আদম সুরত: দিকনির্দেশনার চলচ্চিত্র

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২৩, ০৩:০৭ পিএম
এস এম সুলতান ও তারেক মাসুদ

শিল্পী এস এম সুলতানের কথা প্রথম শুনি বিদ্যালয়ের এক মাস্টারমশাইয়ের কাছে। এর ক’বছর বাদে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় সুলতানের ওপর লেখা প্রচ্ছদকাহিনি পড়ে নিশ্চিত হই অসামান্য প্রতিভাবান এই শিল্পী সম্পর্কে এক ফোঁটা বাড়িয়ে বলেননি আমার শিক্ষক। বাংলার মাটি ও জলের গন্ধ মেখে বেড়ে ওঠা গাঁওগেরামের ঘর পালানো ছেলে সুলতানের রক্তে ছিলে শিল্পের নেশা, রং ও রেখার নিশিডাক। সেই ডাকে তিনি সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত অবধি ঘুরে বেড়িয়েছেন মুক্ত, স্বাধীন বেদুইনের মতো; দুই হাতে ছেনেছেন রঙের ভুবন, তুলির আঁচড়ে জীবনকে গেঁথে তুলেছেন বিশাল ও বর্ণাঢ্য ক্যানভাসে, নানারূপে নানাছাঁদে। তারপর আচমকা একদিন নাম, যশ, অর্থবিত্ত, প্রতিষ্ঠাকে তুড়ি মেরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছেন। আস্তানা গেড়েছেন তাঁর শৈশবের ভূমিতে, ফেলে যাওয়া সেইসব মাটির মানুষের মাঝে, তারপর তাদেরই জীবনযাপন, প্রেম ও শ্রম, আনন্দ ও বেদনাকে বিষয় করে এঁকেছেন একের পর এক আশ্চর্য সুন্দর নিজস্ব নতুন ছবি।

তো, এহেন সুলতানের বিচিত্র, বর্ণাঢ্য জীবন ও তাঁর আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল চিত্রকলা বিষয়ক প্রায় ঘণ্টাখানেকের একটি অনুপম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হলো সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক শহরে। প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ বেশ ক’ বছর ধরেই এই ছবিটি বানানোর কাজে লেগে আছেন, একথা জানতাম অনেক আগে থেকেই, এবার তা চাক্ষুস করে মনে হল, তাঁর পরিশ্রম বৃথা যায়নি, ব্যর্থ হয়নি আমাদের উৎসুক প্রতীক্ষাও। একটি সত্যিকার শিল্পশোভন, আদ্যন্ত উপভোগ্য, ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান ছবি হয়ে উঠেছে তারেকের এই ‘আদম সুরত’, ইংরেজিতে যার নামকরণ করা হয়েছে,The Inner Strength। এই নামটি তিনি বেছে নিয়েছেন সুলতানের ছবির সমঝদার একজন প্রবীণ চিত্রকলা বোদ্ধা আশরাফ আলী উচ্চারিত The figures are the outward manifestation of the inner strength বাক্যাংশটি থেকে, যা সুলতানের ছবির মর্ম বুঝতে অনেকখানি সাহায্য করে আমাদের। তেমনি তার বাংলা নামটিরও বিবিধ তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে হয়। সুলতানের চোখে বাংলার কৃষকের প্রকৃত চেহারা, এই আক্ষরিক অর্থটুকু ছাড়াও অতিরিক্ত আরেকটি ব্যাখ্যার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা জানি, সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট নাবিকের দিশাদানকারী নক্ষত্রপুঞ্জটির নাম কালপুরুষ, লোকমুখে যাকে আদম সুরত বলেও ডাকা হয়ে থাকে। এর সঙ্গে একদা বোহেমিয়ান শিল্পী সুলতানের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়া ও একপর্যায়ে আপন ঐতিহ্যে এসে থিতু হওয়ার যোগসূত্রটি নিছক অমূলক নয়।

ছবিশুরুর টাইটেলে তারেকজায়া ক্যাথরিন শ্যাপিরের আঁকা শিল্পী সুলতানের বিভিন্ন বয়সের প্রতিকৃতির বুদ্ধিদীপ্ত Animation প্রথমেই মনোযোগ কাড়ে। তারপর শিল্পীর নিজের ও তাঁর আঁকা কিছু ছবির স্থিরচিত্রের সঙ্গে স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক অকালপ্রয়াত আলমগীর কবিরের ভরাট গলায় শোনা যায় সুলতানের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি। এর পরপরই তারেকের বিশ্বস্ত সিনেমাটোগ্রাফার মিশুক মুনীরের অনুসন্ধানী, সদাতৎপর ক্যামেরা শিল্পীকে অনুসরণ করে পৌঁছে যায় তাঁর নিভৃত ডেরায়, নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামের এক পোড়োবাড়িতে। সেখানে মিশুকের কুশলী ক্যামেরার ফ্রেমে উঠে আসে সুলতানের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড; কখনো ছাত্র পড়ানো, কখনো একমনে গান শোনা, কখনোবা রংতুলি নিয়ে তাঁর ক্যানভাসে নিমগ্নতার টুকরো ছবি। আর এরই মধ্যে পরিচালক সময় করে নেন শিল্পীর মুখোমুখি হবার, তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ কথোপকথনের। তবে এক্ষেত্রে আমরা প্রশ্নকর্তাকে পর্দায় দেখি না, তাঁর প্রশ্ন শুনি; কেবল শিল্পী সুলতানকেই কথা বলে যেতে দেখি। এতে করে ছবিটি গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত হয়ে একধরনের স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বতঃস্ফূর্তি অর্জন করে। আমরা শিল্পীকে তাঁর জীবনদর্শন, চিত্রভাবনা, সমাজচিন্তা ইত্যাদি বিষয়ে একটানা অন্তরঙ্গ ও অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কথা বলে যেতে শুনি, যা এ ছবির আসল প্রাণ ও আকর্ষণ। সেই সঙ্গে অবশ্য পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে সুলতানের বিভিন্ন বিষয়ে ও আঙ্গিকে আঁকা অজস্র ছবির প্রদর্শনীর যে আয়োজন করেন পরিচালক, তাতে যুগপৎ চোখ ও প্রাণের আরাম হয়।

তারেকের বদৌলতে এই মহান শিল্পীর অনেক উঁচুদরের শিল্পকর্ম এই প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ হল আমাদের। সেই সঙ্গে তাঁর ছবি সম্পর্কে ভাষ্যকার ও বিশেষত স্বয়ং শিল্পীর কণ্ঠে অনেক তথ্য ও বিশ্লেষণ শোনা গেল, যা তাঁর চিত্রকলাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে আমাদের নিঃসন্দেহে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ ছবিতে প্রাপ্তিযোগের পরিমাণ অঢেল। একদিকে আমরা যেমন জানতে পারি সুলতানের রোমাঞ্চকর জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও দর্শনের কথা, অন্যদিকে চিত্রকলা ও শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব বিষয়ে তাঁর মৌলিক মন্তব্যবিষয়েও অবগত হতে পারি। 

তারেক মাসুদের ছবির প্রধান কৃতিত্ব কারিগরি দিক দিয়ে গ্রহণযোগ্র গুণগত মান অর্জন, যা বাংলাদেশের ইদানীংকালের নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিসমূহের ক্ষেত্রে হয়তো সবসময় বলা যাবে না। সে জন্য তিনি আমাদের অকুণ্ঠ অভিনন্দনের দাবিদার। তাঁকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে মিশুক মুনীরের ক্যামেরা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল ও অবস্থান থেকে তাঁর সৃজনশীল চিত্রগ্রহণ, এবং নিপুণ সম্পাদনা ছবিকে আশ্চর্য গতিশীল রাখে সারাক্ষণ। একটি সিকোয়েন্সে জনৈক চাষার মাথাল থেকে ডিজলভ করে ধান মাড়াইয়ের গোলাকার ক্ষেত্র এবং সেখানে থেকে পুনরায় ডিজলভ করে ধান মাড়ানোরত চাষার বউয়ের পায়ের দৃশ্যে যাবার কারিগরি মুন্সিয়ানাটুকু এক কথার অপূর্ব। ছবির সংগীতাংশও এর সৌন্দর্য বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। পুলক গুপ্তের সংগীত পরিকল্পনা যথেষ্ট চিন্তাপ্রসূত ও সুপ্রযুক্ত। আবদুল করিম খাঁ সাহেব ও ভীষ্মদেবের উচ্চাঙ্গ সংগীত, বিটোভেনের নবম সিম্ফনি, ‘আই পি টি এ’র গণসংগীত ও ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটির বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ ছবির মর্মকে মেলে ধরে অনেকখানি। সীমাবদ্ধতার মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে পরিমিতিবোধের অভাব। যেমন, শিল্পীর অনেক কথাতেই পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা গেছে। তাঁর রং বানানোর দৃশ্যটিকেও অহেতুক প্রলম্বিত মনে হয়েছে। এছাড়া ছবির শেষটুকু প্রক্ষিপ্ত ও সাদামাটা লেগেছে। তাঁর মতো অমন একজন বড়মাপের শিল্পীর ওপর নির্মিত ছবির সমাপ্তিদৃশ্যটি আরও গভীর ও প্রগাঢ় কিছু হবে, এমন একটা প্রত্যাশা কাজ করেছিল আলোচকের মনে। কিন্তু এহ বাহ্য, একটি সুনির্মিত শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আদম সুরত‍‍` এর মহিমা তাতে ম্লান হয় না একটুও।