শামীম শিকদারের শিল্পের নন্দনতত্ত্ব

দীপ্তি দত্ত প্রকাশিত: মার্চ ৩১, ২০২৩, ০৫:২৭ পিএম

শামীম শিকদার নিয়ে আলোচনা যথারীতি নারী হিসেবে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। যেমনটা দীর্ঘ সময় চলেছিল নভেরা আহমেদকে নিয়ে। ‘নভেরা পর্ব’ (নারী হিসেবে আলোচনা থেকে শিল্পী হিসেবে আলোচনায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সময়কে বোঝাতে চেয়েছি। যদিও এই আলোচনা এখনো চলমান) শামীম শিকদার নিয়ে আলোচনাকে অনেকখানি সহজ ভিত্তি দিয়েছে শামীমের পক্ষে। তাই শামীমের নারীত্বের ব্যক্তিগত পরিধি ছাড়িয়ে তার শিল্পী পরিচয় নিয়ে নানা বির্তক তৈরি হয়েছে। এই বির্তকে অন্তত দুটি পক্ষকে চিহ্নিত করার সুযোগ হয়েছে মোটাদাগে। একপক্ষ, যারা শামীমের মৃত্যুর পর শিল্পী শামীমকে নিয়ে লিখছেন বা কথা বলছেন। আরেক পক্ষ—যারা শামীমকে চেনেন; কিন্তু দলিলযোগ্য কোনো কথা বলছেন না। তারা প্রশ্ন তুলছেন শামীমের শিল্পী সত্তা নিয়ে। যদিও তারা একই সঙ্গে এটাও স্বীকার করেন যে, কারা শিল্পী, আর কী শিল্প, তা বলা কঠিন। ফলে প্রশ্ন তৈরি হয়, শিল্পী হিসেবে যারা শামীম শিকদারকে স্বীকার করছেন এবং যারা করছেন না—উভয় দলই বোধহয় ভুলতে পারেন না যে শামীম শিকদার সিরাজ শিকদারের বোন বা (এবং সেই সূত্রে) তার পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়টি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, শামীম শিকদারের শিল্পপরিচয় বাংলাদেশের ক্ষমতা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এবং দৃশ্যশিল্প চর্চার ক্ষেত্রে এ কথা বোধ হয় বলার সুযোগ রয়েছে যে, রাষ্ট্রক্ষমতার মূল ধারার সাথে বাংলাদেশের দৃশ্যশিল্পীদের উত্থান-পতনের রাজনীতি জড়িয়ে থাকে।

তাই শামীমকে দেখার জন্য অন্তত তিনটি প্রশ্ন দর্শক বা শিল্পরসিক বিবেচনায় রাখতে পারেন:

১. শামীমের পরিবেশ ও রাজনৈতিক সত্তা সরিয়ে রেখে তার শিল্পভাষা কতটা মৌলিক?
২. বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে শামীমের অবদান কী?
৩. শামীমের শিল্প কতটা রাজনৈতিক? আরও বেশি কেউ এগিয়ে গেলে দেখতে পারেন বা খুঁজতে পারেন তার কাজে রাজনৈতিক প্রকরণ।

শামীমের পারিবারিক রাজনীতি সূত্রটি এমন একটি অবস্থান দখল করে আছে যে, তিনি যেখানেই দাঁড়াবেন, একটি নির্দিষ্ট প্রজন্ম পর্যন্ত তা পূর্বসূরীদের রাজনৈতিক বিভক্তির সূত্র ধরেই একঘেঁয়েভাবে পঠিত হবে। আর এই পাঠ পাঠকের দৃষ্টিকোণের অধিকারের বিচারে চলমান থাকবেই। বরং দেখা যেতে পারে শামীম শিকদারের ভাস্কর্য কতটা মৌলিক এবং ভাস্কর হিসেবে তিনি কতটা গ্রহণযোগ্য?

প্রশ্ন হলো কাদের দ্বারা শিল্পভাষা ও গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপ করা হবে এবং কাদের জন্য তা করা লক্ষ্য? সমস্যা হলো আমরা যারাই তার গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপ করতে বসব, তাদের আছে ঔপনিবেশিক শিক্ষার চোখ, যে চোখেই আবার বিউপনিবেশায়নের ভাষাও আমরা খুঁজি। গত ২৭ মার্চ প্রথম আলোতে একটা লেখা প্রকাশিত হলো, আর তা হলো শিল্পী এস এম সুলতানের ছবি পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি--এদের সাথে ইউরোপে প্রদর্শিত হয়েছিল কিনা, সেই তথ্য উপাত্ত নিয়ে। তথ্য হিসেবে সাধারণ; কিন্তু এর মনস্তাত্ত্বিক চাপ অসাপধারণ। সুলতানের ছবির একটা বাজার তৈরি হলেও সুলতানের ছবি এ দেশের শিল্পরসিকদের সম্মান আদায় করতে পারেনি। আর যেসব গুটিকয়েক ছবি পোস্টারে/বাজারে/বিনির্মাণে ব্যাপকতা পেয়েছে, সেগুলোর শিল্পভাষার মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার কার্যকারণ আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে। বাজারের মূল্য হিসাবের জন্য এইসব তথ্য খুব বড় অনুষঙ্গ। তাই ঔৎসুক্য থাকবেই-- এইসব অনুষঙ্গ বা বাজার প্রশ্ন বা বাজারের প্রাণভ্রমরা-- শিল্পের রাজনীতি, এইসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে শিল্পের নিজস্ব মূল্য কতখানি?

ছোট এই গণ্ডিতে এত ব্যাপক আলোচনার সুযোগ নেই। তাই সহজ বক্তব্য হিসেবে স্বীকার করতে হবে-- শামীম আরা শিকদার বাংলাদেশের একজন ভাস্কর, যেহেতু তিনি প্রচুর ভাস্কর্যের জন্ম দিয়েছেন। তার ভাস্কর্যকে মাধ্যমের সূত্র ধরে তিনটি ধাপে আলাদা করা যায়: সিমেন্ট, স্টিল এবং কাঠ পর্ব। শৈলী বিবেচনায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে স্থাপিত বদ্ধ ফর্মের বৃহদায়তনিক ভাস্কর্য, রেখা প্রধান ভাস্কর্য এবং নানান রেডিমেড অবজেক্টের সম্মিলনে নির্মিত ভাস্কর্য-এই তিনটি ধাপে (তার সব কাজ দেখা সুনিশ্চিত হলে এই পর্ব বিবেচনা পরিবর্তন দাবি করতে পারে) অন্তত দেখার সুযোগ আছে। আমার লেখার শব্দচয়নই বলে দিচ্ছে, আমার বিবেচনাভঙ্গিটি কী! শামীমের কাজে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা তর্কসাপেক্ষে পশ্চিমা শিল্পভাষার দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজকে পাঠ করার সুযোগ করে দেয়।
 
      

শামীম শিকদারের করা ভাস্কর্যসমূহ


ওপরের কাজগুলো শামীমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও রুচির প্রতি পক্ষপাতের প্রমাণ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৭৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তার আগে শামীম ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ফরাসি ভাস্কর মি. সিভিস্কির অধীনে ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে ভাস্কর্য নিয়ে তিন বছর পড়াশোনা করেন। পরে ১৯৭৬ সালে তিনি লন্ডনের স্যার জন স্কুল অব ক্যাস থেকে সনদ অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি চীনের বিখ্যাত ভাস্কর লি ডুলির সঙ্গে প্রায় এক বছর কাজ করেন। আর এসব তথ্য বলছে, শামীম ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতির উত্তরাধিকার। তা চৈনিক বা ফরাসি বা ঢাকা চারুকলা, যেখানেই তিনি শিক্ষা নিয়ে থাকেন না কেন। কারণ, তিনি যেসব প্রতিষ্ঠানে পা রেখেছেন, সকল প্রতিষ্ঠানই ইউরোপীয় শিল্পশিক্ষার মডেলকেই মূলত গ্রহণ করেছে। সেই সূত্রে শামীম ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং তৎকালীন ইউরোপের শিল্পআন্দোলনগুলোর অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। 
  

চীনের বিখ্যাত ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়ানো শামীম শিকদার এবং তার নিজের করা ভাস্কর্য


তার কাঠের কাজে যেমন কুড়িয়ে পাওয়া বা খুঁজে পাওয়া কাঠের টুকরোতে সাদৃশ্যমূলক রূপ নির্মাণের প্রবণতা দেখা যায়, তেমনি স্টিলের কাজে নানা রেডিমেড বস্তুর সম্মিলন ঘটিয়ে তৃতীয় আরেকটি বস্তু তৈরির প্রবণতাও প্রবল। এবং যখন যে মাধ্যমে হাত দিয়েছেন, সে মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে এক-দুটি কাজ করে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত নিরীক্ষা করার প্রবণতাও দৃশ্যমান। তার কাজের বৈশিষ্ট্য বিচারে দেখা যায়, বাংলাদেশের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে করা কাজগুলোতে সূক্ষ্ম কারুকাজ বা একাডেমিক দক্ষতা প্রমাণের চেষ্টার চেয়ে আয়তনিক বিরাট অস্তিত্বের জানান দেওয়ার প্রবণতা গাঢ়। উত্থিত হতে চাওয়া ফর্মগুলো শামীমের কাজে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে স্তূপীকৃত বিরাট বেদীতে। এই সকল ভাস্কর্যের বেদীই প্রাণ। বেদী থেকে উত্থিত হয়ে বেদীর মধ্যেই প্রবিষ্ট বা লীন হওয়ার জন্য যেন রূপগুলো মরিয়া। আবার বিপরীতে তার রেখা-প্রধান ভাস্কর্যও রয়েছে। সেগুলো ক্রীটের ভাস্কর্যের কথা যেমন মনে করিয়ে দেবে, তেমনি ভাস্কর নভেরার কথাও মনে করিয়ে দেয়। তার কিছু ফর্ম লোক ইমেজের কথাও দর্শককে মনে করিয়ে দিতে বাধ্য। তিনি সকল ধরনের কাজকেই ভাস্কর্য বা ত্রিমাত্রিক ধারণার মধ্যে সীমায়িত করতে চেয়েছেন, বা অন্যভাবে বলা যায়, ত্রিমাত্রিক কাজের বাইরে তিনি নিজেকে দেখতে চাননি। সে কারণে রঙীন টাইলসে করা কাজকেও তিনি এক ধরনের ভাস্কর্য হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন।  
 

শামীমের ভাস্কর্যে রেখার নাচন

 

শামীমের করা ভাস্কর্য এবং জয়নুল আবেদিনের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা মাটির পুতুল

 

শামীমের ‘চিত্রিত টাইলসের ভাস্কর্য’

 

শামীমের করা দেয়াল ভাস্কর্য

 

জৈবিক ফর্মের চরিত্রানুযায়ী নির্মিত ভাস্কর্য এবং স্টিলের তৈরি নানা বস্তুর সমাবেশে নির্মিত ভাস্কর্য


কিন্তু এসব কিছুর পরও প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশের শিল্পভাষায় শামীম শিকাদারের অবদান কী? শিল্পভাষার প্রশ্নে মৌলিকত্বের খোঁজ আধুনিক পর্বে আমাদের মতো যে কোনো রাজনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল দেশে খুঁজতে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বরং এ দেশের আধুনিক নাগরিক নন্দননির্ভর শিল্পচর্চার বড় গৌরব বা আন্দোলনের মোটিফ হলো--চর্চাটাই চালিয়ে যাওয়া। এবং ভাস্কর্য নিঃসন্দেহে তার মধ্যে সবচেয়ে দুঃসাহসিক মাধ্যম, যে বক্তব্য বা সংগ্রাম বর্তমান সময়ের জন্যও প্রযোজ্য। শামীম বাংলাদেশের রোমান্টিক উপন্যাসে রূপায়িত নারী-বিরোধী এক চরিত্র, যিনি জীবন চর্চায় সে নান্দনিকতা ভেঙে দিয়েছেন এবং তার শিল্পেও কথিত অভিজাত প্রাচ্যের নান্দনিকতা এবং নাগরিক আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা-- কোনোটাই লক্ষ্য করা যায় না। আর এ কারণে তার ভাস্কর্য লোকজ চিত্রের ফর্মের মতো ভঙ্গুর, অপটু মনে হয়। অথচ তিনি ‘লোকশিল্পী’ও নন। তিনি নিজে বলছেন:

He/She must transform the appearance in the process of engraving sculpture. If the portrait is properly delineated and if there is no discrepancy between the portrait and the model other than the power of heavenly animation, the sculpture cannot but be extolled by the viewers.

শামীমের বক্তব্যের সাথে তার আর্ট কতটা ‘হেভেনলি এনিমেটেড’ হয়েছে, সে প্রশ্ন যে কেউ তুলতেই পারেন। কারণ, প্রত্যেকের ‘হেভেন’ বড় আন্তরিকভাবে এবং রূঢ়ভাবে ব্যক্তিগত। আবার তিনি মাধ্যমের ভিন্নতার পরও তার ফর্মের মধ্যে কীভাবে ঐক্য স্থাপিত হয়, কেন তিনি মেটাল বা স্টিলের শরণ নেন, সে সম্পর্কেও অবহিত করেন পাঠক ও দর্শকদের:

Working in different contrivances, whether glass fibre, cement, wood or metal, I always took care of injecting animation in my works, of vegetal, animal or human kind. Caricature of puppetry or robotics, however, or masks for that matter, had no appeal for me.

In metal, on the other hand, I have found futuristic inspiration in biotic and symbiotic construction that bears the hallmark of my spiritual quest. I believe through them, I am building a bridge with the 21st century for myself and my countrymen. I welcome the process of globalisation but would not like to be swept off my feelings by that process. Be it metal, be it wood, be it cement, I would like to impart bionic spirit in their sculptural metamorphosis in my hands and feel myself one with their pulse like I feel that of my own children.


তবে শামীমের ক্রমাগত রূপকে মূর্ত করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং করে যাওয়াকে অস্বীকারের সুযোগ নেই, যা বাংলাদেশে ভাস্কর্যকে দৃশ্যমান করতে থাকার প্রক্রিয়াকে সচল রেখেছে। নভেরা পাকিস্তান পর্বে এ দেশের মাটিতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য গড়ছেন। আর শামীম সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন, এরপরও যা অব্যাহত ছিল। যেখানে বৌদ্ধিক প্রকরণের চেয়ে, সূক্ষ্মতার চেয়ে, অস্তিত্বের বহমানতাই ঘোষিত হয়েছে। 
 

শামীম শিকদারের লেখা বই  (প্রচ্ছদ পরিকল্পনা এবং বইয়ের নকশা লেখকের নিজের)


তার ‘স্কাল্পচার কামিং ফ্রম হেভেন’ বইটির উপস্থাপনা তার শিল্পের নন্দনতত্ত্ব বুঝতে সহায়তা করে। মৌলিক রঙের প্রাধান্যে যেভাবে তিনি বইটির গ্রাফিক্যাল নকশা করেছেন, তা তার ভাস্কর্য পরিকল্পনার পরিপূরক বলে মনে হতে থাকে। মধ্যবিত্ত ভদ্র রুচির বিরোধিতা করে এই সকল সৃষ্টি। তার সৃষ্টিকে চৌকস ইউরোপীয় দক্ষ কাজের অপভ্রংশ বলে মনে হতে থাকে। এই সৃষ্টি সচেতনভাবে ইউরোপীয় আলোকায়ন তত্ত্বের বিরোধিতা করে না। বরং রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টীয় আগমনে যে প্রাথমিক শবাধার কেন্দ্রিক শিল্পকলা লুকিয়ে বাড়তে থাকে, পূর্বতনদের থেকে ঋণী সেই খ্রিষ্টীয় শিল্পের মতোই শামীমের কাজ স্লোগানে বিপরীত, অথচ রূপে ভঙ্গুর বলে মনে হতে থাকে। এই ভঙ্গুরতা যেমন তার শিল্পের রূপে, তেমনি তার রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও সত্য। যা এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। তাই শামীমের শিল্প কতটা রাজনৈতিক, তা এই প্রশ্নের অবতারণা, অথচ এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই মূর্ত।