[‘দ্বিতীয় বিপ্লব: কী ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে’— এ শিরোনামে আমার একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। সংক্ষিপ্ত এ নিবন্ধটিকে তার ভূমিকা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর গত সাড়ে চার দশকে যত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার হয়েছে তার বড় অংশই ছিল তাঁর ঘোষিত যুগান্তকারী কর্মসূচি এই দ্বিতীয় বিপ্লবকে ঘিরে। পাশাপাশি এও অনস্বীকার্য যে সেইসব জঘন্য অপপ্রচারের যথোচিত উত্তর আমরা আজও জনসমক্ষে তুলে ধরতে পারিনি যথাযথভাবে। আমার প্রকাশিতব্য গ্রন্থটিতে সেইসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে। আশা করি, অতি দ্রুতই বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারবো।—লেখক]
সত্য বাস্তবিকই কঠিন। আরও কঠিন অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি হওয়া। এদেশে এখনো একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসানে যে-নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তাতে উল্লসিত হয়েছেন এমন মানবসন্তানও আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কিন্তু আমরা সচরাচর এসব সত্যের মুখোমুখি হতে চাই না। ফলে ব্যাধিটি অচিহ্নিতই থেকে যায়। আর যখন তা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে তখন করার থাকে না কিছুই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি তৈরির কাজটি যারা করেছিলেন, তারা দিনের পর দিন তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেন। এমনকি তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যার পরও তা থামেনি। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে যেমন, এখনো তেমনি সরকার ও দলের নীতিনির্ধারকগণ তাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এদিকে নজর দেওয়াটা যে খুব জরুরি হয়ে পড়েছে গুলশান ট্র্যাজিডি আমাদের আবারও তা মনে করিয়ে দিয়েছে।
যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের কী দিয়েছে— আমি তাদের কিছুই বলি না। তাদের করুণা করা যেত কিংবা বাংলার বরেণ্য কবি আবদুল হাকিমের (১৬২০-১৬৯০) ভাষায় বলা যেত, ‘সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। কিন্তু আমি তার কোনোটাই করি না। কারণ আমি তাদেরকে কখনোই করুণা বা ক্রোধ কোনোটারই যোগ্য বলে বিবেচনা করিনি। তবে যারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই দেননি, আমি তাদেরকে আয়নায় নিজের অবয়বটি দেখতে বলি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগে তিনি কী ছিলেন, আর এখন কী হয়েছেন সেটি দেখলেই তো এ জাতীয় সব কুতর্কের মীমাংসা হয়ে যায়। কথাটি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। স্বাধীনতার আগের সেই বাংলাদেশ আর এই বাংলাদেশ যে এক নয় তা বোঝার জন্য গবেষক-পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু চারপাশে তাকানোর মতো দুটি নির্দোষ চোখ থাকলেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত চার দশকে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে-অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে, আমাদের নিকট অতীতের বাস্তবতার নিরিখে তা অভাবনীয়ই বলা যায়। আর তার বীজ বপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী হাতেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। এখানে যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো, যারা স্বাধীনতা ও পরাধীনতার প্রভেদ বোঝেন না তাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা।
দাঁত থাকতে সবাই দাঁতের মর্যাদা বোঝেন না। এটি কোনো নতুন কথা নয়। প্রকৃতিদত্ত সহজলভ্য অক্সিজেনের অবারিত সমুদ্রে যার বসবাস, অক্সিজেন-শূন্যতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত না হলে সে অক্সিজেনের মূল্য বুঝবেই-বা কীভাবে? অথচ আমাদের আদি কবিরাও তা বুঝতেন। স্বাধীনতার ধারণা যখন এতোটা স্পষ্টভাবে দানা বাঁধেনি, তখনই আমাদের আর এক বাঙালি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) লিখে গেছেন, ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়!’ স্বাধ্নীতাহীনতায় কেউই বাঁচতে চায় না। কারণ স্বাধীনতার চেয়ে দামি যে আর কিছুই হতে পারে না তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। স্বাধীনতার জন্যে বিশ্বের দেশে দেশে এখনো যারা হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন তারাই জানেন স্বাধীনতার আসল মূল্য। যুগ যুগ ধরে রক্ত ঝরিয়েও অনেকে আজও স্বাধীনতার স্বাদ পাননি। সেদিক থেকে আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যা কখনো ঘটেনি, ঘটবে এমনটি কল্পনাও করা যায়নি, সেই অভাবনীয় ঐতিহাসিক কাণ্ডটিই ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আর এই অসম্ভবকে যিনি সম্ভব করে দিয়ে গেছেন তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ৫৫ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যদি আর কিছু নাও করতেন, শুধু এই একটি কাজের জন্যেই তিনি অমর হয়ে থাকতেন। তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকতো বিশ্ববরেণ্য নেতাদের তালিকায়।
বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান শুধু স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে সীমিত নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন এ দেশটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কঠিনতম কাজটিও— বলতে গেলে এককভাবেই— সম্পন্ন করতে হয়েছিল তাঁকেই। এককথায়, সেটি ছিল প্রায় অসম্ভব দানবীয় এক কর্ম। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে গোটা দেশ ক্ষতবিক্ষত। সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। দেশের প্রধান দু’টি সমুদ্রবন্দরই ব্যবহারের অনুপযোগী। অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত কৃষিখাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। নামমাত্র যে শিল্প ও ব্যাংকবীমা ছিল তাও দেউলিয়া হয়ে গেছে। খাদ্য নেই। কোষাগারও শূন্য। পুলিশ-প্রশাসন কিছুই নেই। নেই স্বাধীন একটি দেশ চালানোর মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ জনবলও। এদিকে মানুষের প্রত্যাশা তখন আকাশচুম্বী। বেকার তরুণ-যুবকরা অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা দেশে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে গিয়েছিল। তারাও ফিরতে শুরু করেছে শূন্য হাতে। অন্যদিকে, আমেরিকা, চীন ও তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবস্থান আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে। দেশের ভেতরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো তখনো তৎপর। এ রকম একটি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হাল ধরতে হয়েছিল সদ্যস্বাধীন এ দেশটির। আরও লক্ষণীয় যে তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিনবছর— ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এটুকু সময়ের মধ্যে তিনি যা করেছিলেন তা দেশবিদেশের ঝানু ঝানু বিশেষজ্ঞদেরও চমকে দিয়েছিল। পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূলতার মধ্যেও যে গোটা দেশের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন তিনি— তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি।
এখানে শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট যে স্বাধীনতাপরবর্তী গত সাড়ে চার দশকে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। তার পরও আমরা খাদ্যে স্বনির্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নসহ সামগ্রিক জীবনমানের ক্ষেত্রেও। সর্বোপরি, মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যে-বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই বাজেটের আকার ইতোমধ্যে ছয় লাখ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের সামনে এই যে অপরিমেয় সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার খুলে গেছে, আলাদীনের সেই আশ্চর্য চেরাগটির নাম হলো স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু কেবল সেই স্বাধীনতাই এনে দেননি, একই সঙ্গে নির্মাণ করে গিয়েছিলেন অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মহাসড়কও। সেই মহাসড়ক ধরেই আমরা এখন তরতর করে এগিয়ে চলেছি। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে স্বাধীনতার পরপরই যে-সংবিধানটি তিনি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন, তা এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গণতন্ত্র শুধু নয়, সর্বপ্রকার মৌলিক অধিকারেরই নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে সেই সংবিধানে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক হলো জনগণ।
২.
প্রাথমিক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে দেশ যখন সামনের দিকে চলতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই হানা হয় চূড়ান্ত আঘাত। সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতির স্থপতিকে। কারা কেন মানবেতিহাসের এ ঘৃণ্যতম হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত করেছিল তা ইতোমধ্যে সকলেরই জানা হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, ষড়যন্ত্রকারীরা যে-বাকশালকে তাদের যাবতীয় আক্রমণের মূল ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল, সেটি ছিল পরীক্ষামূলক একটি কর্মসূচি। কিছুটা যুগান্তকারীও বলা যায়। এর গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দিক ছিল। প্রথমত, দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠন। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিটিই ছিল আসল। বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রথম বিপ্লবটি ছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তাঁর নেতৃত্বেই সেটি সফল হয়েছে। বাকশাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, এ বিপ্লবের লক্ষ্য হলো—‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে সে-কথা বারবার বলেছেনও তিনি। এও বলেছেন যে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন একই নিঃশ্বাসে। সেটি হলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছে কিন্তু প্রকৃত ‘মুক্তি’ অর্জিত হয়নি। শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার নিগড় থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার কাজটি যে কতোটা কঠিন তা তিনি অন্য যে কারো চেয়ে ভালো জানতেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য হলো— অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর ঘোষিত বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের ভুখানাঙ্গা মানুষকে শোষণ-বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের বংশানুক্রমিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
গত শতাব্দীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের খুবই প্রিয় একটি স্লোগান ছিল— ‘এ সমাজ ঘুণে ধরা/এ সমাজ ভাঙতে হবে’। দশকের পর দশক ধরে স্লোগানটি এ-দেশের মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রাণিতও করেছে। গতানুগতিক অর্থে বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী ছিলেন না। সব ধরনের হঠকারিতা বা চরমপন্থা থেকে তিনি নিজেকে সযতেœ দূরে রেখেছেন আমৃত্যু। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু নিজেও সম্ভবত উপলব্ধি করেছিলেন যে দুঃখী মানুষের ভাগ্য বদলাতে হলে ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাঁর ভাষায়, ‘আমি কেন ডাক দিয়েছি? এই ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তা হলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে। না হলে আসতে পারে না। আমি তিন বছর দেখেছি। দেখেশুনে আমি আমার স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছি।...’ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ: ২৬ মার্চ, ১৯৭৫)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতির পিতার অসামান্য এ ভাষণটি যতটা প্রচারিত ও আলোচিত হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটি যদি হয় আমাদের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র, তবে এ ভাষণটি হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ— যেখানে যুগপৎ সুস্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সোনার বাংলার রূপকল্প এবং তা বিনির্মাণের দিকনির্দেশনা।
ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির মধ্যে বিদ্যমান ঘুণে ধরা সমাজ ভাঙার বলিষ্ঠ কিছু উপাদানও ছিল। তিনি তাঁর মতো করে সমাজ-ভাঙার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে কৃষি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বড়ো ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণে সেটি তিনি বলেছেনও খোলাখুলিভাবে। তাঁর ভাষায়, ‘এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। ভয় পাবেন না। ...পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। ...কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলো বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচানো যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি যে পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশ’ থেকে হাজার ফ্যামিলি নিয়ে কম্পালসারি কো-অপারেটিভ হবে।’
মূলত দ্বিতীয় বিপ্লবের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই তিনি গঠন করেছিলেন বাকশাল নামক নতুন রাজনৈতিক দল। এটাকে তিনি বলেছিলেন জাতীয় দল বা প্ল্যাটফরম। দল-মত নির্বিশেষে সকলেরই যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল এ দলে। সামরিক-বেসামরিক বহু সরকারি কর্মকর্তা সেই সুযোগ গ্রহণও করেছিলেন। গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তখন। নানাভাবে দেনদরবারও চলছিল। শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর থেকে যাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর হাস্যকর চেষ্টা করা হচ্ছে— সেই সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন এই দলে। ছিলেন আরও অনেকেই। বাকশালের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় এখনো থামেনি। বলা হয় যে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্যে বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্রকে। সে জন্যেই নাকি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল! বহু তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতের মুখেও আমি এমন কথা বহুবার শুনেছি। এ প্রচারণা যে সুপরিকল্পিত, বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেকটা হরিণের পানি ঘোলা করার সেই গল্পের মতো। বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। দেশিবিদেশি অনেকেই জড়িত ছিলেন এ-ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল তাদের প্রথম লক্ষ্য। ঘাতকরা তাদের লক্ষ্যে এতটাই অবিচল ছিল যে বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতির কোনো হেরফের হতো বলে আমার মনে হয় না।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই যদি বঙ্গবন্ধুর মূল উদ্দেশ্য হতো তবে তার জন্য বাকশাল গঠনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই তিনি আরও বহুদিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর ঘোর বিরোধীরাও নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার অসম্ভব দাবি কখনোই করেননি। সব দল মিলেও যে সেটি সম্ভব হতো না তা তারা ভালো করেই জানতেন। এমনকি চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের সেই কঠিন দিনগুলোতেও সকল বিচারেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নেতা। সেটি তিনি নিজেও জানতেন। যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই মানুষের ঢল নামতো। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর কষ্ট ছিল অন্য জায়গায়। তিনি নিজের সঙ্গেই এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নিজেকে, নিজের চারপাশের সব সীমাবদ্ধতাকে, ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের ওপরও আর ভরসা রাখতে পারছিলেন না। তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। বিশেষ করে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তাঁকে খুব বিচলিত করে তুলেছিল।
নানা সূত্রে এখন জানা যাচ্ছে যে দ্রুত কিছু একটা করার জন্যে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নানা জন নানা পরামর্শ দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন, ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে পা ফেলতে। পরিণতি সম্পর্কে সতর্কও করে দিয়েছেন। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মতো নেতারাও ছিলেন পরামর্শদাতাদের দলে। কিন্তু একাত্তরের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর মতো এবারও বঙ্গবন্ধু স্বীয় সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। কারো কথাই শোনেননি তিনি। এমন নয় যে পরিণতির ব্যাপারে তিনি খুব উদাসীন ছিলেন। ঘাতকের বুলেট যে-কোনো সময়ে যে তাঁর বুক ঝাঁঝরা করে দিতে পারে তাও তাঁর অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সত্য যে কঠিন— নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনেই তা তিনি উপলব্ধি করেছেন পদে পদে। স্বধর্মে অবিচল থাকা যে আরও কঠিন তাও তিনি জানতেন। তবু যুধিষ্ঠিরের মতো তিনিও স্বধর্ম পালনে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। যুধিষ্ঠির চলতেন নিজের বিবেচনা ও বিশ্বাস অনুযায়ী। বিবেকের নির্দেশকে শিরোধার্য জ্ঞান করতেন। এটাই হলো স্বধর্ম। শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও এ-পথ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি যুধিষ্ঠির। এ জন্য বুদ্ধদেব বসু মহাভারতের নায়কের শিরোপাটি তুলে দিয়েছিলেন তাঁর মাথায়। বলেছিলেন— মহাবীর অর্জুন নন, যুক্তিবাদী যুধিষ্ঠিরই হলেন যথার্থ নায়ক। বঙ্গবন্ধুও তাই। বলা যায়, সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ঘাতকের উদ্যত সঙ্গীনকে অগ্রাহ্য করে একাত্তরের মতো আবারও বিবেকের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এটাই তাঁর স্বধর্ম। তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমি রাজা ইডিপাসেরও মিল খুঁজে পাই— কোনো কিছুই যাঁকে নিজ জনগণের মঙ্গলসাধনের ব্রত থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। খুঁজে পাই আমাদের কালের ট্রাজিডির অনন্য এক মহানায়ককে।
বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। সপরিবারে আত্মাহুতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যে-সংগ্রামের সূচনা করে গেছেন, তাকে সফলভাবে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। আশার কথা হলো, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তাঁরই সুযোগ্য কন্যার সুদক্ষ নেতৃত্বে দেশ এখন দৃপ্ত পায়ে সেদিকেই এগিয়ে চলেছে। তবে সেই পথ যে নিষ্কণ্টক নয় তা সুবিদিত। জাতির পিতার সোনার বাংলার স্বপ্ন সফল করতে হলে অবশ্যই সব বাধা অতিক্রম করে সব ধরনের বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডুকতার কলুষ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে হবে। এখানে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র