কাউকে উদ্দীপ্ত করার ঐন্দ্রজালিক হাতিয়ার হলো গান। মানবসমাজে বিশেষত আদিম মানবসমাজে নাচ, গান ছিল দেবতাকে তুষ্ট করার হাতিয়ার। কিন্তু বেশি দিন মানুষ গানকে আর তার দেবতাকে তুষ্ট করার উপাদান হিসেবে ট্যাবু করে রাখতে পারেনি। দেবতাদের মন্দিরের চৌহদ্দি পেরিয়ে মানুষ নিজেদের আনন্দ, বেদনাকে গান আর নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করতে শুরু করে। আদিম মানুষ শিকার করার পর অবোধগম্য ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। আর্যরা অস্ট্রিকদের এই ভাষাকে বলেছিলেন বায়াংসী। পাখির ভাষার মতো ভাষা। পাখির কথাকে আমরা কথা বলি না—গান বলি অথচ পাখিরা স্বগোত্রের মধ্যে তাদের ভাষা বোঝে নিশ্চয়ই, তবু তা আমাদের কাছে গান। আদিম মানুষেরা আনন্দ প্রকাশ করার জন্য যে শব্দসমষ্টি উচ্চারণ করত, তাই-ই ছিল তার গান। আদিম মানুষ এই সংগীতের মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার আত্মবিশ্বাস আর কর্মপ্রেরণা। সংগীতের মধ্যেই তারা তাদের সমস্ত চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে আর নানা সীমাবদ্ধতা সমাধানের চেষ্টা চালিয়েছে। এ কারণেই আদিম মানুষের সংগীত তাদের শ্রম আর জীবিকা বা পেশার সঙ্গে জড়িত। এই আদিম সংগীতই কালের বিবর্তনের ধারায় লোকসংগীত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
মানুষের দুঃখ-বেদনা-আনন্দ-উচ্ছ্বাস যা কিছু অনুভূতিজাত, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত তার গানে। যেকোনো সাংস্কৃতিক প্রত্যয়সমূহের মধ্যে গানই হলো একমাত্র প্রত্যয়, যাতে মানুষ খুব দ্রুত সাড়া দেয় এবং সম্মোহিত হয়।
মানবসমাজে তাই প্রচলিত আছে নানা ধরনের গান। কিছু গান আছে উৎসবকেন্দ্রিক, কিছু ব্রতকেন্দ্রিক এবং কিছু আছে ঘটনাকেন্দ্রিক। উৎসবকেন্দ্রিক গানগুলোর মধ্যে আছে পূজাকেন্দ্রিক গান, যেমন মনসা গীত, লক্ষ্মীর গীত, শিবসংগীত ইত্যাদি। এ ছাড়া ঋতু উৎসবে গাওয়া হয় ফসল কাটার গান, নবান্নের গান। বিবাহ উৎসবে বিয়ের গান ছাড়াও রয়েছে ভাওয়াইয়া, টুসুর গান, চটকা গান, বারমাইস্যা গান, ভাটিয়ালি গান ইত্যাদি। এসব গান ছাড়াও কিছু গানে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ; কোনো বিশেষ সমাজের জীবনচিত্রের ছাপ থাকে। ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি গানেও এ প্রভাব রয়েছে। সব কালে সব সমাজে এমন কিছু গান থাকে, যাতে সেই সমাজের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। বেদে জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এমন কিছু গান প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো বেদে সংগীত নামে পরিচিত। অর্থাৎ যেসব গানে বেদে সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সমাজ পরিচয় বিধৃত হতে দেখি সেই সব গানকেই আমরা বেদেসংগীত বলতে পারি। এই গানের সুরেও বিশেষ বৈচিত্র্য রয়েছে। মালগোত্রের বেদেদের গানের সুর শান্দার গোত্রের বেদেদের গানের সুর থেকে বেশ আলাদা।
অনেক সময় বেদেরা গানের সুরে মন্ত্র পড়ে, শুনে মনে হতে পারে যে, সে গান গাইছে, কিন্তু আসলে সে মন্ত্র পড়ছে। এগুলোকে কোনোক্রমেই গান বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সুমনকুমার দাশ তার বেদে-সংগীত গ্রন্থে যে ২৯টি গান সংকলিত করেছেন, তার মধ্যে ১০, ১১, ১২ ও ১৩ নং গান মূলত মন্ত্র। এগুলো বেদে সংগীত নয়। মন্ত্র দুভাবেই পড়া যায়—আবৃত্তির ঢঙে আর গানের সুরে।
মন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রার্থনা (Prayer) এবং দোহাই (Challenge)। মন্ত্রের প্রার্থনা অংশে থাকে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার কিংবা কোনো ঘটনা ঘটার আকুতি।
যেমন, কালা কালা বিষ আর
কালা হিন্দুরের ফোঁড়া
হাড়ির ঝি চণ্ডীর বরে
না মানে বাধা ॥
এ অংশে বিষ ওঠানোর জন্য চণ্ডীর নিকট প্রার্থনা করা হচ্ছে। মন্ত্রে প্রার্থনার পর পর জুড়ে দেওয়া হয় শর্ত। শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে হুমকি বা চ্যালেঞ্জ (Challenge) দেওয়া হয়। যেমন—
কার আঁচলে থাকারি বিষ
আমার আঁচলে থাক।
আমার আঁচল থাকিয়া যদি
অন্য আঁচলে যাস—
দোহাই লাগে মা-মনসার
মাথা খাস ॥
মন্ত্রে ‘বিষ’ বা ওই জাতীয় বস্তুকে নির্দেশ দেওয়া হয় ওঝার আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য। ব্যর্থ হওয়ার লজ্জা যেন ওঝার নয়, এ লজ্জা যেন ওই বস্তুর। কেননা, এই মন্ত্রের মাধ্যমে ওঝা কোনো নির্দেশ তাকে দেননি, নির্দেশ দিচ্ছেন স্বয়ং দেবতা। যেমন, কার আজ্ঞে?
মা-মনসার আজ্ঞে
কামরূপ কামিক্ষ্যার আজ্ঞে।
কিন্তু গান তো এ রকম কোনো বিষয় নয়। প্রার্থনা সংগীতে নিবেদন থাকে, আকুতি থাকে। থাকে ভক্তি ও ভালোবাসা। Challenge-এর স্থান সেখানে নেই। গানে ফুটে ওঠে বেদনা, আনন্দ, দুঃখ এবং কোনো লোকায়ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বেদে জনগোষ্ঠীও গান প্রিয় একটি সম্প্রদায়। বিশেষত মাল ও শান্দার বেদেদের জীবন যেন গানের সঙ্গেই বাঁধা। তারা বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশি তৈরিতে বেশ দক্ষ।
সিলেটে এমন একদল বেদের সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা নিজেদের পরিচয় দেয় গাইন হিসেবে। এ রকম তিনটি গোত্র হলো ১. লাউয়া মান্তা গাইন, ২. মাল মান্তা গাইন, ৩. হাপড়ে মান্তা গাইন।
লক্ষ করলে দেখা যাবে যে মাল মান্তা হচ্ছে বেদেদের একটি মূল গোত্র। এই গোত্রের দুটি উপগোত্র হচ্ছে ১. সাপুড়ে মান্তা ও ২. লাউয়া মান্তা। উভয় গোত্রের বেদেরা ভালো গায়ক হয়। এ কারণে ধারণা করা হয় সংগীত জগতে মালকোশ নামের যে বিশেষ রাগ আছে, তা এই মালগোত্রের বেদেদের গানের রাগ থেকেই উৎপন্ন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গীয় শব্দকোষে জানান, ‘মালকোশ শব্দটি মালকৌশিক-এর অপভ্রংশ।’ গীতসূত্রসার গ্রন্থ প্রণেতা কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “পুরাকালে হিন্দুস্তানী মালেরা বোধ হয় উত্তম মানের গায়ক ছিল; এখনও হিন্দুস্থানী সাপুড়িয়ারা উত্তম তম্বুড়ি বাজায়। পুরাকালে তাহারা যে সুরে গান গান করিত, সেই সুরের নাম মালকৌশিক রাখা হইয়া থাকিবে, এবং হেমন্তে... মালেরা ফিরি করিতে বাহির হয় বলিয়া, মালকোশ হেমন্তে গাওয়ার রীতি হইয়া থাকিবে।’ আবার কৌশিক শব্দের অর্থ সাপুড়ে। অর্থাৎ এখানে একটি কথা পরিষ্কার যে মাল গোত্রের সাপুড়িয়াদের গানের সুর থেকেই মালকোশ গানের রাগের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সিলেটের বেদেরা যারা নিজেদের গাইন বলে পরিচয় দেয়, তারা মূলত শান্দার গোত্রের একটি উপগোত্র হয়ে থাকবে। কেননা, তারা নিজেদের জেহাদ গাইনের বংশধর বলে মনে করে। অর্থাৎ শাহজালালের সময় তারা শাহজালালের সঙ্গী হিসেবে জেহাদী গান গাইতেন। বাংলাদেশের সাটুরিয়া অঞ্চলের শান্দার পাড়ায় সন্ধ্যার সময় গানের আসর বসে। তারা কালুশাহর মাজারে এই আসর বসায়। আধ্যত্মবাদী গানের সঙ্গে জেহাদি গানও তারা গেয়ে থাকে।
সম্প্রতি ‘বেদে সংগীত’ নামে সুমনকুমার দাশের একটি ‘বেদে সংগীত সংকলনের বই বের হয়েছে। তাতে সংকলিত হয়েছে বেদেদের কিছু গান। এ রকম একটি গান হচ্ছে—
বাইদ্যারে তুই ঘরে ফিরা আয়
সারাদিন দেখি নাই তুরে
কই যে ঘুইরা বেড়াস॥
তুর আশায় থাকি চাইয়া
নাওয়ের বাতায় বইয়া
বাইদ্যারে তুই তাড়াতাড়ি
ঘরে ফিরা আয়।
আসমান মেঘের মতন
আন্ধার হয় আমার মন
ইচ্ছা হয় ছুইটা যাই যখন-তখন।
তুই যে আমার সাত রাজার ধন
বাইদ্যারে তুই ঘরে ফিরা আয়
সারাদিন দেখি নাই তুরে
কই যে ঘুইরা বেড়াস ॥
সারাদিন বাইদ্যা ঘরে আসে নাই। তার বিরহে বেদেনী নৌকার গলুইয়ে বসে গান গাইছে। প্রাণের আকুতি সুরে সুরে ঝরে পড়ছে। তাকে ঘরে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করছে, সারাদিন তাকে দেখতে না পেয়ে বেদেনীর মন যেন মেঘের মতো অন্ধকার হয়ে আছে। বেদেনীর মনের এমন অবস্থা যে তার মনে হয় যখন তখন সে যদি তার বাইদ্যার কাছে ছুটে যেতে পারত! কিন্তু সে তো তা পারবে না, তাই বারবার গানে গানে অনুরোধ জানায় – ‘বাইদ্যারে তুই ঘরে ফিরা আয়’।
(ক)
সাপের খেলা দেখবায়নি গো বাবু
আমি সাপের খেলা দেখাই॥
দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই
যেথায় খুশি যাই।
লোকে বলে বাইদানী
তুমি বলো অভিমানী।
আমি এখন কোথায় যাই
সাপের খেলা দেখবায়নি গো বাবু
আমি সাপের খেলা দেখাই ॥
এসো আজ এইখানে
দেখো আমার খেলা
পায়ে নূপুর পরে আমি নাচি কেমনে
রিনিঝিনি বাজে বুকে তোমার পানে চেয়ে॥
সাপের খেলা দেখবায়নি গো বাবু
আমি সাপের খেলা দেখাই॥
(খ)
নাগিনী দিব কামড় যতনে থাকিস বন্ধু
ওরে ভিনদেশি।
বুকের মধ্যে উথালপাতাল
মনটা হয় মাতাল
বন্ধু তোর লাগিয়ারে
নাগিনী দিব কামড়
যতনে থাকিস বন্ধু
ওরে ভিনদেশি
আড় চোখে তাকাইয়া
কী দেখিস চাইয়া
যেদিন চইলা যামু আরেক গাঁওয়ে
এরপরেও কি রাখবি মনে
কাঙ্গালিনী এই বাইদানীকে।
যতনে থাকিস বন্ধু ওরে ভিনদেশি॥
(গ)
কই যাও বাইদ্যানী
কোমর দোলাইয়া
তোমার কোমড়ের বিছাখান
আমায় দিবায়নি,
কই যাও বাইদ্যানী
কোমর দোলাইয়া॥
কিংবা
বাইদ্যানী আমার লগে যাইবানি
চলো আমার সাধের বাইদ্যানী
বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ, প্রেম, দুঃখ, বেদনা, সংস্কৃতির সমন্বয় সৃষ্ট এই রকম আরও কিছু বেদে সংগীতে স্থান পেয়েছে। সাহিত্যিক তারাশঙ্করের উপন্যাস ‘নাগিনকন্যার কাহিনি’তেও আছে এই রকম আরও কিছু গান।
(ঘ)
জয় বিষহরি গ! জয় বিষহরি
চাঁদোবেনে দ- দিল
তোমার কৃপায় তরি গ।
অ-গ।
চাপাইনগরের ধারে
সাঁতালী পাহাড় গ।
অ-গ।
ধন্বন্তরি মন্তে বাঁধা
সীমানা তাহার গ।
অ-গ।
বিরিখ্যে ময়ূর বৈসে
গত্তে গত্তে নেইল গ।
অ-গ।
বিষ বৈদ্য বৈসে সেথায়
বাণ্ডুলা বাউল গ।
অ-গ।
তুরা খাস গো সুধার মধু
মোরা খাইব বিষ গ।
অ-গ।
তুদের ঘরের কালসপ্য
মোদের গলায় দিস গ।
অ-গ।
আর দিস গো ছেঁড়া বস্তুর
মুষ্ঠি মেপ্যা চাউল গ।
অ-গ।
গুরুর আজ্ঞায় বিষবৈদ্য
বাণ্ডুলা বাউল গ।
অ-গ।৫
বেদে সংগীত হিসেবে পরিচিত আর একটি সংগীত স্থান পেয়েছে জনাব মিহির চৌধুরী কামিল্যার ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি স্বাদে আস্বাদে’ গ্রন্থে—
(ঙ)
চাঁদো রাজার দাপট গেল
বাতাসে মিশিয়া
বেন্যা গান শোন রে॥
একে তো বেহুলা সতি
তারো কোলে মৃত পতি
ভজিলে পাবে ফিরে
বেন্যা গান শোনরে॥
দেশে দেশে যাবে তুমি
পাইবে নিপাট ভূমি
বেন্যা গান শোনরে॥
তাহার দোয়ায় সূর্য ওঠে
চন্দ্র তারারা ফুটে
বেন্যা গান শোন রে॥
গান শুনে চলো বেন্যা মাগনেতে যাই।
ঘরে ঘরে মনসার
দোয়া বড়ো চাই
বেন্যাগান শোনো রে... ৬
বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে যে বিখ্যাত গানে সেটির রচয়িতা জসীমউদ্দীন। পল্লীগীতি বলে পরিচিত এই গানটিতে বেদে সমাজের পরিচয় বিধৃত হলেও গানটি কিন্তু বেদে সংগীত নয়।
বাবু সালাম বারে বার
আমার নামটি গয়া বাইদ্যা বাবু
বাড়ি পদ্মার পাড়
বাবু সালাম বারে বার॥
মোরা এক ঘাটেতে রান্ধিবাড়ি
মোরা আর এক ঘাটে খাই
মোদের সুখের সীমা নাই॥
আমার নামটি গয়া বাইদ্যা বাবু
বাড়ি পদ্মার পাড়॥
বেদেনীরা গাওয়ালে গেলে সুর করে নিজেদের আগমনবার্তা জানান দেয়, এটি কোনো গান নয়, এটি এক ধরনের বিজ্ঞাপন। শহরে হেঁটে হেঁটে যারা সুর করে সবজি বিক্রি করে বা পণ্য বিক্রি করে সেগুলোকে কি আমরা গানের অন্তর্ভুক্ত করি? করি না, কেননা সেগুলো একধরনের বিজ্ঞাপনের জন্যই করা হয়। খালি কণ্ঠে সুর করে বিজ্ঞাপন দিলে তা অনেক দূর অবধি পৌঁছায়, তাই বেদেরাও সুর করে গাওয়াল করে। যেমন,
এই শিঙ্গা টানি-ম্যাজা টানি
কোমর ব্যথা গিঁটের ব্যথা
দাঁতের ব্যথা সারাই-ই॥
এই শিঙ্গা টানি, বাতের ব্যথা
হাতে ব্যথা দাঁতের ব্যথা
দাঁতের পোকা ফেলাই-ই॥
কে বুয়ে রাখবি রে
দাঁতের পোকা ফেলাবি।
এই শিঙ্গা টানি...
বেদেনীর দল কোনো পাড়ায় মজমা বসালে—সাপের খেলা দেখায়, সেই সময় সে কিছু গান গেয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করে বা তাদের মনোরঞ্জন করে। এই গানগুলো সাধারণত ঘটনাকেন্দ্রিক গান। ঘটনা আর কিছু নয়, বেহুলা আর লখিন্দর; মনসার প্রশংসা গীত ইত্যাদি।
এই রকম একটি গানের উল্লেখ আছে মিহির চৌধুরী কামিল্যার ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি স্বাদে-আস্বাদে’ গ্রন্থে।
‘এইনা শরাবন মাসে ঘনবৃষ্টি পড়ে
কালানাগিনী খাইল আজি সোনার লখিন্দরে।
(হায় হায় বিষহরির দোয়া॥)
চাঁদো রাজা তোমার ওগো কেমন তর ঘর
কেমনতর কারিগরে বানাইল বাসর।
তুমার মনে নাই কি রাজা বিষহরির ভর
(হায় হায় বিষহরির দোয়া॥)
সুজন দেখে কান্দে ওই যে সোনার বেহুলা।
কাইন্দে কাইন্দে পদ্মের চক্ষু হইছে ফুলা ফুলা।
মনসার কানে কে গ দিয়েছে সোয়াসার তুলা।
(হায় হায় বিষহরির দোয়া॥)
রাজা কান্দে কান্দে পরজা কান্দে সনকারানি।
আলগোছে বইস্যা পাখি ফেলে চক্ষের পানি॥
কান্দে রাজা কান্দে পরজা কান্দে সনকারানি॥
(হায় হায় বিষহরির দোয়া॥)৭
এভাবে গান গাইতে গাইতে বেদেনীরা সাপ নিয়ে নাচে, সাপের খেলা দেখায় এই গানগুলোকে বেদে সংগীতের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সব গানই বেদে সংগীত নয়, কেননা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বিষহরির গান গেয়ে থাকে। বিষহরির গানে মূলত বিষহরি মনসার স্তব-স্তুতি প্রাধান্য পায়। বাঙালি সমাজে বিষহরির গানের বেশ প্রচলন রয়েছে। এ রকম একটি গান হচ্ছে,
বেহুলা ভাসেরে ভাসেরে অগম দরিয়ায়
অভাগিনী বেহুলার নাইরে গাছের ছায়॥
মৃতপতি কোলে বালা ভাসেরে ভাসে
কী করিবে কোথা যাবে বুঝা বড় দায়॥
যেনা করে বাঁচে আমার ভোলা মহেশ্বর
সেই বরে বাঁচে আমার সোনার লখিন্দর॥
ঝাড় দিল ফুঁক দিল মন্ত্র দিল গায়।
শয্যা ছাড়ি যেন বালা পরান ফিরে পায়॥
মনসা দেবীর দয়ায় বালা ফিরে পেল প্রাণ।
জয় জয় মা-মনসা চাঁদোর মুখে গান ॥
গান শেষ হলে বেদেনীরা হাত পাতে বকশিশ পাওয়ার আশায়। এ সময়ও তাদের মুখে দর্শকদের উদ্দেশে সতর্ক বাক্য বলতে শোনা যায়, এটিও বেদে সংগীত নয়। তবে এই সময় তারা দান বা উপহার ওঠানোর জন্য যে গান গায়, সেটি বেদে সংগীত। যেমন,
তুরা খাস সুধার মধু মোরা খাইবো বিস গ! (অ-গ)
তুদের ঘরের কালসপ্য মোদের গলা দিস গ!(অ-গ)
আর দিস গো ছোঁড়া বস্তুর মুষ্টি মেপ্রা চাউল গ!(অ-গ)
গুরুর আজ্ঞায় বিষবৈদ্য বাণ্ডুলা বাউল গো!(অ-গ)
গানটিতে বেদেদের জীবনের চুম্বক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। বেদেদের সাপ আর সাপের বিষ কাম্য। সাপের খেলা দেখিয়ে বা এ ধরনের কোনো কাজ করে সে বড়জোর একমুঠ চাল নিতে পারে, এর অধিক তার অধিকার নেই, দরকারও না, কেননা সে একধরনের বাউল, সর্প-বাউল।
বেদের দুঃখ সাপের জন্য কীভাবে সোনা হতে পারে, তার নিদর্শন পাওয়া যায় বেদেদের এই গানটিতে,
লাচো লাচো আমার কালনাগিনী কন্যে গ!
অ-গ!
দুস্কু আমার সোনা হইল তুমানিকের জন্যে গ!
অ-গ!
কদম তলায় বাজে বাঁশি রাধার মন উদাসী গ!
অ-গ!
কালীদহে কালনাগিনী উঠল জলে ভাসি গ!
অ-গ!
মোহন বংশীধারীর আমার লয়ন মন ভোলে গ!
অ-গ!
ঝাঁপ দিল কালো কানাই রাধা রাধা বলে গ!
অ-গ!
কালোবরণ কালনাগিনী কালো চাঁদের পাশে গ!
অ-গ!
কালীদহের জলে যুগল নীল কমল ভাসে গ।
অ-গ!৮
ধৈর্যশীল বিধবা বেদেনীর দুঃখ প্রকাশ পায় এই গানে,
উরব হায় হায়, লাজে মরি
আমার মরণ ক্যোনে হয় না হরি!
আমার পতির মরণ সাপের বিষে
আমার মরণ কিসে গ!
মদন-পোড়া চিতের ছাইয়ের,
কে দেবে হায় দিশে গ!
অঙ্গে মেখে সেই পোড়া ছাই
ধৈরয মুই ধরি গ ধৈরয মুই ধরিÑউরর হায় গ!৯
‘বেদে সংগীত’ বেদে জনগোষ্ঠীর নিজস্ব গান হলেও তা লোকসংগীতের অংশ। বেদে সমাজের সুখ-দুঃখ-আবেগ-অনুভূতি সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ সাপকে কেন্দ্র করেই তাদের গানে প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত বেদেদের মধ্যে দেহতত্ত্ব বা আধ্যাত্মিক কোনো নিজস্ব ঘরনার গান নজরে আসেনি। এর চেয়ে বেহুলা-লখিন্দরের জীবন আলেখ্য তাদের গানের উপজীব্য বিষয়। মজমা বা আসরে; কোনো বিয়ের উৎসবে এই গান-ই তারা গেয়ে ওঠে, এটাই তাদের গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
বেদেদের লোকসংগীতের ক্ষেত্র সমীক্ষাভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষণ:
বাংলাদেশের লোসংস্কৃতি এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। সেই লোকসংস্কৃতির ধারকবাহক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে আছে বেদে জনগোষ্ঠী। একসময় তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থাকলেও বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রভাব তাদেরকে সব দিক থেকেই নিঃস্ব করে দিয়েছে। শিল্পবিপ্লব, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাব ও সাংস্কৃতিক অভিঘাতের ফলে আমাদের বৃহত্তর সমাজ থেকে যেমন লোকসংগীত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে একই ভাবে বেদে সমাজ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব সংগীত। আমরা চেষ্টা করেছিলাম মাঠ সমীক্ষার মাধ্যমে বেদে সমাজের কিছু গান সংগ্রহ করার জন্য, কিন্তু সেটি খুব ফলপ্রসূ হয়নি। সাভার বেদেপল্লীতে দীর্ঘদিন যাতায়াতের ফলে অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলেও গান সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে হঠাৎই একদিন বিকেলে উপস্থিত হই বক্তারপুর বেদে পাড়ায়। সেখানে উপস্থিত মল্লিকা (৪২) বাইদ্যানীর সঙ্গে দেখা। স্বামী থাকেন ভারতে। তিনি মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসেন। স্বামী মেদিনীপুরে থাকেন। সেখানে গাছগাছড়া বিক্রির ব্যবসা তার। মল্লিকার বাবার নাম সুরুৎ আলী মাল। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। গায়ের রং ফর্সা, পেটানো শরীর। ১৩ বছর বয়স হলেই তার বাপকে পণ দিয়ে বিয়ে করেছিল একজন। কিন্তু ছেলেমেয়ে হওয়ার আগেই সাপের ছোবলে মারা যায় প্রথম স্বামী। এরপর একটা দলের সঙ্গে তিনি ভারতে যান। সেখানেই তার আবার বিয়ে হয়। গানের কথা উঠতেই উচ্ছল এই বেদেনী পরপর চারটি গান শুনিয়ে দেন। কিন্তু শর্ত হলো, গান লেখা যাবে, কিন্তু রেকর্ড করা যাবে না। আমি তাতেই খুশি। প্রথমে তিনি বেদের মেয়ে জোসনা ছবির গান শুরু করেন। পরে তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দিতেই তাদের নিজস্ব ঢঙে গান গেয়ে ওঠেন—
(ক)
হায়রে...হায়...
যোগী জানে যোগের মায়া
বাইদ্যায় যাচে শিব্চরণ
আমার হয় না ক্যান মরণ!
সাপের সাথে থাকি আমি
সাপের সাথে খাই
আমার প্রাণের মায়া নাই।
নাগের বিষে সুধা খাইয়া
খুঁজে বেড়াই বাদ্যার মন
আমার হয় না ক্যান মরণ!
কলার ভেলায় ঘুমাইও তুমি
সোনার লখিন্দর, আমার
বাইদ্যা লখিন্দর,
আর সাপের ল্যাজা লগে লইয়া আমি
কান্দি সর্বক্ষণ
আমার হয় না গো মরণ!১০
(খ)
আর কত দিন থাকবি বাইদ্যান রে
মাগনেতে যাই।
ঘরের ভেতর একলা কান্দে
তোর পিরিতের রায়(রাই?)। গো
বাইদ্যান ঘরে ফির আয়॥
কালনাগিনীর সাথে থাকি
কালনাগিনীর ফণায় নাচি গো
কালনাগিনীর শরীর দেইখা
শরীল শির্শিরায় গো,
বাইদ্যান ঘরে ফিরা আয় ॥
চাই না আমার কাকই চুড়ি।
চাই না জলে ভাসা সাবান লো
বাইদ্যান ঘরে ফির আয়॥১১
(গ)
মোর কালা জ্বরের কানাই গো
আইজ বাইদ্যান নাই মোর ঘরে গো
মোর মন জ্বলে অনল জ্বলে
তোরে মনে পড়লে গো
আইজ বাইদ্যান নাই মোর ঘরে গো।
কালা জলের কানাই গো॥
সাপের মালা গলায় আমার
সাপের মালা খোপায়
বিষের অধিক শরীল জ্বলে আমার
তুই থাকিস কোথায় রে
কালা জ্বরের কানাই গো
সাপের ফণা মাথায় গো
মোর মন জ্বলে অনল জ্বলে
তোরে মনে পড়লে গো॥১২
মল্লিকা বেদেনী কখনো কারও কাছে গান শেখেননি। সব বেদেনীরই কমবেশি গানের কণ্ঠ ভালো বলে জানান মল্লিকা। তার নিজের গানের গলা চড়া। সহজ-সরল উপস্থাপন ভঙ্গি, জড়তাবিহীন, স্বতঃস্ফূর্ত গ্রাম্যসুর সব মিলিয়ে লোকসংগীতের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই যেন ধরা পড়ে তার গানে। মল্লিকা বেদেনী তার পেশাগত কারণে মজমায় বা আসরে গান করেন এবং তার স্বামী গাছ গাছড়া বিক্রি করে। এগুলো কী ধরনের গান সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারেননি। তিনি গানের ভেতরকার শব্দের অর্থ ও ইতিহাস বলতে পারেন। আমরা কেবল বেদে সংগীতের বাণী সংগ্রহ করতে পেরেছি। সুর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বেদেনীর আপত্তির কারণে। তবে এ কথা ঠিক যে, টেক্সট ও কনটেক্সট ছাড়া আধুনিক ফোকলোর গবেষণা এবং বিশ্লেষণ একেবাবেরই অসম্ভব। কিন্তু বেদে জনোগোষ্ঠীর আড়ালপ্রিয়তা তাদের সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণে তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে একেবারেই উদাসীন। ফলে বেদেদের নিজস্ব বেদে সংগীত এখন একেবারেই বিলুপ্তপ্রায়।
বেদেদের ঐতিহ্যবাহী সর্পনৃত্যযন্ত্র তুবড়ি বা বীণ:
বেদেদের ঐতিহ্যবাহী সর্পনৃত্যযন্ত্র বা বাঁশি হচ্ছে বীণ। এই বীণ বাঁশি বাজিয়ে সাপুরে বেদেরা সাপের খেলা দেখায় বা সাপের নাচ দেখায় বলে এক সর্পনৃত্যযন্ত্র বলা হয়। বীণের আসল নাম তুবড়ি। অঞ্চলভেদে বীণ ‘তিক্তিরী’, ‘পুঙ্গী’ বা ‘মাকুদা’ নামে পরিচিত। আশির দশকে সাপনির্ভর প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। সেসব সিনেমায় সাপুড়ে আর তার বীণ ছিল দর্শক শ্রোতাদের মূল আকর্ষণ। ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয় বলে একে শুষির শ্রেণির বাদ্য বলে। সব শুষির শ্রেণির বাদ্যযন্ত্রের মতো তুবড়ী বা বীণও এককভাবে বাজানো হয়।
সাপ সারা বিশ্বে থাকলেও বীণের ব্যবহার দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে বেদে সম্প্রদায় বা সাপুড়েরা বীণ বাজিয়ে সাপ ধরে এবং বীণ বাজিয়েই সাপের খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। বীণের সুর সাপের মনে মন্ত্রের মতো কাজ করে বলে লোক সমাজে প্রচলিত আছে। বেদেরাও তাই মনে করে। তারা বলে সাপ বীণের সুরের টানে ছুটে আসে বা এর তালে তালে নাচে। কিন্তু এটি সত্য নয়। সাপ শুনতে পায় না। সাপ শব্দের কম্পন টের পায় এবং শব্দের কম্পন অনুভব করার জন্য তার জিব কাজ করে থাকে। মূলত এই জিবের সাহায্যেই সে শব্দের কম্পন টের পায়। কাজেই সাপুড়ে যখন বীণ বাজায় তখন সে শব্দের কম্পন ও সাপুড়ের নাচের তাল অনুসরণ করে নাচতে থাকে। সিনেমায় এই দৃশ্য প্রায়ই দেখানো হয়।
বীণ তৈরি করা হয় শুকনা লাউ দিয়ে যা ‘বস’ নামে পরিচিত। কিন্তু সকল লাউ দিয়ে এই বীণ বানানো যায় না। বীন বানানোর জন্য আলাদা লাউ রয়েছে। এগুলোকে বেদেরা তিত লাউ বলে। এই লাউ পাওয়া যায় জামালপুর শেরপুর অঞ্চলে। তবে চাইলে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গাতেই চাষ করা যেতে পারে এই লাউ। লাউ পেকে গেলে তার ভেতর থেকে লাউয়ের নির্যাস বের করে রোদে শুকাতে হয়। এরপর আলাদাভাবে বাঁশ দিয়ে বাঁশি তৈরি করে দুটো বাঁশি একসাথে বেঁধে ফেলা হয়। বস-এর শুকনো খোলের ভেতর এই জোড়া বাঁশির একপাশ ঢুকিয়ে দিয়ে লাউয়ের মুখটা মোম বা ওই জাতীয় কোন আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। অপর পাশে ফুঁ দেওয়ার জন্য আর একটি বাঁশের অংশ পুরে দেওয়া হয়। ফুঁ দেওয়া বাতাস লাউয়ের খোলের মধ্যে প্রবেশ করে, যা আঙুল দিয়ে চেপে চেপে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই বাঁশির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফুঁ বন্ধ করার সাথে সাথে এর শব্দ থেমে যায় না। জোড়া বাঁশিতে অসমসংখ্যক ছিদ্র থাকে। খোলের মধ্যে বায়ু সঞ্চিত থাকে বলে বাঁশি অবিরত বাজতে থাকে। এ কারণে পরবর্তী ফুঁ দেওয়ার জন্য অনায়াসে শ্বাস নেওয়া যায়। সাধারণ বাঁশির সঙ্গে তুবড়ি বা বীণের এটাই মৌলিক পার্থক্য। বীণ একটি বহুল পরিচিত বাদ্যযন্ত্র হলেও তেমন একটা জনপ্রিয় নয়। বেদে বা সাপুড়ে ছাড়া এ বাদ্যযন্ত্র অন্যরা ব্যবহার করে না। বেদেদের অন্য কোনো সংগীতের সঙ্গেও এই বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় না। এটি কেবল সাপুড়েরা তাদের সাপ খেরা দেখানোর সময় ব্যবহার করে। খেলা দেখানোর সময় বেদেরা একটি মাত্র সুর বীণে বাজান বলে জানান সাভার বেদে পল্লীর সাপুড়ে মো. আরশাদ মান্তা। এই সুরকে বেদে সমাজে ‘মরণ তাল’ বা ‘কালসুর’ নামে পরিচিত। তবে অনেক বেদে বীণে বিভিন্ন ধরনের গানের সুর তুলতে পারে। এর জন্য তাকে দমচর্চা করতে হয়। কারণ বীণে স্বাভাবিকভাবে সুর তুলতে প্রচুর দম দিতে হয় ফলে বীণ বাঁশিতে সাধারণত গানের সুরচর্চা করা হয় না। তাই প্রায় সব শুষিরযন্ত্র সংগীত অন্য যন্ত্রের সঙ্গে বাজানো গেলেও বীণ বাঁশী অন্য কোন যন্ত্র সংগীতের সঙ্গে বাজানো যায় না। তাই তুবড়ী বা বীণকে স্বয়ংসিদ্ধবাদ্যযন্ত্র বলা যায় না।
বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ থেকেই লোকগীতির স্বতন্ত্রধারা লক্স করা যায়। নিরক্ষর লোকজীবনের নানামুখী ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে লোকসংগীতের মধ্যে লোকসমাজের রসবোধ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ অভিব্যক্তি ব্যক্ত হতে দেখা যায়। বাংলার বিভিন্ন পরিবেশ ও প্রতিবেশে আদিম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাজ ও লোকসমাজের ক্রমগতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংগীতের সুর ও বাণীর পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে লোকসংগীতের লিখিত উপাদান রক্ষা করা গেলেও এর সুরকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের বেদে সমাজের বেদে সংগীত একধরনের লোকসংগীতই। কেননা, দেশজ মেঠো সুরের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়েই এর গায়কি গড়ে উঠেছে। তাদের পেশাগত জীবন, আঞ্চলিক ও স্থানিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এটি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়েছে কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের ধারায় এই গান এখন বেদে সমাজ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। সেই দিন আর বেশি দেরি নেই, যখন বেদে সংগীত আর তাদের বীণ বাঁশির মরণ তাল শুনতে মানুষকে দ্বারস্থ হতে হবে ইউটিউবে। কিন্তু সেখানেও কোনো দরদি হৃদয় তাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার সৎচেষ্টায় ব্রতী হয়েছেন, এমন নজির নেই। ফলে এখনই সময় বেদেদের সংগীতের সুরসংবলিত বাণী সংরক্ষণ করার। অন্যথায় বাংলার লোকসংগীতের ধারা থেকে বেদে সংগীত নামক ঐতিহ্যটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র
১. সুমনকুমার দাশ, বেদে-সংগীত, উৎস প্রকাশন, ঢাকা ২০০৮, পৃ. ৩৬
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮
৪. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭
৫. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নাগিনী কন্যার কাহিনী, বঙ্গ-সাহিত্য প্রা: লি:, কলকাতা, পৃ. ১৬-১৭
৬. মিহির চৌধুরি কামিল্যা, পৃ. ১২৫
৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫
৮. তারাশঙ্কর, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮
৯. তারাশঙ্কর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪
১০. মল্লিকা বাইদ্যানী, পোড়াবাড়ি সাভার থেকে সংগৃহীত।
১১. মল্লিকা বাইদ্যানী, পোড়াবাড়ি সাভার থেকে সংগৃহীত।
১২. তুরতুরি বিবি, স ৫৫, পোড়াবাড়ি সাভার থেকে সংগৃহীত।