কালপুরুষেরও শেষ হয়

সুমন মজুমদার প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৩, ০৪:২৭ পিএম

প্রথম যেবার কলকাতা যাই, সীমান্ত পেরোতেই সে কী উত্তেজনা হয়েছিল! বনগাঁ থেকে বাস যত কলকাতার দিকে এগোচ্ছিল, ততই মনে হচ্ছিল আমি সুনীল, সমরেশের শহরে ঢুকে পড়ছি। ক্রমেই আমাকে টানছে সুমন-অঞ্জনের শহর। সেটা ২০০৬—০৭ সাল হয়তো হবে। ভেবেছিলাম থিয়েটারের কারও কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে অন্তত সুনীল ও সমরেশের সঙ্গে দেখা করব। কারণ, তাঁদের দুজনের কাছেই আমার কিছু প্রশ্ন আছে। কী প্রশ্ন ছিল, সেটা না হয় আরেক কথার জন্য তোলা থাক। শুধু বলতে পারি, সমরেশ নিজে থিয়েটারে আসক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমি তেমন কিছু নিয়েই কথা বলতাম।

কলকাতা আর পশ্চিমবঙ্গের এই বিখ্যাতজনদের নিয়ে আমার আদিখ্যেতায় অনেকেরই মেজাজ খারাপ হতে পারে। কিন্তু কেন আদিখ্যেতা দেখাচ্ছি, তা যেহেতু আমার কাছে স্পষ্ট; তাই কে কী বলল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। না, সেবার তো নয়ই। কলকাতায় এরপর আরও অনেকবার গেলেও সুনীল, সমরেশের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। সুমনের কাছেও আর যেতে পারিনি, তবে অঞ্জনের সঙ্গে ঢাকায় কিছু সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল।

সুনীল-সমরেশের প্রতি এই তীব্র আকর্ষণের কারণ বোধ হয় আমার কৈশোর ও যৌবনের প্রথম ধাপ। হুমায়ূন-সুনীল-সমরেশ ট্রায়োতে তীব্রভাবে আচ্ছন্ন থাকায় আমি ঘোরের মধ্যে থাকতাম। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁরাই আমার সাহিত্য চিন্তা ও মনন গঠনে প্রথম ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু দুঃখ, তাঁদের কারও সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি। তার আগেই ২০১২ সালে হুমায়ূন আর নীললোহিত চলে গেলেন। শেষ যেবার সমরেশ ঢাকায় বাতিঘরের দোকানে সবার সঙ্গে আড্ডা দিলেন, ভেবেছিলাম সেখানে অন্তত যাব। তা-ও যেতে পারিনি। কিছুদিন ধরে সমরেশ অসুস্থ শুনছিলাম। মনের মধ্যে মৃত্যু-আশঙ্কাও যে জেগে উঠছিল না, তা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিমাখা ২৫ বৈশাখেই যে তিনি চলে যাবেন, তা ভেবে উঠতে পারিনি। প্রিয় লেখক, সুযোগ হলে আমিও আপনার মতোই এমন কোনো দিনে মরতে চাইতাম।

যে ট্রায়োর কথা আগে উল্লেখ করেছি, তাদের নামের শেষে আহমেদ আছে, নাকি গঙ্গোপাধ্যায়, মজুমদার সেটা আমার কাছে কখনোই বিবেচ্য ছিল না। তাঁরা আমার কাছে ছিলেন কেবলই হুমায়ূন-সুনীল-সমরেশ। সুনীলের ‘ছবির দেশে ও কবিতার দেশে’ বা ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ পড়ে কখনো প্যারিস, কখনো লস অ্যাঞ্জেলেস, কখনোবা আসামের কাজিরাঙার বনসহ কোথায় কোথায় যে কৈশোরে ঘুরে বেড়িয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সমরেশ মানে আমার কাছে কেবলই ছিল ডুয়ার্স, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ির মতো জায়গাগুলো। মনে আছে, তখন সম্ভবত মাত্র এসএসসি শেষ করেছি। কালেভদ্রে জড়িয়ে গেছি ছাত্র ইউনিয়ন আর উদীচীর সঙ্গে। ঠিক সে সময় যদি কারও হাতে সমরেশের ‘গর্ভধারিণী’ এসে পড়ে তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা নিশ্চয়ই পাঠকরা অনুমান করতে পারেন।

হ্যাঁ, আমার সঙ্গেও সমরেশ তাই করেছিলেন, গর্ভধারিণী দিয়ে তিনি আমার তরুণ মনকে এমনই বিভ্রান্ত করে দিলেন যে, সে ঘোর কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লেগেছে। সে সময় সুদীপ, আনন্দ, জয়িতা, কল্যাণদের মতো আমিও স্বপ্ন দেখতাম এই পৃথিবীটা একদিন সাম্যের হবে। ভেঙে পড়বে সমস্ত অসম অর্থনৈতিক কাঠামো। মানুষ শুধু মানুষ হয়ে দাঁড়াবে মানুষের পাশে। এমন আরও কত কি! কিন্তু সুদীপ, আনন্দ, জয়িতাদের যেমন আশাভঙ্গ হতে সময় লাগেনি, আমারও তেমন। যদিও ওরা তপল্যাঙ গ্রামের খোঁজ পেয়েছিল, কিন্তু আমি তেমন কিছু পাইনি। যেভাবে দিনে দিনে আশাহত হয়েছি, সেভাবেই এখনো রয়ে গেছি। আজ বয়স যত বাড়ছে, তারুণ্য যত অতীত হচ্ছে দিনে দিনে, তত যেন সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের উত্তেজনা উদ্দীপনা আরও স্তিমিত হয়ে আসছে। গর্ভধারিণীর শেষটা পড়ার সময় সমরেশের ওপর খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, চার বন্ধুর একটা সুন্দর বিপ্লব কী নির্মমভাবেই না তিনি পণ্ড করে দিলেন। এখন মনে হয়, না সমরেশই ঠিক ছিলেন। এটাই বাস্তবতা। সময় তারুণ্যের বিদ্রোহী মনোভাব, নির্ভীক চেতনাকেও ধীরে ধরে সুকৌশলে ঠিকই একসময় নিজের বশে নিয়ে আসে। তবে গর্ভধারিণী আমার মনে যে তীব্র ছাপ ফেলে গেছিল, সেটা ভুলবার নয়।

গর্ভধারিণী দিয়ে যদি সমরেশের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তাহলে ‘কালপুরুষ’ দিয়ে হয়েছে সখ্য। কলেজে থাকতেই কালপুরুষ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের বস্তির অর্ক, অনুপমা, খুরকি, কিলা, বিলু, কেয়া, ন্যাড়া, ঝুমকি, তৃষ্ণাদের সঙ্গে। যদিও এটি পড়ার আগে আমি তাঁর উত্তরাধিকার ও  কালবেলা পড়িনি। তাই অনিমেষ বা মাধবীলতার প্রতি তখনো কোনো ফ্যাসিনেশন ছিল না। কিন্তু অনিমেষের পঙ্গু অবস্থা, মাধবীলতার সংগ্রাম আমাকে আমার পরিবারের কথা মনে করিয়ে দিত। নানামাত্রিক বিচিত্র পরিবেশে অর্কের অভিজ্ঞতা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আয়নার সামনে। আমি যেন সে সময় অর্কের মধ্যে নিজেকে দেখতে শুরু করেছিলাম। সেই যে সমরেশ আমার মানসপটে কালপুরুষ হয়ে দাঁড়ালেন, আর গেলেন না।

উত্তরাধিকার ও কালবেলা আমার আজও পড়া হয়ে ওঠেনি। অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেন যেন বিচিত্র আলস্য আমাকে এগোতে দেয়নি। এরপর সমরেশের সাতকাহন, আট কুঠুরি নয় দরজা, মহাকাল, লীলাসুন্দরসহ আরও বেশ কয়েকটি বই পড়েছি। কিন্তু গর্ভধারিণী বা কালপুরুষের মতো প্রভাবিত আর কোনোটিই করতে পারেনি।

অতি সম্প্রতি আর সমরেশকে কেন যেন পড়া হতো না। আমার বাসায় কেউ একজন সমরেশের তিনটি বই এনে রেখেছে। পরানের পদ্মবনে, লীলা খেলা ও জলের নিচে প্রথম প্রেম। কিন্তু একটি বইও পড়তে ইচ্ছে হয়নি। তবে কি তারুণ্যের সেই সাহিত্য নায়কের প্রতি কোনো অভিমান চেপে বসেছিল! মনে আছে, সমরেশের ‘মেয়েরা যেমন হয়’ পড়ে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম একসময়। অনেকের কাছে বইটা প্রিয় শুনেছি। কিন্তু আমার কেন যেন মোটেও ভালো লাগেনি। মনে হয়েছে, মেয়েরা কেমন হয়, তা যেন সমরেশ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন বারবার। অথচ পুরুষ হিসেবে মেয়েদের নিয়ে আমারও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি আছে।

সমরেশের গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুনকেও আমার খুব একটা ভালো লাগত, তা নয়। তার চেয়ে বরং সুনীলের সন্তু-কাকাবাবু অনেক বেশি আকর্ষণ করত। যেহেতু খুব বেশি অর্জুন পড়িনি, তাই এ নিয়ে মন্তব্য করাও তাই ঠিক হবে না। কিন্তু যত যা-ই হোক, সমরেশ সব সময়ই আমার কাছে গর্ভধারিণী ও কালপুরুষের স্রষ্টা ছিলেন। গতকাল (সোমবার) যখন তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন সত্যি কষ্ট পেয়েছি। অভিমানে দূরে সরিয়ে রাখা প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলে যে কষ্ট, এই কষ্টা অনেকটাই সে রকম। হায় হুমায়ূন, সুনীল, সমরেশ—আমার প্রশ্নগুলো তোমাদের আর করা হলো না।