এই যে প্রখর তাপে চলাফেরা করতে মানুষের কষ্ট হয়, তার একটা বিহিত তোমাকে করতেই হবে।’ তখন সূর্য জমদগ্নির হাতে তুলে দিলেন মস্তক রক্ষাকারী ছাতা এবং চরণ রক্ষাকারী চর্ম পাদুকা। জমদগ্নি সন্তুষ্ট হলেন। সেই সময় থেকেই জগতে ছাতা এবং পাদুকার ব্যবহার প্রচলিত হয়।

কিন্তু ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে যেই স্ত্রীর প্রেমে জমদগ্নি সূর্যকে বধ করেছিলেন, সেই স্ত্রীকে সে হত্যার নির্দেশ দিতেও দ্বিধা করে নাই।

একদিন রেণুকা নদীতে গোসল করতে গেলেন। স্নান করে ফিরে আসবার সময় রেণুকা এক রাজাকে তার স্ত্রীদের সঙ্গে জলকেলি করতে দেখে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। আশ্রমে ফিরে এলে ঋষি জমদগ্নি রেণুকার কামাসক্তির কারণ বুঝতে পেরে তার পুত্রদের নির্দেশ দিলেন নিজের মাকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু জমদগ্নির প্রথম চার পুত্রের কেউ-ই মাতাকে অস্ত্রাঘাত করতে চাইলেন না। ক্রোধান্বিত হয়ে জমদগ্নি তাঁর চার পুত্রকে অভিশাপ দিয়ে পাথর বানিয়ে ফেলেন।

এরপরে জমদগ্নির ছেলে আমাদের গল্পের হিরো পরশুরাম আশ্রমে এলে তাঁকে বললেন, ‘পুত্র! তোমার এই পাপিষ্ঠ মাতাকে বধ কর; দুঃখ কোরো না।’ তৎক্ষণাৎ পরশুরাম নিজের মাকে কুঠার দিয়ে হত্যা করলেন।

রেণুকার মৃত্যুতে জমদগ্নির ক্রোধ শান্ত হলো। তিনি প্রসন্ন হয়ে পরশুরামকে বললেন, ‘বৎস, তুমি আমার আদেশমাত্রই এই দুষ্কর কার্য করেছ; সুতরাং তোমার যতো ইচ্ছা তত বর নাও।’ তখন পরশুরাম-মাতার পুনরায় জীবিত হওয়া, সেই হত্যার কথা মনে না থাকা, হত্যার পাপ জমদগ্নিকে স্পর্শ না করা ও ভ্রাতাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরত চাইলেন। মহাতপস্বী জমদগ্নি সেই সকল বরই পূরণ করে দিলেন।

কিন্তু মাতৃহত্যার পাপে পরশুরামের কাঠের কুঠারটি পরশুরামের হাতে আটকে যায়। এখান থেকেই এসেছে পরশুরামের কঠোর কুঠার।

পাঁচ.

ভৃগু থেকে শুরু করতে করতে গল্প এসেছে তার পুতির ঘরের পুতির ঘরের পুতি পরশুরামের কাছে। নজরুল বিদ্রোহীতে লিখছেন—

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

পরশুরামের কুঠারের ইউজ একবার আমরা দেখলাম। কিন্তু নিঃক্ষত্রিয় করার ব্যাপারটার ভেতর টুইস্ট আছে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে  ঋচীকের বৌ সত্যবতী বলেছিলেন তার ছেলে জমদগ্নির ওপরে যেন অভিশাপ না লাগে, যেন তার নাতির গায়ে লাগে। এই নাতিই কিন্তু পরশুরাম।

ভৃগু বলেছিলেন উল্টাপাল্টা পায়েস খাওয়ার কারণে তোমার পুত্র ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয় হবে। সত্যবতী সেটা পুত্র থেকে নাতিতে কনভার্ট করে পরশুরামের কাঁধে ফেললেন। আগেই দেখেছেন ভৃগুর এক কথায় কিন্তু বিশ্বমিত্র ব্রাহ্মণ হয়ে যান নাই, ভৃগু কেবল ভবিষ্যৎ বাণী করছেন, বিশ্বমিত্রকে ব্রাহ্মণত্বটা বহু প্যারা খেয়ে অর্জন করে নিতে হয়েছে। এখন দেখবার বিষয় পরশুরাম ক্ষত্রিয়ত্ব কীভাবে লাভ করেন আর কীভাবে নিঃক্ষত্রিয় করেন বিশ্বকে?

তো পরশুরামের ক্ষত্রিয় বিদ্বেষের সূচনা হয় পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। একদিন পরশুরামের পিতা জমদগ্নি অন্য পুত্রদের নিয়ে আশ্রমের বাইরে ছিলেন, এমন সময় ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্য সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এসে জমদগ্নির আশ্রমে ভাঙচুর চালান এবং আশ্চর্য গাভী হোমধেনুর বৎসকে হরণ করেন। ঘটনা জানতে পেরে পরশুরাম হেমধনুর বৎস উদ্ধার করতে গেলে রাজা কার্তবীর্যের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়ে এবং যুদ্ধে রাজা কার্তুবীর্য মারা যান। এর প্রতিশোধ নিয়ে রাজা কার্তুবীর্যের ছেলেরা এসে ধ্যানরত অবস্থায় থাকা জমদগ্নিকে হত্যা করে ফেলেন।

এবারে এখানে বোঝার একটা বিষয় আছে। রাজা কার্তুবীর্যকে পরশুরাম যখন মেরেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই কার্তবীর্যের ছেলেরাও জমদগ্নিকে মারতেই পারেন। কিন্তু একটা মানুষ যখন পূজারত বা ধ্যানরত অবস্থায় আছে তখন তাকে হত্যা করা মহাপাপ। একজন ধর্মজ্ঞ কখনোই এমন পাপ করবেন না। রাজা কার্তুবীর্যের বংশ ক্ষত্রিয় বিধায় তারা এটা করেছে, কারণ তাদের শাস্ত্রজ্ঞান নেই। পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পুরো ঘটনা দেখে পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করার বিষয়ে সংকল্প গ্রহণ করেন।

ক্রোধিত পরশুরাম মহিষ্মতী কার্তবীর্যের পুত্রদের মস্তক ছেদন করে হত্যা করেন। পরশুরামের সবল হাতের বলিষ্ঠ কুঠারে শুধু যে কার্তবীর্যের পুত্রগণ এবং তাদের অনুচরেরা মৃত্যুবরণ করে তাই নয়, পৃথিবীকে একুশবার তিনি ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। কারণ জন্মে জন্মে কেউ যদি ক্ষত্রীয় হয়ে আসে তারাও যেন নিস্তার না পায়। কেউ যেন না বুঝে হন্তারক না হয়ে উঠতে পারে।

সমস্ত ক্ষত্রিয়ের রক্তে সমস্ত পঞ্চক প্রদেশে যে পাঁচটি রক্তময় হ্রদ সৃষ্টি হয় তা তিনি তাঁর পিতৃপুরুষদের প্রতি নিবেদন করেন। পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করবার কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিল এই কুঠার, তাই তাঁর কুঠারকে বলা হয়েছে কঠোর।

নিজেকে পরশুরামের কুঠারের সঙ্গে তুলনা করে এবং বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় করবার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করে নজরুল অনেকগুলো কথা একত্রে বলে ফেলেছেন আসলে। আসেন এবারে ফাইনলাইন টানি।

ছয়.

মাত্র চারটা চরিত্রের কথা আলোচনা করলাম আমরা। ভগবানের বুকে লাথি মারা ব্রাহ্মণ পুরোহিত ভৃগুর বংশ আর ক্ষত্রিয়রাজা গাধিরাজের বংশের মিলমিশে সৃষ্ট এই চার ক্যারেক্টারের ইন্ড প্রোডাক্ট বিশ্বমিত্র আর পরশুরামের একটা আলাদা পরিচয় আছে। তাদের বলা হয় ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়। এরা যুদ্ধও জানেন, আবার শাস্ত্রও জানেন। মহাভারত এবং রামায়ণে এরকম কয়েকজন ব্যক্তির উল্লেখ আছে:

১) পরশুরাম
২) দ্রোণাচার্য
৩) অশ্বত্থামা
৪) বিশ্বমিত্র
৫) কল্কি অবতার (ভবিষ্যতে আসবেন, বিদ্রোহীতে এনারও ইঙ্গিত আছে)

আজকের আলোচনার এই চার চরিত্র (ভৃগু, বিশ্বমিত্র, জমদাগ্নি ও পরশুরাম) আমাদের একটা লার্নেড যোদ্ধাজাতির জরুরতের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। নজরুল যে বিদ্রোহী হয়ে রণ করবেন সেটা গান্ধীবাদী যুদ্ধ না, সেটা অত্যাচারীদের উপড়ে ফেলার সত্যিকারে অংক কষা যুদ্ধ।

কবিতা রচনার সময়টা দেখেন। ১৯২২ সাল। মাত্র দেড় বছর আগে নজরুল সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছেন। নিজের চোখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। দেখেছেন নির্বোধ ক্ষত্রিয়রা (মিলিটারি অর্থে) কীভাবে প্রাণ হরণ করছে মানুষের। এসব দেখে বিতশ্রদ্ধ হয়েছেন যুদ্ধের প্রতি। একই সময়ে নজরুল আবার ভিন্নচোখে প্রত্যক্ষ করেছেন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান (১৯১৮)। উনি খুব পরিষ্কারভাবে বুঝেছেন গান্ধীগিরি করে, শান্তিগিরি করে শান্তি আসবে না। যুদ্ধ করতে হবে। তাই উনি ক্ষত্রিয়কে উৎখাত করার জন্য কোনো সাধুকে ডেকে আনেন নাই। উনি সবচেয়ে বলশালী ক্ষত্রিয়বীর বিষ্ণুর অবতার পরশুরামকে বেছে নিয়েছেন।

নজরুল নিঃক্ষত্রিয় বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন, কিন্তু সেটা সাধুদের দিয়ে নয় বরং বেছে বেছে ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়দের দিয়ে। এবারে ব্রাহ্মণ বলতে কিন্তু যে-সে টিপিক্যাল ব্রাহ্মণকে বাছেননি, নিয়েছেন ভৃগুকে, যেই ব্রাহ্মণ ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার সাহস রাখেন। খেয়াল করেন উনি একটা যুদ্ধের ছক কষেছেন, যেই যুদ্ধে একটা বিপ্লবী পরিকল্পনা থাকবে, সেই পরিকল্পনাটার রুটে রুটেই আমরা ভৃগু, বিশ্বমিত্র, জমদগ্নি আর পরশুরামদের দেখলাম।

এবারে দেখেন মহাভারতের শেষ আরেকজন ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়র কথা বলা হচ্ছে যিনি এখনো আসেননি, যিনি ভবিষ্যতে আসবেন, উনি কল্কি অবতার। খ্রিষ্টানদের আসবেন মাসায়াহ, মুসলমানদের আসবেন মাহাদি। তো নজরুল শান্ত হবেন কখন সেটা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন—

মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ 
ভীম রণ-ভূমে রণিবে না!

আপনি যদি কল্কি পুরাণ পড়েন দেখবেন বলা হচ্ছে, কলির শেষ প্রান্তে অন্যায় দমন করতে বিষ্ণু কল্কিরুপে আবির্ভূত হবেন। তিনি জীবের দুঃখ দূর করার জন্য সচেষ্ট হবেন, তাঁর হাতে থাকবে খড়গ। এই খড়গ দিয়ে তিনি অত্যাচারী ব্যক্তিদের খড়গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের হত্যা করবেন। কল্কির হাতে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমার মতে ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত এবং বঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফরের ভাইব্রাদার লেভেলের ছোটভাই এবং মেসের রুমমেট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ নিজ চোখে দেখা আর বিপরীতে রাশিয়ায় শ্রমিকশ্রেণির একটা রাষ্ট্র কায়েম হতে দেখা নজরুলকে চোখের সামনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর সোভিয়েতের উত্থান এই তত্ত্বগত ছক তৈরির প্রেরণা দিয়েছিলো।

আমার মনে হয় উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল বন্ধ করতে যেই মাহাদি বা কল্কি আসবেন, নজরুলের মতে সেটা মূলত সমাজতন্ত্র!

একশ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে, আমাদের আজ বিচার করতে বসতে হবে নজরুলের স্বপ্নের সেই কল্কি, সেই মাহাদির আকাঙ্ক্ষা কি লাল পতাকা পূরণ করতে পারবেন? সেই অবতার কি তারা হতে পারবে, যারা ভগবানের বুকে লাত্থি মারতে পারে আবার বিশ্বব্যাপী জালিম মোনার্কত্রিয় অর্থাৎ তত্ত্ব আর যুদ্ধের সমাবেশ ঘটানো লাল পতাকার মালিকেরা কি নজরুলের চেতনার ভৃগু হয়ে উঠতে পারবেন? পারবেন পরশুরাম হতে?

লেখক : লেখক ও বিশ্লেষক।