ঈদ রম্য

যানজটে জানজটে

শফিক হাসান প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২২, ০২:২৯ পিএম

যানজটে কি জানজট হয়, জট লেগে যায় জানে? বিতৃষ্ণ হয় প্রাণ-মন! উহু, জান বাঁচানোর জট খোলেও এতে। বিশেষ করে বুদ্ধিমানরা ঠিকই একটা না একটা ইতিবাচক উপায় খুঁজে বের করেন। আমাদের মোকাব্বির হোসেনের কথাই ধরুন না, অফিসে, ঘরে-বাইরের অধিকাংশ মানুষ তাকে বোকা ভাবেন। কিন্তু তিনি যে অনেক চালাকেরও চালাক, মিচকে ভাবুক, এই সত্য আবিষ্কার করতে অনেকেরই মাথায় পেজগি লাগবে; সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণ তারগুলো আউলাঝাউলা হয়ে যাবে।
বাসা থেকে অফিস আর অফিস থেকে বাসার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। পা চালিয়ে হাঁটলে এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছানো যায়। অন্যদিকে বিশ টাকা বাসভাড়া খরচ করে গেলে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। মাঝখানের সময়টুকু সিস্টেম লস ও টাকা লস— দুটোই। চার-পাঁচ দিন হেঁটে যাতায়াত করেছেন মোকাব্বির হোসেন; ঘেমে-নেয়ে একাকার হতে হয়েছে। পানির অভাবের সময় এই পন্থায় গোসল সারার উপায়ও নেই। শরীর ও পরিধেয় পোশাক ভিজে যে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়, সেটা থেকে মুক্তি দিতে পারে ওয়াসার সুপেয় পানিই। পুকুরের পানি পেলে আরও ভালো হতো, কিন্তু এই জনজটের শহরে পুকুর মিলবে কোথায়! চাইলে হাজার হাজার পুকুরচোরের সন্ধান পাওয়া যাবে; কাগজ খুললেই ভিআইপি পুকুরচোরদের ছড়াছড়ি। রঙিন ছবি ছাপা হয় চোর ও চুরনিদের। কিন্তু বেহাত হওয়া পুকুর হস্তগত করা যায় না আর। যে কারণে মোকাব্বির হোসেনদের সাঁতারের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। উল্টো সাঁতার দিতে হয় সমস্যার সমুদ্রে। সেই সমুদ্রে আবার রাঘববোয়াল ও হিংস্র প্রাণীর ছড়াছড়ি। বীভৎস হা ও রক্তাক্ত ঘায়ে তীরের দেখা মেলে না!
বাসে অফিসে যাওয়ার সুবিধা একটাই—জামাকাপড়ে ঘামের দাগ পড়ে না। বাড়তি সাবান ঘষার ঝামেলাও থাকে না। কিন্তু বাসজুড়ে যে রকমারি বুদ্ধিজীবীর আলোচনা সভা, সেখান থেকে প্রাপ্ত বাণী-নির্যাস ঠিকই আস্তানা গেড়ে থাকে মস্তিষ্ক গহনে। কোনো এক রৌদ্র-জ্বলা পাতাঝরা দিনে আলোচনার বিষয় হয় ‘শিক্ষিত বেকার’। তখন পেছনের সারির একজন টেকো বুদ্ধিজীবী আপত্তি জানিয়ে বললেন, ‘শিক্ষিত’ শব্দটা এখানে বাহুল্য। যাদের আমরা শিক্ষিত বলি, মূলত তারাই বেকার হয়। কোনো অশিক্ষিত বেকার কেউ দেখেছেন, কখনো?
বাসজুড়ে গিজগিজ করা ১১৯ জন যাত্রীর একজনও সন্ধান দিতে পারল না অশিক্ষিত কোনো বেকারের! তখন গুঞ্জন বাড়ল—আশ্চর্য, বিষয়টা তো কখনো চোখে ধরা পড়েনি!
টেকো বুদ্ধিজীবী কাম দার্শনিক তখন রুমালে মাথার ঘাম মুছে নিতে নিতে বললেন, অশিক্ষিত লোকজন রিকশা-ভ্যান চালায়, কামলা দেয়, কেউ কেউ মৌসুমি ব্যবসা করে, চা-পানের দোকান চালায়। আর আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি এদের সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে নিজেদের দুরবস্থার বর্ণনা দেয়। কিন্তু তাদের মাথায় কখনোই আসে না, সামনের লোকটি, যাকে আত্মদম্ভে গরীয়ান হয়ে তারা কখনো পূর্ণ মানুষের সম্মান দেয় না। অথচ এই ‘অপূর্ণ’ মানুষই কোনো হাপিত্যেশ ছাড়াই এক বা একাধিক পরিবারের ভরণপোষণ করে যাচ্ছে। নীরবে।
মোকাব্বির বসেছেন তাত্ত্বিকের দুই সারি আসন পরেই। তিনি কান চুলকে বললেন, তাহলে এখন আমরা কী করতে পারি? 
কে কী বলছেন, দাঁড়িয়ে বলেন!
মোকাব্বির দাঁড়িয়ে পুনরুক্তি করলেন। জবাব পেলেন, কখনো মুখ লুকিয়ে থাকবেন না। নিজেকে আড়াল করে চলবেন না। সব সময় ফোকাসিং পয়েন্টে রাখতে হবে নিজেকে। তাহলেই বড় মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেন।
বুদ্ধিটা মনে ধরল। পরদিনই তিনি পাইকারি বাজারে গিয়ে কিনে আনলেন এক গ্রোস টুথব্রাশ। যতক্ষণ যানজটে থাকেন, বাসেই হু হু করে বিক্রি হতে থাকল কম দামি পণ্যটি। এতে সুবিধাই হলো। বাস কন্ডাক্টর এখন আর ভাড়া চায় না। কোনো হকারকেই ভাড়া দিতে হয় না। ত্রিশ টাকায় এক জোড়া টুথব্রাশ বিক্রিতে অভাবনীয় সাফল্য লাভের পরে মোকাব্বির হোসেন শুরু করলেন ডাল ঘুটুনির ব্যবসা। একটি ধাতব ডাল ঘুটুনি এক শ টাকায় কেউ কিনলে সঙ্গে পেয়ে যায় আরও চারটি চার শ টাকার পণ্য ফ্রি! এভাবে একের পর এক চিরুনি, দাঁতের খিলাল, কান খুঁচুনি, হেডফোন, ইয়ারফোন, মানিব্যাগসহ নানামুখী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপাতি বিক্রি শুরু করলেন। এখন আর তাকে অফিসের বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। মেস ভাড়া দুই হাজার টাকা, খাবার বাবদ আরও হাজার পাঁচেক টাকার চিন্তা দূর হয়েছে। বাড়িতেও নিয়ম করে মাসে দুইবার টাকা পাঠান। এমন উদারতায় তার স্ত্রী রেহানা সুলতানা প্রশ্ন করলেন, তোমার প্রমোশন হয়েছে নাকি দুই জায়গায় চাকরি করছ?
মোকাব্বির হোসেন বললেন, পঙ্গু ছিলাম, এখন সুস্থ মানুষ হওয়ার পথে আছি।
অসুস্থতার কথা কখনো বলোনি তো!
কীভাবে বলব, নিজেই জানতাম নাকি! 
তোমার মাথা দেখছি পুরোই শর্টসার্কিট হয়ে গেছে!
অনেকের কিন্তু মাথাই নেই গিন্নি! কিন্তু ঠিকই মাথার আকৃতির মতো একটা জিনিস নিয়ে ঘুরছে-ফিরছে।
আলোচনায় তাল মেলাতে না পেরে রাগ করে রেহানা কল কেটে দিলেন। তার আগে বললেন, তুমি একটা পাগল!

দুই.
ভালোই তো চলছিল ছোট পুঁজির বড় ব্যবসাটা। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল সামনের সিটে তার সহকর্মী ফারুক হোসেন বসা। সেদিনকার মতো আর ব্যবসা চালানো হলো না। গোপন ব্যবসাটার খবর অফিসে জানাজানি হোক, তা চান না আপাতত। আরেক দিন পণ্যের গুণকীর্তনের সময় বাসের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন ফারুক হোসেন। বললেন, ব্যবসা তো ভালোই জমিয়েছেন দেখছি!
ক্যানভাস বন্ধ করে মোকাব্বির হোসেন বললেন, আর বলবেন না, ভাই। কম দামে পেয়ে অনেক পণ্য একত্রে কিনে ফেলেছি। এখন দেখছি, এত জিনিস আমার সারা জীবনেও লাগবে না। তাই বাড়তি জিনিসগুলো বিক্রি করে দিচ্ছি। লাভের দরকার নেই। চালান উঠলেই হলো।
চালিয়ে যান।
আরও সহকর্মী ও পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হতে লাগল। বাধ্য হয়ে নতুন রুটে চলাচল শুরু করলেন তিনি। এখানেও বিশেষ সুবিধা হলো না। লোকজন কি আজকাল তাকে পাহারা দিচ্ছে নাকি!
কদিন বন্ধ রাখলেন গলাবাজির ব্যবসা। রেস্টেরও দরকার আছে। সপ্তাহখানেক পরে বিকল্প রুটের একটি বাসে আবিষ্কার করলেন ফারুক সাহেবকে। একটি কালো ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে বিক্রি করছেন ‘জমি-জমার মাপজোখ ও মামলায় জেতার কৌশল’ শীর্ষক বই। বিক্রিও হতে থাকল টপাটপ। একটা বই চেয়ে নিলেন মোকাব্বির হোসেনও। ধরা পড়ে ফারুক হোসেন লজ্জিত হলেন না। উল্টো হাসলেন। বললেন, বইটি আপনাকে উপহার হিসেবেই দিচ্ছি। কারণ, আপনি আমার গুরু।
গুরু মানে?
গুরু মানে ব্যবসাগুরু। আপনার কৌশল বুঝতে পেরেই আমি ব্যবসাটা শুরু করেছি। বুঝতে পেরেছি, আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। ব্যবসায় লজ্জা নেই রে, ভাই। চুরি তো করছি না কেউই। হারামও খাচ্ছি না।
মোকাব্বির হোসেনের আমতা আমতা করা দেখে তিনি বললেন, আমি নেমে আরেকটা বাসে উঠব। চাইলে আপনি এখন শুরু করতে পারেন। ব্যবসাকে লাটে তুলবেন না। তাহলে নিজেদের ঠিকই খাটে উঠে যেতে হবে!
মোকাব্বির হোসেন বললেন, ঠিক বলেছেন। লজ্জায় কাজ কী! আপনি নামবেন না। অফিসের পৌঁছানোর আগে দুই ভাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করব।
ব্যাগে ভরা ছিল কদুর তেল। এই তেল ব্যবহারে কীভাবে চুলপড়া কমে, চুল ঘন ও কালো হয়, গরমে মাথা ঠান্ডা থাকে, সবিস্তার বর্ণনার আগেই বিক্রি হয়ে গেল সব। হাসি ফুটল দুই চাকরিজীবী কাম ছুটা ব্যবসায়ীর মুখে।
বাস থেকে নেমে ফারুক হোসেন বললেন, যানজট তো আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ব্যবসা হচ্ছে আবার চাকরিও!
সব নেতিবাচক বিষয়েরই কোনো না কোনো ইতিবাচক দিক আছে। সেটা খুঁজে বের করতে পারলেই সুফল মেলে। না বুঝেই আমরা শুধু গালমন্দ পাড়ি।
ঠিক বলেছেন। তবে আমরা অনেকেই বেহুদা ভদ্রলোক সেজে থাকি। এই ভড়ংটুকু বাদ দিতে পারলে আমরা যেমন এগিয়ে যেতে পারব, এগোবে দেশও। শান্তি ও স্বস্তিতে থাকবে সবার পরিবার।

তিন.
ঈদের দুই দিন আগেই ছুটি হলো অফিস। যথারীতি এবারও ভয়াবহ যানজট। মনে মনে খুশিই হলেন মোকাব্বির হোসেন। ব্যবসা ক্ষীরের মতো জমে যানজট আর জনজটেই। তিন গুণ ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটলেন। কিন্তু বাস তো আর চলে না। রাস্তার পাশ থেকে তরমুজ-বাঙ্গি কিনে ফালি ফালি করে বিক্রি শুরু করলেন। প্রতি পিস দশ টাকা। ‘গরমের আরাম’ উচ্চারণ করা মাত্রই বিক্রি হয়ে যেতে লাগল সব। পিঁপড়ার গতিতে গাড়ি এগোলে এক জায়গায় পেয়ে গেলেন কচি ডাব। ডাবেও ভালো দাঁও মারলেন তিনি। ভাগ্যিস, আসার একটা একটা দা ও ছুরি কিনে এনেছিলেন। সেগুলোই কাজে লাগছে এখন। পাইকারি দোকান থেকে বিস্কুট-চানাচুর কিনেও ভালোই বিক্রি হলো। সাবানের দাম সব জায়গায় এক। তারপরও মানুষ কেন বাস থেকে তার সব সাবান কিনে নিল! জবাব খুঁজে পেলেন না মোকাব্বির হোসেন।
এভাবে লবণ থেকে পান-চুন যেখানে যা কিছু পেয়েছেন, সবই কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে থাকলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়। মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন তাদের, যাদের কারণে এই যানজট টিকে আছে বছরের পর বছর। যানজট কারও কারও জন্য জান রক্ষার উপশমও বটে।
গাড়ি দুই ঘণ্টা এক জায়গায় স্থবির হয়ে পড়ে থাকলে খোঁজ নিয়ে তিন মাইল দূরের এক গেরস্ত বাড়িতে পৌঁছালেন মোকাব্বির হোসেন। কিনে আনলেন সাত শ পিস তালপাতার পাখা। বিশ টাকায় কেনা পাখা অনায়াসেই বিক্রি হতে লাগল পঞ্চাশ টাকায়। টাকা রাখার জন্য বড় সাইজের একটি কাপড়ের ব্যাগ কিনেছিলেন আগেই। সেটা ভরতে থাকলে এমন অবস্থায় পৌঁছাল আর টাকা রাখা যাচ্ছে না। আরেকটা ব্যাগ চাইলে কেনা যায় কিন্তু তাতে দূরের গঞ্জ থেকে মাল এনে বিক্রি করাটা কঠিন হবে। হাত তো মাত্র দুটাই, কোনো সহকারীও নেই!
বাড়ি পৌঁছাতে লাগল দুই দিন। ফুলে-ফেঁপে ওঠা টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে মোকাব্বির হোসেন এমনভাবে হাঁটছেন, যেন সেমাই-চিনি কিনে ফিরছেন। কেউ বুঝতে পারলে খবর করে ছাড়বে। বাড়িতে পৌঁছে গোনার জন্য টাকাগুলো ঢাললেন চৌকির ওপরে। দেখে-শুনে তার স্ত্রী হতভম্ব। বললেন, দলা-মোচড়া করা এত টাকা কোত্থেকে আনলে? পকেটমারের চাকরি নিয়েছ নাকি!
কী যা তা বলছ, গিন্নি? বল ঈদ মোবারক!
পকেটমারা টাকাই এখন মাসে দুইবার করে পাঠাচ্ছ বাড়িতে!
ছি, রেহানা। বিশ্বাস হারাতে নেই। পকেট মারিনি, পকেট ভরেছি। সেটা অবশ্যই বৈধ পন্থায়। আর বুদ্ধি থাকলে টাকার অভাব যেমন হয় না। যানজটকেও দোষ দিতে হয় না। 
চুরি-ধারির মধ্যে আবার যানজট টানছ কেন?
বল ব্যবসা-বাণিজ্য। এখন আমি তো মনে করছি, যানজট অর্থনীতির ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করতে পারে! গত দুই দিনের পুরোটা সময় আমি বাসে নানা ধরনের জিনিসপাতি বিক্রি করেছি। কাঁচা টাকা নয়, যা পেয়েছি সবই পাকা টাকা! মানে চকচকে-কচকচে নোট।
তাহলে এবার আমাকে বেনারসি শাড়ি কিনে দেবে তো! গতবারও দেবে বলে শেষ পর্যন্ত দাওনি।
একটা নয়, দশটা বেনারসি শাড়ি কিনবে তুমি। কিনে ফেরার পথে নয়টা শাড়ি গলা চালিয়ে বিক্রি করে ফেলবে। দেখবে, তোমার শাড়িটা ফ্রি পেয়ে গেছ, আবার আরও শাড়ি-চুড়ি কিংবা নতুন বাড়ি কেনার জন্য উদ্বৃত্ত টাকা হাতে রয়ে গেছে! 
রেহানা সুলতানা ফল পেয়ে গেলেন নগদেই। বিশ্বাস ফিরল মোকাব্বির হোসেনের ওপর। তার হাতে এখন অনেক টাকা। ধারদেনা পরিশোধ করার পরও যে টাকা থেকে গেল, সেটা জমা রাখার জন্য ব্যাংকে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে হলো। শুধু শাড়িই নয়, তিনি এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসই বড় বাজারে গিয়ে পাইকারিতে কেনেন। কিছু বিক্রি করে আসেন গাড়িতে, বাকিগুলো বিক্রি হয়ে যায় বাড়িতে। পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামবাসী এখন জানে কম দামে ভালো পণ্য পাওয়া যায় বউ-জামাই ভ্যারাইটি স্টোরে। মোকাব্বির হোসেনের ব্যবসাও রমরমা। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। নিজের ব্যবসায় নিয়োগ দেবেন শ খানেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এক রোমান্টিক মুহূর্তে রেহানাকে বললেন, ওগো, অল্পদিনেই তো আমি শিল্পপতি হয়ে যাব। তুমি হবে শিল্পস্ত্রী। তখন বোধ হয় আমার খাচ্চর বসকেও একটা চাকরি দিতে পারব আমাদের কোম্পানিতে।
চাকরির কথা কানে না তুলে রেহানা মুখে তুললেন খুন্তির কথা। আহ্লাদি কণ্ঠে বললেন, জানো! তোমাকে যারা বোকা বলেছে, এখনো বলে, এদের প্রত্যেককে ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্য আমি ৩০০ পিস খুন্তি কিনেছি। কিন্তু চাহিদা দেখে সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। লাভ হয়েছে ভালোই। সেই টাকা দিয়ে তোমার জন্য একটা সুতি পাঞ্জাবি কিনেছি। 
রেহানা উপহারটা হাতে তুলে দিলে উদীয়মান শিল্পপতি মোকাব্বির বললেন, বাহ, সুন্দর তো! পাঞ্জাবিটা বিক্রি করে দাও।
কী বলছ, বিক্রি করব কেন?
বিক্রির টাকা দিয়ে আরও দুইটা কেনা যাবে। তাহলে বিক্রি করব না কেন? একটা পাঞ্জাবি উপহার দেব আমার শ্বশুর আব্বাকে, আরেকটা আব্বাকে।
তাহলে তোমার পাঞ্জাবি কোথায় রইল!
শ্বশুরবাড়িতে যেতে-আসতে আরও মালামাল বিক্রি করব না? তখন কি আমার পাঞ্জাবি কেনার টাকার অভাব হবে! পায়জামা-জুতাও কিনতে পারব।
বাহ, তোমার তো বুদ্ধির শেষ নেই।
সব মানুষেরই বুদ্ধিমান হওয়া উচিত। নতুন একটি প্রবাদ শিখে রাখ—সংসার সুখের হয় বুদ্ধির গুণে।
নির্বুদ্ধির কারণেও কিন্তু সংসার সুখের হতে পারে!
মোকাব্বির বললেন, এখানটায় তোমরা বরাবরই ভুল কর। সংসার বলতে বোঝ পরিবারের মুষ্টিমেয় সদস্যকে, যারা একত্রে থাকে। কিন্তু সংসার শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘পৃথিবী’।
কথাটা বিশ্বাস হলো না রেহানা সুলতানার। সিদ্ধান্ত নিলেন, আগামীকালই গঞ্জে গিয়ে দশটা অভিধান কিনে আনবেন। একটা নিজেদের, বাকি নয়টা বিক্রির জন্য। অভিধান মুখস্থ করে ফেলতে পারলে রেহানা নিজেই লিখবেন একটি বই—‘বুদ্ধি থাকলে ঠেকায় কোন ব্যাটা’। মোকাব্বির হোসেনকে দিয়ে লেখাবেন আরেকটি ‘যানজটকেন্দ্রিক ব্যবসা’। এতে দাঁড়িয়ে যাবে আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

চার.
দশ বছর পরের ছায়াচ্ছন্ন এক বিকেল।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোকাব্বির হোসেন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে এলো কাগজের এক ছোকরা রিপোর্টার। প্রশ্ন করল, আপনার এই সাফল্যের রহস্য কী, স্যার?
সাফল্য কোনো থ্রিলার উপন্যাস নয়। কিলার হয়েও লাভ নেই। এর জন্য পিলার গাড়তে হয়। আমি সেটাই করেছি।
আপনার প্রোথিত পিলারগুলোর নাম যদি বলতেন...।
লোকাল বাসে এক বছর টুথব্রাশ বিক্রি করো গে। নিজেই জবাব পেয়ে যাবে!
কিন্তু এখন আমার সম্পাদককে কী জবাব দেব! খালি হাতে গেলে তিনি নাখোশ হবেন। আর এটা হচ্ছে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট।
কখনোই অন্যকে খুশি করার চেষ্টা করবে না। নিজে খুশি থাকবে। তাহলেই তুমি জীবনে বড় হবে।
ধন্যবাদ, স্যার। আপনার উপদেশ মনে থাকবে।
এর তিন বছর পরে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় বই ‘খুশি থাকো নিজেই’। লেখকের নাম মোকাব্বির হোসেন চৌধুরী। প্রকাশনাশিল্পের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বিক্রি হলো বাইশ কোটি কপি। প্রথম বই ‘যানজটকেন্দ্রিক ব্যবসা’ অনূদিত হয়েছে বিশ্বের ১৩৪টি ভাষায়। যে সব দেশে যানজট নেই, সেসব দেশেও বইটি বিক্রির শীর্ষ তালিকায় রয়েছে!
সব কথার শেষ হচ্ছে, এই গল্পের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনারা সবাই আবার ব্যবসা ফেঁদে বসার তালে থাকবেন না যেন। সবাই ব্যবসায়ী হলে ক্রেতা থাকবে কে! মনে রাখতে হবে, লক্ষ্মীর বর সবাই পায় না! তবে আমি পেতে পারি; ঈদের পরে নতুন খবর পাবেন!