হাওয়া: পরাবাস্তবের পারদ নিল কত দূরে

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২২, ০৩:৩৮ পিএম

“The thought of all human activity makes me laugh.” This utterance of Aragon’s shows very clearly the path Surrealism had to follow from its origins to its politicization.                                                           -Walter Benjamin 

 

ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তির শেষ নিদর্শন হাজির করতে গিয়ে ‘পরাবাস্তববাদ’ প্রবন্ধে ফরাসি দেশের পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, কবি লুই আরাগোঁর শরণাপন্ন হয়েছিলেন জর্মন দার্শনিক বাল্টার বেনিয়ামিন। উদ্ধৃতির ভেতর কথাটি আরাগোঁ বলেছিলেন ১৯২৪ সালে ‘আ ওয়েভ অব ড্রিমস’ প্রবন্ধে। সেখানে তিনি পরাবাস্তবতার ধারণাকে পরিষ্কার করতে, তাকে তুলনা করেন এক বিস্তৃত দিগন্তের সঙ্গে। দিগন্ত এমন এক ব্যাপার, যা দেখা যায়, কিন্তু কেউ কখনো সেখানে পৌঁছুতে পারে না। এই অভিজ্ঞতা আমাদের বাস্তবেই হয়। মন জানে দিগন্তরেখা বাস্তবে নেই, কিন্তু সে তা দেখতে পাচ্ছে। মানুষের মন এই বাস্তব আর অবাস্তবের সম্মিলন ঘটিয়ে বিরাজ করতে পারে। এই অভিজ্ঞতাই যখন বিশেষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, অন্য ক্ষেত্রে বিস্তৃত করা হয়, তখন সেটি পরাবাস্তব বা অধিবাস্তবে রূপ নেয়। এই পরাবাস্তবের দিগন্তে তখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জাদুময়তা, ভাবালুতা, স্বপ্ন, পাগলামি, মত্ততা ইত্যাদি ভর করে। মানুষের মন তখন বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যবর্তী রেখায় চলে যায়, তার চিন্তার চলাচল দুই দুয়ারি ঘরে পরিণত হয়। মানবসভ্যতার যে কাণ্ড ও কীর্তি—মনে রাখা অপ্রয়োজনীয় নয়, আরাগোঁ এই প্রবন্ধ লেখার বছর কয়েক আগেই পয়লা নম্বর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে— তা বিস্ময়কর। মনুষ্যত্বের পাশে যখন মানুষের অমানবিক, পৈশাচিক হিংস্রতাকে রাখা হয়, তখন তাকে পরাবাস্তব বলেই বোধ হয়। করুণার সঙ্গে কিছুটা কৌতুকবোধও হয় না কি! যা-ই হোক, উল্লিখিত প্রবন্ধে বেনিয়ামিন আরাগোঁসহ আরও অনেকের শরণে দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরাবাস্তববাদ, বিংশ শতকের শুরুর দিকে, কেমন করে বুর্জোয়া বনাম বিপ্লবী রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

 

১.

 

মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ (২০২২) একটি পরাবাস্তববাদী ছবি। যদিও একে বলা হচ্ছে ‘আধুনিক রূপকথা’, পরিচালকই তা বলেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, তবে ছবিটি আমার কাছে ধরা দিয়েছে বাস্তবতারও অধিক কিছু হয়ে। বাস্তব ও অবাস্তবের এই দোলাচলে খেলা চলে যুক্তি ও যুক্তিহীনতার, সে কারণেই ‘হাওয়া’ ডাঙা থেকে যখন জলে যাত্রা শুরু করে, ঠিক তার আগমুহূর্তে ঘাটের এক ক্যানভাসারের মুখে শোনা যায়, ‘দরিয়ায় কোনো সায়েন্স খাটে না’। ছবির শুরুতেই দর্শক ইঙ্গিত পেয়ে যায় সামনে কি ঘটতে যাচ্ছে। দরিয়া নিজেই এক রহস্যময় দুনিয়া মানুষের কাছে, কারণ এর বহু কিছুই এখনো অনাবিষ্কৃত। তাই ‘হাওয়া’র মাছ ধরার জলযান নয়নতারা যখন সমুদ্রযাত্রা শুরু করে, তখন সে আসলে রহস্যের দুনিয়াতেই প্রবেশ করে। জাহাজে থাকা আটজনের সরদার চান মাঝি। তার সহযোগী ইজা। আছে ইঞ্জিন রুমের মিস্ত্রি, প্রতিবাদী ইবা। এছাড়া রয়েছে জেলে নাগু, উরকেস, পারকেস ইতি ও আদি।

 

জাহাজ মাঝ দরিয়ায় আসার পর জালে মাছ ধরা পড়ে। মাঝরাতে চান মাঝি আর তার সহচর ইজা যখন মাছ চুরি করে বিক্রি করার পাঁয়তারা করে তখন তা দেখে ফেলে ইবা, প্রতিবাদ করে। মাছ যদি মহাজনকে না দিয়ে বিক্রি হয়, তবে তার সমান হক তাদেরও। কিন্তু ইবা ইঞ্জিন মিস্ত্রি, সে মাছ ধরে না, কাজেই মাছে তার হক নেই, এটাই চান মাঝির বিচার। অর্থাৎ সে সবাইকে সমান চোখে দেখে না। এই অসমতার যানে একদিন ঝড়ের রাতে জালে উঠে আসে এক নারী। গুলতি নাম তার। সে কি মৎস্যকন্যা, না মনসা দেবীর প্রেরিত দূত অথবা অবতার, তা পরিষ্কার না হলেও, এটা স্পষ্ট হয় গুলতি কোনো সাধারণ মানুষ নয়। তবে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো পরিচালক সুমন এই অস্পষ্টতাকেই এক রহস্যময়ীর রূপে রূপান্তর করতে পেরেছেন। গুলতির অঙ্গসজ্জা থেকেও তা পরিষ্কার হয়। তার কানের দুলে মাছের অবয়ব। তার শাড়ি পরার ঢঙে বেদেনীদের ছাপ। আর শাড়ির রংটা লালচে, খয়েড়ি ধরনের। এমন রংয়ের শাড়ি মনসা দেবীর পরনে দেখা যায়। গুলতির ঠোঁটের লিপস্টিক নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে ভুলে যাবেন না এই গুলতি কোনো মানবী নয়, মন ভুলিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং এরপর আক্রমণ করাই এর ধর্ম। রাবর্ট এগার্সের ‘দ্য লাইট হাউস’ (২০১৯) যারা দেখেছেন, তারা জানেন, মৎস্যকন্যাদের মতো মায়াবিনীরা কেমন করে নাবিকদের চোখে ধরা দেয়। তারা নাবিকের চোখে প্রথমে হয়ে ওঠে আবেদনময়ী, নারীসঙ্গ বর্জিত একঘেয়ে জলরাশির মধ্যে যৌনতার চরম আকর্ষণ। তারপর মোক্ষম সময়ে তারা নিজেদের রূপ ধারণ করে।

 

গুলতি ইবার কাছে বলে, সে বেদের মেয়ে, দেবী (মনসা দেবী?) তাকে পাঠিয়েছে, প্রতিশোধ নিতে। চান মাঝি একসময় ছিল চান ডাকাত। এই ডাকাত গুলতির বাবার প্রাণ নিয়েছিল। অন্যভাবে দেখলে অন্যকে খুন করে লুট করেছিল। লুটেরা চানকে শিক্ষা দিতেই গুলতির আবির্ভাব। গুলতি এখানে অশরীরী। সে মাছ হতে পারে, সাপের রূপও ধরতে পারে। গুলতিকে দেখে ভূত দেখার মতোই প্রথমে চমকে উঠেছিল সবাই, বিশেষ করে চান মাঝি। মার্কস ও এঙ্গেলসের কথার প্রতিধ্বনি পাই, ইউরোপের শাসক, এলিট, ধর্মগুরু ইত্যাদি শ্রেণির লোক যেমন সমাজতন্ত্রকে ভূত দেখার মতো ভয় পেয়েছিল, ঠিক সে রকম গুলতিকে দেখে লুটেরা চান মাঝিও আঁতকে ওঠে। সে-ও ওসব ভূত দেখা লোকেদের মতো শ্রেণিবিভক্ত নয়নতারা জাহাজে এক ও অদ্বিতীয় শাসক হিসেবে কায়েম শুধু নয়, বুর্জোয়াদের মতো অন্যের হক মেরে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। মজার বিষয় এই যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, যা শাসকদের কাছে ভূত বা অশরীরী, সেই হিসেবেই আমরা দেখি গুলতিকে এবং তার বন্ধুত্ব হয় সেই বিপ্লবী ইবার সঙ্গেই। চান মাঝি যখন গুলতিকে বলাৎকার করতে চায়, তখন দৃশ্যত গুলতি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এবং আপন রূপ খুলতে শুরু করে। জাল ও নোঙর হারিয়ে জাহাজটি মাঝসমুদ্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অবধারিতভাবেই দোষ এসে পড়ে গুলতির ওপর। যেহেতু প্রচলিত বিশ্বাসে জাহাজে নারী নিষিদ্ধ! তবে সেই বিশ্বাসে আস্থা নেই ইবার। সে শুরু থেকেই সম্মানের সঙ্গে গুলতির প্রতিরক্ষায় কাজ করে যেতে থাকে। তারা জোটবদ্ধ হয়। একদিন সেটা ধরে পড়ে যাওয়ার পর ইবাকে খুন করে চান মাঝি। ওই মুহূর্ত থেকে উধাও হয়ে যায় গুলতি। এরপর একে একে সে মারতে থাকে জাহাজের নাবিকদের। সবশেষে সাপ হয়ে দংশন করে চান মিয়াকে। গুলতি ভালোবাসত বিপ্লবী ইবাকে। তার লাশের ওপর দিয়ে গুলতি যে প্রতিশোধ নেয়, সেই আনন্দ ও বেদনার সুর দিয়েই শেষ হয় ‘হাওয়া’। বিপ্লবীর মৃত্যু হলেও আদর্শের মৃত্যু নেই— এই বার্তাই যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে দিতে চায় ‘হাওয়া’। একটা প্রশ্ন আসতে পারে চান মিয়াকে মারতে গিয়ে জাহাজের অন্যদের খুন করে কেন গুলতি? এর একটা উত্তর হতে পারে যেহেতু তারা সকলেই চান মিয়ার সহযোগী হয়ে ওঠে সেজন্য, অথবা আরেকটি উত্তর হতে পারে—বিপ্লবের ঝড়ো হাওয়া অনেক নিরীহ গাছকেও উপড়ে ফেলে, ওটা পরিস্থিতির শিকার হওয়া মাত্র।

 

 

২.

 

চান মিয়ার সঙ্গে অনেকে চাঁদ সওদাগরের মিল খুঁজে পেতে পারেন। সেটা অস্বাভাবিক এ কারণে নয় যে পরিচালক রূপকথাকে আধুনিক ভাষ্য দিয়ে পরাবাস্তব চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছেন। পুরাণে শিবের ভক্ত চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মনসা দেবীর যে দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের একটি মোটা দাগের মিল হয় তো এখানে পাওয়া যায়। পুরাণের চাঁদ সওদাগরও ধনিক শ্রেণির, সে আর্য দেবতা শিবের প্রিয়পাত্র। আর মনসা দেবী দেবকুলে ব্রাত্যজন, তিনি অনার্যদের দেবী। আর্য ও অনার্যের দ্বন্দ্বই যেন মূর্ত হয় চাঁদ সওদাগর আর মনসা দেবীর লড়াইয়ে। সেই লড়াইটাই এই চলচ্চিত্রে শেষ পর্যন্ত রূপক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অধিবাস্তবতায় রূপ নেয়। যেখানে প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙেচুরে যায়। সমুদ্রের দিগন্তরেখা ছাড়া আর কোনো কিছুই দৃষ্টিসীমায় আসে না। হাল ও পাল ছাড়া চান মাঝির জাহাজটি অন্তিম অঙ্কে যে রক্তে রঞ্জিত হয়, সেটি যেন বিপ্লবের রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে। লাশ, রক্ত ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ইয়ুজিন দেলাক্রোয়ার বিখ্যাত ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ তৈলচিত্রের নারীটি যেমন মুক্তির কামনা ও অতিমানবীয় সত্তার রূপক বা অ্যালেগরি হয়ে ওঠে, ঠিক এই নয়নতারার পাটাতনেও লাশ, রক্ত ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর গুলতি হয়ে ওঠে অভিশাপ মুক্তি ও শোষণের প্রতিশোধ নেওয়া সত্তার প্রতিভূ। 

 

ছবির বিপ্লবী চরিত্র ইব্রাহিম ওরফে ইবা আসলে কে? ধর্মগ্রন্থে গেলে দেখা যায়, ইব্রাহিম বা আব্রাহাম এমন ব্যক্তি, যিনি সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবান করতে রাজি থাকে পরমের জন্য। কারও কাছে সৃষ্টিকর্তা পরম, কারও কাছে আদর্শই তার পরম, আবার কারও কাছে প্রেমই হয়ে ওঠে পরম। ‘হাওয়া’র ভেতর ইবা আপাতদৃষ্টে প্রেমের কারণে নিজের সবচেয়ে প্রিয়, নিজের জান কোরবান করে দিতে প্রস্তুত থাকে। রূপক অর্থে এই প্রেম আদর্শও বটে। বুর্জোয়া শক্তির আরেক রূপক চান মিয়ার বিপরীতে শোষণ ও বঞ্চনার তলা থেকে জেগে ওঠার আদর্শ। 

 

রূপকথার এই ছবিতে খোদ জাহাজটিও অনন্য এক রূপক। রাষ্ট্র বলেই বোধ হয় এই নয়নতারাকে। লক্ষ করলে দেখা যায়, বৈষম্যের শিকার, বঞ্চিত ইবা থাকে জাহাজের নিচের ঘরে, যেটি ইঞ্জিনঘর। যে ঘর গোটা জাহাজের চালিকা শক্তি। অথচ সেই শক্তিকেই অবহেলা ও বঞ্চিত করে জাহাজের ছাদে বসে থাকা চান মিয়া। যে চান মিয়া সবার অভিভাবক হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তার ভেতরেই আমরা আবিষ্কার করি ডাকাত, লুটেরা, শোষক, খুনি, লোভী ও হাস্যকর রকম ভিতু এক মানুষকে। কে অস্বীকার করবে এই চরিত্র রাষ্ট্রের বুর্জোয়া শ্রেণির রূপায়ণ নয়? অন্যদিকে শাসকদের সহযোগী গোষ্ঠী এলিট গোষ্ঠীর মেটাফোর হয়ে ওঠে ইজা। ইজা মানে তো জমাখরচের সমষ্টি। এই ইজা শাসকের জমাখরচের হিসাব রাখে। সে তার একান্ত সচিব। এই শ্রেণি নিচের দুই শ্রেণির ওপর বসে ছড়ি ঘোরায়। মাঝে থাকা জেলে ও রান্নাবান্নার মানুষগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপক। তারা অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল। চান মিয়া তাদের দলে টানার চেষ্টা করে, অপরদিকে ইবাও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে—পাওনা আদায় করে নিতে হয়। মধ্যবিত্ত থাকে দোটানায়। তবে আদর্শ ওরফে গুলতি তাদের আকৃষ্ট করে সর্বদা। কিন্তু আত্মত্যাগের প্রশ্নে এই মধ্যবিত্ত পিছিয়ে থাকে নিচুতলার মানুষ—যারা প্রকৃত সর্বহারা—তাদের চেয়ে।

 

রূপক ছাড়া ভাষা যেমন হয় না, তেমনি রূপক ছাড়া পরাবাস্তবতাও রচনা অসম্ভব। পরিচালক যদি ছবিটিকে আধুনিক রূপকথা বলেও থাকেন, তাতে সমস্যা নেই। এই রূপকথার ওপর ভর করেই যে পরাবাস্তব ছবি তিনি বানিয়েছেন, সেটি শেষ পর্যন্ত, আমার বিচারে ভীষণ রকম রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। এই চলচ্চিত্র বহুস্তর বিশিষ্ট। তার এক স্তরে যদি থাকে রূপকথা, আরেক স্তরে রূপকভিত্তিক পরাবাস্তব, তো তৃতীয় স্তরে রয়েছে রাজনৈতিক সচেতনতা। শুরুতে যে আলাপ আমরা করেছিলাম, পরাবাস্তবতার ভেতর যেসব উপাদান থাকে, তার সব কটিই এই চলচ্চিত্রে উপস্থিত: বিশ্বাস-অবিশ্বাস, জাদুময়তা, ভাবালুতা, স্বপ্ন, পাগলামি, মত্ততা। ছবির কাহিনি ও চরিত্র বিশ্লেষণ করলে এই উপাদানগুলো বেরিয়ে আসবে। যেমন জাহাজে যা ঘটছে, তা নিয়ে ইবার বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচল, গুলতির জাদুময়তা, উরকেস-পারকেসের ভাবালুতা, জেলেদের অনেক মাছ ধরার স্বপ্ন দেখা, এক রাতে অনেকগুলো জাহাজ যখন একসঙ্গে হয়, তখন মদ ও নারীর জন্য পাগলামি ও মত্ততা—সবই মজুত আছে এই ছবিতে। এই সবকিছু পুঁজি করেই ছবিটি রাজনৈতিক বক্তব্যের দিকে এগোতে থাকে। 

 

 

৩.

 

‘হাওয়া’ ছবিতে ‘সাদাসাদা-কালাকালা’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। গানটি ব্যবহার হয়েছে জনপ্রিয় উপাদান হিসেবে। সাগরের মাঝে গানটি ব্যবহার হলেও, তার জন্ম হয়েছে শাহবাগ এলাকায়। আমার মনে হয়, এই ক্ষেত্রে পরিচালক আরেকটু বিচক্ষণতার পরিচয় দিলে ভালো করতেন। মাঝিমাল্লাদের অনেক গানই তো আসলে আছে, এসব নিয়ে কাজ করা লোকের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নেই। তাদের দ্বারস্থ হওয়া যেত। তবে গানটি যেভাবে ছবিতে প্রয়োগ হয়েছে, তা যথাযথই হয়েছে। 

 

ছবিটির অনেক দৃশ্যই মনে দাগ কাটার মতো। বিস্তীর্ণ পাথারে জাহাজের একা ভেসে থাকার যে দৃশ্য আমরা পাখির চোখে দেখি, সেটি যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি আকর্ষণীয় লাগে নোঙরের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাও যখন গভীর জলরাশির ভেতর ডুব দেয় দর্শককে সঙ্গী করে। আরও একটি দৃশ্য চোখে লেগে থাকার মতো। জাহাজের একটি ঘরের ভেতর ক্যামেরা বসানো, ত্রিভুজ শটে টানাপোড়েন, আর ঘরের দরজা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছে গুলতিকে, এই ডেপথ অব ফিল্ড প্রশংসনীয়। চলচ্চৈত্রিক ভাষার এমন প্রয়োগ বহুদিন পর বাংলা চলচ্চিত্রে দেখা গেল। আমার তো ‘সিটিজেন কেইনে’র (১৯৪১) কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ‘হাওয়া’ ছবির সিনেমাটোগ্রাফি দর্শক দীর্ঘদিন মনে রাখবে। কেন এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফিকে বাহবা দিতে হবে, সেটা বলি। সাগরে নেমে ক্যামেরা চালনা করা এমনিতেই চ্যালেঞ্জিং, শক্ত মাটিতে তেপায়া রাখার সুযোগ নেই যেহেতু, তারপরও ঢেউয়ে ভেসে যে ফ্রেম কেটে বের করা হয়েছে তা দুর্দান্ত ব্যাপার। তা ছাড়া জাহাজের পাটাতনে, ছোট্ট ঘরের ভেতর কিংবা ইঞ্জিন ঘরের ঘিঞ্জি জায়গায় ক্যামেরা বসিয়ে সঠিক কম্পোজিশন করা সত্যিই সংপ্রশ্নবিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু তারপরও প্রতিটি ফ্রেম মনে করিয়ে দেয়, ক্যামেরা দক্ষ শিল্পীর দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। কামরুল হাসান খসরুর কষ্ট সফল হয়েছে বলতে হয়। 

 

অভিনয়ের কথা যদি বলি তাহলে প্রত্যেকেই ভালো অভিনয় করেছেন। তবে গুলতি চরিত্রে অভিনয় করা নাফিজা তুষির আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। চান মিয়ার চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীকে একটি জায়গায় মনে হচ্ছিল তিনি অভিনয় করছেন, যখন নিজেরই পোষা পাখিটি চান মিয়া আগুনে পুড়িয়ে খাচ্ছিল, সেই জায়গাটি। বাকিটা তিনি চমৎকার সামলেছেন। তাকে চান মিয়াই মনে হয়েছে। 

 

তবে এসব টুকিটাকি জিনিস বাদ দিলে ‘হাওয়া’কে বলব বাংলাদেশের চিন্তাশীল চলচ্চিত্রের মুকুটে যুক্ত হওয়া সর্বশেষ পালক। এ ধরনের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়, হাওয়ার বেগে একটি কথা চাউর হয়েছে, ‘হাওয়া’ নাকি কোরিয়ান ছবি, সাং বো সিম পরিচালিত ‘সি ফগে’র (২০১৪) নকল। শুধু এটুকুই বলতে চাই, সমুদ্র, জাহাজ ও একটি মেয়ে থাকলেই সেটি নকল হয়ে যায় না। মূল উপজীব্য এক কিনা, সেটা বিবেচনা করা জরুরি। কোরীয় ছবিটি মানব পাচার নিয়ে করা, আর বাংলাদেশের ছবিটি রূপকথা ও পরাবাস্তবতার ডানায় ভর দিয়ে দাঁড়ানো পুরো দস্তুর রাজনৈতিক বয়ান। 

 

 

দোহাই

 

১. বাল্টার বেনিয়ামিন, রিফ্লেকশনস: এসেইজ, অ্যাফোরিজমস অটোবায়োগ্রাফিকাল রাইটিংস, পিটার ডেমেটজ সম্পাদিত, এডমুন্ড জেফকট অনূদিত, (নিউইয়র্ক: শোকেন বুকস, ২০০৭) 

২. লুই আরগোঁ, আ ওয়েভ অব ড্রিমস (১৯২৪), সুজান দো মুথ অনূদিত (২০০৩), লিংক: https://cutt.ly/FZTFNv7 (নেয়ার তারিখ: ১ আগস্ট ২০২২)