তারেক মাসুদের ‍‍`চলচ্চিত্রযাত্রা‍‍` ইতিহাসের দলিল

লাবণী মণ্ডল প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ০৫:৫১ পিএম

‘চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম’ তারেক মাসুদ। এ লাইনটি পড়ে বারবার মনে হচ্ছে, তিনি তো আসলেই লেখক। একজন চলচ্চিত্রকার স্ক্রিপ্ট লিখেন, তার স্ক্রিপ্টে সহজ-সাবলীল বিষয় থাকে। যে বিষয়গুলো চিন্তায় ধারণ করতে হয়। যেগুলো আবার কলম ধরে লিখতে হয়। যে লেখনীগুলোই একসময় ইতিহাস হয়ে যায়। তারেক মাসুদের ক্ষেত্রে ঠিক সেটিই ঘটেছে। তাঁর লেখাগুলো এখন ইতিহাসের অংশ। সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষীর চলচ্চিত্রপ্রেমী ব্যক্তিবর্গ এবং শিল্প-সংস্কৃতির ধারকবাহকদের মধ্যে লেখাগুলো পৌঁছে যাক এমন প্রত্যাশা একজন পাঠক হিসেবে করাই যায়। 

মাত্র ৫৫ বছর বেঁচেছিলেন তারেক মাসুদ। একজন বাংলাদেশি স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার তিনি।

২০১১ সাল। ১৩ আগস্ট। সেই ভয়াল দিন। যে দিনে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পুরো চলচ্চিত্র টিম। ‘কাগজের ফুল’ নামক চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন দেখতে যান তাঁরা। মানিকগঞ্জের সালজানা গ্রাম। সেখান থেকে ফিরছিলেন; কিন্তু ফেরা আর হয়নি! ঘিওরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে উল্টো দিক থেকে বাস এসে তাঁদের মাইক্রোবাসটিকে ধাক্কা দেয়, মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই পৃথিবীর সমস্ত সুখ-দুঃখকে বিদায় জানিয়ে চলে যান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর। পুরো চলচ্চিত্রজগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন আরও যাঁরা প্রাণ হারান—ওয়াসিম, সেট ডিজাইনার জামাল হোসেন ও মাইক্রোবাসের চালক মোস্তাফিজ। আহত হন ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন ও তাঁর স্ত্রী চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলি।

তারেক মাসুদ বাংলা ভাষার অন্যতম চিন্তাশীল চলচ্চিত্রকার। এটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়; তিনি বহুমুখী চিন্তাশীল কাজের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। যার আভাস পাওয়া যায় ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বইটিতে। এটি তাঁর লেখার সংকলন। এখানে মোট ৩৮টি প্রবন্ধ রয়েছে। যে প্রবন্ধগুলো পড়লে তাঁর চিন্তাচেতনা এবং দর্শন সম্পর্কে জানা যাবে। 

এ বইটিতে যে লেখাগুলো রয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, চলচ্চিত্র সংস্কৃতিসহ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের আত্মানুসন্ধানে তারেক মাসুদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। 

এটি এমন এক বই যেটি যে কোনো চিন্তাশীল পাঠকের জন্য পাঠ্য। একই সঙ্গে কারো যদি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহবোধ থাকে এবং তা নিয়ে গবেষণা করতে চান তাহলে এটি পাঠ্য। তারেক মাসুদের চিন্তা ও দর্শনকে আয়ত্ত করতে চাইলেও এটি পাঠ্য। এ বইটি পাঠককে সমাজ ও মানুষের জন্য নিবেদিত হতে উৎসাহিত করবে। কীভাবে একজন মানুষ তার পিএইচডি ডিগ্রির মায়া ত্যাগ করে সেটি জানাবে বইটি। 

‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বইটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন ক্যাথরিন মাসুদ, নাহিদ মাসুদ, প্রসূন রহমান এবং বেলায়াত হোসেন মামুন। তারা সবাই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই বিশাল বইটি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। এটি ২০২১ সালের প্রকাশনা।   

৩৮টি প্রবন্ধ নিয়ে বইটি হলেও পাঠকের কাছে এটি সাজানো পাওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে কাজটি সাবলীলভাবে সম্পাদকমণ্ডলীরা করছেন। এটির শ্রেণিবদ্ধকরণ দেখলেই উপলব্ধি করা যায়, সম্পাদনার মান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সম্পাদনা কাজটি খুব কঠিন এবং দুঃসাধ্য। এটি ঠিকঠাক মতো না করতে পারলে, বইয়ের নিজস্বতা দাঁড়ায় না। সে হিসেবে এটির সম্পাদনা উল্লেখ করার মতো। ৩৮টি প্রবন্ধকেই বিষয়ভিত্তিকভাবে মোট আটটি অধ্যায়ে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাসঙ্গিক আলোকচিত্র। যা বইটিকে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলবে পাঠকের কাছে। 

‘আমাদের চলচ্চিত্র’ অধ্যায়ে “যেভাবে ‘আদম সুরত’” প্রবন্ধটি শিল্পী এসএম সুলতানের জীবনচরিত নিয়ে। কিন্তু তথাকথিত জীবনীমূলক লেখা কিংবা ফিল্ম সেটি ছিল না। এটি করতে গিয়ে তারেক মাসুদকে দুই বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। টাকার সংকট, জিনিসপত্রাদির অভাবে প্রায় ছন্নছাড়া অবস্থা চলছিল। এর মধ্যে অনেকের টিটকারি এবং অনুৎসাহিত করার গল্পও রয়েছে। 

১৯৮২ সালে ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে স্কলারশিপও হয়ে গিয়েছিল তারেক মাসুদের। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ তখন ক্ষমতায় আসে। ঐ মুহূর্তে তারেক মাসুদ ভারতের রাজনীতির বিরোধিতা করেন। যে কারণে তাঁর স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। 

ভেতরের অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে কাউকে দমানো যায় না। সেটি তারেক মাসুদদের মতো ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে নেওয়া। তিনি ফিল্মের ওপর পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। 

শিল্পী এসএম সুলতান তখন তাঁদের কাছে এক বিস্ময়। কিংবদন্তি। তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আহমদ ছফার একটি লেখা নিয়ে শিল্পী এসএম সুলতানের জীবনের ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে বিদেশে যাওয়া এবং প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার চিন্তা মাথায় পেয়ে বসে। 

শিল্পী এসএম সুলতান হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে হাসপাতালের ভর্তি করা হয়। একথা চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন তাঁকে জানায় এবং বাইরে যাওয়ার বিষয়টিতে ভাবার কথা বলেন। ইতিমধ্যে বিদেশ যাওয়ার সমস্ত কাগজপত্র রেডি।

বই থেকে তুলে ধরছি ‘...তারপর জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কাকতালীয়ভাবে বাসটি সেদিন আসতে অনেক সময় নিয়েছিল। বাসটা এত দেরি না করলে হয়তো মাথার মধ্যে এত উল্টো বুদ্ধি তার আসত না। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিদেশে যাব না, ওই টাকা দিয়েই সুলতানের ওপর ছবি বানানো শুরু করে দেব।...’ 

এই কয়টি লাইন থেকেও একজন মানুষের চিন্তাচেতনা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। জীবনে হয়ত পিএইচডি করার মতো বহু সময় পাওয়া যাবে; কিন্তু এসএম সুলতানকে পাওয়া যাবে। যে চিন্তা করার মতো দুঃসাহস বর্তমান চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে নেই বললেই চলে। 

এভাবেই তৈরি হয় ‘আদম সুরত’। তাঁর জীবনের প্রথম সিনেমা। কিন্তু এটি করতে গিয়ে বারবার তাঁর মনে হয়েছে, ইচ্ছা ও চিন্তার জগত থেকে বাস্তবজগত অনেক ভিন্ন। যেখানে প্রতিনিয়ত পাড়ি দিতে হয় কণ্টকাকীর্ণ পথ, হাজারও বাধা অতিক্রম করেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। তিনি মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে সিনেমাটি সম্পন্ন করতে নেমেছিলেন। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে আসলে সিনেমার সিকিভাগও হয়নি। ধার-দেনা করেই শেষ পর্যন্ত কাজটি করেছিলেন। এ প্রবন্ধটি পড়লে সেই ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জানা যাবে। যা খুবই স্পর্শকাতর এবং শিক্ষণীয়। 

শিল্পী এসএম সুলতান এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁর একটি ফুটেজের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। যে কারণেই এটি একটি ইতিহাস হয়ে আছে। এ প্রবন্ধে তিনি আরও বলেছেন ‘পাঠককে মাথায় রাখতে হবে, ছবিটি আমি সাত বছর ধরে নির্মাণ করেছি। এটি এক অর্থে আমার জন্য শাপে বর হয়েছে—কোনো নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট নিয়ে হয়তো কাজটি শুরু করিনি। যে সময়ে কাজটির শুরু, তখন অভিজ্ঞতা, বয়স—অনেক ক্ষেত্রেই আমি কাঁচা ও অপরিণত।...’ 

কতটা শিক্ষার মনোভাব পোষণ করলে, বিনয়ের শিক্ষক হলে একটি মানুষ এভাবে লিখে যেতে পারেন! অধ্যায়গুলো পড়ছিলাম আর চিন্তা করছিলাম—এমন একজন মানুষকে আমাদের বড়ই প্রয়োজন ছিল! এভাবেই পৃথিবীর ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের আমরা হারাই, প্রতিনিয়ত হারাই। সড়ক দুর্ঘটনায়, খুন-খারাবিতে এবং রাহজানিতে। 

বর্তমান সময়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সময় ব্যয় করে সর্বোচ্চ এক বছর। সেখানে একটি প্রামাণ্যচিত্র দাঁড় করাতে লেগেছে সাত বছর! যদিও চলচ্চিত্রকার এটিকে ‘চিত্রনাট্য’ না বলে ‘নাট্যহীন চিত্র’ই বলেছেন। 

তখনকার দিনে বহির্বিশ্বে ‘সিনেমা-ভেরিতে’ নামের আন্দোলন চলছিল। এটির বৈশিষ্ট্য ছিল দ্রুততার সঙ্গে সিনেমা শেষ করা এবং রাফ অবস্থাতেই সেটি দেখানো। তখন তিনি বলছেন, আমি নতুন একটা আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে, ‘সিনেমা দেরিতে’। কি সুন্দর চিন্তার প্রকাশ! কতটা সাবলীল ভাবনাশক্তি থাকলে এরকম চিন্তাশক্তির প্রকাশ ঘটতে পারে! 

‘আদম সুরত’ করতে গিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত শিখেছেন। শুধু গ্রামবাংলা নয়, শিল্প ও জীবন সম্পর্কেও জেনেছেন এবং শিখেছেন। যেটিই তাঁর জীবনের পথচলাকে আরও বেশি সাবলীল করে তুলেছে। খুব দ্রুত চলচ্চিত্রকার হওয়া এবং নাম বা যশের পেছনে ছোটার মানসিকতা থেকেও মুক্ত করতে পেরেছিলেন নিজেকে। 

ওই অধ্যায়েই ‘সুলতান কেন’ বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছেন। আরও রয়েছে “‘মুক্তির গান’-এর গল্প”, ‘আমাদের মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা ও ব্রাত্যজনের কথা ইতিহাস’, ‘মুক্তির গান, মুক্তির কথা ও তৃতীয় প্রচেষ্টা’, “বিশ্বসভায় ‘মাটির ময়না’” এবং ‘অন্তর্যাত্রা, বহির্যাত্রা’। এগুলো সবই প্রথম অধ্যায়ের বিষয়ভিত্তিক লেখা। এরপরেও আরও সাতটি অধ্যায় রয়েছে, যেগুলোর আবার আলাদা আলাদা বিষয় রয়েছে। 

‘সুলতান কেন’ অধ্যায়টি পড়ে যেটি উপলব্ধি করা যায়, তিনি মূলত জীবনটাকে অভিজ্ঞতাসঞ্জাত করে তুলেছিলেন। তিনি কৃষকের জীবনকে শুধু চিত্রের মধ্যেই রাখতেন না, এটি জীবনে চলার পথে ধারণ করতেন। তিনি নারীকে শুধুমাত্র শিল্পীর রূপ দেননি, কৃষকের স্বপ্নের নারী হিসেবে ভাবনায় স্থান দিয়েছিলেন। তিনি শিল্পের মাধ্যমে কৃষিসমাজকে মহিমান্বিত করেছেন, এটি পড়লে পরিষ্কার হওয়া যায়। 

এখানে কথা রয়েছে ঊনসত্তরের গণজাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা নিয়ে। যে সম্পৃক্ততায় জড়িয়ে রয়েছে এসএস সুলতানের শিল্পীসত্তা। তাঁর আঁকা ‘গণহত্যা’ চিত্রকর্মটির গুরুত্বও তুলে ধরেছেন তারেক মাসুদ তাঁর লেখনীতে। 

প্রতিটি লেখাই একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। প্রতিটি লেখা নিয়ে আলাদা মূল্যায়ন করতে গেলে আরও একটি বইয়ের কাঠামো দাঁড়িয়ে যাবে। যেটি করা সম্ভবও। সবচেয়ে যে বিষয়টি আকৃষ্ট করেছে, তা হলো এখানে অবাঞ্ছিত শব্দচয়ন নেই, যে শব্দের ভিড়ে পাঠক তার মনোযোগ হারাতে পারে। যেকোনো পাঠক তার নিজস্ব চিন্তাশক্তি দিয়েই এক একটি লেখা পড়ে শেষ করতে পারবেন। সহজ-সাবলীল এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়আশয়ের মেলবন্ধন এত সুন্দরভাবে করাটা সত্যিই দুঃসাধ্য। যা একজন সহজ মনের ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব। 

‘মাটির ময়না’ সিনেমা দেখে প্রশংসা করেননি এমন দর্শক পাওয়া মুশকিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারপ্রাপ্ত সিনেমা। এর অনুভূতি তারেক মাসুদ যেভাবে প্রকাশ করেছেন, ‘এ রকম একটি বিশাল প্রাপ্তি শুধু আমার জন্য নয় বা আমার ছবির জন্যই নয়, এটা পুরো জাতির জন্যই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিজয়, এই আনন্দ আমরা উপভোগ করতে পারিনি। কারণ, আমরা যখন কানে পৌঁছাই, এর মধ্যেই ছবিটি দেশে নিষিদ্ধ হয় সেন্সর বোর্ডের কল্যাণে। অত্যন্ত বেদনাহত মন নিয়ে এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা উৎসবের দিনগুলো কাটিয়েছি নিজ দেশে ছবিটির দুর্ভাগ্যের কারণে।...’ এরপর তিনি লিখেন ‘...শুধু আমি আর ক্যাথরিন মাটির ময়না নিয়ে কানে যাইনি। আমি খুবই আনন্দিত যে মাটির ময়নার একটা বড় দলকে আমি কান উৎসবে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। সেটা অবশ্য কান উৎসবের কল্যাণে এবং ফরাসি সরকারের বদান্যতায়...’। 

‘জীবন ও স্মৃতি’ অধ্যায়কে আবার তিনটি বিষয়ে শ্রেণিবদ্ধকরণ করা হয়েছে। যথাক্রমে “তবে আমিও ‘কুয়াশা’ ছিলাম”, স্মৃতিতে অম্লান আলমগীর কবির’ এবং ‘সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি’। এই অধ্যায়ের ‘সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি’ পড়তে গিয়ে বারবার ধাক্কা খেয়েছি। 

কলকাতার ‘চিত্রবাণী’ নামের এক প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানের আহ্বানে তিনি ১৯৮৫ সালে কলকাতা যান। সেখানকার তাঁদের প্রধান প্রশিক্ষক ফাদার গাঁস্তের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছিল ঘনিষ্ঠতা। এটি জানার পর থেকেই তারেক মাসুদ বায়না ধরেন, তাঁর প্রিয় ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করার, শুধু দেখা নয় দীর্ঘ আলোচনা করার আগ্রহও প্রকাশ করেন তিনি। 

সে ঘটনার স্মৃতিচারণ তিনি যেভাবে করেছেন, ‘সারারাত উত্তেজনায় ভালো ঘুম হলো না। অনেকগুলো বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন মনে মনে মুখস্থ করলাম। যথাসময়ে তাঁর বাসায় পৌঁছলাম। যেন সিনেমার শিল্পনির্দেশিত সাজানো সেটে সত্যজিৎ বসে আছেন। ডানে-বাঁয়ে-পেছনে বই আর কাগজপত্র। বাঁ কাঁধের গা ছুঁয়ে খোলা একটি বড় জানালা। সকালের তির্যক অথচ নরম আলো তাঁর মুখের একদিকে এসে পড়েছে। যেন ছবি তোলার জন্য লাইট ঠিক করা আছে, ফোকাস আর অ্যাপারচার ঠিক করে শাটার চাপলেই অসাধারণ ছবি!’ 

এই বর্ণনা পড়ার পর তাঁর সাহিত্যমানের বিষয়টি আরও চমৎকৃত হলো। একটি মানুষ কত গুণে গুণান্তিব হতে পারেন! কত সুন্দরভাবে ঘটনার বর্ণনা দিলেন, যা যেকোনো মানুষকে শব্দচয়ন-বাক্যগঠনও শেখাবে। 

এরপর তাঁদের আলাপচারিতা চলতে থাকল। সত্যজিৎ রায় একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলেন। তিনিও পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। সেভাবেই একের পর এক উত্তর দিলেন। 

‘সত্যজিৎ ও রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে ইতিহাসের দুজন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের কথা লিখেছেন। ঠাকুর ও রায় পরিবারের বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার কথা বলেছেন তিনি। যা পড়লে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে এই দুই পরিবারের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন ‘ঠাকুর ও রায় পরিবারের ইতিহাস কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার পুরো ইতিহাসের একটি অনুকৃতি। সারা বাংলায় উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুত্ববাদী প্রতিশোধপরায়ণতার বিপরীতে শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ নামে একটি সংস্কারধর্মী আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। এ সমাজ থেকে নতুন একটি উদ্যমী, উদার ও সৃষ্টিশীল চেতনার উত্থান ঘটে। সব ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপারে মুক্তমনা অবস্থান এ সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ কারণে তারা বাঙালি রেনেসাঁর নেতৃত্বে পরিণত হয়।’ 

তাঁর এ নিবন্ধ থেকে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ রায়ের চিন্তার সূক্ষ্মতা। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুর পর বহু জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত প্রতীকে পরিণত হন। সত্যজিৎ রায় অবশ্যই এ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এখানে আরও একটি বিষয় বোঝা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠানমুখিতা আর সত্যজিৎ রায়ের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। যা তারেক মাসুদ তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন। 

‘চলচ্চিত্র সংস্কৃতি অধ্যায়ে ‘সমকালীন চলচ্চিত্রের সংকট’ নিবন্ধটি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের পাঠ করাটা জরুরি। কীভাবে মৌলিক গল্প ও ভালো চিত্রনাট্য কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে এবং বাণিজ্যপ্রধান ছবিতে ফর্মুলা ও নকল কাহিনি চিত্রনাট্যের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে সেসব ইতিহাস জানার জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। 

হিন্দি ছবির শট ডিভিশন কীভাবে নকল করে সিনেমা বানাচ্ছে, সেসব আবার সেন্সর বোর্ডে ছাড়া পাচ্ছে। একই সঙ্গে পুরস্কারও পাচ্ছে! এসব বিষয়ে এ নিবন্ধে তিনি তাঁর অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যা একজন চলচ্চিত্রপ্রেমীর জানাটা জরুরি। কেননা ইতিহাস না জানলে সবকিছু ভাসাভাসা হয় এবং যার ভিত একসময় নড়বড়ে হয়ে ভেঙে যায়। তিনি লিখেছেন চলচ্চিত্র আর্ট না ইন্ডাস্ট্রি অর্থে শিল্প, তা নিয়ে কুতর্ক থাকলেও এটা যে একটি কারিগরি মাধ্যম, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। অথচ কারিগরি ব্যাপারে ঢালিউড কেন, আমরা যারা স্বাধীনধারার নির্মাতা, তারাও যথেষ্ট সজাগ নই। আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই, চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি কৃৎকৌশল ও যন্ত্রাদি কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কেবল চলচ্চিত্র নয়, সব শিল্পমাধ্যমে ডিজিটাল টেকনোলজির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়েছে।...’ তাঁর এ লেখায় একই সঙ্গে ক্ষোভ এবং বিশ্বকে জানার অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। তিনি স্পষ্টভাবেই সুস্থ বিনোদন এবং সমাজমনস্ক চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। যে বিষয়টিকে বর্তমান নির্মাতাদের মধ্যে অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। যে কারণেই চলচ্চিত্রের আজকে এত দূরবস্থা। 

তারেক মাসুদ ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ’ নিয়েও মত ব্যক্ত করে গেছেন। যেসব কারণেই এটি একটি গুরত্বপূর্ণ এবং তথ্যবহুল বই। যেটি পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া উচিত এবং বিভিন্নমাধ্যমে নিজ দায়িত্বে প্রচার করাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় চলচ্চিত্রের যা অবস্থা তা নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়া যায় না। সেটি তারেক মাসুদ বেঁচে থাকতেই বলে গেছেন। তাঁর বিচক্ষণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ নিবন্ধটিতে। এফডিসি যে ব্যর্থ, কারিগরিভাবে অকার্যকর, শৈল্পিকভাবে অসফল ছবি নির্মাণের পথে হাঁটছেন সেটি তিনি বহু আগেই বলে গেছেন। যার প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া। বাংলা সিনেমার প্রতি মানুষের বিরক্তিবোধ চলে আসা। এসব হচ্ছে একমাত্র শৈল্পিকতার অভাবের কারণে। বাংলাদেশের ফিল্ম আর্কাইভগুলোর ভয়ংকর দুরাবস্থার কথাও তিনি তুলে ধরেছেন এ নিবন্ধটিতে। তিনি লিখেছেন ‘... বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, যা হওয়ার কথা ছিল শুধু চলচ্চিত্র নয়, জাতীয় স্মৃতির সংরক্ষণাগার, তা পরিণত হয়েছে সিনেমার মহাশশ্মানে। আশির দশকে যখন আর্কাইভ নির্বাসিত হয়েছিল, তখন জহির রায়হান, আলমগীর কবিরসহ অন্যান্য সৃজনশীল নির্মাতার অনেক মূল্যবান ছবি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ...’ এজন্য তিনিই ইতিহাসের অমূল্য ব্যক্তিত্ব। যিনি ইতিহাসকে ধারণ করেছেন এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়বোধ থেকে লিখেই গিয়েছেন একাধিক নিবন্ধ-প্রবন্ধ। 

একের পর এক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জাতীয় মর্যাদা হারিয়ে বিজাতীয় ছবির পৃষ্ঠপোষকে পরিণত কীভাবে হয়েছে, তার ইতিহাসও তিনি তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে কীভাবে ফিল্ম ফেডারেশনগুলো বিনষ্ট হয়েছে, বিভক্তি হয়েছে; ভেঙে পড়েছে সংস্কৃতির সুস্থ কাঠামো। এসব সত্যকে তিনি লেখনীর মধ্য দিয়ে উন্মোচন করেছেন। যেটি পেরেছেন দৃঢ় চিন্তা থাকার কারণে। 

মধ্যবিত্তসহ প্রায় শ্রেণির মানুষ যে সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, সে দায় তিনি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকেই দিয়েছেন। আকাশসংস্কৃতি ও ন্যূনতম বিনোদন সফল ছবি নির্মাণের অভাবেই যে এ দৃশ্য দাঁড়িয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনিও তাঁর লেখায় এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। এভাবে কাটপিস করে যে শিল্পসংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা যায় না, একসময় ভেঙে পড়ে সেটি তিনি বুঝেছিলেন। যে ইন্ডাস্ট্রি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে আছে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বানী করে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। আবার একই সঙ্গে স্বপ্ন বুনেছিলেন ‘এই ছাইভস্ম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প।’ 

তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যতকে সুন্দর ও গঠনমূলক করার জন্য ইন্ডাস্ট্রিকে দায় নেওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে এর অবকাঠামোর ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে আশাহতও হয়েছেন। তিনি চলচ্চিত্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের তাগিদ অনুভব করেছিলেন। যেসব বিষয় নিয়ে তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। চলচ্চিত্রশিল্পের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি কাঠামো নিয়েও রয়েছে তাঁর একাধিক মত। যা বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের জানাবোঝা উচিত। চলচ্চিত্রমাধ্যম যে কেবল একটি ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পই নয়, রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ বাহনও সেটিও তিনি বলে গেছেন। একজন মানুষ তাঁর সেক্টরের সমস্ত ভালোমন্দ নিয়ে ভেবেছেন। কখনও কষ্ট পেয়েছেন, আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। আবারও কখনও আশায় বুক বেঁধেছেন, স্বপ্ন বুনেছেন। যে স্বপ্নের কারণেও আজও তিনি মানুষের চেতনা দখল করে আছেন। এটিই তাঁর সৃষ্টির বিশালত্ব। নিজস্ব কর্মের পরিচয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দ আর নেই। সেটি ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের জীবনচরিত ধারণ করলেই বোঝা যায়। 

‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বইটি পড়তে গিয়ে আমার নিজেকে কেন জানি চলচ্চিত্রের পাঠক হিসেবে মনে হচ্ছিল। এটাও লেখকের পাওনা। যে লেখক তাঁর লেখনীর ভেতরে পাঠককে ডুবিয়ে ফেলতে পারেন, সেই মূলত জনগণের লেখক। যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলে না, অবকাঠামোর কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না, সে শিল্প আর যাইহোক গণমানুষের হতে পারে না। তারেক মাসুদ বইটিতে চলচ্চিত্রের সঙ্গে কীভাবে সমাজ ও মানুষের মেলবন্ধন সেটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলেছেন। সিনেমাশিল্পের সঙ্গে সিনেমাহলগুলোর অবক্ষয় নিয়ে মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি মধ্যবিত্তশ্রেণির জন্য সিনেমাহলগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন এবং সেটি ইন্ডাস্ট্রিগুলো চেষ্টা করলে সম্ভব সে আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। 

একজন চরম আশাবাদী-পরিশ্রমী-স্বপ্নালু মানুষ ছিলেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। সেটি তাঁর এই বই পড়ে আরও বেশি স্পষ্ট হলো। তিনি যে কত গভীরভাবে ভেবেছেন, তা তাঁর লেখাগুলো না পড়লে উপলব্ধি করা মুশকিল। কেন এ বইটি বার বার পাঠ্য বলে উল্লেখ করছি, তার কারণ এগুলোই। শিল্পকে তিনি মানুষের চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। প্রতিকূল পরিবেশই যে কোনো আন্দোলনের জন্য সফলতা বয়ে আনে, সেটি তারেক মাসুদের এই বইতে প্রকাশিত।  

 

বই: চলচ্চিত্রযাত্রা

লেখক: তারেক মাসুদ

প্রকাশক: কথাপ্রকাশ

প্রকাশকাল: ২০২১

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা

মূল্য: ৪০০