৮ম সমধারা কবিতা উৎসব ২০২২

নতুন প্রজন্মের মিলনমেলা

সালমা বেগ প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২২, ০১:৪৮ পিএম

‘কবিতায় ভেসে যাক সর্বমারি’— এই স্লোগানটি প্রতিপাদ্য করে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ৮ম সমধারা কবিতা উৎসব-২০২২। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রোববার রাজধানীর ধানমণ্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি কেন্দ্রের মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো এ উৎসব। 

বলা যায় প্রধানত নতুন প্রজন্মের কবিদের মিলনমেলা ছিল এটি। নানা কারণে এবারের উৎসবটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আনুষ্ঠানিকতা আর চাকচিক্যের সমাবেশ কম থাকলেও এবারের উৎসবটি ছিল ভালোবাসা আর আন্তরিকতার আবেগে ঠাসা। উৎসব মঞ্চ সেজেছিল বিচিত্র রঙের ঘুড়ি আর লোক-ঐতিহ্যের আবহে।

বেলা তিনটা থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কবিরা জড়ো হতে থাকেন। দোতলার মিলনায়তনে আয়োজন। আয়োজনের মুখ্য নিয়ামক সমধারা-সম্পাদক সালেক নাছির উদ্দিনকে তাঁর কর্মীদের নিয়ে অভ্যর্থনায় ব্যস্ত দেখা গেল সূচনায়। নাম নিবন্ধন চলছে। অংশগ্রহণকারী কবিরা বুঝে নিচ্ছেন উৎসব সামগ্রী-ব্যাগ, ব্যাচ, সমধারা উৎসব সংখ্যা : ৮০তম সংখ্যা এবং উৎসবে অংশগ্রহণকারী কবিদের কবিতা সংকলন ‘পদাবলির যাত্রা’।

সালেক নাছির উদ্দিন ও জান্নাত আরা মমতাজ সম্পাদিত ১৫২ পৃষ্ঠার ‘পদাবলির যাত্রা’ কাব্য সংকলনে মোট ১৩০জন কবির কবিতা মুদ্রিত হয়েছে। অধিকাংশ কবিতাকর্মী জড়ো হয়ে যখন উৎসব চত্বরে ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন খুব কাছাকাছি সময়ে সংস্কৃতি চত্বরে উপস্থিত হলেন উৎসবের প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক ‘বাংলা কবিতার রাজপুত্র’খ্যাত হেলাল হাফিজ এবং কবি-কথাশিল্পী ফরিদ আহমদ দুলাল। সঙ্গে আসেন বিশেষ অতিথি কবি নজমুল হেলাল।

তিন পর্বের অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিল স্বরচিত কবিতাপাঠ, দ্বিতীয় পর্বে পুরস্কার বিতরণ এবং তৃতীয় পর্বে স্বরচিত কবিতাপাঠ ও আবৃত্তি। প্রথম পর্বে ১২ জন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠে অংশ নেন আর কবিতা এবং সমধারার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন উৎসবের উদ্বোধক কবি-নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলাল। দ্বিতীয় পর্বে সমধারা পুরস্কার ২০২২ প্রদান করা হয় আনোয়ারা সৈয়দ হক এবং ওমর কায়সারকে। প্রথমজন কথাসাহিত্যে আর দ্বিতীয়জন কবিতায় অবদানের জন্য এ পুরস্কার লাভ করেন। প্রধান অতিথি কবি হেলাল হাফিজ, উদ্বোধক ও অন্যান্য অতিথিকে নিয়ে পুরস্কার প্রাপকদের হাতে পুরস্কার ও পুরস্কারের সঙ্গে প্রাপ্য অর্থ তুলে দেন। দু’জনকে তুলে দেওয়া হয় নিজেদের পোট্রের্ট। পুরস্কারপ্রাপ্ত দু’জনের অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি এ পর্বে কথা বলেন কবি হেলাল হাফিজ, কবি নজমুল হেলাল, লেখক সংগঠক আরিফুর রহমান এবং কবি ফরিদ আহমদ দুলাল।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে কবি হেলাল হাফিজ বলেন, “কবিতা মানুষকে সুন্দরের পথে নিয়ে যায়। কবিতার ভিতর দিয়ে মানবজাতির বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। সমধারা নতুন লেখকদের প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে নারী লেখকদের গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করে আসছে। সমধারার সাথে আমি দীর্ঘদিন যুক্ত। তাদের কাজ আমার কাছে পরিশীলিত মনে হয়। সব সময় নান্দনিক উপস্থাপন সবার নজর কাড়ে। দেখেছি সমধারার কাজে ভিন্নতা। আমার ভালো লাগে। আমাকে টানে তাদের সাহিত্য কর্ম।”

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, “সমধারা সাহিত্য পরিবারে নিজেদের মধ্যে যে বোঝাপড়া, তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। সৃজনশীল যে কোনো সংগঠনের জন্য সমধারা দৃষ্টান্ত হতে পারে। এমন একটি পরিবারের কাছ থেকে পুরস্কার পাওয়া গৌরবের।”

কবি ওমর কায়সার বলেন, “আমার মতো নিভৃতির একজন কবিকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে সমধারা প্রমাণ করলো, সমধারা পুরস্কার প্রদানের প্রচলিত ধারার বিপরীতে চলা একটি প্রতিষ্ঠান। সমধারা আমাকে পুরস্কৃত করলো, সেটি বড় কথা নয়; বড় কথা হলো, সমধারা অনালোকিত অঙ্গনেও তাদের দৃষ্টি প্রসারিত রাখলো। এটাই গৌরবের, এটাই আনন্দের।”

বিশেষ অতিথি কবি নজমুল হেলাল সমধারা আদ্যপান্ত তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। অন্য বিশেষ অতিথি লেখক আরিফুর রহমান বলেন, “সমধারার কার্যক্রম দেখেই আমি এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি এবং প্রতিনিয়ত দেখছি সমধারার অগ্রযাত্রা। সমধারা পরিবারের একজন হয়ে এর পাশে থেকে নতুন প্রজন্মের কবিদের অগ্রযাত্রার আনন্দকে আমি উদযাপন করতে চাই।”

তৃতীয় পর্বে স্বরচিত কবিতা পাঠ ও আবৃত্তিতে অংশ নেন পঞ্চাশোর্ধ কবি ও বাচিকশিল্পী। কবিতাপাঠ ও আবৃত্তি শেষে অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্য রাখেন সত্তর দশকের দুই কবি দিলারা হাফিজ এবং কবি ফরিদ আহমদ দুলাল।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সমধারা সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ ঘোষণা করা হয়। ৯ম কবিতা উৎসব ২০২৩-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যা প্রদান করা হবে বলে জানানো হয়। মুহুর্মুহু করতালির সাথে ঘোষিত পুরস্কার প্রাপকরা হলেন— কথাসাহিত্যে হরিশংকর জলদাস, কবিতায় ফরিদ আহমদ দুলাল এবং শিশুসাহিত্যে স ম শামসুল আলম।

সারাদেশ থেকে দুই শতাধিক কবি-সাহিত্যিকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের কবিদের মিলনমেলা। যদিও অন্যান্য বছর সমধারা কবিতা উৎসবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবি-সাহিত্যিক অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় এবারের উৎসবে বাইরে থেকে কেউ অংশ নিতে পারেননি।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে মোড়ক উন্মোচন করা হয় উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত সমধারা ৮০তম সংখ্যা, যৌথ কাব্য ‘পদাবলির যাত্রা’ এবং সমধারা পরিবারের কবি শুভ্রা নীলাঞ্জনার কবিতার বই ‘তোমার নামেই রাত্রি নামাই’।

সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করেন সমধারা সম্পাদক কবি-সাংবাদিক সালেক নাছির উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সমধারা পরিবারের কর্মীরা।

সাহিত্যের কাগজ ‘সমধারা’ নিয়মিত প্রকাশনার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষণা, অবহেলিত শিশুদের স্বাক্ষরজ্ঞানসহ সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবং একুশ শতকের কবিদের মূল্যায়ন করার লক্ষ্যে সমধারা কবিতা উৎসবের আয়োজন করছে। পাশাপাশি খ্যতিমানদেরও সম্মান জানিয়ে আসছে। ২০১৬ সালে প্রথম সমধারা সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে ‘সমধারা সাহিত্য পুরস্কার’ যাত্রা শুরু করে। প্রথম বছর পুরস্কার প্রদান করা হয় কবি হেলাল হাফিজকে। এরপর পর্যায়ক্রমে— ২০১৭ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ, ২০১৮ সালে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ২০১৯ সালে কবিতায় মৃণাল বসুচৌধুরী, ২০২০ সালে কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন ও শিশুসাহিত্যে রহীম শাহ এবং ২০২১ সালে কথাসাহিত্যে ইমদাদুল হক মিলন ও কবিতায় সরোজ দেবকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।

‘সমধারা সাহিত্য পত্রিকা’ যেভাবে প্রতি বছর কবিতা উৎসবের আয়োজন করে সারাদেশের তরুণ কবিতা কর্মীদের সংগঠিত করছে, তাতে নিশ্চয়ই সমধারা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। আশা করা যায়, যদি সঠিক দিকনির্দেশনায় লক্ষ্য ঠিক রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তবে অদূর ভবিষ্যতে সমধারা এমন এক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে, যেখানে নতুন প্রজন্মের কবিরা খুঁজে পাবে নিরাপত্তা।