একদা এক চন্দননগরে

মোহাম্মদ নূরুল হক প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৩, ০৩:৪৫ পিএম

এই ঘটনা বহুকাল আগের। যে কালে সন্ত্রস্ত সন্ধ্যাকে ভয় পেতো সাধারণ ঘরের নারী-পুরুষ সবাই। সন্ধ্যা নামলে রাজপুতদের ভয়ে সাধারণ ঘরের নারী তো নারী, পুরুষরাও ঘরের বাইরে যেতো না। এই ঘটনা সেই সময়ের, যখন চন্দননগর রাজ্যের সঙ্গে সভ্য দুনিয়ার পরিচয় ঘটেনি।

এই রাজ্যের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী। বড় কোনো জাহাজের দেখা মেলে না সেই নদীতে। তবে, গভীর নিশিতে কুমিরের পিঠের মতো দুলতে দুলতে ছোট ছোট নৌকাগুলো অপসৃয়মাণ সমুদ্রের দিকে চলে যায়। গৃহস্থ বধূরা অবাক বিস্ময়ে দেখে, সেই নৌকায় কুপি জ্বলছে। তাদের মনে হয়, ভগবানের দূতেরা আলো জ্বেলে রেখেছে। সেই সব স্বর্গীয় আলো দূরে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়।

এখানে রাজায়-প্রজায় বৈষম্য প্রকট। এখানে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ বিপুল। এখানে যোগ্যতায় কেউ বিত্তশালী হয় না। কর্মদোষেও হয় না কেউ দরিদ্র। এখানে রাজা-প্রজা সবাই জানেন—‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’—এটি লোক ঠকানো প্রবাদ। তাই এখানে জন্মসূত্রে ভাগ্যবানরাই পূজা পায়। ভগবানের দুনিয়ায় কর্মগুণে কেউ পূজনীয় হতে পারে, এমন তত্ত্ব তারা কেন, চৌদ্দপুরুষও কোনোদিন বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করবে কেন, এই জনগোষ্ঠী প্রমাণে বিশ্বাসী, কথায় নয়। কারণ তারা দেখেছে—ভগবানের দুনিয়ায় রাজা হয় বংশপরম্পরায়। বিত্তশালীও তাই। এখানে চাষির ছেলে সৈনিক হতে চাইলে মৃত্যুদণ্ড। সৈনিকের ছেলে রাজা হতে চাইলেও তাই। রাজারা এখানে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তারা কেবল ঈশ্বরের আদেশ বাস্তবায়ন করেন। তাই রাজার আদেশ অমান্য করা আর ঈশ্বরের বিরোধিতা করা তাদের কাছে একই।

এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যদি কোনো অভিযোগ থাকেও, তারা প্রকাশ করে না। কেবল ভগবানের উদ্দেশে ঊর্ধ্বমুখী দাঁড়ায়। অসীম আকাশের মহাশূন্যে সেই ক্ষোভ মিশ্রিত অভিযোগের বল্লম ছুড়ে মারে। সেই বল্লম মহাশূন্যের কোথাও গিয়ে বিঁধে যায় না, হারিয়েও যায় না। ফিরে আসে অভিযোগকারীর কপালেই। অভিযোগ করার কিছুকালের মধ্যে হয় তার গোয়ালে আগুন লেগে গরুর পাল ভস্ম হয়, নয় সোমত্ত মেয়েটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তারা কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলে না।  

নতুন রাজা দুখাইয়ের অভিষেক। পুরো রাজ্যে সাজ সাজ রব। অভিষেক অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব রাজার কপালে তিলক পরানো। রাজ্যের সবচেয়ে সুদর্শন যুবকটিকে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নতুন রাজার কপালে তিলক এঁকে দিতে হবে। এই নিয়ম যুগ-যুগ ধরে চলে এসেছে।

দুখাই রাজের বাবা রুখাই রাজের অভিষেকে আনুগত্যের নিদর্শন দেখিয়েছিল ওই সময়ের সুদর্শন যুবক মাখন লাল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে রাজার কপালে তিলক এঁকে দিতে হয়েছিল তাকে। রুখাই রাজ খুশি হয়ে তাকে রাজবাড়ির পেছনে একটি কুটির করে দিয়েছিল। বলেছিল, মাখন তোমরা আজ থেকে রাজবাড়ির দাস। তোমার ছেলে সুখন লাল রাজপুত্র দুখাইয়ের সেবা করবে। দুখাই যেদিন রাজা হবে, সেদিন সুখন আঙুল কেটে তাকে তিলক পরাবে।  

-আজ্ঞে মহারাজ! গর্বে মাখন লালের বুক সেদিন সাম্পানের পালের মতো ফুলে ফুলে উঠেছিল।

কিশোর দুখাইয়ের স্বভাব মহাভারতের দুর্যোধনের মতো। সবসময় মারমুখো। আজ মন্ত্রীর ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে কুয়োয় ফেলে দেয় তো কাল সেনাপতির ছেলের আঙুল কেটে দেয়। রাজপুত্র বলে তার নামে কেউ নালিশেরও সাহস পায় না। দুখাইয়ের খেয়াল হলো আজ সে ঘোড়ায় চড়বে না। সুখনকে ঘোড়া বানিয়ে পুরো বাগানবাড়ি ঘুরবে। আদেশ পাওয়া মাত্রই মন্ত্রী-অমাত্যপুত্ররা সুখনকে ধরে এনে উপুড় করে বসিয়ে দেয়। তার পিঠে চড়ে বসে দুখাই। রাজপুত্রের আদেশ, সুখনকে ঘোড়ার গতিতে দৌড়াতে হবে। সুখনও আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। সে তার গতিতেই চলে। তাতে রাগ ওঠে রাজপুত্রের। সুখনের কাঁধে-পিঠে সপাং সপাং চাবুকের আঘাত করেই চলে। সুখন অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতেও পারে না। দুখাইয়ের নির্দেশ, কাঁদা যাবে না। সহ্য করতে হবে। সহ্য করাই সুখনদের ধর্ম। সুখনও তা জানে, কিন্তু মন মানতে চায় না। বারবার বিদ্রোহ করতে চায়, পারে না। সুখন ভাবে—পালিয়ে যাবে। দূরের কোনো রাজ্যে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে সে অস্ত্রবিদ্যা শিখবে। যুদ্ধ করবে। কোনো রাজ্য জয় করে সেই রাজ্যের রাজা হবে। এরপর একদিন। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে অমাত্যপুত্রের বিদ্রূপে। বলে, কী সুখন কী ভাবো? রাজপুত্রের আদেশ পালনই তোমার ধর্ম। এরপর রাজপুত্র-অমাত্যপুত্র-সেনাপতিপুত্র একযোগে হেসে ওঠে। সম্মিলিত বিদ্রূপের হাসিতে শরীরে ব্যথা ভুলে যায় সুখন, মনের ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

এরপর কেটে যায় বহু বছর। সুখন কিশোর বেলা পার হয়ে যুবকে পরিণত হয়। রুখাই রাজা বয়সের ভারে বৃদ্ধ। সুখনের বাবা মাখন লালেরও বয়স বাড়ে। রাজপুত্র দুখাই আগের চেয়ে বেশি নিপীড়ক হয়ে ওঠে। কথায় কথায় প্রজাপীড়ন, পশু-পাখিহত্যা তার নিত্যদিনের নেশা। কোনো কারণ ছাড়াই সুখনের ওপর তার অত্যাচার মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠেছে। সুখন আর সহ্য করতে পারে না। মনের খেদ আর কত গোপন রাখবে!

ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে চরাচরে। সুখন বিড়াল পা টিপে টিপে ঢোকে সেনাপতির ঘরে। সন্তর্পণে বল্লম হাতে তুলে নেয়। এরপর নিঃশব্দে বের হয়ে আসে। ঘরে ফিরতেই মাখনের প্রশ্ন, বাবা বল্লাম পেলি কই? সুখন কোনো জবাব দেয় না। বৃদ্ধ মাখন লালের উৎকণ্ঠা বাড়ে। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেও কোনো জবাব পায় না। মাখন লাল গভীর চিন্তায় ডুব দেয়—ছেলেটার কী হলো? হঠাৎ চোট পাওয়া চিতার মতো এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলো কেন সুখন? রাজবাড়ির প্রহরীর ডাকে তার ধ্যান ভাঙে, ও মাখন, বাড়ি আছ? রাজা বাহাদুর ডাকছেন তোমাকে।

প্রহরীর সঙ্গে মাখন এসে রাজবাড়িতে হাজির। রুখাই রাজ হাতের ইশারায় মাখনকে কাছে ডাকে। গলা যথাসম্ভব শীতল, গম্ভীর। মাখনের মনে হলো, বঙ্গোপসাগরের তলদেশ থেকে কোনো সামুদ্রিক প্রাণীর জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এলো, তোমার ছেলে কই? এই প্রশ্নের আশঙ্কা মাখনের মনে শুরু থেকেই ছিল। তাই কিঞ্চিৎ মনে মনে প্রস্তুতিও ছিল। 
-আজ্ঞে মহারাজ।
-তোমার ছেলে কই?
-জে...
-কী জে জে করছ? ছেলে কোথায়?
-মহারাজ ছেলে তো একটু আগেও বাড়ি ছিল। তবে রাজবাড়ি আসবার সময় তারে বাড়ি দেখি নাই।
-তার মানে কী? তুমি জানো সে কোথায় গেছে?
-মহারাজ, ছেলে কোথাও যায়নি। গেলে তো আমাকে কয়েই যেতো। সে কোথাও যায়নি। আছে নিশ্চয়ই এদিক সেদিক। 
-চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম। ছেলেকে এনে হাজির করো।
-জে আজ্ঞে।

মাখন লালের জীবনে সেরা উচ্চারণ এই একটিই, ‘জে আজ্ঞে’। রুখাই রাজেরও বেশ পছন্দ এই মোমের মতো গলতে থাকা বিনয়টুকু।

রাজ দরবার থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ায় মাখন। তাকায় আকাশের দিকে, সেখানে পুঞ্জিভূত মেঘে অন্ধকার জমাট বাঁধতে থাকে। মনে হয় এখনই ভগবানের সমস্ত ক্রোধ এই ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতর থেকে চন্দননগর রাজ্যে এসে পড়বে। মাখন লাল যখনই বিপদে পড়ে, তখনই কায়মনোবাক্যে ভগবানকে ডাকে। কিন্তু ভগবানের দয়ার ভাগ সে কখনোই পায় না। উল্টো ভগবানের প্রতিনিধির নিষ্ঠুর আক্রোশের শিকার হতে হয়। তাই সে মনকে বোঝায়, রাজা তো ভগবানেরই প্রতিনিধি। সেই প্রতিনিধির অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভগবানের কাছে বিচার চেয়ে কী লাভ? ভগবান তার প্রতিনিধির পক্ষে থাকবে, না কি এই তুচ্ছ ব্রাত্যজনের পক্ষে? রাজা জনগণের মনে ভগবানের প্রতি বিশ্বাস-আস্থা-আনুগত্য এনে দিতে পারবে। ভগবানের প্রতিনিধি হিসেবে সেই কাজের দায়িত্বও তার। কিন্তু ভগবানের জন্য কী এমন করতে পারবে তুচ্ছ মাখন? কিছুই না। কেবল নির্জনে চোখের জল ফেলতে পারবে। চোখ ঘোলাটে হয়ে এলে ভরসাশূন্য আকাশের দিকে তাকাতে পারবে। আচ্ছা ভগবান কি ওই আকাশেই থাকে! তার সঙ্গে কেবল রুখাই রাজই কথা বলতে পারে? এমন কোনো পুণ্য নেই, যার বলে মাখনও ওই পক্ষপাতদুষ্ট ভগবানের সঙ্গে কথা বলতে পারে? মাটির কলসির মতো উপুড় হয়ে থাকা আকাশে মাখনের চোখ তন্ন তন্ন করেও ভগবানের দয়ার কোনো চিহ্ন সে দেখে না। বরং দেখে অসংখ্য তারা জ্বলছে। সেই তারাগুলো নাকি অনন্তকাল ধরে ভগবানের মহিমা প্রকাশ করে চলেছে। এই দৃশ্য দেখেই সে বিধাতার অপার লীলায় বিস্মিত হতে থাকে। এছাড়া আর কী-ইবা করার আছে তার? মাখন বিস্মিত হয়, আর ভাবে, ভগবানের দুনিয়ায় গরিবের জন্মই হলো ভগবানের প্রতিনিধির দাসত্ব করতে।

ঘরে ফিরে অস্থির পায়চারী করে মাখন। তারই চোখের সামনে ছেলে তার এতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো কিভাবে? ছেলে রাজদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণের চেয়ে ছেলে কোথায় পালালো, সেই চিন্তাই এখন মাখনকে বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে।

রুখাই রাজের দেওয়া চব্বিশ ঘণ্টা পার হলো, সুখনের দেখা নেই। ছেলেকে কোথায় খুঁজবে মাখন? দিন যায়, মাস যায়, বছরও পার হয়। সুখনকে আর পাওয়া যায় না। এদিকে রাজা রুখাইয়ের বয়স হয়েছে। বেশ কদিন রোগে ভুগে ভগবানের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বর্গলোকে পাড়ি জমালো রুখাই। তার মৃত্যুও পর নিয়ম অনুযায়ী দুখাই রাজের অভিষেক। সেই অভিষেকে প্রথা মাফিক দুখাই রাজের কপালে নিজের আঙুল কেটে তিলক পরাতে হবে সুখনকেই। কিন্তু সুখন কোথায়? সুখনের খোঁজে রাজ্যময় ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো। তবু কেউ তার খোঁজটুকু পর্যন্ত দিতে পারলো না।  

এখন দুখাই রাজের অভিষেকের কী হবে—চিন্তায় ঘুম হারাম পারিষদের। একেকজন একেক পরামর্শ দেয়। কারও পরামর্শই মনে ধরে না তরুণ রাজার। শেষে অমাত্যের প্রস্তাবে চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হলো। সুখনকে না পেলে, তার বুড়ো বাবা মাখন নিজের আরেক আঙুল কেটে রাজার কপালে তিলক আঁকবে। দুখাই ভেবে দেখে, এতে একঢিলে দুই পাখি মরে। তার অভিষেকও  হয়, সুখনের পালিয়ে যাওয়ার প্রতিশোধও বাকি থাকে না। কিন্তু সে ভুলে যায়, তিলক পরাতে হয় সুদর্শন যুবকের আঙুল কেটে, বৃদ্ধের নয়।

হবু রাজার সম্মতি মিলতেই পারিষদ দ্বিগুণ উৎসাহে ছোটে। কে কার আগে মাখন লালকে পাকড়াও করে আনবে, সেই প্রতিযোগিতাও হয়ে গেলো এক চিলতে। শেষে ঠিক হলো—কোতোয়ালের নেতৃত্বে একদল প্রহরী গিয়ে মাখনকে ধরে আনবে।

সিংহাসনে দুখাইরাজ বসে আছে। পারিষদ চারপাশে স্তুতিতে মগ্ন। কেউ দিচ্ছে জয়ধ্বনি, কেউ পড়ছে মন্ত্র, কেউ বা জপছে নামকীর্তন। এরই মধ্যে সিংহদ্বার থেকে ভেসে এলো হট্টগোলের আওয়াজ। মাখন লালকে ধরে এনেছে কোতোয়াল। পারিষদ অবাক বিস্ময়ে দেখলো, মাখন লালের মধ্যে কোনো বিদ্রোহ ভাব নেই, লেশমাত্র নেই ভয়েরও। সে স্থির-স্বাভাবিক। তবু, কোতোয়াল-প্রহরী তার কোমরে রশি বেঁধে রেখেছে। টেনে হিঁচড়ে যে এনেছে, তার প্রমাণ স্পষ্ট। স্থানে স্থানে পোশাক ছেঁড়া। থেঁতলে গেছে হাঁটুর ওপরের ত্বক। হাতের কনুই থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। পারিষদের ভেতর থেকে কে একজন বললো, মাখনকে এভাবে টেনেহেঁচড়ে আনলে কেন? তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দুখাইরাজ গর্জে ওঠে, চুপ রও। গাদ্দারকে এভাবেই আনতে হয়। এটাই রাজাজ্ঞা।

প্রহরীদের মধ্যে তখন তুমুল গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। তারা আরও সতর্ক হয়ে উঠলো। আর তখনই মাখনের মনে হলো,  এই বুঝি কোনো এক প্রহরী বলে উঠলো আজ তোর শেষ দিন দুখাই! নতুন রাজার কানে শব্দ কি ঠিকঠাক পৌঁছালো? না কি তার মনের ভুল?  বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য দুখাই রাজ হুংকার ছাড়ে, কে? কী বললি?

সবাই চুপচাপ। কারও মুখে কথা নেই। রাজ পণ্ডিত উঠে দাঁড়ালো, মাখন লাল এগিয়ে  এসো। রাজার কপালে তিলক এঁকে দাও। মাখন ধীরে ধীরে টলতে টলতে এগোতে থাকে। রাজপণ্ডিত ছুরি বের করে মাখনের হাতে দেয়। বলে, এবার তোমার ডান হাতের তর্জনী কেটে তার রক্ত দিয়ে রাজাকে তিলক পরাও। মাখন কাঁপা কাঁপা হাতে ছুরিটা ধরে। মনে মনে বলে, হায় ভগবান! তুমি সত্যিই আছ? হঠাৎ সে হু হু করে অক্ষম আক্রোশে কেঁদে ওঠে। কান্না শুনে ক্ষেপে ওঠে দুখাই রাজ—কী ন্যাকামি হচ্ছে? কোতোয়াল সজোরে ধাক্কা দেয় মাখনকে। মাখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুখাই রাজের পায়ের কাছে। দুখাই সজোরে মাখনের মাথায় লাথি বসিয়ে দেয়। এরপরই প্রচণ্ড গর্জন তার, অভিষেক পণ্ডের চক্রান্ত?

আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব মাখন। নাকের ভেতর যেন লবণ স্বাদ অনুভূত হলো। হাত দিয়ে দেখে রক্ত। তার চোখে তখন ঘনায়মান অন্ধকার। সেই ঘোলাটে চোখে একচোখা ভগবানের ভরসাশূন্য আকাশের দিকে তাকায় সে। কিন্তু ভয়ার্ত সে আকাশে ভগবানের কোনো সাড়া পায় না মাখন। তখনই তার মনে হয়, ন্যায়বিচারের জন্য মানুষ চিরকাল ভগবানের ওপরই ভরসা করবে কেন। কখনো কখনো কি মানুষ নিজের হাতে ন্যায়ের দণ্ড তুলে নিতে পারে না? মানুষই কি ন্যায়ের দণ্ড হাতে ভগবান হয়ে উঠতে পারে না? তার মনে দীগন্তরেখায় অপসৃয়মাণ ক্ষীণ রেখার মতো আশা জাগে, যদি সুখন সেই ভগবান হয়ে আসতো! যদি সুখন আজ প্রতিশোধ নিতো। আর তখনই তার মনে হলো, প্রহরীদের ভেতর থেকে শা করে একটি বল্লম এসে পড়লো দুখাই রাজের কপালে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো কপাল থেকে। ঢলে পড়লো দুখাই রাজ। সভায় শোরগোল পড়ে গেলো। সবাই দিগ্বিদিক ছুটছে। আর সেনাপতি পেছন ফিরে দেখে—প্রহরীদের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সুখন লাল।