মৃণাল সেন : জন্ম যদি তব বঙ্গে

প্রসূন রহমান প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৩, ০৮:৪৫ এএম

মাত্র দুই বছর আগেই পেয়েছিলাম সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ। এ বছর মৃণাল সেনের। আর দুই বছর পরেই আসবে ঋত্বিক‌ ঘটকের শতবর্ষ। বিশ‌ শতকের শুরুর কালে কী উর্বর একটা দশক এসেছিল এই উপমহাদেশে—দুই বছর অন্তর অন্তর জন্মেছিলেন তিন মহারথী, যারা বাংলা চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছেন বিশ্বদরবারে।‌ একই কাজ করেও প্রত্যেকের চিন্তা, দর্শন‌ও কর্মপদ্ধতি যেমন‌ আলাদা, তেমনি প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ও‌ সৃষ্টি উচ্চমার্গীয়, মননশীল এবং ধ্রুপদি।

প্রতিটি শতবর্ষ উদ্‌যাপনের কালেই ভাবনা আসে, রবীন্দ্রনাথের পর আর কজন‌ সৃজনশীল প্রাণ আছে যাদের জন্ম এবং জীবনকাল এতটাই অর্থবহ যে আমরা তাদের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করতে পারি? খুব বেশি বোধ হয় নেই। আর চলচ্চিত্র নিয়ে প্রায় সব আলোচনাই অপূর্ণ থাকে একই বাক্যে সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণাল‌—এ ৩টি নাম উচ্চারিত না হলে।

বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া মৃণাল সেন ১৭ বছর বয়সে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় পড়তে গিয়েছিলেন।‌ সময় তখন ১৯৪০। পরিবার ছেড়ে শহরটাকে আত্মস্থ করে নিতে কিছুটা সময় লেগেছিল। তরুণ বয়সে কী দেখেননি তিনি—যুদ্ধ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, বেকারত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং মৃত্যু।

কিন্তু জীবনের ঘটমান চলমান বাস্তবতায় সবকিছুই যে রাজনীতির অংশ, সেই রাজনীতিকেই তিনি মোকাবেলা করতে চেয়েছেন‌ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু করে। তাই তাঁর বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই শুধু রাজনীতি সচেতন নয়, রাজনীতির অংশবিশেষ। চরিত্রগুলো সংগঠক, প্রতিবাদী এবং একই সঙ্গে শিকার। আর দর্শক তার অংশীজন।

রাজনৈতিক কর্মী থেকে থিয়েটার কর্মী, থিয়েটার কর্মী থেকে চলচ্চিত্র কর্মী এবং এরপর নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ, বেড়ে ওঠা এবং প্রতিষ্ঠা। তবে প্রতিষ্ঠার পথে এই যাত্রা অত সহজ ছিল না। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ যে বছর মুক্তি পায়, একই বছর তাঁরও প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। ছবির নাম ‘রাতভোর’। ছবিতে উত্তম কুমার এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় থাকার পরেও ‘পথের পাঁচালী’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অত্যুঙ্গস্পর্শী গুরুত্বের কাছে ছবিটা আড়ালেই পড়ে যায়। মৃণালকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার‌ জন্য একে একে অপেক্ষা করতে হয় হিন্দি ভাষায় নির্মিত দশম চলচ্চিত্র ‘ভুবন সোম’ এর জন্য।

মৃণাল সেন চার্লি চ্যাপলিনের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হলেও নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়েছেন ইতালিয়ান নিউ রিয়েলিজম তথা নব্য বাস্তববাদের ধারাতেই। প্রিয় নির্মাতার মাঝে ভিত্তরিও ডি সিকা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন‌ জ্য লুক গদার এবং কুরোসাওয়া ও। স্বল্প বাজেটে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সক্রিয় সময়কাল পার করেছেন মৃণাল সেন। পার করেছেন কোনো আপসকামিতা ছাড়াই। কাজ করেছেন টেলিভিশনের জন্যও। বাংলা ছাড়াও নির্মাণ করেছেন হিন্দি ও তেলেগু ভাষায়। দুহাত ভরে নিয়েছেন নবীন প্রবীণ কথাসাহিত্যিকদের অসংখ্য ছোট-বড় গল্প-উপন্যাস। স্বল্পদৈর্ঘ্য ও তথ্যচিত্র বাদে ২৫তম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র যখন নির্মাণ করছেন তখন এক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, “আমি কখনো কাজের সংখ্যা গুনতে পছন্দ করি না। এ ক্ষেত্রে অনেকটা ২৫ পেরিয়ে যাওয়া তরুণীর বয়স বলতে না চাওয়ার মতোই।” আরও বলেছিলেন, “আমার কাছে দুই ‘সোম’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক ‘সোম‌’ আমাকে জীবন দিয়েছে, আরেক ‘সোম’ দিয়েছে প্রতিষ্ঠা।

প্রথমজন গীতা সোম, তাঁর স্ত্রী, বিয়ের পর হয়েছেন গীতা সেন। আরেকজন ‘ভুবনসোম’। চলচ্চিত্র। উদযাপনের কালে সবার প্রতিই আমাদের অবারিত ভালোবাসা।

আজ মৃণাল সেনের ১০০তম জন্মদিন। তার জন্মশতবর্ষে রইল আমাদের বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি।