বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে যে গভীর সুসম্পর্ক ছিল, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। রবীন্দ্রনাথ যেমন অনুজ নজরুলের প্রতি আশীর্বাণী প্রদান করে প্রীত হয়েছেন, তেমনি নজরুলও অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে হয়েছেন ধন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। সেসময় কারাগারে ছিলেন নজরুল। বইটি পেয়েই নজরুল বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন, “এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।” নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন তাঁর রবীন্দ্রনাথকে।
সময়টা ১৯৩১-এর মাঝামাঝি। সেবার দার্জিলিংয়েই ছুটি কাটাতে গিয়েছেন নজরুল। সঙ্গে বন্ধু নাট্যকার মন্মথ রায়, সাহিত্যিক অখিল নিয়োগী আরও অনেকে রয়েছেন। ইচ্ছে, পুরো গরমকালটা বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ আর সাহিত্য চর্চা করে কাটানো হবে। গান কবিতা আর নজরুলের প্রাণখোলা হো হো হাসিতে দার্জিলিংয়েরর পাহাড় ভরে উঠছে রোজ। এমনই এক আড্ডার সন্ধেয় কে যেন খবর দিলেন, কাজী শুনেছ কি তোমার গুরুদেবও সপরিবার দার্জিলিংয়েই রয়েছেন এখন’।
শোনামাত্র নজরুল হারমোনিয়াম থামিয়ে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, দে গরুর গা ধুইয়ে, গুরুদেব এসেছেন!
মন্মথ বললেন, কাজীদা, গুরুদেবের সঙ্গে একদিন দেখা করার ব্যবস্থা করুন না। আমরা পায়ের ধুলো নিয়ে ধন্য হই।
নজরুল যেমন, আরে গুরুদেবের পায়ের ধুলো নেওয়ার আবার দিনক্ষণ দেখার দরকার কী? কাল ভোরেই রওনা দেওয়া হবে সদলবলে। চালাও পানসি বেলঘরিয়া।
পরদিন সত্যিই ভোরে নজরুলকে দলপতি করে সকলে পৌঁছোলেন কবির গৃহে। তখন কবির সঙ্গে দীনেন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী আরও অনেকে রয়েছেন।
নজরুল এসেছেন সেই খবর দেওয়া হলো কবিকে। তার কয়েক মুহূর্ত পরে কবিগুরু নিজেই নেমে এলেন নীচে। হাতে কলমটা পর্যন্ত ধরা। কিছু লিখছিলেন বোধহয়, নজরুল এসেছে শুনে আর অপেক্ষা করেননি। কী কাণ্ড তুমি এখানে, এসো এসো!
হ্যাঁ গুরুদেব চলে এলাম পায়ের ধুলো নিতে।
বেশ করেছো। এসো।
মন্মথ দেখছিলেন কাজীদাকে দেখে কবিগুরুর মুখখানি খুশিতে ভোরের আলোয় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
তারপর শুরু হলো গল্প। কবির পায়ের সামনে বসে সকলে। বক্তা শুধু রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। বাকিরা সকলেই শ্রোতা। নজরুল এখন কী জাতীয় গান লিখছে, কেমন রয়েছে, এরপর কী লেখার ইচ্ছে সব কিছু খুঁটিয়ে জানছেন গুরুদেব। তারপর দেশে নতুন কী সাহিত্য রচনা হচ্ছে তা থেকে বিদেশি সাহিত্যের দিকেও আলোচনা ঘুরে গেল।
সব শেষে গুরুদেব বললেন, শান্তিনিকেতনে এসো একদিন।
নজরুলের চটপট উত্তর, হ্যাঁ গুরুদেব, নিশ্চয়ই যাব।
শুনে হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। মনে মনে আবার ভাবলেন, ছেলেটিকে যদি শান্তিনিকেতনে বাঁধন দিয়ে রেখে দেওয়া যেত, তাহলে আশ্রমের ভোলই যেত পালটে, কিন্তু ধূমকেতুকে কি আর এক জায়গায় বেঁধে রাখা যায় কখনও? কিন্তু সেই চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। আসছি সেই গল্পে।
একেবারে ইশকুল বেলা থেকেই গুরুদেব বলতে অজ্ঞান নজরুল। রবীন্দ্রনাথের নামে এতটুকু খারাপ কথা বলার জো নেই তার সামনে। বন্ধুরা জানত দুখু মিয়াকে খ্যাপানোর একটাই উপায় রবীন্দ্রনাথের নিন্দা করা। ব্যাস। একবার হলো কি, গ্রামের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল পেটাচ্ছে নজরুল। হঠাৎ এক বন্ধু দুখুকে রাগানোর জন্য বলে উঠল, ধুর, রবিঠাকুর আবার কবি হলো নাকি? ওর থেকে আমাদের ইশকুলের নিতাই মাস্টার ভালো লেখে।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। ছেলেটি রবিঠাকুরকে আরেকবার বাজে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গোলপোস্টের বাঁশ তুলে সটান তার মাথায় বসিয়ে দিল নজরুল। মাথা ফেটে রক্তারক্তি, সেলাই।
হ্যাঁ, এমনই ছিল তাঁর গুরুভক্তি। কেউ গান গাইতে বললেন, ওমনি দরাজ গলায় একের পর এক রবিঠাকুরের গান। ইশকুলের মাস্টারমশাইরাও অবাক! ছেলেটার কি গুরুদেবের সব গানই মুখস্থ!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে যুদ্ধে গেলেন নজরুল। সঙ্গে রবীন্দ্রস্বরলিপি। সেনা শিবিরেই জমিয়ে দিলেন গান বাজনার আড্ডা। গান মানে গুরুদেবের গান। ওই করাচির শিবিরে বসেই একের পর রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি তুলে ফেলেছিলেন।
তারপর যুদ্ধ শেষে যখন কলকাতার সাহিত্যজগতে এসে ভিড়লেন তখন বন্ধুরা তাঁকে ডাকতেন ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাফিজ’ বলে (কোরান যার পুরো মুখস্থ থাকে তাকে হাফিজ বলা হয়)।
একদিন গজেন ঘোষের আড্ডায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বললেন, কাজী গুরুদেব আপনার কথা বলছিলেন।
মানে! আমাকে চেনেন উনি! হতবাক নজরুল।
চেনেন মানে! আপনার বিদ্রোহী পড়ে তিনি মুগ্ধ। আমরা পড়েছি কি না সেই কথাও জিজ্ঞাসা করছিলেন।
তাই শুনে নজরুলের আনন্দ আর ধরে না। একদিন দেখা করা যায় গুরুদেবের সঙ্গে?
কেন যাবে না? তিনিও অপেক্ষা করে রয়েছেন আপনার জন্য।
এরপর আর কী অপেক্ষা চলে? কিন্তু বন্ধু পবিত্র (গঙ্গোপাধ্যায়), শৈলজানন্দ (মুখোপাধ্যায়) আরও অনেকে বলল, তবে সাবধান কাজী, গুরুদেবের ওখানে গিয়ে কিন্তু তোমার এই হৈ- হুল্লোড় চলবে না।
আরে না না আমি একদম শান্ত থাকব।
রবীন্দ্রনাথ তখন প্রায় চৌদ্দ মাস ইউরোপ ভ্রমণ সেরে জোড়াসাঁকোতে কিছুদিন রয়েছেন। সেই খবর পেয়ে নজরুল বন্ধুদের সঙ্গে চললেন গুরুদর্শনে। বন্ধুদের মনে ভয়, কাজীকে কোনও ভরসা নেই। ওখানে পৌঁছে কী কাণ্ড করবে কে জানে?
কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়েই নজরুল গুরুদেবের কাছে গিয়ে প্রথমে অপলক কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তার আজীবনের আরাধ্যর দিকে। তারপর শান্তভাবে তাঁর পায়ের সামনে বসে পড়লেন।
গুরুদেব বললেন, তোমার বিদ্রোহী তোমার কণ্ঠে শুনি।
নজরুল আদেশ পাওয়া মাত্র শুরু করলেন।
রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন একুশ-বাইশ বছরের ঝাঁকড়া চুল অপরিমেয় স্বাস্থ্যের ছেলেটি গোটা শরীর দুলিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করছে –
বলো বীর—
বলো উন্নত মম শির—
শির নেহারি আমার নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।
আবারও মুগ্ধ হলেন কবি। এই যুবক যে বাংলা কবিতায় নবযুগ আনতে চলেছেন সেই বিশ্বাস তাঁর আরও দৃঢ় হলো। আবৃত্তি শেষে নজরুল বললেন, গুরুদেব এবার আপনার একটি গান শুনি।
রবীন্দ্রনাথ অনেক ওজর আপত্তি করলেন, কিন্তু নজরুলকে এড়ানোর সাধ্য স্বয়ং গুরুদেবেরও নেই। গাইলেন কবি। নজরুল, পবিত্র, শৈলজানন্দ সকলে মন্ত্রমুগ্ধ। কী অপূর্ব সংগীত। জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল।
এবারে তুমি গাও শুনি।
গুরুর আদেশ পাওয়া মাত্র নজরুল শুরু করলেন,
জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।
গান শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, তুমি চারণ কবি। তোমার জায়গা কলকাতা নয়। চলো আমার সঙ্গে শান্তিনিকেতন। ওখানে মনের আনন্দে খাবে দাবে ঘুরে বেড়াবে আর গান গাইবে।
নজরুল তখন অর্থাভাবে জর্জরিত, নিদারুণ অবস্থা। এই প্রস্তাব তার কাছে স্বপ্নাতীত। গুগুদেবের আদেশ সরাসরি অমান্য করলেন না ঠিকই, কিন্তু পরে বন্ধুরা যখন জিজ্ঞাসা করলেন তখন ‘বাঁধন হারা নায়কের সাফ উত্তর, ‘এই বেশ রয়েছি। খাই না খাই মনের আনন্দে গান গাই। এই স্বাধীনতা হারাতে চাই না’।
শুধু কবিতা নয়, পরাধীন জাতিকে মুক্ত করার জন্য সাময়িক পত্রও প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকে ঠিক হলো নজরুলের সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ হবে। সব আয়োজন প্রস্তুত। হঠাৎ নজরুলের মনে হলো তাঁর পত্রিকায় গুরুদেবের আশীর্বাদবাণী থাকবে না, তাই কখনও হয়? ভাবামাত্র টেলিগ্রাম গুরুদেবকে। রবীন্দ্রনাথও কি তার প্রিয় শিষ্যের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে আশীর্বাণীতে লিখলেন—
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।
গুরুদেবের শুভেচ্ছাবার্তা পেয়ে নজরুলের সে কী উচ্ছ্বাস! ঠিক হলো, শুধু প্রথম সংখ্যায় নয়, ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠাতেই গুরুদেবের এই শুভেচ্ছাবার্তা ব্লক করে ছাপানো হবে। প্রথম সংখ্যাতেই ধূমকেতু হৈ চৈ ফেলে দিল শহরে। যেমন জ্বালাময়ী লেখা তার ওপর আবার প্রথম পৃষ্ঠায় বিশ্বকবির বার্তা। যে ক-দিন ধূমকেতু প্রকাশ পেয়েছিল প্রতি সংখ্যাতেই থাকত
…উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে।
নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। ধূমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সশ্রম দণ্ডিত। রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে। নজরুলের খবর নিয়ে তারপর উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে পবিত্রকে যা বললেন তা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের জবানিতেই শোনা যাক—
গুরুদেব বললেন ‘জাতীর জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল। এই আমার সদ্য প্রকাশিত বসন্ত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম। কিন্তু যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো। আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও’।
ঠাকুর পরিবারের বা ব্রাহ্মসমাজের বাইরের কাউকে রবীন্দ্রনাথের কোনও বইয়ের উৎসর্গ সেই প্রথম।
গুরুদেব বইতে স্বাক্ষর করে পবিত্রের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তাকে বলো আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশির্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগানোর কবিও তো চাই’।
কবির বার্তা আর বই নিয়ে জেলখানায় ছুটল নজরুলের প্রাণের বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়। বই হাতে নিয়ে উৎসর্গপত্রে চোখ পড়তে নজরুল দেখলেন সেখানে লেখা রয়েছে—
উৎসর্গ- শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু, ১০ই ফাল্গুন ১৩২৯।
তাই দেখে আনন্দে লাফাতে শুরু করলেন নজরুল। বইটা একবার কপালে ঠেকায় একবার বুকে চেপে ধরে। আনন্দ কী করে প্রকাশ করবে বুঝে পায় না। বন্দির এমন প্রবল উত্তেজনা দেখে ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার পবিত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী?
পবিত্র উত্তর দিলেন, পোয়েট টেগোর ওকে একখানা বই উৎসর্গ করেছেন।
সাহেব ভাবলেন, ছেলেটি ডেডিকেট আর প্রেজেন্ট-এর পার্থক্য বোঝে না। তাই সে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ইউ মিন প্রেজেন্টেড?
নো স্যার নট প্রেজেন্টেড, ডেডিকেটেড।
ওয়ার্ডার বিস্মিত। ‘ইউ মিন দ্য কনভিক্ট সাচ অ্যান ইম্পর্ট্যান্ট পার্সন?
ইয়েস, আওয়ার গ্রেটেস্ট পোয়েট নেক্সট টু টেগোর। সদর্পে উত্তর দিলেন পবিত্র।
কিন্তু নজরুলের মতো এক অর্বাচীন কবিকে আস্ত বই উৎসর্গ করে ফেললেন কবিগুরু! এমন হঠকারিতা অনেক রবীন্দ্র পারিষদেরই সহ্য হয়নি। সরাসরি প্রশ্নও করে ফেললেন কবিকে।
তাদের উত্তর দিলেন রবীন্দ্রনাথ ‘জানি তোমাদের মধ্যে কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ-রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র’।
তরুণ কবির প্রতি এই ভরসাই রবিঠাকুরের অপর নাম।
আবার টেলিগ্রাম করতে হলো রবীন্দ্রনাথকে। এবার অনুরোধ। নজরুল তখন হুগলি জেলে। রাজবন্দিদের প্রতি জেলরের অকথ্য অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন করলেন। ৪০ দিন পেরিয়ে গেল অনশনের। নজরুলের প্রাণ যায় যায়। শত চেষ্টা, অনুরোধ সব ব্যর্থ। শেষে রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করা হলো, গুরুদেব, দয়া করে আপনি বলুন, আপনি আদেশ দিলে তবে নিশ্চয়ই অনশন ভাঙবে।
রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম করলেন, গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।
জেল কর্তৃপক্ষ সেই বার্তা নজরুলের হাতে না দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখে পাঠালেন অ্যাড্রেসি নট ফাউন্ড।
শেষে বিরজাসুন্দরীর হাতে লেবুর রস খেয়ে শেষ পর্যন্ত অনশন ভাঙলেন বিদ্রোহী। সকলের সঙ্গেই কবিগুরুও নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বাঁচলেন।
রবি অস্ত গিয়েছেন এই খবর নজরুল যখন শুনলেন তখন তিনি কলকাতা বেতারের রেকর্ডিং স্টুডিওতে। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। হাহাকার করে উঠলেন বিদ্রোহী কবি। সঙ্গে সঙ্গে লেখনী হাতে তুলে নিয়ে লিখলেন, রবিহারা। কান্নাভেজা গলায় পাঠ করলেন সেই লেখা—
…বিশ্বের রবি ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে…।
সেদিন অসুস্থও হয়ে পড়লেন নজরুল। সেইদিন কে আর জানত ৩৫ বছর পরে ঠিক আগস্ট মাসেই রবিশিষ্য রওনা দেবে রবিলোকে।