শার্ল বোদলেয়ার

পারির পিত্ত: ছয় পদ্য

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২২, ১০:২১ এএম

মুখবন্ধ

ফরাশিদেশের কবি শার্ল বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) ‘অশুভের ফুল’ নামক পদ্যের বইয়ের কারণে অমর হইয়াছেন। কবির জীবদ্দশায় এই বইটির গোটা দুই সংস্করণ—যথাক্রমে ১৮৫৭ ও ১৮৬১ সালে—ছাপা হইয়াছিল। কবির মৃত্যুর গোটা দুই বছর পর—১৮৬৯ সাল নাগাদ—শার্ল আসলিনো এবং থিওডোর দো বঁবিল প্রভৃতি কয়েকজন বন্ধু মিলিয়া ‘গদ্যে লেখা ক্ষুদ্র পদ্য’ নামে তাঁহার আরেকটি কবিতার বই প্রকাশ করেন। বোদলেয়ারের লেখা চিঠিপত্র পড়িয়া জানা যায় বইটির নাম তিনি রাখিতে চাহিয়াছিলেন ‘পারির পিত্ত’। বর্তমানে এই নামেই বইটি জারি আছে। বিশেষজ্ঞগণ জানাইতেছেন বইয়ের পঞ্চাশটি পদ্য ১৮৫৭ হইতে ১৮৬৪ সালের মধ্যে রচিত। ইহাদের গোটা চল্লিশটি কবির জীবদ্দশায় নানান পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। কেবল দশটি পদ্য ছাপা হইয়াছিল ১৮৬৭ হইতে ১৮৬৯ সালের মধ্যে।

উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ফরাশিদেশের রাজধানী ছিল এয়ুরোপখণ্ডের শ্রেষ্ঠ নগর—তাই বাল্টার বেনিয়ামিনের দেওয়া পারি নগরীর ‘উনিশ শতকের রাজধানী’ নামটি একান্তই যথার্থ মনে হয়। শার্ল বোদলেয়ারের কবিতায় নগর জীবনের স্বাদ ও বিষাদ দুইটাই ধরা পড়ে, বিকশমান ধনতান্ত্রিক সভ্যতার প্রায় সকল দৃশ্যই তিনি ধারণ করিয়াছিলেন। ধনতন্ত্রের যুগে মনুষ্যজাতির নিয়তি তিনি অনেকদূর দেখিতে পাইয়াছিলেন। সরল গদ্যে লেখা ‘পারির পিত্ত’ সংগ্রহে এয়ুরোপিয়া ধনতন্ত্রের সমস্ত নগদ বৈপরীত্য—ঐশ্বর্য ও দারিদ্র, সভ্যতা ও অসভ্যতা, কুসুম ও ক্লেদ—ছাড়াও পরাধীন দেশ ও মহাদেশের বকেয়া স্মৃতি কিংবা স্বাধীনতা ও দাসত্বের পরাকল্প যুগপদ হাজির আছে।

গত বছর—২০২১ সালে—শার্ল বোদলেয়ারের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘পারির পিত্ত’ তর্জমার কাজে হাত দিয়াছিলাম। খসড়া একটি শেষও হইয়াছিল কিন্তু পরিমার্জনার অবকাশ জোটে নাই বলিয়া বইটার প্রকাশনা স্থগিত করিতে বাধ্য হই। এই অবসরে ভাবিলাম, বইয়ের কিছু পদ্য অন্তত কিস্তিতে প্রকাশ করি। অদ্য ‘পারির পিত্ত’ নামার প্রথম ছয় কবিতা সর্বসাধারণের হাতে সমর্পণ করিলাম।

১৬ মার্চ ২০২২

 

বিদেশি

 

—বল দেখি, অবাক আদম, কাহাকে তুমি ভালোবাস সবচেয়ে বেশি?

তোমার বাপ, তোমার মা, তোমার বোন, না তোমার ভাই?

—আমার বাপ, মা, বোন, বা ভাই কেহ নাই।

— তোমার ইয়ারদোস্ত?

— কথা যাহা বলিলেন তাহার যে কি অর্থ আজও বুঝি নাই।

— তোমার দেশ?

— ও যে কোথায় কোন অক্ষরেখায় আমার ধারণাই নাই।

— রূপ?

—সানন্দে ভালোবাসিব তাহাকে, সে দেবী আর চিরজীবী।

— সোনা?

— নিকুচি করি তার, যেমন আপনারা করেন খোদার।

— তো কি তুমি ভালোবাস, হে অসামান্য পরদেশি?

— আমি ভালবাসি মেঘমালা... ঐ উড়ন্ত মেঘমালা... ঐ তো ঐখানে, ঐ তো ঐখানে... আশ্চর্য মেঘমালা!’

 

বুড়ির নৈরাশ্য

 

তুলতুলে শিশুটির দেখা পাইয়া মুখে বলিরেখাভর্তি ছোট্ট বুড়ির মনে কি আনন্দ! দেখিলেন সকলেই মজা  করিতেছে আর শিশুর মন যোগাইবার কোশেস করিতেছে। তুলতুলে জীবটিও তাহার—ছোট্ট বুড়ির—মতই হালকাপলকা, তাহারই মতন দন্তহীন, কেশহীন।

উঠিয়া কাছে গেলেন তিনি, চেষ্টা করিলেন একটু মৃদু হাসিয়া চেহারায় আদরের ভাব ফোটাইতে।

জবুথবু দয়াময়ী বুড়ির আদরে শিশুটি উল্টো ভয় পাইল, জোর লড়াই শুরু করিল হাতছাড়া হইতে, আর চেঁচাইয়া ঘরদুয়ার ভরাইয়া ফেলিল।

দয়াময়ী বুড়ি তখন হাল ছাড়িয়া আপনার অনন্ত নির্জনতায় ফিরিয়া গেলেন। এককোনায় বসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে আপনমনে বলিলেন, ‘হায়রে! পোড়াকপাল আমার নাহান বুড়িদের। মানুষ কেন, মাসুম একটা বাচ্চার মন যোগাইবার দিনও গিয়াছে আমাদের; ছোট্ট শিশুকে ভালোবাসিবার কোশেস করি তো তাহার মনেও ভয় ধরাইয়া দেই।’

 

শিল্পজীবীর তওবা

 

হেমন্তের সন্ধ্যা কি যে মর্মভেদী! আহা! যতক্ষণ না চিন্ চিন্ ব্যথা করে ভেদক্রিয়া চলিতেই থাকে! কেননা কোন কোন বেদনা এমন মনোরম যে তাহাদের ভোঁতা হইলেও ধারালো হইতে নিষেধ নাই; আর অনন্তের অধিক সুঁচালো জিনিশ তো হয় না।

আকাশ আর সাগরের বিশালতায় ডুব দিবার তুলনায় বড় আনন্দের জিনিশ নাই। নির্জনতা, নৈঃশব্দ্য, নীলিমার তুলনাহীন নির্মলতা! দিগন্তে দোলায়মান একরত্তি ছোট্ট একটা পাল যাহা আপনকার অকিঞ্চিৎকরতা আর একাকিত্বের মধ্যে আমার অচিকিৎসেয় জীবনের নকল বিশেষ, তরঙ্গমালার একঘেয়ে দোলা—এই সমস্ত পদার্থ আমার ভিতর স্ব স্ব চিন্তারাশির প্রকাশ ঘটায়; কিংবা ইহাদের মধ্যেই আমি চারিয়া দিই আমার ভাবনাবেদনা (কেননা ভাবের ঘোরে ‘আমি’ পদার্থটা হুড়াহুড়ি লোপ পায়); আমি বলি কি, ইহারা ভাবেচিন্তে সঙ্গীতের মতো, ছবির মতো—বচসা নাই, যুক্তির ক্রম নাই, নাই সিদ্ধান্তের ঘটঘটা।

তথাপি এই চিন্তাধারা, সে হউক আমার চিন্তার উৎসারণ কি পদার্থচিন্তার প্রকাশ, বেশিক্ষণ না যাইতেই ভারি ধারালো হইয়া ওঠে। ইন্দ্রিয়পরায়ণতার তেজ একটা অসুখ আর একটা দৈহিক যন্ত্রণার সূচনা করে। আমার অতি প্রসারিত স্নায়ুর তখন আর্তচিৎকারের আর বেদনায় কাতর হওয়ার বিকল্প থাকে না।

তো এখন আকাশের গহন আমার খবরদারি করে, তাহার নিখাদ ভাব করে হয়রানি; সাগরের নির্বিকার রূপ, দৃশ্যমান জগতের অনমনীয় ভাব মনে বিদ্রোহের জন্ম দেয়। ... আহা! তবে এই যন্ত্রণা ভুগিতেই হইবে অনন্তকাল, না রূপ ছাড়িয়া পলাইতেই হইবে চিরদিন? নির্দয়া নিঠুরা ডাকিনী! চিরবিজয়িনী বৈরী, স্বভাবদেবী! নিষ্কৃতি দাও আমাকে! লোভ দেখাইও না আমার বাসনা আর আমার গরিমাকে। রূপের সাধনা এমনই এক দ্বন্দ্বযুদ্ধ যাহাতে পরাজয়বরণের পূর্বক্ষণে শিল্পজীবী ভয়ে আর্তস্বরে চিৎকার পাড়িতে বাধ্য।

 

ভাঁড়

 

এক নববর্ষের দিন, হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার। কাদা আর তুষারের মাখামাখি স্তুপ মাড়াইয়া হাজার গাড়িঘোড়া পথ চলিতেছে, চারিদিকে খেলনাপাতি আর মিঠাই-মণ্ডার ঝিকিমিকি, লুচ্চামি আর বৈরাগ্যের যুগলবন্দী, যেন একান্ত একরোখা নিভৃতচারী লোকের মানসশান্তি ভঙ্গ করার মতলবে সাজানো মহানগরী অনুমোদিত এই উন্মত্ততা।

এই হৈ-হুল্লোড় আর গোলেমালে হরিবোলের মধ্যে, হাতে চাবুকধরা এক ষণ্ডের তাড়া খাইয়া সপ্রাণ একটি গাধা সচ্ছন্দে পথ চলিয়াছে।

গাধাটি যেই পথের মোড় ঘুরিতে যাইবে তখন এক সুদর্শন, সদস্তানা, সপালিশ, নির্দয়হস্তে গলাবন্ধ— আর সর্বাঙ্গে আনকোরা নতুন পোশাক— সাঁটা ভদ্রলোক একান্ত দরবারী কেতায় এই নিরীহ প্রাণীটির সম্মুখে মাথাটা অবনত এবং মাথার টুপিটি উন্নত করিয়া বলিলেন: “আপনার নববর্ষ সুখী ও সমৃদ্ধিশালী হউক”। অতঃপর উপস্থিত— ঠিক কয়জন বলিতে পারিব না—সঙ্গীসাথীর দিকে— চোখেমুখে তৃপ্তির হাওয়ামাখা মুখটা— ঘুরাইলেন। যেন ইচ্ছা আত্মতৃপ্তির বোঝার উপর উহাদের অনুমোদনের আঁটিটি যোগ হয়।

গাধা কিন্তু এই ভাঁড়ের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করিয়া আপনকার কর্তব্য যেখানে ডাকিতেছে সে গন্তব্য অভিমুখে সচল থাকিল।

আমার কথা বলিতে, এই মহান নাদানের উপর জাগ্রত পরিসীমাহীন একটা ক্রোধের করতলগত হইলাম আমি—লোকটিকে আমার মনে হইল তাবত ফরাশি মনীষার সংক্ষিপ্তসার।

 

 

দ্বিগুণ কামরা

 

সুখস্বপ্নের মতন একটি কামরা, সত্য সত্য ধর্মানুভূতি জাগায় এমন একটি  কামরা যাহার গুমোট হাওয়া হালকা গোলাপি আর নীলছোঁওয়া।

আত্মা এখানে পরিতাপ আর কামনার আতরমাখা আলস্যে অবগাহন করে।— ব্যাপারটা গোধুলির মতো, কিছুটা নীলের মতো, কিছুটা গোলাপির মতো; যেন গ্রহণের কালে ইন্দ্রিয়সুখের স্বপ্ন।

আসবাবপত্রের আকার-আকৃতি লম্বা লম্বা, শায়িত, এলানো। আসবাবের গায় স্বপ্নের ছোঁয়া, বলা চলে উদ্ভিদজগত আর খনিজজগতের মতো স্বপ্নাবেশে চলার ক্ষমতা তাহাদের। তৈজসপত্র কথা বলে নীরব ভাষায়, যেমন বলে পুষ্পরাজি, যেমন বলে আকাশবাতাস, যেমন বলে অস্তায়মান সূর্য।

দেওয়ালে দেওয়ালে বিরক্তিকর শিল্পকর্ম ঝোলে না। বিশুদ্ধ স্বপ্নের, মনে বিচারবিবেচনা-বহির্ভূত দাগকাটা ছবির তুলনায় ধরাবাঁধা শিল্পকর্ম—মানবসৃষ্ট শিল্পকর্ম—তো নাস্তিকতার নামান্তর। এই জায়গার সবকিছুই সুষম ভারসাম্য বজায় রাখার উপযোগী পরিমিত পরিমাণ আলো আর সুস্বাদু ছায়ায় শোভিত।

এ ঘরের হাওয়ায় বহু বহুমূল্য আতরের সুবাস অতি-হালকা আর্দ্রভাব ছড়ানো বাতাসে সাঁতার কাটে যে বাতাস বাষ্পস্নানের স্পর্শে আত্মার ঘুম পাড়ায় আর দোলা দেয়।

দরজা-জানালা আর বিছানার মুখে মসলিনের ঝর্ণাধারা তুষারের মতন ঝরে। এ বিছানায় শুইয়া আছেন মানস-প্রতিমা, স্বপ্নলোকের সম্রাজ্ঞী। কিন্তু তিনি এখানে আসিলেন কিভাবে? কে আনিল তাঁহাকে? সুখস্বপ্নের আর ইন্দ্রিয়কাতরতার এই সিংহাসনে যে তাঁহাকে আনিয়া বসাইল সে কোন যাদুকর? তাহাতে কি আসে যায়! তিনি তো এখানে! আমি চিনি তাঁহাকে।

এই সেই চক্ষুযুগল যাহাদের শিখা গোধুলিভেদ করে; এই নির্বিকার আর ভয়াবহ প্রায়-আয়নার ভয় জাগানিয়া ঘৃণার সহিত পরিচয় আছে আমার। ইহারা কাছে টানে, ইহারা পায়ে দলে, যে বোকার দল ইহাদের চোখে চোখে তাকায় তাহাদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করে ইহারা। আমি হরহামেশা ভাবিয়াছি ইহাদের কথা, এই কৌতুহল আর ভক্তি-জাগানিয়া কালো তারকাগুলির কথা।

এই রহস্য, এই নৈঃশব্দ্য, এই শান্তি আর এই সুবাসে পরিবৃত থাকার ভাগ্য আমার হইল কোন মহানুভব দানোর বদান্যতায়? হে প্রশান্তি! এক্ষণে যে জীবনের সহিত আমি তিলে তিলে, পলে পলে পরিচিত সেই তুরীয় জীবনের সহিত সে বস্তুর তুলনা চলে না যাহাকে আমরা সচরাচর জীবন নামে ডাকি, এমন কি তাহা যখন সুখস্বাচ্ছন্দ্যের পরম পুলকে পৌঁছায় তখনও না!

না! তিল বলিয়া কিছু নাই; পল বলিয়া কিছু নাই! কাল হারাইয়া গিয়াছে; যে রাজ কায়েম হইয়াছে তাহা অনন্তের; এ অনন্ত বড়ই সুস্বাদু!

এক্ষণে দরজায় একটা ভয়ানক, ভারি টোকার আওয়াজ শোনা গেল; আর ঘোর দুঃস্বপ্নের মধ্যে যেমন হইয়া থাকে তেমনই মনে হইল কেহ যেন আমার পেট বরাবর কুড়াল দিয়া একটা কোপ মারিয়াছে।

আর তারপর ঘরে ঢুকিল একটা পিশাচ। দেখি আইনের দোহাই দিয়া আমাকে পীড়ন করিতে একটা পেয়াদা আসিয়াছে; দুঃখের কাসুন্দি শুনাইয়া আমার দুঃখের বোঝার উপর শাকের আঁটি চাপাইতে আসিয়াছে এক কুখ্যাত রক্ষিতা; কিংবা পাণ্ডুলিপির পরবর্তী কিস্তি চাহিতে আসিয়াছে জনৈক পত্রিকা সম্পাদকের সুবোধ হরকরা।

পিশাচের টোকার সঙ্গে সঙ্গে এই বেহেস্তি কামরা, মানস-প্রতিমা, স্বপ্নের সম্রাজ্ঞী, মহাত্মা রনে যাহার নাম হয়তো রাখিতেন সিলফিদ—এই যাদুময় জগতের সবটুকুন—হাওয়া হইয়া গেল।

একি আতঙ্ক! মনে পড়ে! মনে পড়ে! এই গাড্ডা, চিরন্তন বিতৃষ্ণার এই বাটি তো সত্য সত্য আমার: সেই একই বেকুবগোছ, ধুলোমলিন, ভাঙাচোরা আসবাব; চিমনির তলায় না আছে আগুনের শিখা, না আছে পোড়াকয়লা, কেবল ছিটকা থুতুতে নষ্ট। ধুলোয় ছাওয়া বিষন্ন জানালার পালায় বৃষ্টির কাটা কাটা ফলা; কাটাকুটিভরা কি শেষ-না-করা কতক পাণ্ডুলিপি, ভয়াল সব তারিখ বরাবর দাগ দেওয়া পঞ্জিকা!

আর যে অলৌকিক সুবাসের মোহে আমার শিক্ষিত রুচি একদা উজ্জীবিত হইয়াছিল তাহার গায়ে চড়িয়া বসিয়াছে বাসি তামাকের পচাগলা দুর্গন্ধ, যাহার উপর আবার জুটিয়াছে বর্ণনাতীত বিবমিষা জাগানিয়া স্যাঁতসেতে ভাব! এক্ষণে এখানে আবর্জনার ভাগাড়ে ছড়ানো দুর্গন্ধে শ্বাস টানি আমরা।

এই বিরাগ-পরিপূর্ণ অপরিসর জগতের মধ্যে সুপরিচিত একটাই মাত্র দ্রব্য আমার দিকে স্মিতহাস্যে তাকায়; লোদানাঁর একটা শিশি— এই সেই ভয়াল পুরাতন পরকিয়া প্রেম— আহা আর দশ পরকিয়া প্রেমের মতন সেও যেমন আদরে-সোহাগে তেমন অবিশ্বাসে সমান অকৃপণ।

আহা! আজ্ঞে! কাল আবার ফিরিয়া আসিয়াছে; সার্বভৌমত্ব এখন কালের; আর এই কুৎসিত বৃদ্ধের সঙ্গে আসিয়াছে তাহার পৈশাচিক সাঙ্গপাঙ্গ সকলেই: স্মৃতি, পরিতাপ, ত্রাস, খিচুনি, উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, এবং স্নায়বিক বিকার।

আপনাদের দিব্য দিয়া বলি, এক্ষণে পলের পর পল সকল পল আরো জোরে, আরো নিবেদিতচিত্তে আগাইতেছে আর দোলনদণ্ড হইতে লাফাইয়া পড়া মাত্রই বলিতেছে, “আমার নাম জীবন, অসহনীয়, অনমনীয় জীবন!”

মানবজীবনে শুদ্ধমাত্র একটিই পল আছে যাহার কাজ হইল সুসমাচার রাষ্ট্র করা, এই সুসমাচার একটা ব্যাখ্যাতীত সন্ত্রাসে আমাদের প্রাণ পরিপূর্ণ করে।

আজ্ঞে! কাল রাজত্ব করে: আপনকার নির্দয় অত্যাচার-অবিচারটা আবার শুরু করিয়াছে সে। হাতের দ্বিগুণ মুগুরটা ঘুরাইয়া সে আমাকে একটা ষাঁড়টাঁড় ভাবিয়া ঠেলিতেছে: “তো খাটিয়া মর! গাধা! তো ঘামিয়া সার, গোলাম! তো বাঁচিয়া মর, হারামি!”

 

যার যার দানব তার তার কাঁধে

 

বিশাল ধুসর আকাশের তলায়, ধুলোমলিন বিশাল প্রান্তরভাগে— পথঘাট নাই, ঘাসপাতা নাই, নাই কাঁটাগুল্ম, নাই বিছুটিলতা— দেখিলাম অনেকগুলি মানুষ কুঁজো হইয়া হাঁটিতেছে।

সকলেই যে যার কাঁধে একটা করিয়া বিশালবপু দানব বহিতেছে। একেকটা দানব যেন একেকটা ময়দা বা কয়লার বস্তা কিংবা রোমক সাম্রাজ্যে পদাতিক সৈন্যদের পিঠে যেমন বোঝা চাপানো হইত তেমন বোঝার মতো ভারি বোচকা।

এই কিম্ভূতকিমাকার পশুটি কিন্তু আদৌ জড়ভরত গোছের কিছু ছিল না; উল্টো পশুটি আপনকার সচল, প্রবল পেশীর বেষ্টনে আঁকড়াইয়া মানুষটির উপর নির্যাতন চালাইতেছিল; দুই দুইটা বিশাল মাপের নখর ঢুকাইয়া বাহকের বুকটা সে কব্জা করিয়াছিল; আর শত্রুপক্ষের মনে বাড়তি ভীতিসঞ্চারের মতলবে পুরাকালে যোদ্ধারা যে ধরনের ভয়াল ভয়াল শিরস্ত্রাণ পরিত সে ধরনের সাংঘাতিক একটা মাথা বাহকের মাথার সমতলে আর একটু উপরে তুলিয়াছিল।

লোকগুলির একটিকে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কোথায় যাইতেছে তাহারা। তাহার উত্তর ছিল, গন্তব্যটা কোথায় তাহা না সে না অন্য কেহ বিন্দুমাত্র জানে; তবে তাহারা নিশ্চয়ই কোথায়ও না কোথায়ও যাইতেছে কেননা সবকিছু ছাপাইয়া উপরে উঠিয়াছে তাহাদের হাঁটিবার দরকার।

একটা মজার জিনিশ অবশ্য চোখে না পড়িয়া যায় না: আপনকার ঘাড়ে ঝোলা, পিঠে চাপা হিংস্র জন্তুটা কিন্তু ঐ মুসাফিরদের মোটেও বিব্রত করিয়াছে এমন মনে হইল না। প্রত্যেকেই ধরিয়া লইয়াছিল জন্তুটা তাহার আপন দেহের অঙ্গবিশেষ। ঐ সকল ক্লান্ত-শ্রান্ত, গম্ভীর মুখমণ্ডলে নৈরাশ্যের ছায়াও পড়ে নাই; আকাশের বিষাদগ্রস্ত গম্বুজতলায়, খোদ আকাশের মতন বিষণ্ন পৃথিবীর ধুলোয় ঢাকা পায়ে অনন্ত অবধি আশায় বসতির দণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর মতন চেহারা হালছাড়া করিয়া তাহারা হাঁটিয়া চলিল।

একসময় শোভাযাত্রাটি আমার পাশ কাটাইয়া চলিতে চলিতে দিগন্তের আবছায়ায় বিলীন হইল: এ দিগন্ত মনুষ্যদৃষ্টির কৌতুহল ছাড়াইয়া গ্রহের গোলাকৃতি তলের অতলে হারাইয়া যায়।

কিছুক্ষণ কোশেস করিলাম রহস্যের কুলকিনারা করা যায় কিনা; তবে বেশিক্ষণ না যাইতেই একটা অপরাজেয় বেপরোয়া ভাব আমাকে গ্রাস করিল; আর ঐ শ্বাসরুদ্ধকর দানবদল লোকগুলির উপর যে ধরনের নির্যাতন চালাইতেছিল তাহার অধিক নির্যাতনে পীড়িত হইতে থাকিলাম আমি।

 

তর্জমা: সলিমুল্লাহ খান