সুন্দরবন এবং উপকূল রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ

বাশার খান প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২, ০৮:৪৯ এএম

সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা বদ্বীপ এলাকায় পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা এবং বাগেরহাট জুড়ে এর অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ সুন্দরবনকে পরিচিতি দিয়েছে অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উৎস হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ এই বন। এখান থেকে সংগৃহীত বনবৃক্ষ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়, আহরিত হয় প্রচুর পরিমাণে মধু, মোম ও মাছ। এখানে আছে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা ও খাল। পাশাপাশি প্রায় ২০০টি ছোট-বড় দ্বীপের নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ এই বন। (সূত্র : সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাপিডিয়া, ভুক্তি : সুন্দরবন।)

সুন্দরবন বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ ও পর্যটন খাতে আয়ের বড় উৎস। অপরদিকে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের রক্ষাকবচ। ২০২০ সালের ২০ মে রাতে বাংলাদেশ ও কলকাতায় আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। আম্পানের আঘাতের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। সেই তুলনায় বাংলাদেশে এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের গাছপালার বাধা পেয়ে বাতাসের গতি কমে দুর্বল হয় আম্পান। নইলে আম্পানের তাণ্ডবে পশ্চিমবঙ্গের মতই বাংলাদেশেরও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতো। এর আগে, ২০১৯ সালের ৯ ও ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসা শক্তিধর ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর ভয়াল থাবা থেকেও বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা  এবং ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রয়ঙ্করকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নইলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বেশি হত। এভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকবচ হিসেবে বুক পেতে বাংলাদেশকে রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন।

তাই দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল রক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শাসনামলে শাসকচক্র যখন রাজস্ব ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য গাছ কেটে সুন্দরবনকে উজাড় করার চেষ্টা করে, তখন বঙ্গবন্ধু বাধা দেন। সুন্দরবন উজাড় করার বিরূপ প্রভাব বাংলার জন্য কত মারাত্মক হতে পারে—তা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। তাদের চিঠিও দেন। এ ঘটনার কথা বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের স্মৃতিচারণেই উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, আমার মনে আছে, ১৯৬৭-৬৮ সালে তদানীন্তন সরকার যারা ছিলেন, আমি বলেছিলাম, আলাপ হয়েছিল চিঠির মাধ্যমে, আলাপ হয়েছিল যে, সুন্দরবনকে রক্ষা করেন। না হলে বাংলাদেশ থাকবে না। তারা বলেন, আমাদের রেভিনিউ নষ্ট হয়ে যায় প্রায় দেড় কোটি টাকার মত, কী করে গাছ কাটা বন্ধ করে দিই? তাহলে চলবে কী করে? আমি তখন বললাম, আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মত আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায় তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই। মেহেরবানি করে দেড়কোটি টাকার জন্য আমার এই বাংলার সর্বনাশ আপনারা করবেন না। কিন্তু কানে দেয় নাই এ কথা। কারণ তারা দরদ নিয়া আসে নাই। কারণ তাদের প্রয়োজন ছিল বাংলার গাছ, বাংলার সম্পদ। বাংলার ও ম্যাটেরিয়াল লুট করে নিয়া যাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। (আনিসুল হক, সুন্দরবন, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, দৈনিক প্রথম আলো, ১৫ নভেম্বর ২০১৯।)

পাকিস্তানের শাসনের ২৩ বছর বাংলার বনজ সম্পদের প্রতি যে চরম উদাসীনতা দেখিয়েছিল সামরিক সরকার, সেদিনকার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু এই কথাগুলোও উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ ওপনিবেশিক শাসনকালেও বাংলার প্রকৃতি ও বনজ সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়ন উপেক্ষিত হওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার বক্তৃতায়। বঙ্গবন্ধু দায়ী করেন, এ কারণে স্বাধীনতার আগের ২৩ বছরে বাংলার মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (আজাদ, ১৭ জুলাই ১৯৭২।)

২.
সুন্দরবনের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী শ্যালা। মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে মালামাল পরিবহনকারী নৌযান খুলনা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থান এবং ভারতের বিভিন্ন বন্দরে যাতায়াত করত শ্যালা নদী হয়ে। এতে শ্যালা নদীতে জাহাজের তেল নিঃসরণ, দূষণ ও শব্দদূষণ হতো, যার বিরূপ প্রভাব পড়তো সুন্দরবনের প্রাণী ও জীবকূলের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হতো সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। ২০১৪ ও ২০১৬ সালে সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে দুই দফায় তেলবাহী ট্যাংকার ও কয়লাবাহী জাহাজ ডুবে যায়। এরপর কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তেল ভাসতে থাকে। তেল ছড়িয়ে পড়া ও কয়লার প্রভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, জলজ প্রাণী ও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সবধরনের নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

বাণিজ্যিক নৌযান চলাচলের কারণে সুন্দরবনের এই ক্ষতির বিষয়টি স্বাধীনতার পরপরই গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুন্দরবন রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি বাস্তবায়নে গ্রহণ করেন কার্যকরী পদক্ষেপ। প্রথমে বঙ্গবন্ধু মংলা ও খুলনার মধ্যে বিকল্প নৌপথ তৈরির জন্য পথ খুঁজেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তখনকার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জেনারেল এম এ জি ওসমানী মংলা এলাকায় পরিদর্শনে যান। পরে বঙ্গবন্ধু নিজেই স্থান পরিদর্শন করেন।

এরপর বঙ্গবন্ধু উদ্যোগে লুপ কার্টিং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের ঘষিয়াখালী থেকে রামপালের বেতবুনিয়া হয়ে মোংলা নদীর মুখ পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার কৃত্রিম নদীপথের সৃষ্টি করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চ্যানেলটি পুনঃখনন করা হয়। চ্যানেলটি দিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮২৬টি নৌযান চলাচল করে। এখন আর কোনো জাহাজ শ্যালা নদী ব্যবহার করে না। ফলে সুরক্ষা পাচ্ছে সুন্দরবন। (আবদুস সামাদ ফারুক, বঙ্গবন্ধু : নদী ও নৌপথ, সোনার বাংলায় সুনীল স্বপ্ন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ২০২০, পৃষ্ঠা ৮৯-৯০।) বঙ্গবন্ধুর এ উদ্যোগ সুন্দরবনের অসংখ্য জলজপ্রাণি ও পরিবেশ বাঁচানোর জন্য সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে।

৩.
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের অবকাঠামো ছিল ধ্বংসপ্রায়। অপরদিকে, মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের লুটপাটে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ছিল অর্থশূন্য। এই কঠিন বাস্তবতা সামনে নিয়েই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কাজ করতে শুরু করেন। এরমধ্যে বাংলার পরিবেশ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপকূল রক্ষায় উদ্যোগী হন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে উপকূলীয় বাঁধ, বন সংরক্ষণ ও বন্যপশু রক্ষণাবেক্ষণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে এই সময়টিতে বঙ্গবন্ধু খুবই ব্যস্ততার মধ্যে পার করেছেন। তারপরও উপকূল, বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার কাজগুলো নিজে তদারকি করেছেন, এমনকি সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে। ১৯৭২ সালের ৩ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগের দিন ২ ডিসেম্বর ১৯৭২, উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, বন সংরক্ষণ ও বন্যপশু রক্ষণাবেক্ষণ দেখার জন্য খুলনা সফরে যান। সেখানকার বুড়িগোয়ালনী নদীতে নোঙ্গর করা ইনভেস্টিগেটর জাহাজে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ওই সফরে বঙ্গবন্ধু দ্রুত মনপুরা দ্বীপের একটি জরিপ প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। উপকূলীয় বাঁধ ও দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যবস্থার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে তিনি একটি বন কেন্দ্র স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দেন। উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের পর বাঁধের ওপর পরিকল্পিতভাবে হোগলা গাছ লাগাতে দায়িত্বরত কর্মচারীদের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।

মাটি জমে উপকূলে নতুন নতুন চর হয়, এটা প্রাকৃতিকভাবে হয়ে থাকে—যা উপকূল রক্ষায় খুবই সহায়ক। নতুন ভূমি ও চরকে পরিকল্পনায় আনার ব্যাপারটিও ঠিক করেন বঙ্গবন্ধু। দায়িত্বরত সরকারি কর্মচারীদের সমুদ্র থেকে আরও ভূমি উদ্ধারের সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয় সেদিনকার বৈঠকে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭২।) উপকূল রক্ষায় এই বিষয়গুলি খুবই টেকনিক্যাল। সেদিনকার বৈঠকে পরিকল্পনা ও নির্দেশনাগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায় একজনর অভিজ্ঞ পরিবেশবিদের ভূমিকায়।

একজন প্রকৃত পরিবেশপ্রেমিক বলেই তিনি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র এবং উপকূল রক্ষা করতে উদ্যোগ নেন এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে উন্নয়ন উদ্যোক্তার পাশাপাশি সুন্দরবন ও উপকূল রক্ষাকারী রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায়ও সরব থাকতে দেখা যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক।