বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের নানাবিধ শাখায় কাজ করেছেন। তাঁর মেধা ও মননের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যে উচ্চকিত হয়েছে তাঁর মানব ধর্মের স্লোগান। তবুও কখনো কখনো পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি নাস্তিক ছিলেন? আবার অনেকেই বলেছেন, তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। প্রকৃতি ও পরম ব্রহ্মের উপাসক ছিলেন। তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন নিরাকার ঈশ্বরকে নিয়ে। প্রচুর গান লিখেছেন পূজা পর্যায়ে। শেষ বয়সে লিখেছেন ‘রবিবার’ (আশ্বিন ১৩৪৬) শিরোনামে ছোটগল্প। যে গল্পের নায়ক অভীক। অভীক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের সন্তান। নায়িকা বিভা ব্রাহ্মধর্মের মেয়ে। সেই রক্ষণশীল সমাজে প্রেম নিষিদ্ধ। দুজনের একান্ত সাক্ষাতের সুযোগ ঘটতে পারে ছুটির দিন রবিবারে। কিন্তু সেদিন বিভার উপাসনা গৃহে যাওয়ার দিন। ফলে অভীক বোঝে ধর্মই মানুষকে মানুষের সঙ্গে মিলতে দেয় না। অভীক হিন্দু কট্টর বংশের সন্তান। কিন্তু সে নাস্তিক। অভীক তার মাকে বলে, ‘মা, দেবতাকে অনেককাল ছেড়েছি, এমন অবস্থায় আমাকে দেবতার ছাড়াটা নেহাত বাহুল্য।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভীকের মুখ দিয়ে বলেছেন, ‘ধর্ম মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো। তোমরা ভারতবর্ষের ঐক্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখ। কিন্তু যে দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি; সে দেশে সব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই। আমিই ভারতবর্ষের ত্রাণকর্তা।’ পরের বছর তিনি লেখেন ‘ল্যাবরেটরি’(আশ্বিন ১৩৪৭) শিরোনামে একটি গল্প। সেই গল্পের অধ্যাপক চরিত্র নিজেকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি শেষ বয়সে নাস্তিক হয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা দরকার নাস্তিক কাকে বলে? নাস্তিক শব্দটি নতুন নয়। শব্দটি মৈত্রয়নী উপনিষদের সমকালীন। ভারতীয় সনাতন বৈদিক ধর্মে নাস্তিক শব্দের অর্থ, যারা বেদে অবিশ্বাসী। আবার পাণিনি বলেছেন, সে নাস্তিক; যে পরলোক মানে না। নাস্তিক সম্পর্কে ধর্মীয় বোদ্ধারা বহুদিন থেকে চিন্তিত। অগ্নি পুরাণের ষোড়শ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে দেবতা-অসুরের যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হলে দেবতারা শ্রীবিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু বুদ্ধদেব হয়ে জন্ম নেন পৃথিবীতে। বেদ বিরোধী তত্ত্ব প্রচার করেন বুদ্ধদেব। ফলে অসুরেরা নরকগামী হন। অসুরেরা বিনাশ হন। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ভারতে চার্বাক গোষ্ঠী, আজিবিকাশ, কেশকম্বলিন, পুকূথ কাত্যায়ন প্রমুখ নেতৃত্ব বেদ ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে আসেন বুদ্ধদেব, মহাবীর। নাস্তিক তারাই, যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করেন না। বর্ণবিভাজনের বিরোধিতা করেন। তাই সব ধর্মেই নাস্তিকদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে।
মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাস্তিক ছিলেন না। তিনি পরজন্মে বিশ্বাস করে ছোটবেলায় ও মধ্য বয়সে প্ল্যানচেট করতেন। সে জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন এমনটা ভাবাও উচিত নয়। কেননা তিনিই পরে স্বীকার করেছেন, ‘ভূতের বিশ্বাস পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই ন্যুনাধিক পরিমাণে আছে। যখন বলা যায়, আমি এই ভূতের বিশ্বাসের কুসংস্কার কাটাইয়াছি; তখন এমন কথা বলা হয় না যে, আমি মনুষ্যত্বের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করিয়াছি।’ (হিন্দু ব্রাহ্ম তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, জৈষ্ঠ্য ১৩১৯)। গঙ্গায় স্নান কি পুণ্য অর্জনের সহায়ক? এই প্রশ্নে তাঁর উত্তর, ‘কোনো একটি বিশেষ নদীর জলে স্নান করলে নিজের অথবা ত্রি কোটি সংখ্যক পূর্বপুরুষের পারলৌকিক সদগতি ঘটার সম্ভাবনা আছে এ বিশ্বাসকে আমি সমূলক বলে মেনে নিতে রাজি নই এবং এ বিশ্বাসকে আমি বড়ো জিনিস বলে শ্রদ্ধা করি নে।’ (তপোবন, শান্তিনিকেতন, অগ্রহায়ণ, ১৩১৬)। জ্যোতিষচর্চার বিরুদ্ধেও তাঁর গল্প ‘চোরাই ধন’ তা-ই প্রমাণ করে। আবার আপনজনের আবদারে কয়েক জন জ্যোতিষীকে হাতও দেখিয়েছিলেন তিনি।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তায় বা সাহিত্যে নাস্তিকতা থাকতে পারে। যদিও রবীন্দ্রচর্চায় কিছুটা চার্বাক প্রীতি ক্রিয়াশীল কিংবা ঈশ্বরচিন্তায় তার ছেদ রয়েছে। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, যেমনটা টিএইচ ইলিয়ট কিংবা উইলিয়াম শেকসপিয়রও। বাস্তবক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরবাদী হয়েও তাঁর ঈশ্বর অনুভূতিতে মানবিক প্রাধান্য স্পষ্ট করেছে তাঁর কাব্য-গল্প-উপন্যাসে। এমনকি তার দার্শনিক প্রজ্ঞা সমৃদ্ধ প্রবন্ধগুলোতেও। তাতে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বর্গের চেয়ে মর্ত্যের আকর্ষণ ও গুণগান দিয়ে তার সৃষ্টি-সৌরভ ছড়িয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে ধর্ম কোনো মোহ নয়, বরং ধর্মমোহ থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। তাই এই মুক্তি পথেও সমস্ত বৈষম্য ও মানবকল্যাণের সব বিরোধিতার অবসান ঘটে। তিনি অনুভব করেছিলেন, আত্মার লক্ষণ হচ্ছে শুভবুদ্ধি, সে শুভবুদ্ধি সবাইকে এক করতে পারে। ঘোরতর ধর্মবিশ্বাসীর সংকীর্ণতা দুষ্টে আবিলগ্রস্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম থেকে বিমুক্ত মানুষকে স্বচ্ছ মুক্তমনের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় তা বিধৃত করেছেন। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণে ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত হয়ে ৬৬ বছর বয়সে তাঁর চিত্তধারা প্রবাহিত করেছেন এভাবে:
ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায়, বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্রে মানে না, মানে মানুষের ভালো।
এখানে একটি কথা অবশ্যই বুঝতে হবে, বিধাতা বা ধর্ম বলতে তিনি জীবন দেবতা ও মানব ধর্মের কথা বলেছেন।
এ কবিতা লেখার কিছুদিন আগে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ শান্তিনিকেতনে এক ভাষণে বলেছেন, ‘...এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে সোজাসুজি নাস্তিকতা অনেক ভালো।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে নাস্তিক চরিত্র জগমোহনের (জ্যাঠামশাই) মুখ দিয়ে বলেছেন, ‘দেখো বাবা, আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমরা কিছু মানি না বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।’ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্মে সারাজীবন আস্থা রেখে চলেছেন। বার্ধক্যে এসে তাঁর উপলব্ধি হয়তো অহেতুক মনে হতে পারে। তাই তো ৭১ বছর বয়সে হেমন্ত বালা দেবীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্টভাবে লেখেন, ‘ধর্মমত আমার আছে কিন্তু কোনো সম্প্রদায় আমার নেই। আমি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে গণ্যই করি না। …আমি ধর্ম সমাজের রকম পরা ছাপা মারাদের মধ্যে কেউ নই। রাজার দত্ত উপাধি আমি ত্যাগ করেছি, সম্প্রদায়ের দত্ত উপাধিও আমার নেই।’ (৮ নভেম্ভর ১৯৩২) ফলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত মানবতাবাদের কবি। যে ধর্ম মানুষের হিংসা-বিদ্বেষের কারণ হয়, তাকে তিনি ঘৃণা করতেন মনে-প্রাণে। তিনি মনে করতেন, ধর্ম মানুষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির হাতিয়ার। মানুষের মর্যাদাকে, সাম্যবোধকে তিনি আপনার সত্তার গভীরে স্থান দিয়েছিলেন বলে শাস্ত্র মানা ধার্মিকদের কূপমণ্ডুকতার প্রশয় দেননি।
এ জন্যই হয়তো তিনি নাস্তিকতার মহত্ত্বকে প্রকাশ করলেন ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জ্যাঠামশাই ও ‘রবিবার’ গল্পের অভীক চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। সেখানে ভগবতসত্ত্বার অস্তিত্ব স্বীকার না করেও মানুষ যে কত বড় হতে পারে, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্য, শিল্পকলা এবং চিঠিপত্রে বারবার মানুষের কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘খুঁজি নরদেবতারে’। তাঁর মূল আসলে দর্শন। তিনি তাঁর একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার ঠাকুর মন্দিরেও নয়, প্রতিমাতেও নয়, বৈকুণ্ঠেও নয়—আমার ঠাকুর মানুষের মধ্যে—সেখানে ক্ষুধা তৃষ্ণা সত্য, পিত্তিও পোড়ে, ঘুমেরও দরকার আছে—যে দেবতা স্বর্গের তার মধ্যে এসব কিছুই সত্য নয়।’ (চিঠিপত্র-৯, ১৪ জুন, ১৯৩১) অন্য চিঠিতে তিনি নাস্তিকদের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘কত লোক দেখেছি যারা নিজেকে নাস্তিক বলেই কল্পনা করে, অথচ সর্বজনের উদ্দেশ্যে নিজেকে নিঃশেষ নিবেদন করছে। এও প্রায়ই দেখা যায়, যারা নিজেকে ধার্মিক বলেই মনে করে, তারা সর্বজনের সেবায় পরম কৃপণ, মানুষকে তারা নানা উপলক্ষ্যেই পীড়িত করে বঞ্চিত করে। বিশ্বকর্মার সঙ্গে কর্মের মিল আছে, মহান আত্মার সঙ্গে আত্মার যোগ আছে কত নাস্তিকের—তাদের সত্য পূজা জ্ঞানে, ভাবে কর্ম্মে, কত বিচিত্র কীর্ত্তিতে জগতে নিত্য হয়ে গেছে, তাদের নৈবেদ্যের ডালি কোনোদিন রিক্ত হবে না।’ (চিঠিপত্র-৯, ২৩ জুন ১৯৩১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই চিঠিতে বলেছেন, ‘মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বিদ্যা, আরোগ্য, শক্তি, সাহস দিতে হবে এই সাধনায় যারা আত্ম নিবেদন করেছে তারা কোনো দেবতাকে বিশেষ সংজ্ঞা দ্বারা মানুক বা না মানুক, তারা সেই দিব্য পুরুষকে জেনেছে, সেই মহান আত্মাকে, সেই বিশ্বকর্মাকে, যাঁকে জানলে মৃত্যুর অতীত পাওয়া যায়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নাস্তিকেরা আচার-বিচার সংস্কার এমনকি দৈব অস্তিত্বের ধারণা কোনো কিছুর পায়েই তারা নিজেদের বলি দেননি।’ তাই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘দেশ-বিদেশের সেইসব নাস্তিক ভক্তদের আমি আপন ধর্ম্মভাই বলেই জানি।’
আমরা দেখেছি, কবি ধর্মকে নিয়ে যত ভাবনার গভীরে গেছেন, সেখানে তিনি অসার বস্তু পেয়েছেন। তাই তার মনের মধ্যে ধর্ম নয় মানব সভ্যতা, মানুষের কল্যাণবোধ কাজ করেছে। সেটি কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস নয়। হোসেনুর রহমান ‘রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ চিন্তা’ প্রবন্ধে যাকে বলেছেন, ‘Profound awareness, a new insight.’ কবি বার বার বলেছেন শাস্ত্রীয় ধর্ম আমি গ্রহণ করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাস্ত্রীয় ধর্মকে পরিহার করে মানবধর্মকে উঁচু স্থান দিয়েছেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের ধর্মকে মানবতাবাদের ধর্ম হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে এক একটা প্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠো। দাঁড়াতে বসতে চলতে শুতে, যাবৎ নিদ্রিত না হবে, এই মৈত্রী স্মৃতিতে আবদ্ধ থাকবে।’ ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল বাণী হলো, শেষ পর্যন্ত মানব ঐক্য হবে আধ্যাত্মিক এবং রেশনাল। এই আধ্যাত্মিক অর্থ ঐশ্বরিক জীবনচর্চা নয়, মানব সভ্যতার ও মানবমৈত্রীর চর্চা। নাস্তিক যে সৎ, প্রবঞ্চক নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন উপন্যাস-গল্পে তা বিধৃত করেছেন। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে জগমোহনকে আদর্শহীন নাস্তিক না করে মানবকল্যাণমুখী করে গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জগমোহনের নাস্তিক ধর্মের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল লোকের ভাল করা।’ জগমোহন যখন বলেন, ‘কোনো গরজ নাই সেইটে আমার সবচেয়ে বড় গরজ।’ তাই তো ধার্মিকেরা কোনো যুক্তির ধার ধারেন না। তাঁদের যুক্তি হলো ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মালিনী’ নাটকের ধর্ম শক্তির কঠোর নেতা ক্ষেমঙ্কর ধর্মের প্রচলিত ছকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। ব্রাহ্মণদের দিয়ে শাস্ত্র বাণী উচ্চারণ করে মালিনীর নির্বাসন নিশ্চিত করেছে। এ অসত্য নির্বাসন প্রসঙ্গে সুপ্রিয় প্রশ্ন তুলেছে। ‘ধর্মাধর্ম সত্যাসত্য কে করে বিচার। আপন বিশ্বাসে সৎ করিয়াছে স্থির, শুধু তল বেঁধে সবে সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চারণে? যুক্তি কিছু নহে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাস্তিকতার ওপর সোমেন্দ্রনাথ বসুর ‘নাস্তিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ আছে। তাতে নাস্তিকদের সততা ও পরিচ্ছন্ন জীবন চেতনায় যে চিত্র রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হলো: ‘রবিবার গল্পে রবীন্দ্রনাথ অনবদ্য সৃষ্টি অভীক যে নাস্তিক কিন্তু সত্য, সুন্দর ও স্বচ্ছতার মূর্ত প্রতিবিম্ব। অভীক বিভাকে ভালোবাসে কিন্তু অভীক যেহেতু নাস্তিক কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য তাদের মিলনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো।’ এখানে অভীক নির্ভীকভাবে তার নাস্তিকতা প্রকাশ করলো। বিভাকে বললো, ‘তুমি যাকে ঐশ্বর্য বল তারই সর্বোচ্চ চূড়ায় তুমি আমাকে পৌঁছায় দিতে পারতে। তোমার ভগবান মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।’ বিভা ও অভীকের এমন কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাস্তিকদের কত উচ্চ স্থান দিয়েছেন। নাস্তিকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বোধ যে কত উচ্চ স্থানে তার অসংখ্য প্রমাণ আছে তাঁর উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, নাটিকাতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রাশিয়া ভ্রমণকালে রাশিয়ার নতুন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিন্দুকের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘অন্য দেশের ধার্মিকেরা ওদের যত নিন্দাই করুক আমি নিন্দা করতে পারবো না।’
তাই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘লোকের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে মুঢ়তাকে বাহন করে যে ধর্ম মানুষের চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট করে, সেই ধর্ম রাজশক্তির সকল অনাচারের সহায়। সে বিষকন্যার মতো, আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে সে মারে।’ তিনি বলেছেন, ‘ধর্ম মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।’ তিনি নাস্তিকতার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘য়ুরোপে এমন অনেক নাস্তিক আছেন, যাঁরা বিশ্বমানবের উপলব্ধির দ্বারা তাঁদের কর্মকে মহৎ করে তোলেন, তাঁরা দূরকালের জন্য প্রাণপণ করেন, সর্ব্বদেশের জন্যে। তাঁরা যথার্থ ভক্ত।’
সুতরাং বলাই যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যে এক অমোঘ অথচ অনুচ্চারিত ও অপ্রিয় সত্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুসংস্কার মানুষকে যে সীমাহীন দুর্ভোগের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করে, তা শতাধিক বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাস্তিক না আস্তিক, এই তর্ক খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না।
তথ্যসূত্র :
বরিবার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চতুরঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিঠিপত্র-৯, ২৭ জুন ১৯৩১
নাস্তিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ বসু
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ধর্ম, অপূর্ব কুমার রায়
রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ চিন্তা, হোসেনুর রহমান
লেখক : কথাশিল্পী ও গবেষক।