ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বহু বাঙালি কৃষি পেশায় যুক্ত। কৃষক যুগ যুগ ধরে কঠোর পরিশ্রম করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। কিন্তু কৃষক সমাজ অবহেলিত। নানা সময়ে জমিদার ও সরকার দ্বারা শোষিত ও নির্যাতিত। বাংলার কৃষক সমাজ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে বইটি পাঠকের মনের খোরাক জোগাবে। তখনকার সমাজে কৃষকদের বিষয়ে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকে চিন্তাভাবনা ও লেখালেখি করেন। তবে রমেশচন্দ্র দত্তের ‘বাংলার কৃষক’ বইটি সময়ের সাহসী চিন্তার প্রতিফলিত হয়েছে।
ভারতবর্ষের কৃষক সমাজের জীবনচিত্র ও সমাজতাত্ত্বিক চিন্তা ফুটে উঠেছে এ গ্রন্থে। মুঘল আমলে কৃষকের নানান অধিকার প্রসঙ্গে আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আলোচনা দেখা যায়। মুঘল রাজস্ব কাঠামোর কেন্দ্র ছিল বাংলার কৃষিজীবী রায়তরা। রাজা ও কৃষকের মধ্যে দেশে প্রকৃত উৎপাদিত ফসলের বণ্টনই মূলনীতির ভিত্তিতে মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। (পৃ. ১)
মুঘল আমলেও কৃষকের নিজের অধিকার ও ন্যায্য বিষয়ে সুস্পষ্ট ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়নি। জমিদার ও প্রজাসাধারণ তথা ভারতের কৃষক সমাজের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনেও নানান অনিয়ম ফুটে উঠেছে। ইতিহাসের পরিক্রমায় দশসালা বন্দোবস্ত, পাট্টা ব্যবস্থা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল।
কিন্তু কৃষকের জীবনে জোর, জুলুম ও অন্যায় চলতে থাকে। এই সময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ ও চুয়ার বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব বিদ্রোহের কারণ ছিল কৃষিজাত পণ্য ও কৃষকদের নিয়ে। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া নীতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ছিল। কৃষিজাত (সামন্তবিরোধী ও রাজনৈতিক (উপনিবেশবিরোধী) এই দু’ উপাদান একত্রিত হয়ে গ্রামীণ সমাজে বিশাল সমস্যার উদ্ভব ঘটে। ফলে পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ বিদ্রোহে সামন্তবিরোধী ও উপনিবেশবিরোধী তেজ ছিল। (পৃ. ১০)
বইটিতে নরহরি কবিরাজের সুদীর্ঘ ভূমিকা যুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া আর সি দত্তের একটি লেখকের মুখবন্ধ রয়েছে। বইটির বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত—অনুবাদকদ্বয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। যা বইটির বিষয়ে ও লেখক সম্পর্কে নানান অজানা বিষয় সমাদৃত হয়েছে। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে গ্রামীণ জনসংখ্যা ও কৃষক সমাজ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ‘নারী ও শিশুসহ মোট তিন কোটি সত্তর লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে আমরা মোট দুই কোটি জনসংখ্যাকে কৃষক শ্রেণী হিসেবে গণ্য করতে পারি। কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা প্রকৃত কৃষক নয় এবং তাদের সংখ্যা মোটামুটি পঞ্চাশ লক্ষ ধরা যায়।’ (পৃ. ৫১) দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের শাসনামলে বাংলার রায়ত সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনে বাংলার রায়ত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে, যা গবেষক ও লেখকদের জন্য কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত বাংলার কৃষক। কৃষকের প্রধান সম্পত্তি ও তাঁর সমস্ত আশা আকাঙ্ক্ষার মূলে এক খণ্ড চাষের জমি।এ জমিটা তাঁর প্রাণের মতো প্রিয়। বিলাসবহুল জীবনের কল্পনা নেই। (পৃ. ৭৯)
পঞ্চম অধ্যায়ে ন্যায় শাসন নিয়ে ধারণা রয়েছে। ‘প্রাচ্যদেশের মনে সর্বদা ক্ষমতার সাথে নির্যাতনের কথা চলে আসে, ক্ষমতা অপব্যবহারের শত শত বছরের বিবরণ থেকেও এসবেরই সমর্থন পাওয়া যায় এবং একটা বদ্ধমূল ধারণা লাভ করে। মনের এই দাস্য অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা একটা বিরাট কাজ।’ (পৃ. ১১০) সেকালের সমাজব্যবস্থায় গ্রামীণ শিল্প নিয়ে ষষ্ঠ অধ্যায়ে সুন্দর আলাপ রয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে রাজস্ব ও কর আদায় করত তখকার জমিদার শ্রেণি। গৃহকর নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্কের আলোকপাত রয়েছে সপ্তম অধ্যায়ে।
‘বাংলার কৃষক’ বইটির লেখক হলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। তিনি একজন বাঙালি চিন্তাবিদ ও সাহসী লেখক। ১৮৭৪ সালে কলকাতা থেকে ‘দি পিজেন্ট্রি অব বেঙ্গল’ নামে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশের ১০৬ বছর পরে ১৯৮০ সালে কলকাতা থেকে আরেক নতুন সংস্করণ প্রকাশ পায়। নতুন সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন নরহরি কবিরাজ। নতুন সংস্করণে সম্পাদক নরহরি কবিরাজ ৫৩ পৃষ্ঠার এক সুদীর্ঘ ভূমিকা যুক্ত করেন।বহুমুখী চিন্তাবিদ রমেশচন্দ্র দত্ত সম্পর্কেও জানা যায় এ গ্রন্থে। লেখক ২৬ বছর বয়সে এ বইটি প্রকাশ করেন। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। অধ্যাপক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে ভুমিকা দেখা যায়। এসবের মধ্যে নিজেকে একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। যা এ সমাজের জন্য বিরল দৃষ্টান্ত। বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৮ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। এ বইটি অনুবাদ করেন সাদাত উল্লাহ খান ও কাজী ফারহানা আকতার লিসা। ‘বাংলার কৃষক’ বইটি গবেষক, লেখক ও পাঠকের কাছে প্রয়োজনীয়তা ও গভীরতা অপরিসীম।
বাংলার কৃষক, রমেশচন্দ্র দত্ত, অনুবাদক: কাজী ফারহানা আক্তার লিসা ও সাদাত উল্লাহ খান, প্রচ্ছদ : আনওয়ার ফারুক, বাংলা একাডেমি, জুন ২০০৮, ঢাকা, মূল্য : ১৫০ টাকা, পৃ. ১৬৮।