মুখবন্ধ: শিশিরের কারাগার

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০৫:০৩ পিএম

সাইফুল ইসলাম শিশির একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা—বিশেষ ‘সিনেট সদস্য’—পরিচয়ে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তখন শুনিয়াছিলাম তিনি সদ্য কারামুক্ত হইয়াছেন। শিক্ষকমহলেও তাঁহার বেশ প্রতিপত্তি। তাঁহার ছাত্রসংগঠনের নাম ছিল ‘বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’। শিশিরের সহিত আমার আলাপ-পরিচয় ঐ যুগেই। ১৯৮৩-৮৪ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নমানের শিক্ষক ছিলাম। দীর্ঘদিন পর—চল্লিশ বছর তো হইবেই—আবার দেখা হইল তাঁহার সহিত। নিজের লেখা অনেকগুলি বই লইয়া একদিন আমার বর্তমান কর্মাগারে আসিলেন তিনি।

শিশির প্রতিভাবান মানুষ। তাহার স্বাক্ষর এই নাতিদীর্ঘ কারাকাহিনীতেও পাইলাম। এখানে শুদ্ধমাত্র দুই দুইবার নিজ কারাবাসের কঠোর কাহিনী নহে, অখ্যাত ও বিখ্যাত দুই ধরনের কারাবন্দির কথাও তিনি দরদ দিয়া লিখিয়াছেন। তাঁহার তীক্ষ্ণ রসবোধ, প্রাঞ্জল ভাষা এবং কালিমামুক্ত জীবনদৃষ্টি এই বইয়ের সম্পদ।

 

মাঝে মাঝে তিনি লোকসঙ্গীত আর ভদ্রকবিতার অনাবিল উদ্ধৃতি হাজির করিতেও কসুর করেন নাই। দেশবিখ্যাত আহমদ ছফা রচিত ১৯৭৭ সালের একটি গান অধুনাপ্রয়াত গায়ক ফকির আলমগীর আত্মসাৎ করিয়াছিলেন। সেই জনপ্রিয় গানের পাঁচটি পংক্তি শিশির উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেই পাঁচ পংক্তি ‘আহমদ ছফা রচনাবলি’ মধ্যে এই বিন্যাসে পাওয়া যায়:

ঘর করলাম নারে আমি

আমি সংসার করলাম না

আউল বাউল ফকির সেজে

আমি কোন ভেক নিলাম না।

মনের ঘরে প্রবেশ করে

মনকে কাছে পেলাম

জন্মদিনের মত আজো

শিশু থেকে গেলাম

ভালো-মন্দ কোন কিছুর

হিসাব নিলাম না।

            (ছফা ২০০৮: ৪৮৯)

 

এই পংক্তিগুলো যে আহমদ ছফার রচনা সে সত্য শিশির হয়ত জানিবার সুযোগই লাভ করিতেন না, যদি না এই অধমর্ণকে মুখবন্ধমত কিছু একটা লিখিবার আদেশ করিতেন। শিশির গানটি জনৈক কারাবন্দি সাইফুল ইসলাম জুয়েলের গলায় শুনিয়াছেন। তাঁহার মতন জুয়েলও হয়ত জানিতেন না এই গানটি আহমদ ছফার রচনা। কবির লক্ষ্য মনে হয় পূর্ণ হইয়াছে। প্রমাণ তাঁহার রচনা এখন লোকসঙ্গীতের মর্যাদা পাইতেছে। মনে পড়িতেছে সাইফুল ইসলাম মানে ‘ইসলামের তরবারি’। আমিও এইসব লেখা পড়িয়া অনেক তরবারির আঘাত পাইলাম, অজানাকে জানিতে পারিলাম। মনে পড়ে সত্যেন সেনের এমন কিছু লেখাও একদা পড়িয়াছিলাম।

বর্তমান বইয়ের সম্ভবত সবচেয়ে মূল্যবান অংশ তাঁহার প্রথম কারাবাস কাহিনী। কাহিনীটা একুনে চল্লিশ বছর আগের। আমাদের দেশের থানাহাজত আর কারাগার-বন্দিশালা যে আজও মানবেতর অবস্থায় সেই মর্মন্তুদ কাহিনী শিশিরের লেখায় বক্ষ্যমাণ। সঙ্গে সঙ্গে ফাটকের ভিতরে যাহারা আটক থাকেন তাহারা পরস্পর যে নতুন মানবিক সম্পর্ক গড়িয়া তোলেন সে কথাও নানান ফাঁকফোকর দিয়া প্রকাশিত।

শিশির যৌবনে যে রাজনীতির অনুসারী ছিলেন, যদি আজও সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতেন আমি নিঃসন্দেহে বিস্মিত হইতাম। স্বভাবতই তাঁহার বিবর্তন হইয়াছে। এতদিনে ‘বিপ্লব’ শব্দটি অভিধানের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। ডাক্তার মুহাম্মদ ইউনূসের দারিদ্র্য যেমন মাথা লুকাইয়াছে জাদুঘরে। সেই গুজবের মতন শিশিরের জবানেও এক্ষণে স্থানলাভ করিতেছে ‘জাতীয়তাবাদী শক্তি’ প্রভৃতি বুলি। লেখক পরিচয়ে তিনি কামিয়াব—এ সত্যে সন্দেহ কি!

 

৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

 

 

দোহাই

 

১. আহমদ ছফা, ‘আহিতাগ্নি,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, ৫ম খণ্ড (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ৪৮৭-৫৩৪।

২. সাইফুল ইসলাম শিশির, অদেখা কারাগার, প্রকাশিতব্য।