প্রথম পর্ব

শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ: কতোটা মৌলিক সৃজন তারা, কতোটা প্রভাবিত

আকিমুন রহমান প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২২, ০৩:১৪ পিএম

এক.  ‘প্রভাতজীবনে এ নেশায় কে মাতাইয়া দিয়াছিল!’

 

১৯১৭ সালে বাংলা সাহিত্যে এমন দুই কিশোরের আবির্ভাব ঘটে, যারা দুরন্ত; যারা তুলনারহিত দুরন্ত। কখনো কখনো তারা শান্ত রূপেও বিরাজ করে, কিন্তু অচিরেই তারা জানিয়ে দেয়, ওই প্রশান্ত রূপটির মোড়কে কোনো দুর্দমনীয় আর অশঙ্ক দামালপনাকে মুড়ে রেখেছে তারা। যেন তাদের মধ্য দিয়ে তাদের স্রষ্টা—মনুষ্যজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ স্বল্পায়ু যে কৈশোরবেলাটি -তাকেই মনুষ্য-দেহকাঠামো দিয়ে রেখেছেন। তাদের আবির্ভাব কাল থেকেই,বাংলা সাহিত্য, তাদের দিয়ে চমকিত ও বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে ওঠে। সাধারণ পাঠকের মুগ্ধতা তারা যতটা পায়,তারও চেয়ে ঢের বেশি অনুরক্তিমোড়ানো স্তব তারা পায় পণ্ডিতজনের কছে থেকে। তারা গণ্য হতে থাকে আমাদের সাহিত্যের আদি মানবকিশোর বলে। তাদের গড়ে তুলেছেন যেই কারুকার, তিনি স্তুতি পেতে থাকেন অপূর্ব অভিনব চরিত্রসৃজনকারী হিসেবে। 

ওই যে দুই কিশোর, আখ্যানে তারা একই সঙ্গে দেখা দেয় না। তারা পরস্পর পরিচিত হয় নিজেদের এক উটকো বিপত্তির কালে। দুজন তখন একে অন্যের সহায় হয়ে ওঠে, একসঙ্গে তারা উপস্থিত বিপত্তির মোকাবেলাও করে। তবে সেই প্রথম সাক্ষাৎকালেই তাদের মৈত্রী ঘনীভূত হয় না। বরং একজনের প্রকাশ্য ডাকাবুকোপনা ও বেয়ারা চলনবলন দেখে অন্যজনের শরীর ও মন সংকোচ ও কুণ্ঠায় জড়োমড়ো হয়ে যেতে থাকে। তখন ওই দস্যিজনের জন্য অপরজনের চিত্তে যেমন বিমুখতা জাগে, তেমনি আবার ঘন বিস্ময়ও জেগে ওঠে।  কিন্তু দূরত্ব রয়ে যায়। থাকে অনেক দূরত্ব। তাদের মিত্রতা গড়ে ওঠে পরে। ক্রমে কদমে কদমে একসঙ্গে চলতে চলতে।

বাহ্যত তাদের স্বভাবে কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। একজন বিদ্যুৎক্ষিপ্র। দুনিয়াকে সে বোঝেশোনে ভালো, বোঝে তার নিজের বুঝ অনুসারে। এবং সে আপনা থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এই জগৎ-সংসারকে পাত্তা দেবার কোনো কারণ নেই। সে তার কিশোরবেলায়ই এমন মীমাংসায় অনড় হয়ে ওঠে।  তার প্রকাশ্য সকল আচরণেই সে পরোয়াশূন্য। সে গ্রাহ্য করে না কোনো কিছুকেই। চরাচরের অন্য দশজনের চক্ষে নিজেকে সুবোধ প্রতিপন্ন করার কোনো তাগাদা নেই তার। তার অন্তরাত্মা যা করতে চায়, চালু বিধিবিধানগুলো যেভাবে দলে চলতে চায়,সে সেটা করে। করে অকুণ্ঠপ্রাণে। সামাজিক নিন্দা আর অখ্যাতির শঙ্কা কদাপি স্পর্শ করে না তাকে।

সেইজন বিজুলিপাতের মতো ঝিলিক দিয়ে, হঠাৎই, হাজির হয় আমাদের সমক্ষে। চোখ তো ধাঁধায়ই, চিত্তও চমকিত করে, প্রবল। সে গৃহে-সংসারেই বাস করে,তবে সেটা নিতান্তই যেন, থাকতে হয় বলেই থাকা। যেন গৃহত্যাগের সঠিক লগ্নটির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাকে; অপেক্ষমাণতার সময়টুকুতে সে আছে,সংসারে অন্যদের সঙ্গে। দিন পার করে চলছে শুধু। অন্তরে সে  কতটা দরদি কতটা মায়াকাতর, তার সন্ধান জানে শুধু গুটিকয় লোক, যারা তার নিবিড় নিকট হবার ভাগ্য পায়! তবে বাইরে সে সদা নিস্পৃহ। লোকচক্ষে তার চলাচলতি গণ্য হতে থাকে হঠকারী আর চরম খামখেয়ালীতে ভরা বলে। তবে ভেতরে ভেতরে সে বিপন্নের ত্রাতা। যেকোনো বিপদাপন্নের সহায় হবার জন্য সদাপ্রস্তুত। বরাবর সে তাদের বান্ধবের অধিক বান্ধব। যেকোনো সংকটের কালে সে একাই সংকট সামলে নিতে এগোয়। এমনই নির্ভীক তার প্রাণ। বয়স্করাও যেই পরিস্থিতিতে ভয়ে মিনমিন, সেখানে কিশোর এইজন—ভাবনা ও ভয়মুক্ত হয়ে এগোতে থাকে। অগ্রগামী সে, সকল বিপন্নতা মোচনের কাজে।

ঝঞ্ঝা ও নদীস্রোতের মতো পরোয়াশূন্য অকুণ্ঠতা ও তেজকে ধারণ করে সে, তার অন্তরে এবং বাইরে। সর্ব সংসারী লোকের চক্ষে সে ‘লক্ষ্মীছাড়া, সর্বনেশে, বখে-যাওয়া’ একজন; যার সান্নিধ্য থেকে নিজ নিজ পুত্রদের তফাতে রাখার জন্য সকলে মরিয়া! সুশীল সামাজিকগণ উদ্বিগ্ন থাকে সকল সময়, পাছে তার প্রভাবে অন্য গৃহস্থবালকগণ তার মতোই বিগড়ে যায়। নিয়ম মানার পথ ত্যাগ করে,তারা না আবার হয়ে ওঠে বিপথগামী। তাহলে সংসারে বিপত্তির আর অন্ত থাকবে না! এই যে অন্য পথ-উতলা, বুনো আর নিয়ম ভঙ্গ করার জন্য উদগ্র কিশোর; ইন্দ্রনাথ নামেই তাকে আমরা চিনতে থাকি। 

তার সহচর অন্য যে-জন, এই কিশোরকালেই সে যেন হয়ে উঠেছে, কেবলই এক দর্শক। সমাজ-সংসারকে কেবলই নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে যেতে থাকা এক দর্শক। সে আছে সমস্ত কিছুতেই। বড়দের ফরমাশমাফিক চলনে আছে, বিধিরীতিমতো কর্মসম্পাদনে আছে; কিন্তু কোনো কিছুতেই তার কোনো লগ্নতা নেই। সে আছে সন্তর্পণ আলগোছে। 

এইজন বাহ্যিকভাবে নিতান্ত শান্ত, সংসারের নিয়ম-নির্দেশ মান্য করায় তার যেন কোনো আপত্তি নেই,বরং ওটি করে যেতে থাকে সে বিকারশূন্য মনে ও শরীরে।  মুরব্বি-পরিজন ও বিবিধ বিধির মধ্যে, সে, সুগাঢ় মৌনতা নিয়ে বাস করে চলে। তার অন্তরের ওঠাপড়া বা অস্থিরতার কোনো সংবাদ  কেউ জানে না। বা, তার ভেতরে কোনো তীব্র প্রবল  অন্য এক সত্তারও বসত আছে, এমনটাও তার পরিজনদের কেউ ভাবতেও পারে না। 

 নিতান্ত সাদাসিধে চলন-বলন তার। সে কাউকেই তার অন্তরের পরিচয় জানতে দিতে চায় না। নিজের ভেতরের বিলোড়ন ও দৃপ্ত তেজকে ঢেকে রেখে, সদা সে থাকে চুপমুখে। যেন থাকে ছায়ার মতো। ধীর ছায়া। সুবোধ নম্র ছায়া। কিন্তু ভেতরে-গহিনে সে ইন্দ্রনাথের মতোই বিধি-ছন্নভন্ন করে তোলার জন্য  প্রস্তুত। অন্তর অন্তরে সে-ও ইন্দ্রনাথের মতোই খর বিজুলি এক। সে-ও পথে নেমে নেমে, পথ হারিয়ে ফেলার তাগাদাকে বোধ করে তার সর্বসত্তায়। কিন্তু ওই কিশোরকালে, সেই তাগাদাকে প্রকাশ করে ওঠার, সামর্থ্য যেন সে পায় না! আমরা জেনে উঠি যে তার নাম শ্রীকান্ত। 

এই যে দুই কিশোর—শ্রীকান্ত ও ইন্দ্রনাথ, বাংলা উপন্যাসে তাদের আগমন ঘটে শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব ( ১৯১৭) উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। তাদের স্রষ্টা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬- ১৯৩৭)।  শরৎচন্দ্র দেখান যে বাহ্যিকভাবে দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন তাঁর এই দুরন্ত দুই বালক—তাদের এই কিশোর বয়সে, সমাজ-সংসারবাসী বটে; সামাজিক রীতিবিধি মান্যকারী সুমতি-সম্পন্নদের সঙ্গেই বসবাস তাদের; কিন্তু তারা শিষ্ট সুশীল হবার বোধ ও তাগাদাহীন। তারা চলতে চায় নিজ অন্তরের সাব্যস্ত করে দেওয়া নিয়ম ধরে। সমাজে সংসারে তাই তারা বাস করে খাপছাড়া,বহিরিস্থিত হয়ে। তারা চালিত হয় নিজ প্রাণের বাসনা, বিবেচনা ও বাঞ্ছা দিয়ে। যেই বাঞ্ছা ও বিবেচনাকে স্থিরমন্থর,নড়ন-অনীহ সমাজ ও সামাজিকেরা চিরকাল ধরে গণ্য করে আসছে মন্দমতি বালকের দুর্বুদ্ধি বলে। 

আমাদের এই বালকদ্বয় প্রবলরকমেই দুর্বুদ্ধিচালিত। তারা দুইজন তাদের আশপাশের- অচলতামোড়ানো, শম্বুক-মন্থর আর পরিতোষে নিদ্রালু সংসারে আর সমাজে নিয়ে আসতে থাকে অস্থির সচলতা। আর আনতে থাকে, অতি সমাজ-গর্হিত কর্মকাণ্ডের দমক-ঝমক। যেই দমক-ঝমকের ঝাপটার দাপটে নিয়ম-মোড়ানো শিথিল জীবন ত্রস্ত  আর বেদিশা আর উথাল-পাথাল হতে থাকে। 

 আখ্যানের প্রকাশকাল থেকেই মনে করা হতে থাকে,এমন অভিনব দুরন্ত কিশোর নায়কের দেখা, বাংলা সাহিত্য, এর আগে অমন তীব্রভাবে আর কখনো পায়নি। পণ্ডিতজনেরা তাদের দুজনের অভিনবত্ব ও দৌর্দণ্ডপ্রতাপশালিতার মহিমারচনায় থাকেন অক্লান্ত ও মুখর। তাঁরা জানাতে থাকেন, ওই দুইজন শুধু অভিনবই নয়; তারা আমাদের সাহিত্যে প্রবলরকম মৌলিক সৃষ্টি এবং তারাই আদি কিশোর।

আমরা এখন বিবেচনা করে দেখতে পারি যে ওই নায়কেরা কতটা মৌলিক-সৃজন বলে গণ্য হতে পারে। বা, তারা কতটা অন্য কোনো প্রভাবজাত সৃষ্টি!  এ-ও আমরা যাচাই করতে পারি যে এই দুজনের আগে অমন ছুট-তুরন্ত কিশোর-নায়কের উপস্থিতি কি বাংলা সাহিত্যে আদৌ আমরা পেয়েছি? নাকি তারা দুজনই প্রথম পথিক!

 

দুই. তারা এমনিই এসে ভেসে যায়!

 

বাংলা সাহিত্যের অতি দূরকালের দিকে যদি আমরা নজর রাখি; আমরা দেখতে পাব, আছে তারা। আছে ওই নবীন কিশোরের উপস্থিতি। আমাদের তল্লাটে, শ্রীকান্ত বা ইন্দ্রনাথের এসে ওঠার বহু আগে থেকেই তারা আছে আমাদের সাহিত্য ভূখণ্ডে। আছে তাদের দুর্দান্ত প্রাণশক্তি ও অচল সংসারে উপদ্রব সৃজন করার মহাশক্তি নিয়ে। 

 একটি বা দুটি ব্যতিক্রম বাদে, এই কিশোরদের কেউই সুশান্ত অচপল নয়। তারা ধীরতার সন্ধান জানে না। বা, স্থিরতার সঙ্গে তাদের জানাশোনা নেই। যেন তাদের সঙ্গে তুলনা চলে ঝঞ্ঝার, পারিপার্শ্ব টালমাটাল করে দেওয়া ঝঞ্ঝা। বা, তুলনা চলে সুতীব্র স্রোতোধারার। কূল ভেঙে অকূলের দিকে ছুটে চলে যেই প্রখর স্রোতে। এমনই তারা প্রায় প্রত্যেকে। এবং একেবারে সেই আদি থেকেই, এই কিশোরদের ওই পরোয়াশূন্যতা ও বিধিলঙ্ঘনকরণের স্পর্ধার স্তবে বাংলা সাহিত্য গভীররকমে মগ্ন। 

তবে এখানে লক্ষ করার বিষয় এই যে এই কিশোরেরা দীর্ঘ সময় ধরে আখ্যানে উপস্থিত থাকে না। মনুষ্যসন্তানের কিশোর বয়সের মতোই, এই চরিত্রগুলো, উপাখ্যানে, হঠাৎ এসে হঠাৎই  উধাও হয়ে যায়। বা যদি কোনো রচনায় তাদের কোনো কোনোজনের দীর্ঘ উপস্থিতি লক্ষও করা যায়, অর্থাৎ তারা কিশোরকালকে পেরিয়ে তারুণ্যে পা রেখে তারপর পরিণত বয়সে পৌঁছে গেছে, এমনটা যদি দেখা যায়; তখন আমরা দেখি যে সেই শঙ্কশূন্য কিশোরটি তারুণ্যে পা রাখা মাত্রই, অকস্মাৎই, পরিণত হয়েছে ভিন্ন এক টলোমলো ও ধুকন্ত, কাতর মানুষে। ওই তরুণ বা পরিণত মানুষটির সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত কিশোরটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাদের মধ্যে কোনো সাযুজ্যই নেই। সে অভিন্ন নামধারী বটে, কিন্তু আদতে সে ভিন্ন শরীরের আর ভিন্ন নিরীহতায় মোড়ানো এক ভিন্নজন। 

অধিকাংশ কিশোরই এইখানে অল্পায়ু নিয়ে দেখা দেয়। হয় সে অকালপ্রয়াত হয়, নয় তো সে নিখোঁজ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বা, আগাগোড়া বদলে গিয়ে হয়ে ওঠে অচেনা আরেকজন। সংসার শুধু অল্প কয়েক দিনের জন্য যেন তাকে, ওই নির্ভীক দুর্দান্তকে, পায়। তারপর তাকে খোয়াতে বাধ্য হয়। সে হারিয়ে যায়। এই বিষয় আমাদের জানাতে থাকে যে অমন তীব্র তেজকে অমন অল্পায়ুর বেড়ের মধ্যেই পেতে হয়, নতুবা ওই তীব্র প্রতাপকে  দীর্ঘকাল ধরে ধারণ করে যাবে, এমন সামর্থ্য নেই এই সংসার-ধরিত্রীর। 

যদিও পুরো বাংলা সাহিত্যের দুনিয়ায়, তারা আছে মাত্র গুটিকয়জন। কিন্তু যেই কয়জনই আছে , তাদের বেয়াড়া গোয়ার্তুমি, তাদের বেয়াদবির শক্তি, সকল নিষেধ-বিধিকে তছনছ করে দেওয়ার রোখ- রচনায় এমন মহিমাদীপ্র হয়ে উপস্থাপিত হয়ে আছে যে সেসব পাঠ করে করে  আমাদের মনে হতে থাকে; বাংলা সাহিত্য ওই অমন পরোয়াহীনতাকেই চিরকাম্য আর মহামহৎ বলে জানে। তাই তারই বন্দনায় এ-সাহিত্য এমন উদ্বেল আর এমন উচ্ছ্বাসময়। 

আমাদের সাহিত্যে প্রথম যে দুদর্ম্য আর অশঙ্ক মানব-কিশোরের দেখা  আমরা পাই, তার নাম কৃষ্ণ। যদিও পণ্ডিতজনেরা বাংলা সাহিত্যের দস্যি-দামাল কিশোর নায়কের আদি উদাহরণ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রাখালকেই স্মরণ করে থাকেন; কিন্তু রাখালের আগমনের অনেক আগে, অনেক শতাব্দী আগেই; দেখা দেয় আমাদের সাহিত্যে-ভূভাগের  প্রথম কিশোর-নায়কটি। সে আবির্ভূত হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের (১২০১-১৮০০ খ্রি.) মাঝামাঝি সময়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে একেবারে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়পর্বে ‘পদাবলী সাহিত্যের যে কূলপ্লাবী মহাধারা প্রবাহিত’ হয়েছে,ওই মহাধারার একটি ধারা হচ্ছে ‘ কৃষ্ণের বাল্যলীলা’। এই বাল্যলীলা অংশে রূপায়িত হয়েছে এক ‘অতি প্রাণময় মানবকিশোর’-এর ভীষণ দুরন্তপনাগুলো।

 যদিও  বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণ নিতান্ত সামান্য এক মনুষ্যসন্তান হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি। এখানে কৃষ্ণ হচ্ছে ভগবান বিষ্ণুর নর-অবতার। বাল্যলীলা অংশে মনুষ্যদেহধারী ভগবানের কিশোরজীবনের মাহাত্ম্য-গাথা, শব্দেছন্দে তুলে ধরাই যদিও সব পদকর্তার লক্ষ্য; তবে সেই ভগবৎ-মহিমার পরিচয় দিতে গিয়ে, পদকর্তাগণ মূলত রচনা করে তুলেছেন এক মানব-কিশোরেরই জীবনালেখ্য। তাঁরা রূপ দিয়ে উঠেছেন ওই মানব-কিশোরের দুর্দম্য প্রবণতাগুলোকে, আর তার প্রাণের সত্য পরিচয়টিকে। 

যদিও তার প্রথম তারুণ্যের রাধা-অনুরাগের জন্যই, কৃষ্ণ, এই ভূভাগের পাঠক-অন্তরের জল-স্থল-অন্তরীক্ষ দখল করে আছে; দখল করে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; তবে মনুষ্য-অবতার হিসেবে  তাকে যেমন জন্ম নিয়ে মাতৃক্রোড়ে আসীন হতে হয়,তেমনি তাকেও পেরোতে হয় কিশোরবেলা। সেইখানে আছে মায়ের শাসন ও দরদ; আছে সখাসন্নিধানে যাপিত দামাল দিনরাত। বাল্যলীলাবিষয়ক পদগুলো কৃষ্ণের ভীষণ দুরন্তপনাময় কিশোরবেলাটিকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। 

সেই ছেলে ভয়শূন্য, ভীষণ অশান্ত। ‘বয়সে কিশোর মোহন ভাতি/ বদন ইন্দু জলদ-কাঁতি’। দেখতে সে মনোহর,চাঁদের মতন ঝলমলে মুখ তার। দেহকান্তি মেঘের মতন শোভাময়। কালিন্দী নদীতীরের বৃন্দাবনে তার বাস। কিন্তু বৃন্দাবনের ঘরে ঘরে একদা  সুখ ও আনন্দ থাকলেও, আজ আর তা নেই। সেখানে আছে এখন কঠিন অশান্তি, আর নিরুপায় ক্রন্দনের রোল। আজ কালিন্দী নদীতীরে তীরেও কিছুমাত্র শান্তি-স্বস্তি নেই। কারণ, নদীজলে এসে বসত গেড়েছে মহাহিংস্র সরীসৃপ-কালী নাগ। ওই নাগের নিশ্বাসের বিষে বিষে আকাশ-বাতাস বিষাক্ত হয়ে গেছে। ‘তাহার উপরে বায়/ পাখি যদি উড়ি যায়/পড়ে তাহে তেজিয়া পরাণ’। নদীজলও বিষময় হয়ে উঠেছে: ‘ বিষ উথলিছে জলে/ প্রাণী যায় যদি কূলে/ জলের বাতাস পাঞা মরে’। সমস্ত তল্লাটবাসী যখন আতঙ্ক ও যাতনায় ধড়মড় করছে, উদ্ধারের কোনো উপায় যখন কেউই আর খুঁজে পাচ্ছে না; তখন ওই কিশোর কৃষ্ণ একাকী অগ্রসর হয় নিদানের বন্দোবস্ত করতে। ‘দেখি  যদুনন্দন/ দুষ্ট-সর্প-বিনাশন/উঠিলেক কদম্বের  ডালে/ তাহার উপরে চড়ি/ ঘন মালসাট মারি/ঝাঁপ দিলা কালী-দহ-জলে।’ কিশোরের এমত দুঃসাহস দেখে আর্তনাদ করে ওঠে জগৎ-গৃহস্থালী। প্রবল ভয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যায় গ্রামবাসীদের সকলে: ‘ ব্রজবাসিগণ কান্দে ধেনু-বৎস শিশু/ কোকিল ময়ূর কান্দে যত মৃগপশু।’ .. .. ‘ ফুকরি শ্রীদাম কান্দে/ কেহ থির নাহি বান্ধে’ .. ‘ পড়ে সবে মুরছিত হৈয়া’। কিন্তু সেই কিশোর ,পরোয়াহীন কিশোর, যায় নাগের মুখোমুখি হতে। কঠিন দ্বৈরথে উগ্র ভয়াল নাগকে পরাস্ত করে সে, রক্ষা করে পশুপক্ষী আর জনপদবাসীর জীবন। ওই লড়াইয়ে সে কতটা ক্ষতাক্ত হয়, সেদিকে দৃকপাতও নেই তার। সে যে দুষ্টের উপদ্রবদমনে সমর্থ হয়েছে,সেই উল্লাসে ঝলকে উঠতে থাকে তার দেহ ও মন।

এই বালক তারপর ক্রমে কেবলই নারী-মনোহরণ-কারবারি এক তরুণ হয়ে ওঠে। তখন তার পরহিতব্রতী দুরন্তপনা কোন সুদূরে যে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়! আমরা তখন পাই অন্য এক যুবাকে; যে কিনা রাধা নামক বালিকার চিত্তজয় করার জন্য কত কী করে চলতে থাকে। তখন আমরা কেবল পাই ওই তরুণের বিবিধ ক্রন্দনকে। পাই তার কত ছল, কত বংশীবাদন, কত না মিটন্ত তৃষ্ণার দমক, কত রাধা-নৈকট্যসুখী চিত্তের উদ্বেলতা! কত রূঢ় প্রত্যাখ্যান দিয়ে দিয়ে সে, রাধাকে ছন্নভন্ন করে করে, অবলীলায় কোন মথুরায় চলে যায়। এই তরুণ বয়সে সে, এই কৃষ্ণ, কেবলই ভোগ-তৃষ্ণ পুরুষ, কেবলই সম্ভোগ-কাতর এক যুবা মাত্র।  শুরুতে যেই পরোয়াহীন আত্মোৎসর্গকারী  কিশোরটিকে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম; এখন এই তরুণবেলায়,  সেই তরুণ হয়ে ওঠে অন্য প্রবণতাসম্পন্ন অন্য মানুষ। ওই কিশোরের সঙ্গে যার অমিল প্রবল।

ওই ‘দুষ্ট-বিনাশন’ কৃষ্ণ-কিশোরের আগমনের কয়েক শতাব্দী পরে যে দেখা দেয়, সে রাখাল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর বর্ণপরিচয়-প্রথম ভাগ (১৮৫৮) গ্রন্থে ওই নিয়মছিন্নকারী, স্থির-ধীর সংসারে দৌরাত্ম্য ও উৎপাত সৃজনকারী কিশোরের গল্প বলেন। বলেন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ওই কাহিনিটিকে ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘অনেক দুষ্ট, লেখা-পড়ায় অমনোযোগী বালকের কাহিনী’ বলে অভিহিত করেন। 

রাখালের সঙ্গেই এইখানে বিরাজ করে গোপাল। সে বড় ‘সুবোধ’, ভারী নম্র ও সুশীল। আর, রাখাল নামের  বালকটি অ-সুবোধ, অভব্য এবং সকলের জন্যই অ-সহ।  বিদ্যাসাগর জানান, ‘গোপাল যেমন সুবোধ, রাখাল তেমন নয়। সে বাপ মার কথা শুনে না, যা খুসী তাই করে; সারাদিন উৎপাত করে; .. .. .. ..রাখাল, পড়িতে যাইবার সময়, পথে খেলা করে; মিছামিছি দেরি করিয়া, সকলের শেষে পাঠশালায় যায়। আর আর বালকেরা পাঠশালায় গিয়া পড়িতে বসে। রাখালও দেখাদেখি বই খুলিয়া বসে। বই খুলিয়া হাতে করিয়া থাকে, একবারও পড়ে না। .. .. ..খেলিবার ছুটি হইলে, রাখাল বড় খুসী। খেলিতে পাইলে সে আর কিছুই চায় না । খেলিবার সময়, সে সকলের  সহিত ঝগড়া ও মারামারি করে; এ কারণে গুরু মহাশয় তাহাকে সতত গালাগালি দেন।’ 

গোপালের এমত সকল উৎপাত-উপদ্রবের বিবরণদানের পরে;, বিদ্যাসাগর রায় দেন যে সংসারের কারোই ওই ভীষণ দুষ্ট কিশোরটির মতো হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন: ‘রাখালকে কেহ ভালবাসে না। কোন বালকেরই রাখালের মত হওয়া উচিত নয়। যে রাখালের মত হইবে, সে লেখাপড়া শিখিতে পারিবে না।’ এই সংক্ষিপ্ত রচনাটি এমন হিতোপদেশের মধ্যেই সমাপ্ত হয়। তাই আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব হয় না, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাখাল কতটা বদলাল। নাকি অ-বদলানোই রয়ে গেল সে বরাবর; রয়ে গেল বিধিমালা, ঝিমন্ত সংসারে এক উপদ্রব আনয়নকারীই। 

সেই কাহিনি আর বর্ণিত হয় না ঠিকই, কিন্তু বিদ্যাসাগরের সমস্তটা জীবনাই যেন ওই গল্পের শেষাংশটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট-প্রত্যক্ষ করে তুলতে থাকে। এই জীবনে বিদ্যাসাগর বরাবর আছেন চির তেরিয়া-কিশোর বা চির নব্য-তরুণ হয়ে।  অন্ধ, দয়াশূন্য, আর দাঁতাল হিংস্র সমাজের শান্তির-ঝিমুনি চলতে দেবার ঘোর বিপক্ষে যিনি। বিপুল কুবিধি-মোড়নো সংসারকে মুক্ত করাই যাঁর পণ। তাই তাঁর কঠিন লড়াই। চলতেই থাকে চলতেই থাকে। 

বিদ্যাসাগর আমাদের সকলকে, রাখালের মতো হতে বারণ করে কাহিনি শেষ করেন ঠিকই; কিন্তু নিজস্ব জীবনাচরণ দিয়ে তিনি আমাদের কাছে পৌঁছান এক ভিন্ন বার্তা। অপসংস্কারদুষ্ট সংসারকে মুক্তি ও কল্যাণ দেওয়ার জন্য তিনি যেন উপদ্রব ও উৎপাতকারী হয়ে ওঠার জন্যই আমাদেন প্রাণিত করে চলেন; যেন বা প্ররোচিত করে চলেন অ-সুবোধ এক নব্য রাখাল হয়ে ওঠারই জন্য। লোকসকলের মঙ্গল সাধনের জন্য, আর কুপ্রথা ও অন্যায়কে থেঁতলে দেওয়ার জন্য অমন উৎপাতকারীকেই তো দরকার, এই সংসারের। তাঁর জীবনাচরণ আমাদের সামনে তারই তুমুল উদাহরণ হয়ে আছে।

  রাখালের  একটু পরেই আমরা পাই মোহনলালকে। তাকে আমরা পাই যোগীন্দ্রনাথ সরকার ( ১২৭৩- ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ)-এর জয়-পরাজয়  (প্রকাশকাল অজ্ঞাত, তবে আনুমানিক ঊনবিংশ শতকের শেষাশেষি রচিত ও প্রকাশিত) উপন্যাসে। এ- কিশোর, যার নাম মোহনলাল, সে-ও দুর্দান্ত দুষ্ট।  উত্তম পুরুষে বর্ণিত এই আখ্যানের গোড়াতেই মোহনলাল আমাদের জানিয়ে দেয়, পিতৃহীন সচ্ছল সংসারে, মায়ের দরদের অপব্যবহার করে করে  কতটা উচ্ছন্নে সে যেতে পেরেছে। সে বলে:  ‘…শাসন করিবার কেহই ছিল না। ... আমি মায়ের আদুরে গোপাল হইয়া হাসিয়া খেলিয়া দিন কাটাইতাম। মাকে বেলা দুপুর পর্যন্ত ফাঁকি দিয়া, বাগানে বাগানে পাখির ছানা খুঁজিয়া বেড়াইতাম। কখন সমবয়সীদের সঙ্গে জুটিয়া প্রতিবেশীর বাগানে পাকা কুল, বাতাবিলেবু, কাঁচা আম, কচি শসা প্রভৃতি চুরি করিতে যাইতাম। কখন জেলের ছেলেদের সঙ্গে মিশিয়া, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়াও নদীতে নৌকা চড়িয়া বেড়াইতাম, কখনও বা নদীর চড়ায় গিয়া চড়িভাতি করিতাম। একদণ্ড আমাকে বাড়িতে কেহ স্থির হইয়া থাকিতে দেখে নাই।’ 

 এভাবে দিন  যেতে থাকে; কিন্তু শেষে আর অমন নিরুপদ্রবে উৎপাত করে যেতে থাকার পরিস্থিতিটা থাকে না। কারণ, ‘পাড়ার কয়েকটা দুষ্টু ছেলের সহিত’ মোহনলালের ‘কিছু বেশী ঘনিষ্ঠতা হওয়াতে’, তার মা ‘বড়োই ভয় পাইলেন’, এবং ‘পুত্রকে রক্ষা করার ব্যবস্থা’ হিসেবে স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

তবে তাতেও মায়ের পুত্রের শেষরক্ষা হয় না। বরং স্কুলে গিয়ে সে আরও বিপুল কুসঙ্গ লাভ করে। মোহনলাল জানায়, ‘মায়ের বুঝিবার নিতান্ত ভুল হইয়াছিল। স্কুলে গিয়া অতি অল্পদিনের মধ্যেই আমি অনেকগুলি কুসঙ্গী পাইলাম এবং তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া, স্কুল হইতে পলাইয়া, বাগানে বাগানে ঘুরিয়া, পাখির ছানা ও ফলমূল চুরি করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম।’ তবে ওইটুকু দুরন্তপনা নিয়েই মোহনলাল পরিতুষ্ট থাকে না। দিনে দিনে সে হয়ে ওঠে  বিষম ‘মন্দ স্বভাব’সম্পন্ন। ‘ক্লাসের প্রায় সকলেই’ … তাকে ভয় করে। সগৌরবে সে এমন এমন আস্ফালন করে চলে: ‘আমার অত্যাচার-প্রবৃত্তি এমনই প্রবল ছিল যে আমাকে ভয় না করিত, এমন ছেলে ক্লাসে কেহই ছিল না। এমনকি, আমি কোন অত্যাচার করিলেও শিক্ষককে বলিয়া দিতে কেহ সাহস করিত না।’

মোহনলালের কৈশোরিক ওই দুরন্তপনা ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে না। বরং সে কালক্রমে হয়ে ওঠে কুচক্রী আর নির্দয় আর বিবেকহীন এক লোক। সে থাকে কুঁচুটে, দুষ্টতাগ্রস্ত এবং হিংস্র। নিরীহ ভালোদের অত্যাচার করে, নানাভাবে তাদের অহিত সাধন করে করে, সে ব্যাপক উল্লাস পেতে থাকে। নিরন্তর অমনটা করে যেতে থাকাই হয়ে ওঠে তার দেহধারণের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

ওই হীনতাগ্রস্ত মানুষটি শেষে, জীবনে, কীভাবে চরম শিক্ষাটা পায়; কীভাবে অবশেষে সে বিবেকজাগ্রত এক মানুষে পরিণত হয়; ওটি নির্দেশ করাই এই আখ্যানে হয়ে ওঠে লেখকের একমাত্র লক্ষ্য। মোহনলালের কিশোরকালের অধীরতা গল্প বলার মধ্য দিয়ে চিরকালীন কিশোরের সত্য অবস্থাটির চিত্রণ করার চেষ্টা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত আখ্যানটি সদুপদেশ প্রচারের এক মাধ্যমমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। জয়-পরাজয় রসোত্তীর্ণ গল্প হবার ভাগ্য পায় না। 

মোহনলাল অসাধুতা সংশোধনপ্রক্রিয়ার এক দৃষ্টান্ত হওয়ার জন্য বলিপ্রাপ্ত হয়;  অন্যদিকে ফটিক হয়ে ওঠে রূঢ়, বিরুদ্ধ পরিবেশের পেষণে পিষ্ট এক অসহায় প্রাণের উদাহরণ মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) “ছুটি” গল্পটি বেরোয় পৌষ ১২৯৯ বঙ্গাব্দে। কিশোর ফটিকও অফুরন্ত প্রাণশক্তির তেজে সদা ধাবমান আর সদা চঞ্চল। বদ্ধ ও থির সংসারে নিত্য আছড়ে পড়ে তার ভীষণ তীব্র গতি ও দুর্দান্ত উচ্ছ্বস। এই সব কিছুকেই থির সংসারের চোখে মনে হতে থাকে অতি উপদ্রব ও বিড়ম্বনা বলে। ফটিক দণ্ডমাত্র স্থির থাকতে জানে না। প্রহরে প্রহরে এই ‘বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায়’ ‘চট করিয়া একটা নূতন ভাবোদয়’ হয়। এবং নিজ ভক্ত-অনুসারী ছেলের দলকে নিয়ে সে ওই সব যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খলতা, পাঠে অমনোযোগ’ দিয়ে দিয়ে ফটিক তার মায়ের ‘হাড় জ্বালাতন’ তো করেই; সেই সঙ্গে অন্য আরেক শঙ্কাও সে তার মায়ের মনে অহনির্শি জাগিয়ে রাখে। তার মা পলে পলে এই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে যে, না-জানি ফটিক তার ছোট ভাই নিরীহ মাখনটাকে কোন যন্ত্রণায় দিয়ে ফেলে: ‘তাহার মনে সর্বদাই আশঙ্কা ছিল - কোনদিন সে মাখনকে জলেই ফেলিয়া দেয় কি মাথাই ফাটায়, কি কী একটা দুর্ঘটনা ঘটায়!’

তবে  হঠাৎই মায়ের অন্তরের ওই আশঙ্কা দূর হবার একটা পরিস্থিতি চলে আসে। ফটিকের কলকাতাবাসী মাতুল-তার ভগ্নীর ভালোমন্দের খয়খোঁজ করার জন্য—গ্রামে এসে হাজির হয়। এবং পিতৃহীন সংসারের ওই জ্যেষ্ঠ দুরন্তপুত্র ফটিকের উপদ্রবে দিশাহারা ভগ্নীকে রেহাই দেবার নিদান হাজির করে ভ্রাতাটি। সে ফটিককে কলকাতায় নিয়ে যাওয়াটাকেই ভগ্নীর জীবন ও সংসার নিরুপদ্রব করার মোক্ষম উপায় বলে জানায়। এবং অনতিবিলম্বে ফটিকসহ তার মাতুল কলকাতায় ফিরে যায়। সেইখানে শুরু হয় ফটিকের এক ভয়াবহ দণ্ডভোগের কাল। না মামার সংসারের কোনোজন তাকে দরদ ও মায়া দিয়ে গ্রহণ করে; না ফটিক ওই দালানকোঠার ঘেরের ভেতরে সহজ নিশ্বাস ফেলার কোনো পরিস্থিতি পায়। 

সে সেখানে কেবলই বিড়ম্বনা-বিদীণর্ হতে থাকে। নিত্য অপমানে অপমানে কেবলই ক্লিষ্ট হতে থাকে। এই দমবন্ধ হয়ে আসতে থাকা জীবনে ফটিক চক্রবর্তীর ‘কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে’ পড়তে থাকে। লেখকের জবানী থেকে তারপর আমরা জানতে পেতে থাকি: ‘প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করিয়া উচ্চৈস্বরে স্বরচিত রাগিনী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীণর্ স্রোতস্বিনী,সেইসব দল-বল উপদ্রব স্বাধীনতা, এবং সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী অবিচারিণী মা অহর্নিশি তাহার নিরুপায় চিত্তকে আকর্ষণ’ করে চলে। আর অহর্নিশ নিরন্তর তার কেশ-ক্লিন্ন প্রাণ গুমরে মরতে থাকে।

আমরা দেখতে পাই যদিও এই গল্পের নায়ক এক দুরন্ত বালক, কিন্তু তার দুরন্তপনাই এখানে মুখ্যবৃত্তান্ত হয়ে আসে না। রবীন্দ্রনাথ এখানে বরং অন্য আরেক দর্শন ব্যক্ত করায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তিনি জানাতে থাকেন যে, কিশোরবেলাটি তার সকল রূপ-রস-গন্ধ-তেজ নিয়ে দেখা দেয় সত্য; কিন্তু মূঢ় সংসারের ‘চারিদিকের স্নেহশূন্য বিরাগ’ ওই অবোধ কিশোরবেলাকে  ‘পদে পদে কাঁটার মতো’ বিদ্ধ করে করে, একেবারে বিষবিষাক্ত করে দিতে সমর্থ হয়; এবং প্রাণের ও দেহের মৃত্যু অবধারিত করে তোলে। ফলে শেষ পর্যন্ত এই গল্পে আমরা ফটিকের দুরন্ত বেদনাকে যতটা পাই, তারও চেয়ে বেশি পাই লেখকের দর্শন-ভাবনাটিকে।

তারপর ১৯১৫-এর দিকে, আমরা সাক্ষাৎ পাই পাগলা দাশুর। এই দাশু-যার পোশাকি নাম দাশরথি রায়—ওই দস্যি-উৎপাতকারীর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের পরিচয় ঘটিয়ে দেন সুকুমার রায় (১৮৮৭- ১৯২৩)। 

 

(চলবে)