মেয়ের আবদার বলে কথা। মাস শেষে বেতন তুলেই এক হাজার টাকা আলাদা করে রেখেছেন শুক্রবারের জন্য। শুক্রবার সকাল সকাল মিতুকে নিয়ে গেছেন কোনাবাড়ী বউবাজারে। বাজারের সবচেয়ে বড় সাইজের পাঙাশ মাছটা কিনেছেন রোজিনা বেগম। মাছটা মিতু নিজে ঠিকমতো বহন করতে পারছে না। তবু জোর করেই মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বহন করছে মিতু। এইডা কী রে? বড় মাছ। কত বড় রে? ম্যালা বড়। কেডায় (কে) খাইবো? আমি খামু। কেডায় খাইবো রে? আমি একলাই খামু রে। কতানি (কতটুকু) খাবি রে? ভেক্ষানি (পুরোটা) খামু রে—এভাবেই বলতে বলতে মা রোজিনা বেগম আর মিতু বউবাজার থেকে ফিরছিল রাজ বেকারির গলির বাসায়।
এক রুমের এক কামরায় রোজিনা বেগম আর তার চাচাতো বোনের বসবাস। তেরো কক্ষের এই টিনশেড বাসার দুটি কমন বাথরুম আর তিনটা রান্নাঘর। এল আকৃতির এ বাসাটির একটু উঠানও রয়েছে। চারদিকে এত বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে যে ওপর থেকে এটিকে এখন ভাগাড় বললেও ভুল হবে না। দুই হাজার ছয় শ টাকা ভাড়া আর চার শ টাকা বিদ্যুৎ ও পানি বিল—এই মোট তিন হাজার টাকা দুজনে ভাগ করে দেন। যেভাবে সিরিয়াল দিয়ে গোসল আর রান্না করতে হয়, সেটি চিন্তা করলে এগুলোকে ঠিক বাসা বলা যায় না। তবু পেটের দায়ে এটা ভাগ্য বলে মেনে নিতে হয় তাদের। রোজিনার সকাল শুরু হয় ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। ঘুম থেকে উঠেই রান্না ঘরে সিরিয়াল দেন। তারপর বাসনকোসন পরিষ্কার করে ঘর গুছিয়ে মেয়ের ঘুম ভাঙান। মা-মেয়ে খেয়েদেয়ে রেডি হন। মিতুকে ছাকিরন চাচির কাছে দিয়ে বের হন গার্মেন্টের উদ্দেশে। পাক্কা পনেরো মিনিট হেঁটে পৌঁছান এজে ফ্যাশন লিমিটেড কোম্পানির গেটে। দুপুরে লাঞ্চে এসে দুমুঠো ভাত গেলেন মেয়েকে নিয়ে।
প্রায় দিনই কাজ শেষে ফিরতে ফিরতে মাগরিব থেকে এশা হয়ে যায়। চিন্তা হয় মিতুর জন্য। মিতুও প্রথম দিকে কেমন মনমরা হয়ে গিয়েছিল এভাবে একা থেকে থেকে। এখন অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে। মোটামুটি ওভার-টাইমসহ নয়-দশ হাজার টাকা বেতন তুলতে পারেন রোজিনা বেগম। এর মধ্যে বাসাভাড়া, খাওয়াদাওয়া, কাপড়চোপড়, মিতুর স্কুলের খরচ, বুড়ো মায়ের জন্য কিছু টাকা পাঠানো তো আছেই। এর ওপর আবার ছাকিরন বেওয়ার বেতন। শুধু বেতনই নয়, টুকটাক এটা-সেটা না দিলে তার মন পাওয়া যায় না। এমন টানাটানির মধ্যে যদি পরিবারের কারও অসুখ করে তবে দেনা করা ছাড়া যেন পার নেই। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে বিছানায় গিয়ে লাইট অফ করলে মনটা যেন হু হু করে কেঁদে ওঠে। কত কালের পুরোনো স্মৃতি ভেসে ওঠে তার লেখাজোখা নেই। দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে তবুও যুদ্ধ করছেন; কারও কথায় কান না দিয়ে একলা চলছেন। কেন, কে জানে? হয়তো মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই। কতজনে কত কথা বলে, এমন একলা জীবন নিয়ে। মিতু একটু বেশি দুষ্টুমি করলে ছাকিরন বেওয়াই বলে বসে—তর মেয়াডা (মেয়েটা) আর দেকপার পামু না, আর কত জিদ ধইরা থাকপি? কত মেয়াছল (মেয়েমানুষ) আছে না, বউ মরা মাদবর (মাঝ-বয়সী) বিয়া কইরা সুখে সংসার করতাছে। তর এক জিদ, কারুরি (কারো) কথা হুনবি (শুনবি) না। তা কর! তর মেয়া তুই মানুষ কর। আমি আর দেকপার পামু না।’ রাগ হয় রোজিনার। মুখে-চক্ষে দু-চারটি কথা শোনাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুখ বুঝে সইতে হয়। শুধু ছাকিরন চাচির কথাই না, হাজার রকমের কথা শুনতে হয় রোজিনার। মোড়ের মুদিদোকানদার থেকে অফিসের কতজনে কত রকম কথা বলে তার শেষ নেই। এই যে, কোনো দোকানে ফ্লেক্সি দিতে গেলে কত অজানা নম্বর থেকে কত যে ফোন আসে। আজব কিসিমের মানুষ! কত ভেক্ ধরে। আবার ধরেন, গার্মেন্টের পাশে সারির অপারেটর আকবর ভাই। বউ-পোলাপান থাকতে কত রকম ‘নাটক’ করে রোজিনার সঙ্গে। সারা দিন ঘুরঘুর করতে থাকে। এই তো খিলিপান, না-হয় চানাচুর, কখনোবা সাফারি পার্কে ঘুরতে যাওয়ার বায়না, আরও কত কী। সায় দেয় না রোজিনা। কী আশ্চর্য ঘটনা। সেদিন লোডশেডিংয়ের সময় গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছিল আকবর। কষে থাপ্পড় দেয় রোজিনা। পড়ে অবশ্য ভয় পেয়েছিল। আকবর যদি পাছে কোনো ক্ষতি করে ফেলে।
প্রায় তিন বছর ধরে থাকছেন এভাবেই। তবে গার্মেন্টে কাজ নেওয়ার পাঁচ বছর হয়েছে। দুই বছর বিধবা মাকে সঙ্গে নিয়েই ছিলেন। তখন তিনিই মিতুর দেখাশোনা আর টুকটাক ঝিয়ের কাজ করতেন এ-বাড়ি ও-বাড়ি। কিন্তু একবার এমন জন্ডিস ধরল যে বাঁচানোই দায়। প্রতিবেশীরা বলল ঢাকার জন্ডিস খুব মারাত্মক। এখানে চিকিৎসাপাতি করে তেমন লাভ নেই; বরং বায়ু বদলাতে হবে। পরে সে যাত্রায় গ্রামে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে রোজিনার মা। তারপর আর ভ্রমেও মনে করেনি এ তিলোত্তমা শহরের কথা। এর পর থেকে পাঁচ-সাত বছরের মিতুকে সারা দিন টুকটাক দেখাশোনার ভার পাশের কামরার ছাকিরন চাচির ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন রোজিনা বেগম। ছাকিরন বেওয়া তার দুই নাতি রুবিনা, মিমের সঙ্গে মিতুকেও স্কুল যাওয়া-আসাসহ সারা দিন দেখাশোনা করেন। এ বাবদ মাসিক সাত শ টাকা আর বছরে দুটি শাড়ি দেন রোজিনা। আসলে শুধু টাকার জন্য না, ভালোবাসার টানেই এ দায়িত্ব নিয়েছেন ছাকিরন বেওয়া। রোজিনার বেগমের অকূল পাথারে তিনি কা-রীই হয়েছিলেন বৈকি! এ কারণেই রোজিনাও নিশ্চিন্তে মেয়েকে রেখে গার্মেন্টে ডিউটি করতে পারেন। সকালে রান্নাবান্না করে মা-মেয়ে দুজনই খেয়ে রেডি হন। তারপর মিতুকে ছাকিরন চাচির কাছে রেখে চলে যান গার্মেন্টে। ছাকিরন চাচিকে নানি বলেই জানে মিতু। স্কুলে যাওয়া বাবদ পাঁচ টাকা করে নেন নানির কাছ থেকে। এজন্য আগে থেকেই টাকা দিয়ে রাখেন রোজিনা বেগম। চটপটে মিতুও বেশ মজার সঙ্গে স্কুলে যান। মন খারাপ হয় স্কুল থেকে ফিরে এসে। নানি চলে গেলে তার ভালো লাগে না। রুমে একলা বসে টিভি দেখে বা অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলে। ছাকিরন বেওয়া অবশ্য বেশ চোখে চোখেই রাখে।
দুপুরের লাঞ্চে সময় হিসাব করা রোজিনা বেগমের। যাওয়া-আসা ত্রিশ মিনিট, নিজে ও মিতুকে খাওয়ানো পনেরো মিনিট। আর মিতুকে বিছনায় নিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা পাঁচ-দশ মিনিট। এই তো এক ঘণ্টা লাঞ্চ টাইম হাওয়া। মা উঠে গেলে মিতু মোচড় দিয়ে উঠে যায় বিছানা থেকে। রুম থেকে বের হয়ে খোঁজে খেলার সাথি। রুবিনা, মিম, হালিমা—কারও দেখা পেলেই শুরু হয় পুতুল খেলা। ছাকিরন বেওয়ার বারণ যেন ওরা কেউই শুনতে পায় না। এ ছাড়া অবশ্য পাশের অ্যাপার্টমেন্টের কুদ্দুস দারোয়ানের সঙ্গেও বেশ খাতির হয়েছে। দাদা বলেই ডাকে। বেশ আদরও করে। এটা-ওটা কিনেও দেয় মাঝেমধ্যে। কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন না থাকলেও এসবই আপন ভুবন মিতুর। স্কুলের সময় অতটা চিন্তা হয় না রোজিনা বেগমের। দুপুরে লাঞ্চের পর মিতুকে রেখে যেতে কেমন যেন মনটা শুকিয়ে যায়। তবু যেতে হয় কাজে। মিতুও এটা-সেটা নানান জ্বালাতন করে। অনেক সময় দুটো চড়-থাপ্পড় দিয়েও রুমে রেখে যান। এই তো গত পরশু বায়না ধরেছে গার্মেন্টে যাবে। কোনোভাবেই পিছু ছাড়ে না। অবশেষে রাগের মাথায় দুটো থাপ্পড় দেন মিতুকে। একদম মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। তবু ছাকিরন বেওয়াকে ডেকে রুমে রেখে বের হন গার্মেন্টের উদ্দেশে। কাজে বসে মন খারাপ হয়ে যায়। ফোন করেন ছাকিরন বেওয়াকে। ইদানীং বিকেলে দু-তিনবার করে মিতুর খোঁজ নেন রোজিনা। এতে ছাকিরন বেওয়াও যেমন বিরক্ত হন, অন্যদিকে গার্মেন্টের সহকর্মীরা প্রায়ই বলে, কী রে মিতুর মা। ঘনঘন বারান্দায় ক্যা? মনে রং ধরল নাকি! উত্তর করে না রোজিনা।
প্রায়ই সোয়া পাঁচটা বাজে। লাইনম্যান খিস্তিখেউর শুরু করছে। ‘সারা দিনে কয়টা আপার পার্টস করছ। আশি পিস মালও পাস করতে পারো নাই। না পারলে মেশিন ছাইরা দেও। ম্যালা মানুষ আছে। স্যারেরা তুমার ওপর চ্যাতা। আইজ আমি মেকাপ কইরা নিলাম।...যাও কাল থিকা একশ’ কইরা দিবা। আরমান স্যার কইছে।’ রোজিনা বলে, ‘ইন্টার লুপ সিস্টেমের সেলাই! সময় লাগতাছে ভাই। ক্যামনে এত দিমু। হাত তো কম চালাই না। এমন উত্তরে লাইনম্যান সুপারভাইজারকে ডেকে আনে। বাজে কথা বলে। এত কাজ করার পরও এমন কথা শুনে বুকে খিল ধরে যায় রোজিনার। এমন সময় বারবার ফোন বাজতে থাকে। হাতে নিয়ে দেখে ছাকিরন চাচির ফোন। রিসিভ না করে কেটে দেয়। তবু কল আসতে থাকে ছাকিরনের। আবার কেটে দেয় রোজিনা। এভাবে চারবার। এরপর দেখে বাড়ি-মালিক সালাম চাচার ফোন করেছে। কী হলো আবার! ঘাবড়ে যায় রোজিনা। ফোন রিসিভ করা মাত্রই ধমক দেন বাড়ি-মালিক। বলে, ‘ফোন ধরস না ক্যা রে রোজিনা? তাড়াতাড়ি আয়, তর তো হুঁশ-জ্ঞান নাই। এতে ছোট মাইয়া একলা রাইখা যাস। কী আর কমু।’ বুকটা ফাঁকা হয়ে যায় রোজিনার। কথা বলতে পারে না। ‘কী হইছে চাচা? মিতুর কিছু হইছে? অ্যাক্সিডেন্ট করছে নাহি? কন আমারে’ কাঁদতে থাকে রোজিনা। চোখের জলে ঝাপসা দেখে সবকিছু। ‘বাসায় আয় তাড়াতাড়ি, দেকপার পাবি নে’ বলে ফোন রেখে দেয় বাসার মালিক। কারও কিছু না বলে বের হয়ে যায় গার্মেন্ট থেকে। এমনকি গেটে অপ্রস্তুত দারোয়ানকেও সার্চের সুযোগ না দিয়ে উঠে পড়ে রিকশায়। চারদিকের যানজট, ভিড়-বাট্টা, গাড়ির বিকট হর্ন—কিছুই তার মাথায় নেই। কান তালা লেগে গেছে তার। কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। শুধু রিকশাওয়ালাকে বলতে থাকে আরও জোরে চালান ভাই, একটু তাড়াতাড়ি যান। চোখের সামনে ভাসতে থাকে ফ্রক পরা ছোট মিতু। খিলখিল করে হাসছে। স্কুলের জন্য তৈরি হতে হতে বলছে, ‘মা আমি বড় হইয়া ডাক্তার হমু। তুমার কোমরের ওষুধ দিমু। ভালা হইয়া যাবা গা। আমাগর ম্যালা টেকা হইবো।’
রাজ বেকারির গলির মোড়ে যেতেই স্লো গতিতে যায় রিকশা। সামনে এত মানুষের জটলা আর পুলিশ ভ্যান দেখে মাথায় বাজ পড়ে যায়। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। কী হয়েছে মিতুর? আঁচ করতে পারে না রোজিনা। চিৎকার করে বলতে চেষ্টা করে, আমার মিতুর কী হয়েছে? বুকের ভেতর থইথই করতে থাকে বানের জলের মতো আর্তনাদ। বুক-পিঠ খিল ধরে যায়। কথা বলতে পারে না। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে ভিড়ের দিকে। ধুপ করে পড়ে যায় রিকশা থেকে।