চিত্রকলা

ক্যাসপার ডেভিড ফ্রিয়েডরিখ: অসীমের সীমানা

আসমা সুলতানা প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২২, ০৩:০৫ পিএম
উপরে শিল্পী ক্যাসপার ডেভিড ফ্রিয়েডরিখের আত্ম-প্রতিকৃতি, ১৮০০

শিল্পকলা যে বিষয়গুলো আমাদের শেখাতে পারে, তাদের মধ্যে, অপ্রত্যাশিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণটি হলো;  ‘কিভাবে দুঃখ সহ্য করতে হয়’। শিল্পকলা আমাদের মনে জাগিয়ে ‍তুলতে পারে, অন্ধকার, বিষণ্ণ, কষ্টকর, সংশয় আর বিচ্ছিন্নতায় ভরপুর দৃশ্যগুলোকে। এবং যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি, সেটিকে স্বাভাবিকীকরণ ও মর্যাদা দান করে। মাহাত্ম্য আর কারিগরি দক্ষতায় তারা উন্মোচন করে, দুঃখ মানবিক এই পরিস্থিতির আবশ্যিক একটি অংশ। মহিমান্বিত দুঃখের একজন চিত্রকর, ক্যাসপার ডেভিড ফ্রিয়েডরিখ। ১৭৭৪ সালে বাল্টিক সাগরের তীরে উত্তর জার্মানির একটি প্রাচীন বাণিজ্যিক শহর, গ্রাইফসভাল্ডে তাঁর জন্ম। উত্তর জার্মানির কঠোরতার মানদণ্ডে খুবই সুন্দর একটি শহর।

ওয়ান্ডারার অ্যাবাভ দ্য সি অব ফগ , ১৮১৮

শৈশব থেকেই তিনি গ্রীষ্মের ভোরে গাছের প্রাচীরের ওপরে কুয়াশার অস্পষ্টতায় গির্জা, টাওয়ার, পাহাড়ের চূড়াগুলো যেভাবে আবির্ভূত হতো, সেই দৃশ্যপটকে দেখতে ভালোবাসতেন। ফ্রিয়েডরিখের বাবা খুব স্বল্পবাক, বিষণ্ণ মেজাজের, দক্ষ কারিগর ছিলেন, আর মাকে হারান শৈশবেই। এরপরে, মাত্র তেরো বছর বয়সে চোখের সামনে ছোট ভাইকে, বরফ জমা একটি হ্রদের পানিতে ফাটল দিয়ে পড়ে, ডুবে মারা যেতে দেখেছিলেন। বিশ বছর পূর্ণ হবার আগেই তিনি মা এবং দুই বোন ও এক ভাইকে হারিয়েছিলেন। সেই সময় থেকে বিষণ্ন একটি চরিত্র হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। তাঁর চরিত্রের সেই গাম্ভীর্য, ক্যানভাসেও জায়গা করে নিয়েছিল। মিতবাক, আবেগপ্রবণ আর লাজুক হয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। শিল্পী হিসেবে খুব অল্প বয়স থেকেই প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যসূচক শৈলীটি ক্যানভাসে আবির্ভূত হতে বহু বছরের দারিদ্র্য, দুর্ভোগ আর সংগ্রামের দরকার পড়েছিল।


মিডোস নেয়ার গ্রাইফসভাল্ড, ১৮২২ 

 

১৭৯০ সালে তিনি, গ্রাইফসভাল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলায় প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন, পরর্বতীকালে সুপরিচিত কোপেনহেগেন একাডেমিতে বিখ্যাত ডাচ প্রতিকৃতি শিল্পী জেনস জুয়েলের অধীনে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ড্রেসডেন বহুবার এসেছিলেন ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা খুঁজতে। সেই যুগের রুচিতে সূর্যকরোজ্জ্বল, ধ্রুপদি ভূদৃশ্যচিত্রের চাহিদা ছিল বেশ। গ্রীষ্মের ইতালি যেমন আদর্শ ছিল। কিন্তু ফ্রিয়েডরিখ প্রকৃতির সেই দিকগুলোর দিকে আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন, সেই মুহূর্ত অবধি, যা মানুষ ভেবে এসেছে তাদের সংবেদনশীলতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর আদৌ কৌতূহলোদ্দীপক কোনো কিছু নয়: শীতল, আর্দ্র সকাল, সাগরতীরে হিমাবাহ-শীতল রাত, সূর্য ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তের ম্লান প্রহর, শেষ বসন্তে প্লাবিত মাঠ।


ক্রস ইন দ্য মাউন্টেইন, ১৮০৮

শিল্পী হিসেবে পূর্ণতাপ্রাপ্ত  ফ্রিয়েডরিখের প্রথম চিত্রকলা—সত্যিকারভাবেই প্রথম বড় সৃষ্টি, যেখানে তিনি জীবনের প্রতি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে শুরু করেছিলেন, সমসাময়িক দর্শকদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। প্রথাগত দেবদূত, ক্রন্দনরত সাধু আর সৈন্যদের বদলে তিনি যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার দৃশ্য এঁকেছিলেন টিউটোনিক ফারগাছের মধ্যে রুক্ষ একটি পাথুরে পাহাড়ের ওপর। যখন পেছনের সূর্যের আলো মেঘের ওপর আঘাত করছে। পাহাড়ের ওপর যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার দৃশ্যে, তিনটি আলোর রশ্মি গম্ভীর মেজাজি আকাশের দিকে বিস্তৃত, যেন, প্রকৃতি যিশুর চেয়ে ফ্রেমের মধ্যে আসলে জায়গা দখল করে আছে সেটি নিজেই ‘স্বর্গীয়’। তিনি চিত্রটি এঁকেছিলেন সুইডেনের রাজা চতুর্থ গুস্তাভ অ্যাডোলফের প্রতি নিবেদন হিসাবে (যে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় যখন সম্রাট  ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন)। অবশেষে টেটশেন দুর্গে (বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) এর জায়গা হয়, টেটশেন অল্টার নামে এটি সুপরিচিত।


দ্য সি অব আইস, ১৮২৪

 

শিল্পী অনুধাবন করেছিলেন, প্রকৃতি বহুভাবে তার গম্ভীর মেজাজকে প্রকাশ করতে পারে, যা এর আগে খ্রিষ্টীয় কাহিনিগুলোর আক্ষরিকভাবে চিত্রকর্মে উপস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। সময়ের সঙ্গে, তিনি সরাসরি যিশুর প্রতি তথ্যনির্দেশটি বাতিল করে দিয়েছিলেন এই চিত্রকলায়, কিন্তু ট্রাজেডির সেই পরিবেশ এবং তাঁর জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে সংযুক্ত দুঃখটি রেখে দিয়েছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, দীর্ঘ গাছ, পাহাড়, কুয়াশা, খাঁজকাটা শৈলশ্রেণি, চন্দ্রোদয়, রাতে পানির স্থিরতা, উন্মুক্ত গুল্মাবৃত সমতল পতিত জমি, কষ্ট, ভালোবাসা, যন্ত্রণা আর পরিত্রাণসংক্রান্ত বার্তাগুলোর অনুরূপ বহু বার্তা ধারণ করতে পারে, যা খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিকরা একসময় শুধু গসপেলেই খুঁজে পেতেন। তিনি এখনো সেই মানুষগুলোর জন্য অনন্যভাবে উপযোগী একজন শিল্পী হিসেবে রয়ে গেছেন, যারা আর বিশ্বাস করেন না ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গভীর আবেগগুলোর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন।


উইম্যান অ্যাট আ উইন্ডো, ১৮২২

 

১৮১০ সালে তিনি বার্লিন একাডেমির মেম্বার হন, ড্রেসডেন একাডেমিতেও তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়। স্পষ্টতই সেই মুহূর্তে তিনি জার্মান শিল্পকলার জগতে নিজের জায়গাটি নিরাপদ করেছিলেন। তবে তাঁর সুখ্যাতি ক্রমশ কমতে শুরু করে, যখন রিয়ালিজম রোমান্টসিজমকে অতিক্রমণ করেছিল। স্ত্রী ক্যারোলাইন তাঁর বহু চিত্রকর্মে আবির্ভূত হয়েছেন, কিন্তু সব সময়ই একাকী। একাকী নারী বা পুরুষের চিত্র আঁকার একটি প্রবণতা ছিল তাঁর; যেন তিনি বিশ্বাস করতেন আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই কেবলই সচেতনতার উপরিপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়, যখন আমরা সভ্যতার কোলাহল থেকে দূরে নির্জনে একাকী এসে দাঁড়াই। তাঁর নিজেরও খুব অল্প কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এবং একটি পর্যায়ে প্রায় কখনোই তিনি স্টুডিওর বাইরে আসেননি।

 

নিঃসঙ্গতা এমন কিছু, যাকে এড়াতে হবে (কাজ, মদ্যপান, যৌন কল্পনার দ্বারা), বদলে, তিনি প্রস্তাবনা করেছিলেন এটি আমাদের গভীরতম সম্ভাবনাগুলোর সংস্পর্শে আসার মতো একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আরও বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির রূঢ়তা, মানবজীবনের দুুঃখকে দেখার একটি সান্ত্বনাদায়ক আর ক্ষতিপূরণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে। মানুষ নিষ্ঠুর হতে পারে, নিয়তি অনুকম্পাহীন হতে পারে, কিন্তু হিমশৈল বা বরফ খণ্ডের অনবক্রম্য সংঘর্ষ নিয়ে গভীর ভাবনা আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে অবমুক্ত করতে পারে, আমাদের নিপীড়ন করছে এমন কোনো বিশেষ পরশ্রীকাতরতা, ক্ষত অথবা হতাশার অতিক্রমন করে, এটি আমাদের ব্যক্তিগত যন্ত্রণাভোগের বোধটিকে হ্রাস করতে পারে।

‘মুনরাইজ ওভার দ্য সি’-এর মতো কাজগুলো মহাবিশ্বে আমাদের গুরুত্বহীনতার প্রতি সচেতন করে তোলে, অনন্তকালের উপায়গুলোর তুলনায় সাধারণ মানুষের বিপর্যয় কতটা তুচ্ছ এমন ধারণায় উজ্জীবিত করে। জীবনের  চাপিয়ে দেওয়া অবোধ্য ট্রাজেডিগুলোর সামনে নতি স্বীকার করতে যা আমাদের প্রস্তুত করে তোলে। এখান থেকে সাধারণ বিরক্ত আর চিন্তাগুলো প্রশমিত হয়। আমাদের ভ্রান্ত গুরুত্বপূর্ণতার ওপর জোর দাবি করে, অপমানগুলোর সংশোধন করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে—কোনো মহান শিল্পকর্মের সহায়তায়, অপরিহার্য শূন্যতাকে বুঝতে আর মূল্যায়ন করার চেষ্টা করতে পারি।

‘রকি রিফ অন দ্য সি শোর’ চিত্রে ফ্রিয়েডরিখ লক্ষণীয় মাত্রার অমসৃণ খাঁজকাটা পাথরের স্তূপের চিত্র, সমুদ্রতীরের খানিকটা অংশ, উজ্জ্বল দিগন্ত, দূরবর্তী মেঘ, ম্লান আকাশ ব্যবহার করেছিলেন পরিত্রাণমূলক একটি দুঃখবোধের মেজাজ সৃষ্টি করতে। কল্পনা করতে পারি, ভোর হবার আগেই এখানে হেঁটে যাচ্ছি, নিদ্রাহীন রাত্রির শেষে একটি বিষণ্ণ অন্তরীপে, মানব সঙ্গ বিবর্জিত, প্রকৃতির মৌলিক কিছু শক্তির সান্নিধ্যে। অপেক্ষাকৃত পাথুরে ছোট দ্বীপগুলো, যা একসময় নাটকীয় আর দূরের ওই বড় পাথুরে দ্বীপের মতো একই রকম ছিল, যা একসময় প্রবল বেগে বের হয়ে এসেছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর। দীর্ঘ সময়ের ধীর পরিক্রমায় একদিন এটিও ক্ষয়ে যাবে। আকাশের প্রথম অংশটিতে কোনো ফর্ম নেই, শূন্য, বিশুদ্ধ রুপালি শূন্যতা, কিন্তু ঠিক এর ওপরেই ভেসে আছে মেঘগুলো, যারা তাদের নিচের তলে আলোকে ধরে আছে এবং তারপর এটি হাতবদল করে তাদের অর্থহীন ক্ষণস্থায়ী পথে চলে যেতে সহায়তা করতে, আমাদের সব চিন্তার প্রতি যা নির্বিকার।

আমাদের সম্পর্কগুলোর প্রতি অথবা আমাদের প্রাত্যহিক কোনো জীবনের চাপ আর সংগ্রামের প্রতি চিত্রকর্মটি সরাসরি কোনো তথ্য নির্দেশ করে না। এটির কাজ হচ্ছে আমাদের মনের সেই অবস্থার সঙ্গে একটি যোগসূত্র করা, যেখানে কাল ও সময়ের বিশালতা, এবং আরও বড় পরিকল্পনার কাঠামোয় আমাদের পরিস্থিতির গুরুত্বহীনতার ব্যাপারে আমরা প্রবলভাবে সচেতন হই। বিষণ্ণতার চেয়ে কাজটি বরং গম্ভীর, প্রশান্ত, কিন্তু হতাশাপূর্ণ নয়। এবং মনের সেই পরিস্থিতিতে - আত্মার সেই অবস্থানে, আরও রোমান্টিকভাবে বললে, যেমনটি হয় তাঁর প্রায় প্রতিটি কাজের সঙ্গে, অনাগত দিনগুলোর তীব্র, দুর্দম, বিশেষ দুঃখগুলো মোকাবেলা করার জন্য আরও বেশি প্রস্তুত হই।


রকি রিফ অন দ্য সিশোর, ১৮২৪

 

আইকনিক এবং তাঁর নামের সমার্থক ওয়ান্ডারার অ্যাবাভ দ্য সি অব ফগ, চিত্রকর্মে গাঢ় সবুজ ওভারকোট, পায়ে বুটসহ একজন ব্যক্তিকে দেখি, মেঘাচ্ছন্ন কুয়াশাময় একটি ভূদৃশ্যের দিকে যিনি তাকিয়ে আছেন। কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তের মধ্যে তিনি একটি ‘রুকেনফিগুর’ (Rückenfigur ) এঁকেছিলেন, অর্থাৎ পেছন থেকে দেখা একটি শরীর। যিনি নিজেকে স্থির করে ধরে আছে একটি ছড়ির সাহায্যে। অন্ধকার পাথুরে চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চরিত্রটি চিত্রকর্মের ঠিক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ জোসেফ কোয়েরনার মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই চিত্রকর্মটির কেন্দ্র অবস্থান করছে এই মানুষটির হৃৎপিণ্ডের ওপর, পুরো মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছে এই হৃদয়’। বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে রোমান্টিক এই চিত্রকর্মটি এনলাইটেন্টমেন্ট যুগের মূল্যবোধগুলোর (যুক্তিবাদ, শৃঙ্খলার) বিরুদ্ধে নন্দনতাত্ত্বিকদের শুরু করা সেই রোমান্টিসিজম আন্দোলনের প্রতিভূ, যে মূলবোধগুলো ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ইউরোপজুড়েই শিল্পীরা আবেগ, কল্পনা আর  মহিমান্বিত বিষয়গুলোর প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন। ফ্রিয়েডরিখের চিত্রকর্মে বন্য, বশ না মানা প্রকৃতি বিষয় হিসেবে জায়গা নিয়েছিল।

বিশেষ করে এই পর্বটি ব্যক্তি ও তাঁর ব্যক্তিক তীব্র আবেগকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল। আর তিনি এই সব গুণই একটি মানুষের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন, যিনি সুবিশাল এবং অজ্ঞেয় একটি এলাকার দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় এঁকেছিলেন, ঠিক ক্যানভাসে কেন্দ্রে। এই কম্পোজিশনটি নির্মাণে, দক্ষিণ-পূর্ব ড্রেসডেনে এলবে স্যান্ডস্টোন পর্বতমালায় বেশ কয়েকবার গিয়েছিলেন, আলাদা করে প্রতিটি পাথর আর প্রাকৃতিক কাঠামো তিনি স্কেচ করেছিলেন, তারপর স্টুডিওতে তিনি এই সবগুলো একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন একটি নতুন কল্পিত ভূদৃশ্যচিত্র। জুলিয়ান হালাডিন তাঁর ২০১৬ সালের প্রবন্ধ “Friedrich’s ‘Wanderer’: Paradox of the Modern Subject, এ লিখেছিলেন, ‘এখানে বিষয়বস্তুই দর্শকের প্রতিভূ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, এই মানব উপস্থিতির দিকে তাকাই, এই দৃশ্যটির সাধারণ মাত্রাটি নির্ধারণ করার লক্ষ্যে, আরও বিশেষ করে এই চিত্রিত জগতের ব্যাপনস্থল স্থিতিমাপে আমাদের শরীরকে সম্পর্কিত করে’।

শিল্পীর উত্তরাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যখন নাৎসিরা ফ্রিয়েডরিখকে তাদের আদর্শিক একজন পূর্বসূরি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। সে কারণে পরবর্তী সময়ে তাঁকে বহু গবেষকের বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দিয়েছিল।  অবশেষে সত্তরের দশকে রবার্ট রোসেনব্লুম ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মগুলো জড়ো করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শিল্পী রথকোর সঙ্গে ফ্রিয়েডরিখকে যুক্ত করেছিলেন, এই দুই শিল্পীর মহাবিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হবার তাড়না অনুসন্ধানের প্রচেষ্টার একটি সূত্রে। তাঁর বইটি মূলত Modern Painting and the Northern Romantic Tradition, Friedrich to Rothko তাকে আলোচনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে ( অবশ্যই নানা সমালোচনাসহ)। এখনো ইতিহাসবিদরা জানেন না এই Rückenfigur এর মডেল কে ছিলেন, তবে মনে করা হয় বন বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্নেল ভন ব্রিনকেন হচ্ছেন এই মডেল, তাঁর পরনের  কাপড় রাজা দ্বিতীয় ফ্রিয়েডরিখ ভিলহেইম স্বেচ্ছাসেবক রেঞ্জার সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেছে, যারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে প্রুশিয়ার পক্ষে লড়েছিলেন। তিনি সম্ভবত ১৮১৩-১৪ সালে মারা যান, আর এ কারণে মনে করা হয় চিত্রকর্মটি দেশপ্রেমের একটি এপিটাফ, যা সূক্ষ্মভাবে ফরাসিদের পরাজয়ে উচ্ছ্বাস আর আরও বড় একটি কাহিনি, প্রুশিয়ার একীভূত হওয়া আর জার্মান জাতীয়তাবাদের কথা বলছে।

অনেক শিল্পীর মতো, তিনিও খুব বেশি সফলতা পাননি। অল্প কিছু অনুরক্ত গম্ভীর মানুষ তাঁর ভক্ত ছিলেন ও তারা কিছু ছবি কিনেছিলেন ( সেই সময়ের দুইজন বিখ্যাত চিত্রকর কারস্টিং এবং ডাল, তাঁর বন্ধু ছিলেন)। ১৮৪০ সালে তিনি মারা যান, প্রায় বিস্মরিত হয়েছিলেন বলা যায়। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, দূর ভবিষ্যতে, তাঁর সৃষ্টিগুলো গভীরভাবে মানুষ ভালোবাসবে,  তাঁর চিত্রকর্ম আমাদের আনন্দ দেয় সে কারণে নয়, বরং সুনির্দিষ্টভাবে এটি জানে সবার মধ্যে থাকা সবেচেয়ে দুঃখের অংশটিকে কিভাবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা আর প্রকাশ করা যায়।