আমার এক সাংবাদিক বন্ধু—পেশায় সাংবাদিক হইলেও যাহাকে বলে নেশায় সাহিত্যিক—কিছুদিন আগে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকজন আজকাল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপন করিবার পক্ষে এতখানি উৎসাহী হইয়াছেন কেন? প্রশ্নটির সঙ্গে একটা লেজও জুড়িয়া দিলেন তিনি: বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী কি কোন অন্যায় কিংবা অপরাধ ঢাকিবার মতলবে এত বেশি বেশি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পথিক হইতেছেন? একদিন যাঁহারা শহিদ হইয়াছিলেন, এতদিনে তাঁহারা ‘ভাষা শহিদ’ মাত্র হইয়াছেন। কাল কি হইবেন তাহা কেবল কালই বলিতে পারে।
সেদিন তাঁহার প্রশ্নের জওয়াব দিতে পারি নাই। কিন্তু ঋণশোধ করিতে হইবে বলিয়া এই কয়ছত্র লিখিতে বসিয়াছি। আমাদের এই দেশটি যখন ব্রিটিশ জাতির শাসনাধীনে ছিল—তখন জনসাধারণের বেশির ভাগই শিক্ষার সুযোগ হইতে বঞ্চিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ভারতভাগযজ্ঞে পুরাতন বাংলাদেশের যে অংশ লইয়া পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশ গঠিত হইয়াছিল তাহার সাক্ষরতার হার ছিল শতকরা ছয়ের মতন। আশা করা গিয়াছিল, দেশ স্বাধীন হইলে দেশমাতৃকার বেশির ভাগ লোকই ঘরে-বাহিরে যথাযথ শিক্ষার সুযোগ পাইবেন। দেশের সকলের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছাইতে হইলে দেশীয় ভাষা বা মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া উপায় নাই—সেদিন এ সত্যে সকলেই আস্থা রাখিয়াছিলেন।
১
বিভাগপূর্ব বাংলাদেশে শিক্ষা আয়োজনের ভিতর মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার শেষ চেষ্টা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমিডিয়েট ও বি.এ. পর্যন্ত পরীক্ষায় বাংলা ভাষায় পরীক্ষার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অন্তত একটি উপকার আশা করা গিয়াছিল যে ইহাতে লেখকেরা বাংলায় বইপত্র লিখিতে উৎসাহিত হইবেন আর ছাত্রসাধারণও অল্প স্বল্প বাংলায় পড়িতে আর লিখিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিবেন। বহুদর্শী মনীষী ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাশয়ের কথা ধার করিয়া বলিতেছি, “[এই ব্যবস্থার পর কেহ] আমার মত একেবারে আনাড়ী থাকিয়া যায় না। এইটুকুই যা লাভ”।
শীল মহাশয় অবশ্য অধিক দুঃখের সহিত যোগ করিয়াছিলেন, “কিন্তু তাহা [অর্থাৎ লাভটা] কিছুই নয়, অতি সামান্য। এ ব্যবস্থায় বাংলা সাহিত্য বা ভাষা বিশেষভাবে অধ্যয়ন অধ্যাপনার বিষয় হয় নাই; পরীক্ষা অনেকটা সখের জিনিষ দাঁড়াইয়া গেছে। আর ইহাতে বাংলার ভিতর দিয়া দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি শিখিবার কোন কথাই নাই; সুতরাং যথার্থ মানসিক বিকাশের কোন সুযোগ নাই” (শীল ২০১৩: ৪৪-৪৫)। এক কথায় ব্যবস্থাটা ছিল আধাকাচড়া।
দুঃখের মধ্যে, ঘটনার শেষ কিন্তু সেখানেই হয় নাই। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাশয় অন্য একটা সমস্যার দিকেও আঙুল তুলিয়াছিলেন: “আর একটি ব্যবস্থা এ সকলের চেয়েও মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের পথকে বেশ একটুখানি প্রশস্ত করিয়াছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থী ইচ্ছা করিলে ইতিহাস বিষয়ে বাংলায় পরীক্ষা দিতে পারে; সে বিষয়ে বাংলা পাঠ্যপুস্তকও নির্দ্দিষ্ট হয়। শিক্ষক মহাশয়ও ইচ্ছা করিলেই অধ্যাপনার সময় বাংলা ভাষা অবলম্বন করিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে অল্পসংখ্যক স্কুলে ছাত্র কিংবা অধ্যাপক এই সুযোগটি গ্রহণ করিয়া থাকেন” (শীল ২০১৩: ৪৫)। প্রশ্ন হইতেছে: কেন?
ব্রজেন্দ্রনাথ শীল (১৮৬৪—১৯৩৮) মহাশয়ের অনুরাগীরা বলিয়া থাকেন তিনি দেশি-বিদেশি মিলাইয়া গোটা ১০টি ভাষার তোতলাইতেন। ১৯১২-১৯২১ সালের সুপরিসর কালখণ্ডে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক পদে বৃত থাকিবার পর তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন হইয়াছিলেন ১৯২১ সালে। সেখানে ছিলেন ১৯৩০ পর্যন্ত। তাঁহার যে রচনাটি হইতে এক্ষণে সাক্ষ্য গ্রহণ করিতেছি তাহা ১৯১৫ সালের রচনা। ছাপা হইয়াছিল প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত ‘সবুজ পত্র’ নামক নামকরা পত্রিকায়। এই সাক্ষ্য হইতে যাহা শিখিলাম তাহাতেই আমার সকল দুঃখের সার হইল। ইচ্ছা করিলে প্রবেশিকা, মাধ্যমিকা ও কুমারসম্ভব পরীক্ষা বাংলায় দেওয়া চলিত। কিন্তু অল্পসংখ্যক ছাত্রই সেই সুযোগটি গ্রহণ করিয়া বাংলা ভাষাকে বাধিত করিতেন। শিক্ষক মহাশয়ও ইচ্ছা করিলেই অধ্যাপনার সময় বাংলা ভাষা অবলম্বন করিতে পারিতেন। দুঃখের মধ্যে, অল্পসংখ্যক অধ্যাপকই সেই ইচ্ছাটি পোষণ করিতেন।
প্রশ্ন হইতেছে: কেন এমন হয়? ইচ্ছার জন্মভূমি যে সংসারে সেখানকার কর্মযজ্ঞে যে ভাষার কদর সে ভাষাতেই ছাত্রদের পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা জাগিবে। অধ্যাপক মহাশয়েরাও অধ্যাপনায় সেই ভাষাটাই অবলম্বন করিবেন। ইহাই স্বভাবশাস্ত্রের বিধান। যাহা স্বভাব মানবসমাজে প্রবেশ করিলে তাহারও একটা অভাব অনুভূত হইয়া থাকে। সেই অভাবপূরণের চেষ্টাকেই আমরা বলিতে পারি ইতিহাস। যে জাতি বা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস থাকে না প্রকৃত প্রস্তাবে সে জাতিই পরাধীন।
২
ইংরেজ শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি আলাদা দেশ তৈয়ার হইল। তখন পাকিস্তান নামা দেশে যেমন ইংরেজির জায়গায় উর্দু তেমনি নতুন স্বাধীনতা পাওয়া ভারতেও একই জায়গায় হিন্দি ভাষা বসাইবার আয়োজন চলিতেছিল। তখন পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশে—উর্দুর বিপক্ষে শুদ্ধ নয়—ইংরজির স্থলেও বাংলার পক্ষে আন্দোলন জমিয়াছিল। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রচরিত একটি প্রচারপত্রে লেখা হইয়াছিল “বাংলার জন্য আন্দোলন, উর্দুর বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। ইংরেজীর বদলে উর্দু, বাংলা—সকল ভাষাকে রাষ্ট্রে সমমর্যাদা দেওয়ার আন্দোলন।” অধিক কি, প্রচারপত্রে লেখা হইয়াছিল: “ইংরেজ পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষি জাতিকে পশ্চাৎপদ রাখিয়া ‘সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য একটী ভাষা—ইংরেজী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিয়াছিল। লীগ সরকারও একই উদ্দেশ্যে এখন পর্য্যন্ত ইংরেজী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু রাখিয়াছেন এবং একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিতে চাহিতেছেন” (পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫২)।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও অন্য অনেকের মধ্যে ইতিহাসবেত্তা যদুনাথ সরকার (১৮৭০—১৯৫৮) প্রভৃতি মনীষী শিক্ষার বাহন যথারীতি ইংরেজি রাখিবার পক্ষে সবুজ সবজির মতো যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন। আর পদার্থবিজ্ঞানের জগদ্বিখ্যাত অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ তাঁহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন। সরকার মহাশয়ের যুক্তি পড়িয়া সাহিত্য-সাধক সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা—যুক্তিগুণে তো বটে—প্রসাদগুণেও উপাদেয় বলিয়া এখানে খানিক উদ্ধার করিতেছি। আলী সাহেবের ভাষায়, “সরকার মহাশয় ইংরেজি ভাষার যে গুণকীর্তন করেছেন তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা পৃথিবীতে আর নেই, অদ্যকার (বিশেষ জোর দিয়ে আমিও বলছি অদ্যকার) দিনে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং দর্শনের চর্চা করতে হলে ইংরেজি ভিন্ন গত্যন্তর নেই। কিন্তু ইংরেজি চিরকাল এদেশের শিক্ষার মাধ্যম তথা উচ্চাঙ্গ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বাহন হয়ে থাকবে—এ ব্যবস্থা আমরা কাম্য বলে মনে করিনে। একথা ঠিক যে, আজই যদি আমরা ইংরেজি বর্জন করি তবে সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হব, কিন্তু কোনদিনই শিক্ষার মাধ্যমরূপে বর্জন করতে পারব না—একথা আমরা বিশ্বাস করিনে” (আলী ২০১৮: ২৩৯)।
মুজতবা আলী সাহেবের এই লেখাটি ১৯৪৭ সালের পরের কোন এক সময়ের হইবে। ঠিক কোন বছরের লেখা বলিতে পারিতেছি না, তবে অন্তর্গত সাক্ষ্য দেখিয়া মনে হয় ইহা খুব সম্ভব ১৯৫০ সালের দশকের মধ্যে লেখা হইয়া থাকিবে। পরের হইবে না। তাহার কারণ যদুনাথ সরকার মহাশয় এন্তেকাল ফরমাইয়াছিলেন ১৯৫৮ নাগাদ। লেখাটিতে কোথায়ও ভদ্রলোকের নামের আগে ‘পরলোকগত’ বা স্বর্গত শব্দটি দেখিলাম না।
সকলেই জানেন, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবও ফরাশি-জর্মন প্রভৃতি অনেকগুলি ভাষায় সচল ছিলেন। তাঁহাকে বিদগ্ধই বলা যায়, তবে বিদগ্ধজনের কথাই শেষ কথা—এমন কথা বলিব না। তাঁহার সাক্ষ্য অবশ্য মোটেও ফেলিয়া দিবার মতন জিনিশ নহে। উদাহরণস্বরূপ—সৈয়দ মুজতবা আলী লিখিলেন: “বস্তুত বহু গবেষণা করে শিক্ষকগণ এই চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতেই এসেছেন যে, মানুষকে ব্যাপকভাবে দোভাষী করা যায় না। গোলামদের কথা আলাদা। তারা যখন দেখে অর্থাগমের পন্থা মুনিবের ভাষা শেখা তখন সবকিছু বিসর্জন দিয়ে প্রভুর ভাষা শেখে—আমি যে রকম শিখেছিলুম, ফলে আজ না পারি উত্তম বাংলা বলতে, না পারি মধ্যম ইংরেজি লিখতে। কিন্তু আমার ছেলে গোলাম নয়—আমার আশা সে একদিন বাংলাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করবে। আমার ছেলে না পারুক, যদি আপনার ছেলে পারে তাতেই আমি খুশি এবং যদি সেদিন তার খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে ইংরেজ-ফরাসি আপন আপন মাতৃভাষাতে তার কেতাব অনুবাদ করে—আজ যে রকম মাও সেতুঙের চীনা বই বেরুনো মাত্রই ইংরেজ গায়ে পড়ে তৎক্ষণাৎ স্ব-ভাষায় তার অনুবাদ করে, এখনও যে রকম ইংরেজ ‘শকুন্তলা’ নাট্যের অনুবাদ করে—তবে আমি অমর্ত্যলোক থেকে তাকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করব। অনন্তকাল ধরে আমরা শুধু ইংরেজি থেকেই নেব, কিছু দেবার সময় কখনও আমাদের আসবে না—এ কথা ভাবতেও আমার মন বিরূপ হয়” (আলী ২০১৮: ২৪১)।
মুজতবা আলী সাহেবের মন যতই বিরূপ হউক না কেন—ইংরেজি হইতে লইবার কাল আমাদের পক্ষে এখনও অনন্তই আছে—আমাদের পঞ্জিকা জুড়িয়া আছে ইংরেজি। দিবার সময় আজও আমাদের আসে নাই। আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ হামেশা বলিতেছেন, যাঁহারা চারিদিকের এত বিজলিবাতি, এত এত দালানকোঠা, এত গলিপথ রাজপথ, এত পুল-সেতু, এত উন্নতির কিছুই দেখিতে পায় না তাঁহারা তো নিতান্ত ‘আগাছা’। আশঙ্কা হয়, যাঁহারা—সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো কিংবা এই অধম লেখকের মতো—না পারেন উত্তম বাংলা বলিতে, না পারেন মধ্যম ইংরেজি লিখিতে তাহাদিগকে কি বা বলিব! গাছা? না পরগাছা?
৩
এখানেই মনে হয় আমার সাংবাদিক ও সাহিত্যিক বন্ধু তাঁহার প্রশ্নের জওয়াব পাইবেন। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মধ্যম শ্রেণী আজও এই দেশে উত্তম (অর্থাৎ বাংলা) ভাষায় শিক্ষা দিবার মতো প্রতিষ্ঠানাদি স্থাপন করিতে সক্ষম নহেন। তাই তাঁহারা বিকল্পস্বরূপ চক্ষুলজ্জা পরিহার করিয়াছেন। তাঁহারা যাহা করিতেছেন তাহা সেই মধ্যম (অর্থাৎ ইংরেজি) ভাষার মধ্যস্থতায় শিক্ষার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। সভ্যতার অপর নাম লজ্জা। মানুষেরই লজ্জা আছে। যখন মানুষ লজ্জাশরম পরিহার করে তখন কি তাহাকে আর মানুষ বলা চলে? দুঃখের কথাটি শেষ হইয়াও শেষ হইল না।
ফরাশি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে যাহার সারমর্ম হইল: কবিতায় মধ্যম আর অধমে কোন তফাত নাই (লাকাঁ ১৯৯০: ৪৬)। যাহা মধ্যম তাহাই অধম। আমাদের শিক্ষাদীক্ষার বর্তমান চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রসঙ্গেও এই প্রবাদটি মোক্ষম খাটিতেছে। এইদেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা শুদ্ধমাত্র ‘মধ্যম’ শিক্ষা নহে, এই শিক্ষা ‘অধম’ হইতে বাধ্য। এই জন্যই আমাদের এত আনন্দ! ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ আমাদের মুশকিল আসান করিয়াছে। আমরা বাংলাকে ‘মাতৃভাষা’ জ্ঞানে সম্মান জানাইবার সুযোগ লাভ করিয়াছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি এই দেশে একদা ‘শহিদ দিবস’ বলিয়া গণ্য হইত। এখনও বেশ তাহার রেশ আছে। তাই তাহার নাম দাঁড়া হইয়াছে ‘ভাষা শহিদ দিবস’ আর সঙ্গে জুটিয়াছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপাধি। কিছুদিনের মধ্যে প্রথম অংশটুকু সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হইলে আমি অবাক হইব না। শহিদ দিবস, ইহার মধ্যেই, এখনই তাহাদিগকে লজ্জা দিতেছে। তাই তাঁহারা দিনটিকে একটি সংখ্যায় মাত্র পর্যবসিত করিয়াছেন। এই সেদিনও দেশের পত্রপত্রিকা বিশেষ সংখ্যার নাম রাখিয়াছে: “অমর একুশে: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”। ১৯৫২ সালে—আমরা দেখিলাম—প্রশ্নটি ছিল বাংলা কি মাতৃভাষাই থাকিবে না রাষ্ট্রভাষায় উন্নীত হইবে? আজ এত বছর পর আমরা একই জায়গায় নতুন করিয়া হাজির হইয়াছি। বাংলা কি রাষ্ট্রভাষাই থাকিবে না মাতৃভাষায় নামিয়া যাইবে?
বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পরম পূজনীয় নাম। তাঁহার নামে সরোবর হইতে বিশ্ববিদ্যালয় সকলই স্থাপিত হইয়াছে। অথচ শিক্ষাদীক্ষা বিষয়ে কবি সাহেবের উপদেশটা যে কি ছিল তাহা সকলেই ভুলিতে বসিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ—এক নম্বরে—বলিয়াছিলেন, মাতৃভাষায় সাহিত্য গড়িয়া না উঠিলে শিক্ষার মানও উত্তম হইবে না। সাহিত্যের পুষ্টিসাধনের জন্য বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, কলাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চাঙ্গের বইপত্র লিখিতে হইবে। কেবল তাহার সঙ্গেই মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়া যাইবে। তাঁহার দুই নম্বর কথাটি ছিল, মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, কলাবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষা না দিলে ছাত্র বা শিক্ষক কাহারোই যথার্থ মানসিক বিকাশ হইবে না, তাঁহাদের কাহারোই উদ্ভাবনী ও সৃজনীশক্তি স্ফূর্তিলাভ করিবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরম বন্ধু দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কবির সমর্থনে এই মন্তব্য যোগ করিয়াছিলেন: “বস্তুত এই দুইটি উপায়ের মধ্যেই একটি অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ আছে। কারণ, সাহিত্য ছাড়া শিক্ষা হয় না এবং শিক্ষা ছাড়াও সাহিত্য হয় না” (শীল ২০১৩: ৪৩)।
আমরা সামান্য মানুষ। যাঁহারা চারিদিকে এত উন্নতির আলো দেখিয়াও না দেখার ভান করিতেছেন তাঁহারা যদি আগাছা, তবে বিশেষ করিয়া আমাদের ভাষায় সাহিত্য ও শিক্ষা দুইটারই এহেন অধোগতি দেখিবেন না বলিয়া যাঁহারা পণ করিয়াছেন তাহাদিগকেই বা অধিক কি বলিব! যে ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়া যায় না, তাহাকে রাষ্ট্রভাষা বলা যায় না। এমন কি সংবিধানের পাতায় লেখা হইলেও যায় না। মনে রাখিতে হইবে, ১৯৫৪ সালের মধ্যেই বাংলা পাকিস্তানের দুই রাষ্ট্রভাষার এক ভাষা বলিয়া স্বীকৃতি পাইয়াছিল আর ১৯৫৬ সাল নাগাদ ঐ দেশের প্রথম সংবিধানেও তাহার স্থানলাভ ঘটিয়াছিল। সে কথা আওড়াইয়া কি হইবে! সাধু কি ধর্মের কাহিনী শুনিবে?
২ মার্চ ২০২২
দোহাই
১. ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ‘শিক্ষাবিস্তার’, বাংলা রচনা, তপনকুমার ঘোষ সম্পাদিত (কলকাতা: পত্রলেখা, ২০১৩), পৃ. ৪৩-৪৮।
২. সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘ইংরেজি বনাম মাতৃভাষা’, রচনাবলি, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৮), পৃ. ২৩৯-২৪৭।
৩. পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি, পূর্ববঙ্গ সাংগঠনিক কমিটি, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে সাড়া দিন’, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
৪. Jacques Lacan, Television: A Challenge to the Psychoanalytic Establishment, trans. D. Hollier et al., ed. Joan Copjec (New York: W.W. Norton, 1990).