মেয়েটির নীল চোখে রৌদ্রের কী অপরূপ খেলা! যেন প্যারাডাইস থেকে নেমে আসা কোনো অ্যাঞ্জেল। দরজার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার শরীরের ছায়াটা সারা ঘরময় ছড়িয়ে। আর সে যেন এক খণ্ড সোনালি আলো। এই পরিবেশে সে ছিল একেবারে বেমানান। লম্বা গাউন, মাথায় হ্যাট। হ্যাট উপচে সোনালি চুল কাঁধ বরাবর ছড়িয়ে আছে। শত বছরের প্রশ্ন নিয়ে মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে প্রশ্ন— আমার চোখে বিস্ময়!
এই প্রান্তিক অঞ্চলে একজন বিদেশিনীর হঠাৎ আগমন সত্যি বিস্ময় সৃষ্ট করে। আমি বললাম, ইয়েস?
মেয়েটি বলল, মে আই কাম ইন প্লিজ?
—ইয়েস প্লিজ।
মেয়েটিকে বসতে বললাম, আপনি মিস্টার ফরহাদ মুন্সী?
—‘জি!’ আমি তো অবাক। এই বিদেশিনী আমাকে চিনল কীভাবে? আবার সে বাংলা বলছে!
—আপনি হয়তো অবাক হচ্ছেন আমার বাংলা শুনে।
—খানিকটা হচ্ছি বইকি। আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?
—গিভ মি সাম ওয়াটার প্লিজ।
—ও শিওর।
মেয়েটি জল শেষ করে বলল, আজকের ওয়েদার ভেরি হট।
—হুম। শীত তো শেষ। চৈত্র চলে এলো বলে।
—আমি ঢাকায় এসেছি অ্যাবাউট টোয়েন্টি ডেজ। আজ সকালের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে রাজশাহী এসেছি। তারপর একটা গাড়ি নিয়ে সোজা আপনার কাছে।
—আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে, সেটা তো জানা হলো না। আর এখানেই বা কেন এসেছেন?
—ও, বলছি। আসলে অনেক দিন থেকেই ভাবছি আমি দাদনচকে আসব।
দাদনচক নামটি এতটা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করল তাতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই অঞ্চলের সঙ্গে তার বহুদিনের কোনো সম্পর্ক আছে। গত বছর ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় এখানে একজনকে পাঠিয়েছিলাম খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। তিনি আপনার ব্যাপারে ইনফরমেশন দিয়েছিল আমাকে। ইউ আর আ, রাইট?
—এই দু-একটা বই আছে আমার। রংপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করি আমি।
—এখানকার নীলচাষের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
—এ বিষয়ে আমি যে খুব বেশি জানি, তেমনটি নয়। তবে যেটুকু শুনেছি এখানকার মাটি নীলচাষের জন্য উপযোগী ছিল এবং প্রথম দিকে এখানে নীলচাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়াভাবে করত। ১৮৩৩ সালে সনদ আইনের ফলে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হয়। তারপর ব্রিটেন থেকে দলে দলে নীলকররা আসতে শুরু করে। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মুনাফা। তারা অধিক লাভের আশায় কৃষকদের ওপর নানা কৌশলে অত্যাচার শুরু করে। কৃষকেরা অত্যাচরে জর্জরিত হয়ে নীলচাষে অসম্মতি জানালে নীলকররা ভয়াবহ অত্যাচার শুরু করে। এই অত্যাচার মোটামুটি ১৯৬০ সালে শুরু হয়ে ১৯০০ সাল পর্যন্ত চলে। ম্যাম, হটস ইয়োর নেম?
—আমি ওলিভিয়া।
—ওলিভিয়া, আপনি কি নীলচাষের ওপর গবেষণাধর্মী কোনো কাজের সঙ্গে সংযুক্ত?
— ‘নো নো, আমার স্টোরিটা ভিন্ন।’ ওলিভিয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ‘আপনাকে আমি বলব।’
আমি অনুভব করলাম নিশ্চয় কোনো গভীর বিষয় আছে। ‘আচ্ছা, আপনি চা তো খান? এখানে এখন কফিও পাওয়া যায়। বললে ব্যবস্থা করে দিতে পারব।’
— না, ঠিক আছে। আমার সঙ্গে সব ব্যবস্থা আছে।
—‘ঠিক আছে। তারপরও।’ তারপর ওলিভিয়া যা বলে উঠল, সে বিষয়ে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
—দুপুরে যদি মোটা চালের ভাত আর নলিতাশাকের ব্যবস্থা করতে পারেন তো ভালো হয়।
—এসব খাবারের নাম আপনি কোথায় শুনলেন? আপনি দেখছি ভালোভাবেই স্টাডি করে এসেছেন।
—আমার দাদার বাবার ডায়েরিতে এই খাবারের নাম শুনেছিলাম।
—বিষয়টা একটু খুলে বলুন তো।
—আমার দাদার বাবা এখানে নীলকর ছিলেন।
— সে তো অনেক আগের কথা!
—জি। আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে কেভিন সাহেবের একটি ডায়েরি ছিল। সেই ডায়েরিটা পড়ে পড়ে আমি বড় হয়েছি।
—ইন্টারেস্টিং!
—জি। সেখানে তিনি লিখেছেন বাংলার মানুষ ভীষণ সহজ-সরল তারা বিদেশিদের ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করত। বিদেশিদের আপ্যায়ন করে তারা খুশি হতো। কেভিন সাহেব কোনো কোম্পানির হয়ে নয়, নিজে ব্যক্তিগতভাবে নীলের বিজনেস করার জন্য এখানে আসেন। প্রথম দিকে উইলিংলি চাষিরা নীল চাষ করত। কিন্তু যখন দেখল নীলচাষে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরিবারের খাদ্যঘাটতি দেখা দিচ্ছে, তখন তারা নীলচাষে আগ্রহ হারায়।
—আরেকটি কারণ ছিল দাদন। একবার কোনো চাষি দাদন নিলে সে অনেকটা কৃতদাসে পরিণত হতো। নীলচাষের পর ফসল নীলকরের হাতে তুলে দিলেও সে দাদন শোধ হতো না।
—এ কথা বলেছেন কেভিন সাহেব। দাদন গ্রহণ করার পর কোনো কারণে কোনো চাষি যদি পরের বছর নীলচাষে অসম্মতি জানাত, তবে তাকে সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় প্রকাশ্যে অত্যাচার করা হতো। কেভিন সাহেব রাল্ফ নামের এক নীলকরের কথা বলেছেন। সে এসেছিল ক্যান্টব্রির মতো পবিত্র শহর থেকে। মিস্টার কেভিন তাকে পবিত্র নগরী থেকে বিতাড়িত শয়তান বলেছেন। যে চাষি দাদনের অলিখিত শৃঙ্খলে বন্দী তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্ত্রী, কন্যাদের ধর্ষণ করত। অথচ এ অঞ্চলের মেয়েরা নিজের সতীত্বকে নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যবান মনে করত। অনেকে আত্মহত্যা করত।
ওলিভিয়ার চোখে লজ্জা আর অপরাধবোধের ছায়া পড়ল। তার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার চোখে আর ঠোঁটের দিকে চেয়েছিলাম। ‘আচ্ছা আপনি বাংলা শিখলেন কোথায়? আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অদিতি লাহিড়ীর অধীনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করছি। বলতে পারেন ওই ডায়েরি আমাকে বাংলাদেশ, বাঙালি আর বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। তা ছাড়া জীবনানন্দ দাশকে তাঁর নিজের ভাষায় পড়ার আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। ব্রিটেনে আমার অনেক বাঙালি বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলে চর্চাটা সচল রেখেছি। মি. কেভিনের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহানারা। জাহানারার গর্ভে আমার দাদার জন্ম। তাই বলতে পারেন আমার শরীরেও বাঙালির রক্ত আছে। মিসেস জাহানারার কথাও কেভিন সাহেব অনেক জায়গায় বলেছেন। কেভিন সাহেব কলেরা মহামারির প্রকোপে পড়েছিলেন। জাহানারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে সেবা করে সারিয়ে তুলেছিলেন। সে সময় অঞ্চলে নাকি ভয়াবহ সব মহামারি দেখা দিত। চিকিৎসাব্যবস্থাও তেমন ছিল না। কেভিন সাহেব তার প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে কোনো ভালোবাসা ও সেবা-যত্ন পাননি। তাই তিনি জাহানারাকে বিয়ে করে বিশ শতকের শুরুর দিকে ব্রিটেনে নিয়ে যান।
নলিতার শাক, ছোট মাছ, আউশ চালের ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। ওলিভিয়াকে চামুচ দেওয়া হলেও সে হাত দিয়ে খেতে শুরু করল। মাছের কাঁটা সুন্দর করে বেছে ভাতের সঙ্গে মেখে মুখে পুরে দিচ্ছিল সে। খাওয়া শেষ হলে আমি বললাম, আপনার জন্য রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে একটু জিরিয়ে নেন।
—ঠিক আছে।
আমি ভাবছিলাম, ওলিভিয়ার এই আগমনের পেছনে কারণটা কী? পূর্বপুরুষদের অপরাধবোধ কি তার ভেতরে সঞ্চরিত হয়েছে? নাকি তার শিকড়ের সঙ্গে এই মাটির গন্ধ জড়িয়ে আছে সেই কারণে এখানে তার আসা? নাকি শুধুই ফ্যান্টাসি?
আধা ঘণ্টামতো ভাতঘুম দেওয়ার পর একটা ছোটখাটো হইচই এ আমার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে দেখি ছোট ছোট বাচ্চাদের জটলা। ওলিভিয়া তাদের মাঝে চকলেট বিতরণ করছে। তাদের সঙ্গে ছবি তুলছে। আমাকে দেখে সে এগিয়ে এলো। ‘আমাকে আশপাশের কোনো ফসলের মাঠে নিয়ে যেতে পারবেন?
—‘অবশ্যই। চলেন।’ সামান্য এগিয়ে গেলে একটা ফসলের ক্ষেত ছিল সেখানেই তাকে নিয়ে গেলাম। ধান কাটা হয়ে গেছে বিরান মাঠ পড়ে আছে। চারিদিকে বিষণ্ন ধু-ধু বিকেল ছড়িয়ে আছে। একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে ওলিভিয়া কপালে ঠেকাল। পুব আকাশের প্রায় অস্তমিত সূর্যের কিরণ এসে ওলিভিয়ার কপাল সোনালি আলোয় ভরিয়ে দিল।