যথার্থ বাংলা ছোটগল্পের জন্ম-লালন ও বিকাশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই। এমনকি এরপর যুগ যুগ ধরে লিখিত সার্থক ছোটগল্পগুলোর বেশির ভাগই রাবীন্দ্রিক। ছোটগল্পের এমন একটি ছাঁচ তৈরি করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, সেই ছক ভেদ করে সহসা নতুন কিংবা সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো রীতির আবিষ্কার তেমন সহজ কর্ম নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের লেখকরাই কেবল রবীন্দ্ররীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েননি, খোদ রবীন্দ্রনাথও আত্মপ্রেমে অভিভূত ছিলেন। একটি গল্পের আদলে আরেকটি গল্প লিখেছেন। একটির জবাব কিংবা পরিপূরক হিসেবেও অন্য গল্প লিখেছেন। তেমনই দুটি গল্প হলো, ‘সমাপ্তি’ ও ‘হৈমন্তী’।
‘সমাপ্তি’ ও ‘হৈমন্তী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ মে ১৮৬১-৭ আগস্ট ১৯৪১) ছোটগল্প। প্রথম গল্পের প্রথম প্রকাশকাল ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ (১৩০০ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রিকায়। দ্বিতীয় গল্পের প্রথম প্রকাশকাল ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩২১ বঙ্গাব্দ)। প্রকাশিত হয়েছিল প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়। প্রথম গল্পের ২১ বছর পর দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সমাপ্তি’ গল্পের মূল চরিত্র দুটি, অপূর্ব ও মৃন্ময়ী। এ ছাড়া অপূর্বর মা ও মৃন্ময়ীর বাবা, মৃন্ময়ীর মা ও খেলার সাথি। অন্যদিকে ‘হৈমন্তী’ গল্পেরও মূল চরিত্র দুটি। হৈমন্তী ও অপু। এর বাইরে রয়েছে হৈমন্তীর বাবা, অপুর বাবা-মা।
‘সমাপ্তি’ গল্পের নায়ক অপূর্ব। শহরে লেখাপড়া করা যুবক। বাড়ি গ্রামে। বাড়ি ফেরার পথে একদিন কিশোরী মৃন্ময়ীকে দেখে মুগ্ধ হয়। ইতিমধ্যে তার বিয়ের জন্য কনে দেখা শুরু হলে অপূর্ব জানিয়ে দেয়, সে মৃন্ময়ীকেই বিয়ে করবে। যথাসময়ে বালিকা মৃন্ময়ীর সঙ্গে অপূর্বর বিয়েও হয়ে যায়। বাল্য বয়সে বিয়ে হওয়ায় সংসারধর্মের প্রতি মৃন্ময়ীর মন বসে না। সে উড়ু উড়ু থাকে। স্বামী-শ্বশুরবাড়ি, কোনো কিছুই তার ভালো লাগে না। তার বরং ভালো লাগে খেলার সাথি রাখালের সঙ্গ। কিন্তু সেই ভালো লাগা সামাজিক কারণেই মেনে নিতে পারেন না তার শাশুড়ি। তবে মৃন্ময়ীর প্রতি সংবেদনশীল অপূর্ব। তাই মৃন্ময়ীর মন ভালো করার জন্য তাকে নিয়ে নৌকায় গিয়ে তার বাবার সঙ্গে দেখা করে আসে। বিষয়টি অপূর্বর মা ভালোভাবে নেন না। ইতিমধ্যে অপূর্ব শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। যাওয়ার আগে মৃন্ময়ীকে নিয়ে যেতে চাইলেও সে স্বামীর সঙ্গে যেতে রাজি হয় না। বরং মায়ের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। এরপর অপূর্ব যাওয়ার সময় বলে যায়, যত দিন মৃন্ময়ী তাকে আসতে বলবে না, তত দিন সে আসবে না। অপূর্ব চলে যায় শহরে, মৃন্ময়ী যায় মায়ের কাছে। কিন্তু সেখানে খেলার সঙ্গী রাখালকে আর আগের মতো পাওয়া যায় না। এবার তার মন কাঁদে স্বামীর জন্য। তাই সে ফিরে আসে শাশুড়ির কাছে। চিঠির পর চিঠি লেখে স্বামীকে। কিন্তু সেই চিঠিতে ঠিকানা থাকে না বলে স্বামীর কাছে পৌঁছায় না। এদিকে অপূর্বÕi মা-ও দুশ্চিন্তায় পড়েন। তাই মেয়ের বাড়িতে যাবেন ঠিক করেন। যাওয়ার সময় মৃন্ময়ীকেও নিয়ে যান। সেখানেই নাটকীয়তার মাধ্যমেই স্বামী-স্ত্রীর মিলন হয়।
‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তী-অপুর বিয়ের সময় হৈমন্তীর বয়স ১৭, আর অপূর্বর বয়স ১৯। অপুর পরিবারের সদস্যরা হৈমন্তীর ১৭ বছর বয়সকে স্বজনদের কাছে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। শুরুতে তাদের ধারণা ছিল হৈমন্তীর বাবা মন্ত্রীগোছের কোনো প্রভাবশালী হবেন। তার প্রচুর অর্থ-সম্পদ থাকবে। কিন্তু দিন যত যায়, তত তারা হতাশ হতে থাকে। আর হৈমন্তীর ওপর নানাভাবে মানসিক পীড়ন শুরু করে। একপর্যায়ে হৈমন্তী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার হাওয়ার পরিবর্তনের পরামর্শ দেন ডাক্তার। কিন্তু অপুর বাবা সেই পরামর্শ নিয়েও কটাক্ষ করেন। শেষ পর্যন্ত হৈমন্তীর কোথাও যাওয়া হয় না। অসুস্থ মেয়ে দেখতে আসেন বাবা। বাবা-মেয়ের হৃদয় স্পর্শ করা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে বাবা বিদায় নেন। গল্পের কথক এখানে ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন, অপুর বিয়ের জন্য আবার কনে দেখা শুরু হবে। এই গল্পে যৌতুক প্রথার কুফলের চিত্র তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ।
দুই.
উভয় গল্পের মূল বিষয় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক; নারীর প্রতি নিপীড়ন প্রকাশিত হয়েছে। ‘সমাপ্তি’তে স্ত্রী বাল্যবধূ, তার চপলতা স্বামীর কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। তবে স্ত্রীর মনের অপরিপক্বতা, পরিপূর্ণ নারীত্বের অভাবে স্বামীর মনে অব্যক্ত ক্ষোভ যেমন ছিল, তেমনি ছিল তীব্র অভিমান ও ভালোবাসাও। ‘হৈমন্তী’তে স্ত্রীর ১৭ বছরের বয়সকে স্বামীর গ্রহণযোগ্য মনে হলেও শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ছিল আপত্তির। এখানে নারী নিপীড়নের আরও একটি কারণ ছিল যৌতুক। যে নিপীড়ন শেষ পর্যন্ত দাম্পত্যের চিরস্থায়িত্বের প্রতি অশনিসংকেত হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। উভয় গল্পের বেশ কিছু মিল-অমিল রয়েছে। মিল-অমিলগুলো পর্যালোচনা করলে মনে হবে, রবীন্দ্রনাথ একই ধরনের ঘটনাকেন্দ্রিক ভাবনাকে কালের ব্যবধানে দুইভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিশ্লেষণ, বুঝেছেন দুই দিক থেকে। তার এই পর্যবেক্ষণ-বোঝাপড়ার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। এগুলো হলো:
ক। ‘সমাপ্তি’তে বাল্যবিবাহ ও ‘হৈমন্তী’তে যৌতুকের অভিশাপ
খ। ‘সমাপ্তি’র অপূর্ব হৃদয়বান, দায়িত্বশীল, ‘হৈমন্তী’র অপু ভীরু
গ। ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী চঞ্চলা, প্রেমময়ী; ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী ধীরস্থির, প্রাজ্ঞ ও প্রেমময়ী
ঘ। ‘সমাপ্তি’তে মিলনেই শেষ, ‘হৈমন্তী’ শেষ অশুভ ইঙ্গিতে
ঙ। ‘সমাপ্তি’তে রবীন্দ্রনাথ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন, ‘হৈমন্তী’তে সমর্পণ করেছেন।
‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী নিতান্তই বালিকা—অপূর্ব পরিপূর্ণ যুবক। আইন অনুযায়ী অপূর্বর বিয়ের বয়স হলেও মৃন্ময়ীর হয়নি। তবু অপূর্বর আগ্রহ ও জিদের কারণেই উভয়ের বিয়ে হয়। কিন্তু সেই বিয়ের জন্য না শারীরিকভাবে না মানসিক প্রস্তুতি ছিল মৃন্ময়ীর। তবু সামাজিক রীতির কারণেই শৈশবের খেলাধুলা-আনন্দযজ্ঞকে বিসর্জন দিয়ে তাকে স্বামীর ঘর করতে আসতে হয়। এসেই দুরন্ত হরিণী বাঁধা পড়েছে কঠিন লোহার শিকলে। এমনকি স্বামীর ভালোবাসায়ও তার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। তাই অপূর্ব শহরে যাওয়ার সময় যখন মৃন্ময়ীর কাছে একটি চুমুর আব্দার করে, তাতেও তার মনে গলে না। স্বামীকে চুমো খায় না। সে শারীরিক-মানসিক বয়সে শিশু। তাই তার কাছে পরিণত বয়সের স্বামীর মূল্য নেই, বরং খেলার সঙ্গী রাখালের জন্যই তার যত দরদ। মূলত বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বাল্যবিবাহ হওয়ায় মৃন্ময়ীর মনে অপূর্বর জন্য কোনো ভালোবাসা জন্মায় না। তাই অপূর্ব যখন বাড়ি থেকে শহরে যাবে বলে, তখনো স্বামীর জন্য তার মনে কোনো ভালোবাসা বা আকর্ষণ জাগে না।
এদিকে ‘হৈমন্তী’ গল্পের নায়ক অপু পরিণত বয়সের হলেও নায়িকার বয়স তখনো আঠারো হয়নি। অবশ্য অঙ্কের হিসাবে কাঁটায় কাঁটায় ১৮ বছর বয়সেই কোনো নারী পরিণত নারী হয়ে ওঠে, এমন কোনো নজিরও নেই। তাই ১৭ বছর বয়সী হৈমন্তীকে কিশোরী নয়, পরিপূর্ণ রমণী হিসেবেই গণ্য করা যায়। এ ছাড়া তৎকালীন সমাজে যৌতুক প্রথাও স্বতঃসিদ্ধ নিয়মের মতোই। এ ক্ষেত্রে কনের বয়স যত বেশি, যৌতুকের পরিমাণও তত বেশি দাবি করত বরপক্ষ। হৈমন্তীকে তৎকালীন সমাজের চোখে কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়ে মাত্রই ‘আইবুড়ো’। আর এই ‘আইবুড়ো’ মেয়েদের যৌতকু ছাড়া বিয়ে প্রায় অকল্পনীয়। সেই সমাজে হৈমন্তীর বাবা তাকে কেবল পড়াশোনা করিয়েছেন, কিন্তু ‘সময়মতো’ শিশু বয়সে পাত্রস্থ করার কথা ভাবেননি। তার এই না-ভাবার বিষয়টি যতটা মানবিক-সংস্কৃতিবান, ততটাই সমকালের চোখে ‘অযোগ্যতা’ দায়িত্বহীনতা। অপুর বাবা-মা ও সমাজের চোখে হৈমন্তীর বাবা অন্তত দুই ধরনের দোষ করেছেন। প্রথমত, মেয়েকে সময়মতো পাত্রস্থ না করা, দ্বিতীয়ত আইবুড়ো মেয়ের বিয়েতে যৌতুক না দেওয়া। বাবার তথাকথিত নির্বুদ্ধিতার খেসারত দিতে হয় হৈমন্তীকে। তার জীবনে নেমে আসে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা।
‘সমাপ্তি’র নায়ক অপূর্ব হৃদয়বান-প্রতিবাদী, কিশোরী স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে নিজের মায়ের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়, দায়িত্বশীল, ‘হৈমন্তী’র নায়ক অপু ভীরু, ন্যায্যবিষয়ে কিংবা যৌতুকের মতো ঘোরতর অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস নেই।
‘সমাপ্তি’ গল্পের নায়ক অপূর্ব হৃদয়বান-দায়িত্বশীল। কিশোরী বধূর সব ধরনের চঞ্চলতার প্রতি তার আন্তরিক প্রশ্রয় দৃশ্যমান। এমনকি খেলার সঙ্গী ‘রাখালের প্রতি’ স্ত্রী মৃন্ময়ীর টানকেও সে সহানুভূতি-সহিষ্ণুতার সঙ্গে দেখে। বিয়ের পর বাল্যসখার প্রতি মৃন্ময়ীর টানকে অপূর্ব কখনোই বিদ্রূপ করে না। উপরন্তু মৃন্ময়ীকে প্রফুল্ল রাখার জন্য রাখালের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু তত দিনে রাখালের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেরে মৃন্ময়ী। তাই সে সেই প্রস্তাবেও রাজি হয় না। তবে স্ত্রীকে প্রফুল্ল রাখতে অপূর্বের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। নিজের মাকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে মৃন্ময়ীকে তার বাবার কাছে নিয়ে যায় অপূর্ব। বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। এই যাওয়া-আসার বিষয়টিকে অপূর্বের মা ভালো চোখে দেখেন না। ফল হিসেবে মা-ছেলে সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। পরিবেশ গুমোট হয়ে উঠছে, বিষয়টি বুঝতে পেরে অপূর্ব শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সঙ্গে নিজের স্ত্রীকেও নিতে চায় সে। কিন্তু মৃন্ময়ী যেতে রাজি হয় না। এমনকি অপূর্বের শেষ অনুরোধ ‘একটি চুমো’ দিতেও রাজি হয় না মৃন্ময়ী। অপূর্ব কিছুটা অভিমান কিংবা ক্ষোভ নিয়ে শহরে চলে যায়। এর কিছুদিন পরই শুরু হয় অপূর্বের জন্য মৃন্ময়ীর মনে ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। কিন্তু তখন অপূর্ব অনেক দূরে। তবে মৃন্ময়ী অপূর্বকে প্রায় চিঠি দেয়, কিন্তু ঠিকানা ছাড়া। তাই সেই চিঠি অপূর্বের কাছে পৌঁছয় না। অথচ মৃন্ময়ী ভেবে অস্থির অপূর্ব বুঝি অভিমান করে তার চিঠির জবাব দেয় না। শেষ পর্যন্ত অপূর্ব ও মৃন্ময়ীর দেখা হয়। সেই দেখা অপূর্বের শহরে বাসায় নয়। গ্রামেও নয়। বোনের বাড়িতে, বোনের উদ্যোগে। দীর্ঘদিন ধরে অপূর্বর প্রতি মৃন্ময়ীর উদাসীনতা দম্পতির প্রেমে ভাটা ফেলতে পারেনি। মৃন্ময়ীর প্রতি অপূর্ব রুষ্ট হয়নি। বরং পরম মমতায় স্ত্রীকে কাছে টেনে নেয়। স্ত্রীর সব আবদার পূরণের চেষ্টা করে। বয়সে, মননে অসম হলেও মৃন্ময়ীর প্রতি ভালোবাসার কমতি রাখে না অপূর্ব। এমনকি দায়িত্ব পালনেও কিছুমাত্র উদাসীনতা দেখায় না।
বিপরীতে বিপরীতে ‘হৈমন্তী’র নায়ক অপু ভীরু। বাবা-মা ও পুঁজির দাস সে। নিজের ইচ্ছার যেমন মূল্য দিতে অক্ষম সে, তেমনি স্ত্রীর সম্মান বাঁচানোরও গরজ কিংবা মানসিক সামর্থ্য তার নেই। স্ত্রী উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীল, প্রাজ্ঞ ও সাহিত্যবোধসম্পন্ন আধুনিক মানুষ। এমন স্ত্রীকে নিয়ে অপু গর্ব করে স্বগতোক্তি করতে গিয়ে বলে, ‘আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।’১ এমন কথা নিজেকে শোনায় সত্য, কিন্তু স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে বাবা-মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। স্ত্রীকে রক্ষার জন্য ন্যূনতম উদ্যোগও নেয় না। স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে সংসারে কোনো লড়াই করা দূরে থাক, দুটি যুক্তিও তুলে ধরতে দেখা যায় না অপুকে। সে কেবল পুঁজির দাস, সে কেবল প্রথার পূজারি। স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে যুক্তি দিলে বাবা-মায়ের বিরাগভাজন হতে পারে, আবার স্ত্রীর সম্মান রক্ষার্থে তাকে নিয়ে দূরে গেলে বাবা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ওপরে ওপরে অপু যতই সরল-স্ত্রীপ্রেমী হিসেবে নিজেকে দেখাক, ভেতরে ভেতরে পুরুষতন্ত্রের অনুগত। বিত্তের দাস, চিত্তের পূজারি নয়। গল্পের শেষাংশ বলে দেয়, অপুর প্রকৃত চরিত্র কী। গল্পের শেষবাক্য স্মরণয়ী—‘শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো একদিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে।’২ এই কথাগুলোর ভেতর দিয়ে একজন ভীরু-অথর্ব স্বামীর পরিচয় মেলে। যে স্বামী গোপনে স্ত্রীকে ভালোবাসে, প্রকাশ্যে তা স্বীকার করতে পারে না। গোপনে যার জন্য প্রাণপাত করে, প্রকাশ্যে তার প্রাণ গেলেও তাকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কিংবা চেষ্টা থাকে না। বরং তাকে এড়িয়ে চলার একটা সন্তর্পণ কৌশল থাকে। অপুও তাই। মা তার জন্য পাত্রীর সন্ধান করছেন, সেই খবরে তার বিচলিত-বিপর্যস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু না, সে বরং নির্বিকার। বরং এক কদম এগিয়ে বলেই রাখে, দ্বিতীয় বিয়ের অনুরোধ হয়তো অগ্রাহ্য করতে পারবে না। অর্থাৎ এমন আভাসের ভেতর দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ অন্যায্য কর্মকে বৈধতা দেওয়ারও একটি কদর্য যৌক্তিতা তৈরি করে রাখে। এদিক থেকে অপুকে কেবল ভীরু নয়, লোভী, নিষ্ঠুর ও পুরুষতন্ত্রের কঠোর অনুগামীই মনে হয়।
‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী চঞ্চলা। ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী ধীরস্থির ও প্রাজ্ঞ। দুজনেই প্রেমময়ী। একজন মৃন্ময়ী অপটু-স্বল্পশিক্ষিত-প্রায় নির্গুণ হয়েও ভাগ্যবতী। তার স্বামী স্ত্রী-অন্তপ্রাণ। আর হৈমন্তী সর্বগুণে গুণান্বিতা হয়েও দুর্ভাগ্যের শিকার। মৃন্ময়ী অল্প বয়সী। সংসারের কোনো কাজ যেমন বোঝে না, তেমনি স্বামীর মনও না। যদিও পরবর্তী সময়ে স্বামীকে ভালোবাসতে শুরু করে, তার গুরুত্ব অনুভব করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অপূর্বর বোনের বাসায় নাটকীয়ভাবে স্বামীর সঙ্গে মিলন ঘটে। বিপরীতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন হৈমন্তীকে যখন মানসিক পীড়নের ওপর রাখে, তখনো স্বামী হিসেবে অপু তাকে আশ্বস্ত করেনি, নির্ভরতাও দেয়নি। বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস হয়নি তার। এর চেয়েও বড় কথা, ইচ্ছাই প্রকাশ করেনি সে।
গল্প দুটির সমাপ্তির ক্ষেত্রে পরিণতি দুই রকম। ‘সমাপ্তি’র শেষ হয়েছে নায়ক-নায়িকার মিলন দিয়ে। নায়ক অপূর্ব বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় নায়িকা বালিকা বধূ মৃন্ময়ীকে বলে, ‘তুমি ইচ্ছা করিয়া ভালোবাসিয়া আমাকে একটি চুম্বন দাও। অপূর্বের অদ্ভুত প্রার্থনা এবং গম্ভীর মুখভাব দেখিয়া মৃন্ময়ী হাসিয়া উঠিল। হাস্য সংবরণ করিয়া মুখ বাড়াইয়া চুম্বন করিতে উদ্যত হইল—কাছাকাছি গিয়া আর পারিল না, খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এমন দুইবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে নিরস্ত হইয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। শাসনচ্ছলে অপূর্ব তাহার কর্ণমূল ধরিয়া নাড়িয়া দিলো।’৩
এরপর অপূর্ব কলকাতায় চলে যায়। যাওয়ার আগে ‘অপূর্ব বলিয়া গিয়াছিল, তুমি চিঠি না লিখিলে আমি বাড়ি ফিরিব না।’৪ যে অপূর্বকে সারাক্ষণ পাশে পেয়েও তাকে গুরুত্ব দেয়নি, তার দীর্ঘ বিরহে মৃন্ময়ীর মনে গভীর প্রেম জাগে। অনুতাপে দগ্ধ হয় সে। অনুশোচনায় ভেঙে ভেঙে পড়তে পড়তে সে নিজেকে ধিক্কার দেয়। এরপর অনেকক্ষণ প্রতীক্ষার পরও যখন অপূর্ব বাড়ি আসে না, তখন অপূর্বর মা পুত্রবধূ মৃন্ময়ীকে নিয়ে কলকাতায় নিজের কন্যার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হন। সেখানে রাতের খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত মৃন্ময়ী-অপূর্ব দেখা হয় না। অর্থাৎ মা, বোন কিংবা ভগ্নিপতি কেউই অপূর্বকে মৃন্ময়ীর উপস্থিতির কথা জানায় না। কেবল বোন তাগিদ দেয়, দ্রুত শুতে যেতে। বোনের কথামতো সে-ও তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে শুতে চায়। আর তখনই ঘটে মিলনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যার জন্য আগে থেকেই আকাঙ্ক্ষিত ছিল অপূর্ব, তার তার বিরহে এখন আরও প্রবল আকাঙ্ক্ষা জেগেছে মৃন্ময়ীর।
খাটে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইতেছে এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্বণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময় প্রকাশের অবসর দিল না। অপূর্ব প্রথমে চমকিয়া উঠিল তাহার পর বুঝিতে পারিল অনেক দিনের একটি হাস্যবাধায় অসম্পন্ন চেষ্টা আজ অশ্রুজলধারায় সমাপ্ত হইল।৫
রবীন্দ্রনাথ বাল্যবিবাহে দোষ দেখেননি। বরং বালিকাবধূর উপযুক্ত বয়স হওয়ার পর বরের সঙ্গে মিলনের নাটকীয়তার অবতারণা করেছেন। অর্থাৎ তৎকালীন হিন্দু সমাজে যা ঘটতো, তার শীর্ষভাগ চিত্র ফটোগ্রাফির মতোই এই গল্পে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সামান্য তুলির আঁচড়ও দিয়েছেন। সেটি হলো, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসা, দায়িত্ববোধের চিত্র দেখানোর ক্ষেত্রে অপূর্বকে প্রচল সমাজের প্রতিনিধি করে দেখাননি। তাকে কিছুটা বিদ্রোহী-প্রথাভাঙার পথিক হিসেবে দেখিয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি অভিমান সত্ত্বেও তার প্রেম জিইয়ে রেখে মিলনের মাধ্যমে গল্পটির সমাপ্তি টেনেছেন।
কিন্তু ‘হৈমন্তী’ গল্পের সমাপ্তি টেনেছেন সমাজের কাছে নিজেকে অসহায়ভাবে সমর্পণের মধ্য দিয়ে। এই গল্পে নায়িকা হৈমন্তী উচ্চশিক্ষিতা, রুচিশীল, প্রাজ্ঞ হওয়ার পরও তার প্রতি শ্বশুরবাড়ির লোকজেনের গঞ্জনা থামে না। স্বামী অপুও এসব গঞ্জনার তীব্র প্রতিবাদ করেনি। কোনো প্রতিরোধও গড়ে তোলেনি। তবে হৈমন্তীর শরীর খারাপ হয়ে পড়লে তাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে অপূর্ব, তখন তার বলেন, ‘অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পণ্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়!’৬ হৈমন্তীর অসুস্থতাকেও গুরুত্ব দিতে নারাজ অপুর বাবা। এতে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন হৈমন্তীর বাবা। হৈমন্তীও বাবার অপমানে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রথম অপুর ভেতর স্বামীর বোধ জাগে। বাবার কাছে গিয়ে সে বলে, ‘হৈমকে আমি লইয়া যাইব।’ জবাবে তার ‘‘বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, ‘বটে রে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।’’৭ কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ত্রী ডাক্তার দেখাতে কি বায়ুপরিবর্তনের জন্য; কোথাও নিয়ে যেতে পারে না। নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করে না। বরং কখন তার মা নতুন করে পাত্রী খুঁজতে বের হবেন, সেই বিষয়টি ভাবতে শুরু করে অপু।
অপুকে রবীন্দ্রনাথ পুরুষ করে তৈরি করেছেন, কিন্তু তার ভেতর পৌরুষ দেননি। নারী দেহের প্রতি তার মনে কামনা দিয়েছেন, মানব-মনের প্রতি মমত্ব দেননি। তাই অপু এক নিষ্ক্রিয়-অথর্ব চরিত্রে পর্যবসিত হলো। যে কেবল ভাবতে পারে স্ত্রীর গুণাগুণ নিয়ে, প্রসঙ্গক্রমে পাশের বাড়ির বউদির গুণমুগ্ধ অবিবাহিত যুবকের মতো হৈমন্তীর প্রশংসাও করতে পারে। কিন্তু যেসব গুণের জন্য স্ত্রীর প্রশংসা করে, সেগুলো তুলে ধরে তার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে পারে না।
‘সমাপ্তি’তে রবীন্দ্রনাথ সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন। দেখাতে চেয়েছেন, কিশোরীর কাছ থেকে তার পূর্ণ কর্মফল আশা করতে চাইলে তাকে নারীতে পরিণত হওয়া পর্যন্ত সময় দিতে হবে। এর জন্য স্বামীকে ধৈর্যশীল, সহৃদয়-সংবেদনশীল হতে হবে। নারী দাসি নয়, সে পুরুষের সহযাত্রী। একজন আরেকজনের সহযোগী হয়ে উঠতে পারলে সমাজে পরিবর্তন আসবে। অন্যদিকে ‘হৈমন্তী’তে সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চললেন। হলেন সমাজেরই একজন।
তিন.
১৩০০ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৩২-৩৩ বছর। ওই বয়সে ‘সমাপ্তি’ গল্পে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই গল্পের ২১ বছর পর ৫৩-৫৪ বছরের প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ সমাজের কাছে নিজে সমর্পণ করলেন। তাই সমাজে যা ঘটে তারই চিত্র আঁকলেন। যা ঘটা উচিত, তার স্বপ্ন নিজে দেখলেন না, সমাজকেও দেখালেন না।
গল্প দুটির মধ্যে মিল যেমন আছে, তেমনি গরমিলও আছে। দুটিতেই যৌতুক-বাল্যবিবাহের প্রতি রক্ষণশীলদের পক্ষপাত দেখানো হয়েছে। দুটিতে নারীকে অসহায়-অবলা হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে, পুরুষ চরিত্রগুলো একেকটা একেক স্বভাবের। যেমন সমাপ্তির অপূর্বের সঙ্গে হৈমন্তীর অপুর মিল সামান্যই। মিল কেবল স্ত্রীর প্রতি মমতা। তা-ও অপূর্ব যতটা স্ত্রীপ্রেমে একনিষ্ঠ, অপু ততটা নয়। অপূর্ব কাজে প্রমাণ দেয় ভালোবাসার, অপু যতটা নীতিবাক্য উচ্চারণ করে, কাজে ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয়। স্ত্রীপ্রেমে একনিষ্ঠ তো নয়। বরং স্ত্রীর বিরুদ্ধে যে বাবা-মা, অপু তাদেরই অনুগত।
আবার ‘হৈমন্তী’ গল্পে অপুর বাবা-মা যৌতুকলোভী। কিন্তু ‘সমাপ্তি’ তেমন নয়। তবে এই গল্পের চিত্র আরও ভয়াবহ, এখানে শৈশবহত্যার দৃশ প্রকট। মৃন্ময়ী কিছু বোঝে ওঠার আগেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। উভয়গল্পে শাশুড়ি পুত্রবধূকে মানসিক নিপীড়ন করেন। তবে হৈমন্তীতে নিপীড়ন কখনোই থামে না। সমাপ্তিতে নিপীড়ন শেষ হয়ে স্নেহ মমতায় রূপ নেয়। মৃন্ময়ী বাবা ইশানচন্দ্র যেমন, হৈমন্তীর বাবা গৌরীশংকরও তেমন। দুজনই কন্যাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। দুজনই কন্যা-অন্তঃপ্রাণ বাবা। ইশানচন্দ্র কন্যার শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে কখনো অপমানিত হননি, কিন্তু গৌরীশংকর কেবল অপমানিতই হননি, তাকে মর্মাহত-ব্যথিত হয়ে কন্যার শ্বশুরালয় থেকে ফিরে যেতে হয়েছিল।
‘সমাপ্তি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ যে সমাজকে বদলে দিতে চেয়েছেন, ‘হৈমন্তী’ গল্পে তিনি সেই সমাজেই ফিরে এসেছেন। শেষোক্ত গল্পে তিনি সমাজবদলের স্বপ্ন দেখেন না, বরং রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন। প্রথম গল্পে নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তিনি সরব। কিন্তু দ্বিতীয় গল্পে তিনি নিষ্ঠুরতাকে মেনে চলতে বাধ্য হয়েছেন। হোক ন্যায় নিষ্ঠুরতা কিংবা অন্যায় নিষ্ঠুরতা’ কোনো নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে নন তিনি। এই ক্ষেত্রে তিনি শিষ্টাচার দেখানোর পক্ষে, পুরুষতন্ত্রের সমর্থক।
তথ্যসূত্র :
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘হৈমন্তী’ গল্পগুচ্ছ, বিশ্বভারতী, ৯৬ এন মহারানি ইন্দিরা দেবী রোড, কলকাতা ৬০। প্রকাশকাল: পুনর্মুদ্রণ-১০৪২৪। পৃষ্ঠা-৫৯৯
২. তদেব, ‘হৈমন্তী’ পৃষ্ঠা-৬০৬
৩. তদেব, ‘সমাপ্তি’, ১৮৫
৪. তদেব, ১৮৭
৫. তদেব, ১৮৯
৬. তদেব, ‘হৈমন্তী’, পৃষ্ঠা- ৬০৫
৭. তদেব, পৃষ্ঠা-৬০৬