রুশদি, খোমেনি এবং ধর্মমনস্তত্ত্ব

জাকির তালুকদার প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২২, ০৩:৩৫ পিএম

‘রুশদির নিন্দা কোনো মুসলমানের মুখে শুনলেই অন্য পক্ষ নিশ্চিত হচ্ছেন, ইনিও তাহলে আর-সব মুসলমানের মতোই সাম্প্রদায়িক—সম্ভবত মৌলবাদের সমর্থক। আবার যখনই কোনো হিন্দু রুশদির সমর্থনে মুখ খুলছেন, অমনি তাঁর সম্বন্ধে অপর পক্ষের ধারণা জন্মাচ্ছে, ইনিও তাহলে সব হিন্দুর মতোই মুসলমানের হেনস্তায় খুশি হন।’ [আমাদের দুজনের কথা এবং অন্যান্য। গৌরী আইয়ুব। পৃষ্ঠা ৩৭০]

১৯৮৮ সালে স্যাটানিক ভার্সেস বিতর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের রুশদি-বিষয়ক মনস্তত্ত্বের সারকথা।

সব হিন্দু যে রুশদির প্রশংসা করেননি, তার প্রমাণ তো প্রকাশের বছরেই মুম্বাই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীর নিন্দা। খুশবন্ত সিং হিন্দু না হলেও মুসলমান অন্তত নন। তিনি জন্মগতভাবে শিখ। তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধর্ম পালন করতেন কি না জানি না। স্যাটানিক ভার্সেস বেরোনোর আগে প্রকাশক তাঁর কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছিলেন উপন্যাসটি প্রকাশ করা যাবে কি না সে বিষয়ে মতামত নেওয়ার জন্য। সে বিষয়ে খুশবন্ত সিংয়ের নিজস্ব ভাষ্যটাই আমরা বরং একবার পড়ে দেখতে পারি। তিনি পরের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, পেঙ্গুইন যখন আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে রুশদির স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করেছিল, তখন তারা ৮৫,০০০ পাউন্ড অগ্রিম রয়্যালটি দিয়েছিল। তারা এখানেও “স্যাটানিক ভার্সেস” পাঠিয়েছিল, যেহেতু আমি পেঙ্গুইনের সাহিত্য পরামর্শদাতা, তাই তারা এই বিষয়ে আমার মতামতও জানতে চেয়েছিল। যখন আমি সেই স্ক্রিপ্টটি পড়ি, তখন আমি তাদের লিখেছিলাম যে আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই এই স্ক্রিপ্টটি ছাপতে পারি না, অন্যথায় আপনারা বড় সমস্যায় পড়বেন। গল্প যা-ই হোক না কেন, এতে ইসলামের নবী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে এমন কিছু রয়েছে, যা পড়া মুসলমানদের অভিপ্রেত হবে না।

আমি বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে, কিন্তু এই অধিকারও রুশদিকে দেওয়া যায় যে তিনি ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তি-সত্তাকে টার্গেট করবেন। এটি তিনি বোকামি করলেন। সম্ভবত তিনি জানেন না যে তিনি কত দূর যেতে পারেন কিংবা তার কতটুকু যাওয়া উচিত। এর পরিণতি তাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে।’ [উদু পত্রিকা ‘যেহনে জাদীদ’]।

আমাদের উপমহাদেশে একটি ধারণা মোটামুটি প্রচলিত আছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মুসলমানদের তুলনায় ধর্মবিষয়ে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকটাই উদার। নিজেদের ধর্ম নিয়ে, দেবদেবী নিয়ে তারা খুব স্পর্শকাতর নন। কিন্তু গৌরী আইয়ুব ‘শয়তানি পদাবলী’ নিয়ে লেখার সময় সেই আশির দশকেই কংগ্রেসের রাজীব গান্ধীর শাসনামলে প্রশ্ন তুলেছেন বিষয়টির সর্বাঙ্গ-সত্যতা নিয়ে। জানাচ্ছেন তাঁর পরিচিত অনেক লোকের মানসিকতার কথা, যারা এমনিতে শিক্ষিত, সজ্জন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক। গৌরী আইয়ুবের পর্যবেক্ষণে ‘এঁরা বেশিরভাগই ইসলামের কুৎসা ও মুসলমানের অপমানে চিরদিনই আনন্দ পান বলেই এই বই নিয়েও এত মাতামাতি করছেন। যদি নিরপেক্ষভাবে সবারই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করবার জন্য এঁরা উৎসুক হতেন তাহলে “নাইন আওয়ার্স টু রাম” কিংবা “রাম রিটোলড” কিংবা “ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য”-ও অবাধে পড়বার অধিকার অর্জনের জন্য তাঁরা কোনো আন্দোলন করেননি কেন? হিন্দু সমাজ যদি এতই বেশি সমালোচনা-সহিষ্ণু এবং উদার-দৃষ্টিসম্পন্ন হয়, তাহলে আজও ওই সব বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে কী করে?...উক্ত বইগুলোর যে কোনো একটির ওপর থেকেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দেখা যাক না হিন্দু সমাজের গার্জিয়ানরা কী বলেন?” ড. আম্বেদকরের বই “রিডলস অব হিন্দুইজম” নিয়েও একই কথা বলেন গৌরী।

মনে রাখা দরকার, গৌরী আইয়ুব নিজে নাস্তিক ছিলেন। ঘোষণা দেওয়া নাস্তিক। আবু সয়ীদ আইয়ুবকে বিয়ে করার সময় হিন্দু থেকে তাঁকে মুসলমান হতে হয়নি। বিয়ের পরের জীবনে হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধর্মের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান—কিছুই পালন করেননি তিনি। তিনি ভারতের মুসলমানদের টেনে কথা বলবেন, এমন অপবাদ তাঁকে কেউ কখনো দিতে পারেনি। রুশদি যেভাবে ইসলামের প্রবর্তক এবং তাঁর স্ত্রীদের নিয়ে নোংরা কথা বলেছেন উপন্যাসে, হিন্দুধর্মের কোনো অবতারকে নিয়ে তেমন কোনো উপন্যাস লিখে তারপর দেখা হোক উপমহাদেশের হিন্দুদের প্রতিক্রিয়া। মামির সাথে পরকীয়া বা ষোলো শত গোপিনীর সাথে লীলা চালিয়ে যাওয়ার পরেও ভক্তদের কাছে তার ভাবমূর্তি যদি অমলিন থাকে, তাহলে আজকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেড় হাজার বছর আগের হজরত মুহাম্মদের তেরোজন স্ত্রী থাকা নিয়ে সংসার করার পরেও মুসলিমদের ভক্তিকে কি অযৌক্তিক বলা যায়?

পশ্চিমের খ্রিষ্টানদের তো কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি তারা সুপার পাওয়ার হওয়ার পরে। তারা কতখানি সহনশীল? ব্রুনো, গ্যালিলিও, স্পিনোজাসহ আরও অনেকের ইতিহাস তো তাদের সহনশীলতার বিপক্ষেরই দৃষ্টান্ত। আধুনিক যুগে সত্যিই তারা সাহিত্য-শিল্প এবং মতপ্রকাশের বিষয়ে সর্বংসহা হতে পেরেছেন কি না, তা পরীক্ষা করা হয়নি। সে জন্যই আমেরিকার কর্নেল এবং মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক আলী এ মাযরুই সালমান রুশদি এবং সমকালীন বড় কথাসাহিত্যিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘The real equivalent of comparative would be in portraying the Virgin Mary as a prostitute, and Jesus as the son of one of her sexual clients. Also comparable would be aû novel based on the thesis that the twelve apstoles wewr Jesus‍‍`s homosexual lovers and the last supper was their last sexual orgy together. It would be interesting to speculate which ones of the leading writers would match in procession in defence of the "rights" of such a novelist.’

না। গত ৪৪ বছরে রুশদি তো বটেই, পাশ্চাত্যের কোনো বড় কথাসাহিত্যিকই এগিয়ে আসেননি এমন ‘থিসিস’ বা ‘হাইপোথিসিস’কে কেন্দ্র করে কোনো উপন্যাস লিখতে। এবং আমরা পশ্চিমের খ্রিষ্টানদের প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগও পাইনি।

২. 
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে পাশ্চাত্যের টার্গেট ইসলাম। লাল পতাকার পরে সবুজ পতাকা। সোভিয়েত পতনের আগের ৭০ বছর বামপন্থাকে উত্ত্যক্ত করা, এবং তাদের বিরুদ্ধে একতরফা মিডিয়া-যুদ্ধ ছিল পশ্চিমের একমাত্র চালিকাশক্তি। অঘোষিত অনেক প্রক্সিযুদ্ধ চালিয়েছে তারা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। দূরদর্শিতাহীন মুসলিম নেতারা পা দিয়েছে পশ্চিমের ফাঁদে। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদি জোস ছিল এই সব মৌলবাদী, যুদ্ধবাজ, অন্ধবিশ্বাসী ইসলামিক গ্রুপের সব তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু। মুজাহেদিন, তালেবান, লাদেন, আইএস—সবই পশ্চিমের সৃষ্টি। সাঈদী ওয়াজে বলত, একসাথে সব শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে একটা একটা করে শত্রুকে ধরতে হবে। তাই অন্য শত্রুদের সাথে কৌশলগত মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। প্রথম শত্রু সমাজতন্ত্র। তার জন্য আমেরিকা, সৌদি, ইরান সবাইকে পাশে নিয়ে কমিউনিস্টদের উচ্ছেদ করতে হবে পৃথিবী থেকে। কিন্তু বেচারার ধারণাই ছিল না, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং যুদ্ধের ফ্রন্টকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি মুসলমানদের নেই। তারা দাবাখেলার বোড়ে মাত্র। ধারণাই ছিল না যে পশ্চিমা খ্রিষ্টানবিশ্বও ঠিক একই উদ্দেশ্য নিয়ে ইসলামি মৌলবাদী ঘাতক গ্রুপগুলোর জন্ম দিচ্ছে, লালন-পালন করছে, অস্ত্রসজ্জিত করছে, সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। তথাকথিত ইসলাম কায়েমের গ্রুপগুলো আসলে পশ্চিমের হাতের পুতুলমাত্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পরে আমেরিকা হলো একমাত্র পরাশক্তি। তারপরে তো শান্তি আসার কথা। যুদ্ধাস্ত্র কমার কথা। ওয়ারশ-র মতো ন্যাটো জোটেরও তো বিলুপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই হয়নি। কারণ অস্ত্রবাণিজ্য ছাড়া পশ্চিম টিকতে পারে না। আর এত দিন ধরে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যে দানবগুলোকে তারা সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো তখন তাদেরই মাথাব্যথার কারণ। এই গ্রুপগুলোর স্বপ্নভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। তাদের রক্তমজ্জায় যে হঠকারিতার অমোচনীয় বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম, সেগুলো তাদের ওপরেও আছড়ে পড়তে শুরু করল। যদিও সেগুলো ছিল বোমার নামে পটকা ফোটানোর মতো মৃদুশক্তির। কিন্তু সেই হঠকারিতাগুলোই পশ্চিমকে সুযোগ করে দিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনার। যে মিডিয়া ৭০ বছর ব্যস্ত ছিল সমাজতন্ত্র-ফোবিয়া সৃষ্টি করতে, তারা তখন থেকে নিয়োজিত হলো বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া সৃষ্টি করতে। দিশেহারা, চিন্তায় পিছিয়ে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদের দুর্দশার হতাশা কাটানোর জন্য আরও বেশি করে মৌলবাদিতা এবং জঙ্গিত্বের আশ্রয় নিল।
পশ্চিমের পোয়াবারো। যা চেয়েছিল, ভেবেছিল, সব কাঁটায় কাঁটায় মিলে যাচ্ছে। 
কিন্তু বিশ্বব্যাপী সাধারণ মুসলমানের অবস্থা সবচাইতে খারাপ। যারা জঙ্গি না, মৌলবাদী না, দিন আনে দিন খায়, তারা রোজ অপমানিত হয়। নিজেদের দেশের গণবিরোধী শাসকশ্রেণির দ্বারা, এবং বিদেশি শক্তিধরদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের দ্বারা, এবং সেই সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসার দ্বারা। এই অপমানিত-অবমানিত জনগোষ্ঠীর সামনে যখন তাদের ধর্মপ্রবর্তককে হীনভাবে উপস্থিত করা হয়, তখন তাদের কাছ থেকে খুব কি সুসহনীয় প্রতিক্রিয়া আশা করা যায়?

রুশদিকে হত্যার ফতোয়া এসেছিল ইমাম খোমেনির দপ্তর থেকে। খোমেনি শিয়া নেতা। মুসলমানদের মধ্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিরা শিয়াদের মুসলমান বলে স্বীকারই করতে চায় না। তবু যে সবাই রুশদির ওপর ক্ষুব্ধ, তার কারণ হজরত মুহাম্মদকে শিয়া-সুন্নি সবাই তাদের ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে মান্য করে। তারপরেও খোমেনির ফতোয়ার কয়েক মাস পরেই রিয়াদে ৪৬টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে খোমেনির ফতোয়াকে ইসলামবিরোধী বলে ঘোষণা করা হয়। ইরান অনেক চেষ্টা করেও অন্য দেশগুলোর কাছ থেকে রুশদিকে শাস্তি দেওয়ার সম্মতি আদায় করতে পারেনি। এখন প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক, কেন এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি? কেন ইমাম খোমেনির ফতোয়াকে ইসলামবিরোধী বলা ৪৫টি মুসলিম দেশের সরকার তাদের বক্তব্যকে নিজ নিজ দেশে গুরুত্বের সাথে লাগাতার প্রচার করেনি? ইসলামের কোন যুক্তিতে খোমেনির ফতোয়া ভুল, সেই যুক্তিটিকে কেন নিজ নিজ দেশের জনগণের সামনে উত্থাপন করেনি? করলে তো সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ অন্তত নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দিতে পারত যে, রুশদি অপকর্ম করলেও তাকে হত্যা করা ইসলামসম্মত নয়। তাই তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে।
কিন্তু ৪৪ বছর ধরে পক্ষ-বিপক্ষের লোকেরা ইমাম খোমেনির ফতোয়াটির কথাই শুধু বলে আসছে। পশ্চিমা মিডিয়াও সেটাই করে আসছে। উদ্দেশ্য তো রুশদিকে রক্ষা করা নয়। বরং এই কথা প্রচার করা যে দেখ মুসলমানরা কেমন বর্বর, একটা বই লেখার জন্য তাদের ধর্মীয় নেতা লেখককে হত্যার হুকুম দেয়!

৩.
আবেগের দরজায় আঘাত লাগার ব্যাপারটির সাথে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি পরিচিত। ভাবা যাক, বঙ্গবন্ধুর কথা। বঙ্গবন্ধুকে গালি দিলে আপনি কি এই দেশে বিনা শাস্তিতে পার পাবেন? ধরুন যত দিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, তত দিন বঙ্গবন্ধুর নামে অনেক প্রকাশ্য গালিগালাজ শুনতে হয়েছে আপনাকে। সহ্য করেছেন। কিন্তু বুকে রক্তক্ষরণ হয়েছে আপনার। এখন যেমন জিয়াউর রহমানের ভক্তরা সহ্য করেন। ভক্তি-ভালোবাসা তো এমনই যুক্তিহীন।
নেতা, আত্মীয়স্বজন সবার কথা নাহয় বাদই রাখেন, নিজের ঘনিষ্ঠ কারও সম্পর্কে অহেতুক নিন্দাবাদ শুনলেও তো আপনার-আমার কানমাথা গরম হয়ে যায়। মুখে তো প্রতিবাদ করিই, শক্তিতে কুলালে হয়তো শারীরিকভাবেও ছেড়ে কথা বলি না।
একটি ধর্মের প্রবর্তক, যাকে দেড় শ কোটি মানুষ আদর্শ হিসেবে মানে, তার সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক নোংরা কথা লিখলে সেই মানুষদের বুকের সম্মিলিত রক্তক্ষরণ কতখানি হতে পারে, তা আপনি অনুভব করতে পারবেন, যদি মানবিক এবং সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। সাহিত্য মানুষকে কাঁদায়। তবে সেই কান্না চরিত্রের সাথে পাঠকের সমমর্মী কান্না। কিন্তু মনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশে নির্বিকার ছুরি বসিয়ে কাঁদানো রচনাকে সাহিত্য বলবে কেউ? অন্তত যারা আঘাত পেয়েছে, তারা কি বলবে?

[ওপরের কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্য সালমান রুশদি বা কোনো শিল্পী-সাহিত্যিকের ওপর হামলাকে সমর্থন করা নয়। খুব কম দেশই আছে, যেখানে লেখকরা বাংলাদেশের সত্যনিষ্ঠ লেখকদের মতো এতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সরকারি দমনযন্ত্র, আইসিটি আইনের ৩২ ধারার পাশাপাশি অন্ধ মৌলবাদীরা কখন কার ইশারায় কোন লেখকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা কেউ বলতে পারে না। খুব অল্প সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশে যতজন লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক মৌলবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন, তা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এ দেশের সত্যনিষ্ঠ লেখকদের কেউ নিরাপদ নন। 
আমি শুধু বলতে চেয়েছি, লেখার মাধ্যমে যে জনগোষ্ঠীকে আমরা আঘাত করি, তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণটিও আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। আর ১৫০ কোটি মুসলমানের সবাই রক্তপিপাসু নয়।]