জঁ-লুক গদার: ছকভাঙা ছায়াছবির কারিগর

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২, ০৮:০৪ পিএম

ফরাসি দৈনিক সংবাদপত্র লে মন্ড জানাল, জঁ-লুক গদার, ফরাসি-সুইস পরিচালক, যাঁর সিনেমাগুলো ঐতিহ্যগত সিনেমার ফর্মগুলোকে ভেঙে দিয়েছিল এবং ১৯৬০-এর দশকের রেডিক্যাল নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথ দিয়েছিল, আজ মারা গেলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। 

গদার ১৯৬০ সালে ‘ব্রেথলেস’ ফিল্মটি দিয়ে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, যা তাঁর প্রজন্মের সৃজনশীল ধারা এবং সামাজিক উত্থানকে চিহ্নিত করেছিল। ছবিটি নতুন চিত্রগ্রহণের কৌশল, হাতে ধরা ক্যামেরার ব্যবহার এবং জাম্প কাটের সঙ্গে  একটি নান্দনিক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। 

অর্ধশতাব্দীরও বেশি বিস্তৃত ছিল তাঁর কর্মজীবন। তাঁর ছবিগুলো ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিল। গদারের কাজ, যা হলিউডের পরিচালকদের যেমন কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো, মার্টিন স্কোরসেস এবং রবার্ট অল্টম্যানকে প্রভাবিত করেছিল। এতে প্রবন্ধ, ডকুমেন্টারি এবং চলচ্চিত্র তৈরির বিষয়ে চলচ্চিত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল।

“একটি গল্পের একটি শুরু, একটি মধ্য এবং শেষ থাকা উচিত, তবে সেই ক্রমে হতেই হবে এমনটি নয়”, গদার একবার বলেছিলেন। তিনি ১৯৬০-এর দশকে ফরাসি ভাষায় এক ডজনেরও বেশি নিউ ওয়েভ ফিচার ফিল্ম তৈরি করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘আ উইম্যান ইজ উইম্যান’, ‘দ্য লিটল সোলজার’, ‘কনটেম্পট’, ‘দ্য রাইফেলম্যান’, ‘ব্যান্ড অফ আউটসাইডার’ এবং ‘ম্যাসকুলিন ফেমিনিন’ ইত্যাদি। 

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে গদারের কাজ আরও রাজনৈতিক দিকে মোড় নেয়। ১৯৬৮ সালে, তিনি এবং পরিচালক ক্লড লেলুচ ফ্রান্স জুড়ে প্রতিবাদকারী ছাত্র ও শ্রমিকদের সংহতি জানিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসব বাতিল করতে সক্ষম হন।

সেই বছর, সোভিয়েত পরিচালকের ওপর ভিত্তি করে, ‘ডিজিগা ভার্তোভ’ গ্রুপ নামে একটি মার্কসবাদী সিনেমা কালেক্টিভ তৈরি করে গদার সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেন। ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে যৌথটি ভেঙে যাওয়ার আগে প্রায় অর্ধ ডজন চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল।

৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে গদারের জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান। তার বাবা পল-জিন, পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার আগে ফ্রান্সের চিকিৎসক ছিলেন। বোধহয় ডাক্তার বাবার ধী-শক্তি গদারের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। গদারের মা ওডিল ছিলেন ব্যাংকারদের একটি ধনী পরিবারের কন্যা। 

১৯৩৮ সালে, গদার সুইস শহর নিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং তার মধুর শৈশব লেখাপড়া, স্কিইং, টেনিস খেলা এবং বিভিন্ন পারিবারিক এস্টেটের মধ্যে ভ্রমণ করে, বিভিন্ন লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে সমৃদ্ধ করে তোলেন।

১৯৪৯ সালে, তিনি ড্রপ আউট হওয়ার আগে প্যারিসের সোরবনে নৃতাত্ত্বিক ছাত্র হিসেবে নথিভুক্ত হন। প্রায় একই সময়ে তিনি চলচ্চিত্র ক্লাবে যোগদান করেন। যেমন সিনেমাথেক, যেখানে পরিচালকের স্বতন্ত্র শৈলির ওপর ফোকাস করা চলচ্চিত্রগুলোই মূলত দেখানো হতো।

‘গ্যাংস্টার’ ফিল্ম এবং আলফ্রেড হিচককের একজন ভক্ত গদার ১৯৫২ সালে ‘লে কাইয়ে দ্যু সিনেমা’য় সমালোচক হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক পত্রিকাটি তাঁকে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে প্রবেশাধিকার দিয়েছিল।

১৯৫৪ সালে, বাবা-মা প্যারিসে তাঁকে টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। গদার সুইজারল্যান্ডের একটি বাঁধে কাজ করার এবং সেই অভিজ্ঞতার নথিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল ‘অপারেশন কংক্রিট’ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর যাত্রা। কতোটা লক্ষ্যস্থির হলে অমন ধনী পরিবারের ছেলে বাঁধের শ্রমিক হিসেবে আয় করে ছবির মূলধন জোগাড় করেন! আশ্চর্য হতে হয়।

১৯৬০ সালে ‘ব্রেথলেস’-এর মাধ্যমে তাঁর সাফল্য আসে, এটি একটি ব্লকবাস্টার, যার টিকিট ফ্রান্সে ২ মিলিয়নেরও বেশি, মানে ২০ লক্ষেরও বেশি বিক্রি হয়েছিল। ফিল্মটিতে অভিনয় করেছেন ২৬ বছর বয়সী একজন পলাতক অপরাধী, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন জঁ-পল বেলমন্দো, যিনি একজন আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে রোমান্টিকভাবে জড়িয়ে পড়েন। জঁ সেবার্গ অভিনয় করেছিলেন।

১৯৬২ সালে, গদার ফ্রাঙ্কো-ড্যানিশ অভিনেত্রী আনা কারিনাকে বিয়ে করেছিলেন। যিনি তাঁর সাতটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। পরে এই দম্পতির বিচ্ছেদ ঘটে। তিন বছর পরে, তিনি ঔপন্যাসিক ফ্রাঁসোয়া মৌরিয়াকের নাতনি অ্যান ওয়াইজেমস্কিকে বিয়ে করেন। তিন বছর পর সেই বিয়েও ভেঙে যায়। 

সম্মানসূচক অস্কার পেয়েছিলেন বটে। কিন্তু পুরস্কার নিতে যেতে হবে বলে আর যাননি। এই ছিলেন গদার। শিল্পের ছকভাঙা কারিগর।

ছক ভেঙে ফেলতে গেলে আগে ছক জানতে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটিতে বলেছেন, “গদারের প্রায় যেকোনো ছবি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তাঁর একটা প্রধান লক্ষ্য হলো সিনেমার সনাতন রীতিগুলিকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ভেঙে ফেলা। কাজেই গদারকে বোঝবার আগে বোঝা চাই এ সনাতন রীতিগুলিকে, যেমন প্রাক্-সেজান যুগের সনাতনী ইউরোপীয় পেন্টিং-এর সঙ্গে পরিচয় না থাকলে, সেজানকে বোঝা যায় না।”

কাজেই আমরা যারা শিল্প সাহিত্যের ছক ভেঙে নতুন করে গড়তে চাই, আগে দরকার সেটাকে গভীরভাবে জানা। পড়া, দেখা, মানুষ ও  প্রকৃতিকে চেনা। জীবনকে গভীরভাবে ‌অনুভব করা না গেলে কোনো কিছুই হয়ে ওঠা হয় না।

পুরস্কার! সে তো বাড়ির শেলফে বা উইকিপিডিয়ায় থাকে। সৃজনশীলরা পাত্তাও দেন না। যেমন গদার যাননি অস্কার নিতে।

সৃষ্টি আসলে নিজেকে উপভোগ এবং চ্যালেঞ্জের জন্য। গদার জানতেন। যেমন জানতেন আমাদের মাণিক, সত্যজিৎ রায়।