শার্ল বোদলেয়ারের

গরিবের চোখ প্রসঙ্গে

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩, ২০২১, ০২:০৮ পিএম

উনিশ শতকের ফরাশি কবিদের সেরা বিবেচিত শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) আমাদের দেশের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমসাময়িক। ১৮৪০ সালের পর তাঁহার প্রতিভার স্ফূর্তি ঘটে। কিন্তু তিনি জীবিতাবস্থায় একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ (লে ফ্লুর দো মাল/ Les Fleurs du mal) প্রকাশ করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন ১৮৫৭ সালে। প্রকাশের কয়েক সপ্তাহ না যাইতেই গ্রন্থটির বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয় । আর অনতিবিলম্বে গ্রন্থের গোটা ছয়টি কবিতা নিষিদ্ধ করা হয়।

চার বছর পর "পারির ছবি" নামা নতুন একটি বিভাগ সহ বর্ধিত আকারে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয় । ঐ সময়ে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশক হইতেই বোদলেয়ার সরল গদ্যে কিছু কিছু নতুন ধরণের কবিতাও রচনা করিতে শুরু করেন।

তাঁহার পরিকল্পনা ছিল গোটা একশ কবিতা লইয়া নতুন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করিবেন। মাত্র পঞ্চাশটির মতন কবিতা রচনার পর তিনি পরলোক গমন করিলে পর দুই বছরের মাথায়, ১৮৬৯ সালে, পঞ্চাশটি কবিতা (ও ভূমিকা বলিয়া চালান যায় এমন একটি চিঠি) লইয়া কবির বন্ধুরা যে নতুন বইটি প্রকাশ করিলেন তাঁহার নাম "লো স্প্লিন দো পারি" (Le Spleen de Paris)।  

বাংলা গদ্যে ইহার নাম আমি প্রস্তাব করিয়াছি "পারির পিত্তি"। বইটির বিকল্প নাম "প্যেতি পোয়েম অঁ প্রোজ" (Petits Poèmes en prose)। ইহার সরলানুবাদ হইতে পারে: গদ্যে রচিত ক্ষুদ্র কবিতা।

এক্ষণে অনূদিত "গরিবের চোখ" পারির পিত্তি কাব্যগ্রন্থের ২৬ নম্বর কবিতা । যতদূর জানিতে পারিলাম, এই কবিতাটি দুই বার, যথাক্রমে ১৮৬২ ও ১৮৬৪ সালে, পত্রিকান্তরে ছাপা হইয়াছিল । বোদলেয়ার একবার ইহার কোমল গান্ধার নাম রাখিয়াছিলেন "লো কাফে নফ" (Le Café neuf) বা নতুন ক্যাফে । শেষ পর্যন্ত "লেজিয়ু দে পোবর্" (Les yeux des pauvres) বা "গরিবের চোখ" নামটাই কবির পছন্দ হইয়াছিল।

এই কবিতায় (এবং আরো কয়েকটিতে) ফরাশি দেশের নব বিকশিত ধনতন্ত্রের তীব্র তির্যক নৈতিক বিচার পাওয়া যায়। ১৮৫১ সনের অভ্যুত্থানে লুই নাপোলেয়ঁ ক্ষমতা দখল করেন। তাঁহার রাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারন হাউজমান পারি নগরের রাস্তায় শ্রমিকদের ব্যারিকেড সৃষ্টি করা অসম্ভব করার উপায়স্বরূপ বড় বড় মহাসড়ক নির্মাণ করেন । জার্মান সাহিত্য বিশারদ বাহ্লটার বেনিয়ামিন এই যুগের নাম রাখিয়াছিলেন "হোখ কাপিটালিজমুস" (Hoch Kapitalismus) বা সহি বড় ধনতন্ত্র। "গরিবের চোখ" সেই যুগের সাক্ষী মাত্র নহে, তাহার বিচারের বাণীও বটে । গত ৩১ আগস্ট ছিল শার্ল বোদলেয়ারের মৃত্যুবার্ষিকী । সেই বার্ষিকীর স্মরণিকাস্বরূপ এই তর্জমা পেশ করিতেছি।

আমরা এখানে কবিতার যে পাঠ অনুসরণ করিয়াছি তাহা সম্পাদনা করিয়াছেন বোদলেয়ার বিশারদ ক্লদ পিশোয়া । তাঁহার সম্পাদিত সংস্করণ নীচে উল্লেখ করিয়া রাখিলাম।

Charles Baudelaire, Oeuvres complètes: I, text établi par Claude Pichois (Paris: Éditions Gallimard, 1975).

 

 

গরিবের চোখ

শার্ল বোদলেয়ার। তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান

 

আহা! আপনি জানিতে চাহিয়াছেন কি কারণে আজ আমি আপনাকে ঘৃণা করি! আমার পক্ষে আপনাকে জিনিশটা ব্যাখ্যা করিয়া বোঝান যত সহজ, আপনার পক্ষে তাহা মাথায় ঢোকান নিঃসন্দেহে তত সহজ নহে। কেননা আমার বিশ্বাস, নারীর মাথায় কিছুই যে ঢোকান সম্ভব নহে আপনি এই দুনিয়ায় সে সত্যের তিলোত্তমা উদাহরণ।

সুদীর্ঘ একটা দিন একসঙ্গে কাটাইলাম আমরা কিন্তু আমার মনে হইল দিনটা বড় দ্রুতই ফুরাইয়া গেল। সত্য সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম আমরা, আমাদের যত চিন্তাভাবনা সবই একে-অপরে জানাইব আর এখন হইতে আমাদের দুই আত্মা হইবে হরিহর একাত্মা।—যাহাই হউক, এই জাতীয় স্বপ্ন আদৌ অপূর্ব পদার্থ নহে—পার্থক্যের মধ্যে, স্বপ্নটা সকলেই দেখে কিন্তু তাহার ফলটা কার্যত কদাচ ফলে।

সে সন্ধ্যায় আপনি হয়রান হইয়া নতুন বড় রাস্তার কোনায় আনকোরা নতুন ক্যাফেটাতে বসিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। এখনও ঐ জায়গাটা ইটপাথরের খোয়াভরা তবে ইতিমধ্যেই আপনার অসমাপ্ত জৌলুশের প্রদর্শন মহাসমারোহে শুরু করিয়া দিয়াছে। ঝিকমিক করিতেছে ক্যাফেটা। অন্দরে ঝলমলে গ্যাসের বাতি দেখিলেই বোঝা যায়, উদ্বোধনের উত্তেজনাটা এখনও শান্ত হয় নাই। পুরাদমে দীপ্যমান বাতির চোখধাঁধান আলোতে শাদা দেয়ালগুলি অধিক ঝিকমিক করিতেছে। আয়নার উচ্চকিত বিস্তারে সোনারঙ দেয়ালের সাজি আর কার্নিশের আলপনা ফলিয়াছে, মুখে লাগাম আঁটা কুকুরে টানা রথে চড়িয়া গালফোলা বয়বেয়ারা ছুটিয়াছে আর মনিবন্ধে শিকারি ঈগল বসাইয়া নারীর দঙ্গল হাসিঠাট্টায় মজিয়াছে; ফলফলারি, মিষ্টির ভাঁড়, আর নিষাদের শিকার পাখির মাংসভরা তস্তরি মাথায় চলিয়াছে জলপরী আর দেবকন্যার দল, কমনীয় হাতে কোমল পানীয়ভরা সুরাহি কি চূড়ামণ্ডিত দোরঙা মালাই-কুলফির মিনার আগাইয়া দিতেছে এব আর গনুমেদগণ। এককথায়, এই দুনিয়ার যত ইতিহাস আর পুরান সমস্তই এই রাক্ষসভোজের পায়ে লুটাইতেছে।

আমরা আসন পাতিয়াছিলাম যে জায়গাটায় তাহার ঠিক সামনে—রাস্তার উপর—একটা লোক ঠায় দাঁড়াইয়া। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মুখে ক্লান্তির ছাপ, দাঁড়িতে পাক ধরিয়াছে। এক হাতে এক ছেলে, আর হাতে কোলে লইয়াছে ছোট্ট একটা প্রাণী। উনপাঁজুরে ছোটনটির হাঁটিবার তাকত হয় নাই এখনও। কাজের বুয়া যাহা করিয়া থাকে লোকটা আজ সে কাজই করিতেছে—বাচ্চাকাচ্চা লইয়া সন্ধ্যাবেলা একটু হাওয়া খাইতে বাহির হইয়াছে। সবার কাপড়চোপড় টুটাফাটা। তিন মুখেরই হাবভাব সাংঘাতিক ভারিক্কি। ছয়টি চোখের দৃষ্টি আনকোরা নতুন ক্যাফের দিকে অনড় স্থির তাক করা। সকলের চোখই সমান—আর বয়সভেদে আলাদা আলাদা—বিস্ময়ে ভরপুর।

বাবার চোখ কহিতেছে, ‘আহা! কেয়া বাত! কেয়া বাত! এই গরিব দুনিয়ার যত সোনাদানা সবই দেখি এখানে এই দেয়ালের গায়ে ঢালা।’—ছোট্ট বালকটির চোখ: ‘কেয়া বাত! কেয়া বাত! এখানে ঢুকিতে পারেন কেবল যাহারা আমাদের নাহান নহেন!’ এক্কেবারে পুচকে ছোড়াটির কথা কি আর কহিব, উহার চোখে বেকুব আর অতল একটা শিহরণ ছাড়া আর কিছুই নাই—এতই তাজ্জব সে।

গানওয়ালা গাহিয়া থাকেন, প্রাণের আনন্দ মনে দয়ার আর হৃদপিণ্ডে করুণার সঞ্চার করে। কথাটা সেদিন সন্ধ্যায়—অন্তত আমার ক্ষেত্রে—সত্য প্রমাণিত হইয়াছিল। এই চোখ পরিবারটি দেখিয়া আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। শুদ্ধ তাহাই নহে—সামনে সাজান কাঁচের পাত্র আর মদিরাদানের সারি দেখিয়া কিঞ্চিৎ লজ্জাও পাইয়াছিলাম। ক্ষুধাতৃষ্ণা আমাদের যাহা পাইয়াছিল তাহার মাপে এইগুলি ছিল অতি অতিকায়। আমার দৃষ্টিটা আপনার দৃষ্টি বরাবর ঘুরাইলাম। আশা করিয়াছিলাম আমি সেখানে, প্রিয়তমা আমার, আমার ভাবনাটাই দেখিতে পাইব। বড়ই সুন্দর আর বড়ই আশ্চর্য কোমল আপনার চোখ দুইটি; আপনার সবুজ নয়নে হুজুগদেবীর বাস আর তাহার ভাবাদর্শ চাঁদ হইতে পাওয়া। আপনার ঐ নয়নযুগে আমার নয়ন দুইটি যেই ডুবাইতে গেলাম আপনি বলিয়া উঠিলেন, ‘গাড়িবারান্দা প্রমাণ হাচোখা যত্তসব লোকজন! এগুলা দুই চোখের বিষ আমার! ম্যানেজারটাকে একটু ডাকিয়া বলিতে পারেন না, সরাইয়া দিক লোকগুলি!’

তিলোত্তমা আমার, একের অপরকে বুঝিতে পারা কি কঠিন! আর মানুষে মানুষে—মায় একজন আরজনের প্রেমে মশগুল যাহারা তাহাদেরও—চিন্তার আমদানি-রপ্তানি কি অসম্ভব!

১৮৬২/১৮৬৪