আমাদের মহারাজ

ফয়সাল আহমেদ প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২২, ০৫:৫৭ পিএম

ত্রৈলোক্যনাথকে কেহ-কেহ ‘ঠাকুর’ বলিয়া ডাকিত। ত্রৈলোক্যনাথ ছিল একজন পলাতক আসামী। সে প্রতিদিন গঙ্গা স্নান করিত এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ন্যায় চলাফেরা করিত। ‘মহারাজ’ নামে তাহার খ্যাতি আজিও বাংলার বিপ্লবীদের নিকট বিদিত। পলাতক আসামী হইয়াও, সে ছদ্মবেশে আদালত-প্রাঙ্গণে ডাব বেচিবার ছলে উপস্থিত হইত এবং বিচারের ফলাফল অবগত হইত। নৌকার মাঝিরূপে সে পুলিসের দৃষ্টি এড়াইত। ত্রৈলোক্যনাথের সহিত পরিচয় করিয়া আমি আরও কয়েকজন খাঁটী বিপ্লবীর সন্ধান পাইলাম—শ্রী মতিলাল রায়, ‘আমার দেখা বিপ্লব ও বিপ্লবী’ ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া এক বিপ্লবীর নাম ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।  লোকে যাঁকে মহারাজ বলে ডাকে। তিনি বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতীক। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিযুগে যে কয়জন ভারতবর্ষে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, ব্রিটিশ শাসকদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁদের অন্যতম।

১৩৩ বছর আগে বাংলার নির্যাতিত-নিপীড়িত, মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় মহারাজের জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ মে, বঙ্গাব্দ ২২ বৈশাখ ১২৯৬ সালে তদানীন্তন ময়মনসিংহ জেলা, বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার অন্তর্গত কাপাসাটিয়া গ্রামে। মহারাজের পিতার নাম দুর্গাচরণ চক্রবর্তী, মাতা প্রসন্নময়ী দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম।
মহারাজ ডাকাতি করেছেন, খুন করেছেন, টাকা জাল করেছেন। তবু মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। কারণ, তিনি এসবের কিছুই নিজের জন্য করেননি। সবই করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। ডাকাতি কিংবা খুন করা তাঁর পেশা ছিল না। তবে এ নিয়ে মহারাজের আক্ষেপ ছিল। তিনি বলতেন, ‘স্বাধীন ভারতে আমাদের হাতে যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকত, তবে আমরা যাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছি, তাদের বংশধরদের মধ্যে যারা বিপন্ন, তাদের সরকারিভাবে সাহায্য করতাম।’

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পলাতক অবস্থায় মহারাজকে ছদ্মবেশে নানা স্থানে থাকতে হয়েছে। এই সময়ে কখনো পয়সাওয়ালা ধনী মানুষ, কখনো মাঝি, কখনো চাকর বা কুলির রূপ ধারণ করতে হয়েছে। যখন নৌকায় থাকতেন তখন মাঝির বেশে থাকতেন। নৌকা নিয়ে পূর্ববঙ্গে অনেক ডাকাতি করেছেন। ডাকাতির সময় বড় ঘাসী-নৌকা ব্যবহার করতেন।  নিজেরাই এই নৌকা চালাতেন। তখন স্বদেশী ডাকাত ধরার জন্য পুলিশ খুব তৎপর ছিল। পুলিশ বিভিন্ন ঘাটে নৌকা থামিয়ে তল্লাশি চালাত। 

যেভাবেই হোক স্বদেশী ডাকাতদের ধরা তাদের জন্য ফরজ হয়ে উঠেছিল। নদী-নৌকা-লঞ্চ সর্বত্র ঘোরাফেরা করত পুলিশের দল। নদী আর নৌকায় থাকতে থাকতে একসময় মহারাজ ‘কালীচরণ মাঝি’ নামে খ্যাতিমান ওয়ে উঠলেন। বহুদিন নৌকায় নৌকায় কাটিয়েছেন, দীর্ঘদিন  নৌকা যাপনে তাঁর চেহারাও মাঝির মতো হয়ে গিয়েছিল। কেমন ছিল ডাকাত ত্রৈলোক্যনাথের রূপ? জিতেশচন্দ্র লাহিড়ী তাঁর ‘নমামি’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘পদ্মা ও মেঘনা নদীর গ্রামগুলির ধনী মহাজনদের বাড়ীতে পরপর কয়েকটা ডাকাতি হয়েছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ডাকাত দলের নেতা এক কৃষ্ণকায় পাঞ্জাবী। প্রকাণ্ড বড় তার দাড়ি। নদীতীরের বড় লোকদের মনে সে একটা রীতিমতো বিভীষিকা। কত অদ্ভুত কাহিনী ঘটে গেছে তার সম্বন্ধে। কেউ বলে পুরাণের শব্দভেদী বাণ আয়ত্ত করেছে সে, শব্দ লক্ষ্য করেই সে ছোড়ে অব্যর্থ গুলি। কেউ বলে লাঠি ভর করে এক লাফে ওঠে দোতলায়। অবলীলাক্রমে লাফ দিয়ে পড়ে ভূমিতে। হাত দিয়ে ভাঙে সিন্দুকের তালা, হুঙ্কার দেয় দৈত্যের মতো। নির্মম পাষাণ সে। অথচ কোনো ক্ষেত্রেই করেনি সে নারীর অসম্মান। এক বাড়ীতে একজন দস্যু একটী মহিলার অঙ্গ থেকে গয়না খুলে নিচ্ছিল। কিন্তু সহসা কে যেন তাকে দুকান ধরে তুলে ধরল শূন্যে। সকলে চেয়ে দেখল সেই দুর্ধর্ষ পাঞ্জাবী। এ-ও শোনা যায় ডাকাতি করতে গিয়েও সে রোগীর সেবা করে, বাড়ীর মেয়েদের কাছে জল চেয়ে খায় আর বলে কুচ্চু ভয় নেই মায়ি।’

মহান এই বিপ্লবীকে সবাই পছন্দ করতেন। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও তাঁকে সমীহ করতেন। অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধ ছিল। কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বগুণে তিনি তা অর্জন করেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বিশ্ববরেণ্য নেতারা তাঁকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। মহারাজকে শ্রদ্ধা করতেন বাংলার আরেক স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

মহারাজের একান্ত আপনজন নেতাজি সুভাষ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি তাঁর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন ‘...রেঙ্গুন হইতে আমরা মান্দালয় জেলে যাই। মান্দালয় জেল মান্দালয় ফোর্টের ভিতর এবং রাজা থিবোর প্রাসাদের নিকট। মান্দালয় জেলে আমরা তেরজন একত্র ছিলাম। সত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র স্বদেশী আন্দোলনের সময় ঢাকায় থাকিয়া পড়িতেন এবং অনুশীলন সমিতির একজন উৎসাহী সভ্য ছিলেন। মান্দালয় জেলে পৌঁছানোর পরই সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন, মহারাজের সিট আমার পাশে থাকিবে এবং সুভাষবাবুর পাশে আমার থাকার সৌভাগ্য হইয়াছিল। সুভাষবাবুর জন্ম বড় ঘরে, শৈশব হইতে তিনি সুখে লালিত পালিত হইয়াছেন। কিন্তু দেশের জন্য দুঃখ-কষ্ট বরণ করিতে তিনি কাহারও অপেক্ষা পশ্চাৎপদ ছিলেন না। তিনি অম্লানবদনে সকল কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। তিনি সকল অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকিতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে কোন আপত্তি নাই তাঁহার, যাহা পান তাহাই খান। চাকর-বাকরদের উপরও তাঁহার ব্যবহার খুব সদয়, কখনও কটুকথা বলেন না। কাহারও অসুখ হলে তিনি নিজে সারারাত্রি জাগিয়া সেবা করিতেন। একবার টেনিস খেলিতে যাইয়া আমি পড়িয়া যাই, তাহাতে হাঁটুর চামড়া উঠিয়া যায় ও ঘা হয়। সুভাষবাবু প্রত্যহ নিজ হাতে আমার ঘা নিমপাতা সিদ্ধ জল দ্বারা ধোয়াইয়া দিতেন। খেলা, হৈ চৈ, আমোদ-প্রমোদ সবটাতেই তাঁর বেশ উৎসাহ ছিল। কয়েদীরা খালাসের সময় সুভাষবাবুর কাছে কাপড় জামা চাহিত। তিনি কাহাকেও ‘না’ বলিতে পারিতেন না। সুভাষবাবুর মত লোককে জেলখানায় সঙ্গী হিসাবে পাওয়া খুব সৌভাগ্যের বিষয়। [পৃষ্ঠা ১১৩-১৪]

১৯৭০ সালের ২৪ জুন যশোরের বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে মহারাজ ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় সীমান্তে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অশ্রুসজল তাঁকে বিদায় জানান। ভারতে পৌঁছে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, পুরোনো বন্ধু, সহযোদ্ধা, আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন, কথা বলছেন, সংবর্ধনা নিচ্ছেন, সেই সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এ সময় তিনি ভারতের পার্লামেন্টে ভাষণ দেন। এটি তাঁর জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। মৃত্যুর তিন দিন আগে ১৯৭০ সালের ৬ আগস্ট দিল্লিতে পার্লামেন্টে সংবর্ধনার উত্তরে তিনি এই ভাষণ প্রদান করেন। মহারাজ বাংলা ভাষাতেই ভাষণ রেখেছিলেন। ভাষণের ইংরেজি তরজমা করেন লোকসভা সদস্য শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী।

৯ আগস্ট দিল্লিতে শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের বাসভবনে মহারাজের সম্মানে এক সংবর্ধনা ও ভোজসভার আয়োজন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রী জগজীবন রাম, সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত, শ্রীত্রিদিব চৌধুরী, ডা. ত্রিপুরা সেন, কে কে শাহ্, শ্রীউমাশংকর দিক্ষিত ও নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলে ডেপুটি লিডার আকবর আলী খান। মহারাজ তাঁদের সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। স্মৃতিচারণাও করেন তিনি। রাত সাড়ে ১০টায় ভোজসভার সমাপ্তি ঘটে। এদিন রাতেই ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ৯ আগস্ট রাতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মহারাজ।

যে মানুষটি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে, দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন, তাঁকেই আজ আমরা ভুলতে বসেছি! বলা উচিত, ভুলে বসে আছি। মহারাজ আরও অনেকের সঙ্গে সেদিন প্রাণ বাজি রেখে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন বলেই এই দেশ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। সাতচল্লিশে দেশভাগ হলো ধর্মের ভিত্তিতে, বহু মানুষ দেশ ত্যাগ করল। কিন্তু তিনি প্রিয় জন্মভূমি পূর্ব বাংলা ছাড়লেন না। এই দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে রয়ে গেলেন। অন্য দেশের নাগরিক হলেও ভারতের সরকার ও জনগণ শেষ বিদায়ে মহারাজকে রাজার সম্মান দিয়েছে। ভারতে তাঁর নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। আছে প্রতিষ্ঠানও। যদিও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার যথাযথ সম্মানের সঙ্গে মহারাজের চিতাভস্ম ভারত থেকে এনে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিসর্জন দেয়। এখানেই শেষ। গত পাঁচ দশকে দখল, অবহেলা আর অযত্নে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন বসতভিটা বিলুপ্তির পথে। আজকে তাঁর ৫২তম প্রয়াণদিবসে সরকারের কাছে দাবি জানাই, মহারাজের শেষ স্মৃতিচিহ্ন বসতভিটার দখল উচ্ছেদ করে সেখানে তাঁর নামে একটি গবেষণাকেন্দ্র ও স্মৃতি-কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হোক।

 

লেখক :  প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ‘এবং বই’